#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-২২
দর্শন এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে করতে বন্ধুদের পাশ কাটিয়ে অর্ষাকে খুঁজতে চলে গেল। ওর বন্ধুরা ওকে দেখে ভীষণ অবাক হচ্ছে। এই দর্শনকে ওরা চিনেই না। দর্শন যেখানে কোন দিন কোন তর্কে জড়ায়নি সে আজ হাতাহাতি করছে। ওরা ভীষণ ভয়ে আছে। প্রিন্সিপাল পর্যন্ত ঘটনা চলে গেলে জল অনেক দূর গড়াবে। দর্শনের ইমেজ খারাপ হবে।
দর্শন, অর্ষাকে ওর ক্লাসের সামনে দেখতে পেল। ও প্রিয়ার সাথে কিছু নিয়ে কথা বলছে। ওকে ভীষণ চিন্তিত লাগছে। মনে হচ্ছে কোন সমস্যায় আছে। অর্ষা ঠোঁট কামড়ে ধরে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। প্রিয়া যা বলছে তা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। এ-সব দর্শন কেয়ার না করে ওর সামনে গিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করল,
“অর্ষা, তুমি জুবায়েরের সাথে ড্যান্স করছো?”
অর্ষা দর্শনের দিকে চেয়ে কিছুটা আঁতকে উঠে। ওকে দেখে অস্থির লাগছে। কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। মুখটাও কেমন লাগছে।
অর্ষার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে দর্শন খুব রেগে গেল। শক্ত গলায় বলল,
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি। এন্সার মি।”
অর্ষা বুঝতে পারছে না কি উত্তর দেবে। কারণ ও নিজেও জানে না কি করবে। কিছুক্ষণ আগেই জেনেছে জুবায়েরের সাথে ড্যান্স করবে। মেমের সাথে কথা বলেও লাভ হয়নি। এখনও সিদ্ধান্ত নেয়নি কি করবে। এখন দর্শনকে কি বলবে। দর্শন নিশ্চয়ই কোথাও থেকে জেনে এসেছে।
অর্ষা আমতা-আমতা করে বলল,
“কিছুক্ষণ আগেই জেনেছি ওর সাথে আমাকে পারফরম্যান্স করতে হবে।”
দর্শন উত্তর পাওয়ার সাথে সাথে বলল,
“করবে না। ওর সাথে তুমি কোন পারফরম্যান্স করবে না। তুমি জানো না ওকে? জেনেও কী করে এখনো বলিষ্ঠ কন্ঠে বলতে পারছো না যে ড্যান্স করবে না? আমতাআমতা করছো?”
“আমি মেমের সাথে কথা বলেছি কিন্তু তিনি জানালেন এখন কিছুই সম্ভব না। তাই ভাবছি কি করব।”
দর্শনের কপালের রগ ফুটে ওঠেছে।
“কী করবে মানে? ওর সাথে তুমি ড্যান্স করবে না। নাম কেটে দিয়ে আসবে।”
“নাম কেটে দিয়ে আসব মানে কী? জুবায়েরের সাথে তোমার কী সমস্যা? ড্যান্স করতে হলে একজন পার্টনার লাগবেই। তোমার ওকে পছন্দ না হলে তুমি আসো। তুমি পারফরম্যান্স করো আমার সাথে।”
এত কিছুর মাঝেও দর্শন ওর কথা শুনে শান্ত হয়ে গেল। দমে গেল কিঞ্চিৎ। বিরবির করে বলল,
“আমি নাচের ‘ন’ ও জানি না।”
কিন্তু হারলে তো চলবে না। তাই ওকে শুনিয়ে বলল,
“তুমি জানো না সামনে আমার পরীক্ষা? আমার এসব ফালতু কাজে সময় নেই।”
অর্ষা অটল থেকে বলল,
“পারলে তো? আমি যার সাথে ইচ্ছে নাচ করব। তুমি আসবে না এর মধ্যে। আমি তোমার কথা শুনতে বাধ্য নই।”
দর্শন আবারও রেগে গেল। একটু আগে জুবায়ের যা ইঙ্গিত দিয়েছে তাতে অর্ষাকে ওর হাতে কিছুতেই ছাড়া যাবে না।
দর্শন শুধু বলল,
“তাহলে শুনে রাখো তুমি যদি ওর সাথে পারফরম্যান্স করো তবে আমি তোমার সাথে ব্রেক আপ করব।”
দর্শন আর একটা কথাও বলল না। ঘুরে সোজা হাঁটা ধরল।
অর্ষা ওর কথা গায়ে মাখল না। আত্মবিশ্বাস নিয়ে পেছনে থেকে চিৎকার করে বলল,
“ব্রেক আপ করবে? ঠিক আছে আমিও দেখে নিব। করো ব্রেক আপ।”
প্রিয়া ওর কথা শুনে অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে রইল। ডান বাহু চেপে ধরে বলল,
“পাগল হয়েছিস তুই? দর্শন ফাজলামো করছে না, ওকে সিরিয়াস লাগছে। মনে হচ্ছে কোথাও গণ্ডগোল পাকিয়ে এসেছে। ব্রেক আপ বুঝিস? যে ছেলের জন্য দিনরাত কেঁদে ভাসিয়েছিস আজ তার সাথে ব্রেক আপ শব্দটা এত সহজে জুড়ে দিচ্ছিস? আমার কথা শোন দর্শন যা বলে তাই কর।”
“দূর! লেকচার দিস না তো। দর্শন ভালোবাসার দাবিতে যা বলবে আমি তাই করব। ওর ভালোবাসার জন্য সব ছাড়তে পারি।”
প্রিয়া যে বহুরূপী অর্ষাকে দেখছে। ওর দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে।
“তাহলে এ-সব কী ছিল?”
অর্ষা আলতো হাসল। তারপর বলল,
“ও যখন অধিকার দেখায় তখন আমার ভীষণ ভালো লাগে। আর ওকে জ্বালাতে তার চেয়ে বেশি ভালো লাগে।”
প্রিয়ার মাথায় হাত।
“হায় আল্লাহ! তোকে বুঝতে পারি না।”
“তোর বুঝে কাজ নেই। শুধু এটুকু বুঝে রাখ গুরুত্ব পেতে ভালোবাসি, অবহেলা পেতে নয়। কারো লাইফে সেকেন্ড অপশন কখনোই হতে চাই না।”
……
“তোমার কাছ থেকে এমনটা একদমই আশা করিনি। তুমি কারো গায়ে হাত তুলেছো? হাও দিস পসিবল? এর পেছনে কী কারণ রয়েছে দর্শন?”
প্রিন্সিপাল স্যার দর্শনকে প্রশ্ন করল।
দর্শন একবার জুবায়েরের দিকে তাকাল। তারপর স্যারের দিকে চেয়ে বলল,
“স্যার, আপনি আমাকে ভালো করে চিনেন। আমি কখনো কোন কলহ-বিবাদ, মারামারিতে জড়াইনি। কিন্তু ও আমাকে বাধ্য করেছে। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।”
“কী এমন হয়েছে যে তুমি নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারোনি?”
দর্শন আমতাআমতা করছে। কী করে বলবে বুঝতে পারছে না। প্রিন্সিপাল ওর নীরবতা আর কাচুমাচু মুখ দেখে বিরক্ত হলো।
“চুপ করে আছো কেন দর্শন? জুবায়ের
তুমি বলো ঘটনা কী? ওকে কী বলেছো?”
“আমি এমন কিছুই বলিনি স্যার যাতে ও আমার গায়ে হাত তুলবে।”
দর্শন ওর অকপটে বলা মিথ্যা শুনে ভীষণ ক্ষেপে গেল। হিতাহিতবোধ হারিয়ে বলল,
“তুই কিছু বলিসনি? অর্ষাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলিসনি? বাজে ইঙ্গিত দিসনি?”
এ-সব বলার পরেই দর্শনের হুশ হলো। রাগের মাথায় অর্ষাকে এই ঘটনায় জড়িয়ে ফেলল। ওর নামটা এখানে না জড়ানোই উচিত ছিল।
জুবায়েরের মুখ থমথমে। প্রিন্সিপাল স্যার জিজ্ঞেস করলেন,
“অর্ষা কে?”
দর্শনের এখন আর চুপ থাকার উপায় নেই। তাই পরিচয় দিল অর্ষার।
“অন্বেষা হাসান।”
“ফার্স্ট ইয়ারের অর্ষা?”
“জি স্যার।”
“ওকে নিয়ে কী সমস্যা তোমাদের মধ্যে?”
দর্শন আর জুবায়ের দুজনেই চুপ। কেউ উত্তর দিচ্ছে না। কি উত্তর দিবে?
প্রিন্সিপাল স্যার ওদের চুপ দেখে জুবায়েরকে প্রশ্ন করল,
“ও সত্যি বলছে? অর্ষাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলেছো?”
“জি না স্যার। আমি অর্ষাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলিনি।”
দর্শনের ইচ্ছে করছে ওর নাকে একটা ঘুষি মারতে। কিন্তু নিরুপায়। স্যারের সামনে একদমই সম্ভব না।
“স্যার, ও মিথ্যা বলছে। ও অর্ষাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলেছে বিধায় ওর গায়ে হাত তুলেছি। নয়তো কেন তুলব?”
প্রিন্সিপাল স্যার পড়েছেন বিপাকে। কার কথা বিশ্বাস করবে। তবে দর্শন মিথ্যা বলার ছেলে নয় এটুকু বিশ্বাস ওনার আছে। অর্ষাকে নিয়ে ওর মনে একটা সফট কর্ণার আছে সেটা বুঝতেও বাকি নেই।
“জুবায়ের আর দর্শন তোমরা একে অপরের কাছ থেকে দূরে থাকবে। যদি পরবর্তীতে তোমাদের নামে কোন কমপ্লেইন আসে তবে ভালো হবে না। একবারের মতো ছেড়ে দিলাম পরের বার দেব না।”
জুবায়ের আর দর্শন একে অপরের দিকে ক্ষিপ্ত দৃষ্টি দিল। তারপর জি স্যার বলে চলে গেল।
…….
দর্শন রাগ করে পুরো দিন অর্ষার সাথে কথা বলেনি। অর্ষাকে এত করে বলল তারপরও ওর কথার মূল্য দিল না। যে মেয়ে ওর জন্য পাগল ছিল। প্রপোজাল পেয়ে কেঁদে কেটে ভাসিয়েছে সে এখন ওর কথার বিন্দুমাত্র রেস্পেক্ট করে না। পেয়ে গেলে কি সত্যিই মূল্য হারায়? অর্ষার কাছে কি ওর কোন মূল্য নেই? অর্ষাকে জোর করে পড়ায়, না পড়লে রাগ করে এইজন্য কি অর্ষা ওর উপর বিরক্ত? সাত দিন পর টেস্ট পরীক্ষা শুরু কিছুই পড়তে পারছে না ওর জন্য। মনই বসছে না। এক মন এক সাথে কত দিকে বসতে পারে?
অর্ষা কল করল ওকে। দর্শন রিসিভ করল না। ওর কল দেখে নাক ফুলিয়ে বসে রইল। অর্ষা বারবার কল করছে। কিছুক্ষণ আগেই দর্শন আর জুবায়েরের ঘটনা জানতে পেরেছে। দর্শন এত সাংঘাতিক ঘটনা ঘটিয়েছে আর ও এতক্ষণে জানল?
বারবার কল করায় কল রিসিভ করল দর্শন।
“হ্যালো! কী দরকার?”
“তুমি না-কি জুবায়েরের সাথে আজ মারামারি করেছো?”
“হ্যাঁ করেছি। তো?”
অর্ষার কেন জানি আনন্দ লাগছে খুব। ওর বয়ফ্রেন্ড ওর জন্য একটা ছেলেকে মেরেছে। উফফ!
তবুও ভাব মেরে বলল,
“তো মানে কী? মারামারি কেন করছো?”
“আমি মারামারি কেন করছি তা জানার দরকার নাই। তুমি গিয়ে ওর সাথে নাচো।”
অর্ষা কঠিন গলায় বলল,
“কী বলছো এ-সব? এভাবে কেন বলছো?”
“কেন বলছি? তুই তো আমাকে দুই টাকার দাম দিস না। তুই জানিস ও আজকে তোকে নিয়ে কত আজেবাজে কথা বলেছে? কত বাজে ইঙ্গিত দিয়েছে? যা গিয়ে নাচ ওর সাথে। নাচতে গেলেই বুঝবি। ও একটা লোফার। ওর কোন ক্যারেক্টার আছে? আমার কথার দাম তো দিবি না। যা নাচ গিয়ে। বয়ফ্রেন্ড হিসেবে আগলে রাখতে চেয়েছি কিন্তু তুই তো আগলে আগলে থাকবি না।”
অর্ষা ওর কথা শুনে গোপনে ঢোক গিলে নিচু কন্ঠে বলল,
“রাগ করছো কেন? আমি তো ক্যান্সেল করে দিয়েছি। তোমাকে দাম দেই না কে বলল? আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না তারপর তোমার কথায় ক্যান্সেল করে এসেছি।”
“তাহলে তখন কেন বলছিলে তুমি নাচ করবে? ব্রেক আপের ব্যাপারটাও সহজ ভাবে নিলে।”
“আমি তোমাকে ইচ্ছে করে জ্বালাচ্ছিলাম।”
“এভাবে না জ্বালিয়ে কেরোসিন গায়ে ঢেলে লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে দে। এখুনি ভিডিও কল দে। আজ সারারাত তুই পড়বি। আমি কড়া নজরে রাখব তোকে। এটাই তোর শাস্তি।”
অর্ষা ঢোক গিলল ভয়ে। আধাঘন্টা পড়লেই হাঁপিয়ে যায় সেখানে সারারাত?
দর্শন ধমকে উঠে,
“কানে শুনিস না না-কি? ভিডিও কল দে। ফার্স্ট!”
রাত একটা। অর্ষা দর্শনের সাথে ভিডিও কলে থেকে পড়ছে। ভিডিও কলে থাকতে ভালো লাগল যদি মন ভরে দর্শনকে দেখতে পেত। আড়চোখে দর্শনের দিকে তাকালেই দর্শন দেয় ধমক। তাছাড়া পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। দর্শন ওর পড়া নিচ্ছে ফাঁকে ফাঁকে। কান্না পাচ্ছে খুব। কিন্তু সেটা করেও লাভ হবে না আজ দর্শন ক্ষেপেছে খুব। অর্ষার মন পড়ে আছে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, লাইকি আর টিকটকে। মনটা আকুপাকু করছে। অসহায় ফেস করে দর্শনের দিকে তাকালেও ওর মন গলছে না। কত নিষ্ঠুর প্রেমিক! একটু মজা করার এই শাস্তি?
আগাম একটা করে বেশি পর্ব পড়তে চাইলে আমাকে এক্ষনি ফ্লো করুন ✊🖐️
চলবে……!
(গঠনমূলক কমেন্ট করুন প্লিজ।)