#কহিনুর_দ্বিতীয়_খণ্ড,পর্ব:২৭
কলমে:ইয়াসমিন
সারারাত তুষারপাতের পর ভোররাতে আকাশ পরিস্কার হয়ে গেলো। পর্ব আকাশে রক্তিম সূর্য উঠার আগমনী বার্তা বয়ে সোনালী রশ্মি চিকচিক করছে। গুণগুণ কান্নার শব্দে কহিনুরের ঘুম ভাঙলো। কম্বল ছেড়ে আড়মোড়া দিয়ে বসতেই সামনে কাঠের সোফাতে বসা এক অগন্তুকের দিকে ওর নজর আটকে গেলো। ছেলেটা চোখে হাত দিয়ে নেকি শব্দে মেয়েদের মতো সুর করে কাঁদছে। কহিনুর ভ্রু কুচকে ফেলল। কপালে ভাজ পড়লো কয়েকটা। ঘুমানোর আগে দরজা বন্ধ করা হয়নি কারণ বাবা মা যখন তখন ওকে খোঁজ নিতে আসে। উনাদের টেনশনে রাখা ঠিক হবে না ভেবে দরজা বন্ধ করা হয়না। তাই বলে এই অগন্তুক ভেতরে চলে আসবে এটা কেমন কথা?আবছা আলোতে ছেলেটার আবয়ব ভালো দেখা না গেলেও কহিনুর ওর বয়সটা অনুমান করে নিলো। আঠারো সতেতো বা ওর বয়সী। তবে একটু বেশিই হ্যাঙলা রোগা পাতলা চিকুন গোছের। মনে প্রশ্ন জাগলো ছেলেটা এভাবে কাঁদছে কেনো? কহিনুর কথা বলবে কিভাবে বুঝতে পারছে না। ওর ভাবনার অবসান ঘটিয়ে ছেলেটা নাক টেনে বলল,
> এটা আমার কক্ষ,অনুমতি ছাড়া তুমি দখল করেছো। ভেবেছিলাম ভয় দেখিয়ে তোমাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিব কিন্তু তুমি আমার চোখে আঘাত করেছো। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। চিকিৎসক জানিয়েছে যে ক্ষত করেছে সে ছাড়া ঠিক হবে না। দয়াকরো এই এতিমের উপরে। আমি তোমার সব কথা শুনবো। ছায়ার মতো পাহারা দিবো তোমাকে। কৃতদাশ হয়ে থাকবো।
ছেলেটা একদম কথাগুলো বলে থামলো। কহিনুর আনমনে হাতটা মুখে দিয়ে ভাবছে ও কি ডাক্তার যে এই ছেলেটার চক্ষু পরিক্ষা করে ঠিক করে দিবে? কি অদ্ভুত কথাবার্তা।ছেলেটার মাথায় সমস্যা আছে। এই বাড়িতে ওরা যখন এসেছিল তখন বন্ধ অবস্থায় ছিল। কোনো জনমানবের চিহ্ন পযর্ন্ত ছিল না। বাড়িতে লোকজন থাকলে বোঝা যেতো। তবে কি ছেলে মিথ্যাচার করছে? কথাটা ভেবে ও চোখ রাঙিয়ে ছেলেটার দিকে তাঁকালো সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা চমকে উঠে বলল,
> এই না না আমি মিথ্যাচার করছি না। আল্লাহ জানেন আমি মিথ্যা বলিনা। মিথ্যা মহাপাপ। সব বলবো আগে আমার চোখ ঠিক করে দাও প্লিজ।
কহিনুর কি করবে বুঝতে পারছে না। এই ছেলেটার চোখ কিভাবে ঠিক করবে অনেক ভেবে চিন্তে ও বিছানা থেকে নেমে গিয়ে ড্রয়ার থেকে ড্রপ খুজেঁ নিলো। দুদিন আগে বাবা বেশ কিছু ওষুধ এনে রেখেছেন। যেকোনো সময় কাজে লাগতে পারে ভেবে। কহিনুর সেখান থেকে চোখে লাগানো তরল ড্রপটা ওর সামনে এগিয়ে দিয়ে ইশারা করলো লাগিয়া নিতে। ছেলেটা করুণ মুখ করে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বলল,
> একা হবে না লাগিয়ে দাও।
ছেলেটার কথা ভেবে ওর খারাপ লাগলো তাই অপেক্ষা করলো না দুচোখে দুফোটা ওষুধ লাগিয়ে অপেক্ষা করলো উত্তরের আশায়। কয়েক মূহুর্ত পেরিয়ে গেলো এভাবেই। হঠাৎ ছেলেটা ওর সামনে বসে পড়লো। কহিনুর চমকে উঠে পিছিয়ে আসলো। ওর চোখেমুখে কৌতূহল খেলা করছে। ছেলেটা আবারও কেঁদে উঠলো। কহিনুর উতলা হচ্ছে পাশের কক্ষে বাবা মায়ের কানে শব্দটা গেলে কেমন হয়ে যাবে তাই নিজেও ছেলেটার পাশে হাটুতে ভর দিয়ে হামু হয়ে বসে পড়লো। হাত দিয়ে ইশারা করলো কি হয়েছে? ছেলেটা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,
> তোমার মনে অনেক দয়া । আমি তোমাকে ভয় দেখিয়ে গৃহছাড়া করতে চেয়েছিলাম সব শুনেও তুমি আমাকে সাহায্য করেছো। চোখে একটুও যন্ত্রণা নেই বিশ্বাস করো? লোকে ঠিকই বলে বিশ্বাসে মিলাই বস্তু তর্কে বহুদুর। আমি প্রথমে আসতেই চাইনি। আজ থেকে তোমার ছায়া সঙ্গীর মতো বিপদে আপদে আমাকে তোমার পাশে পাবে কথা দিচ্ছি। আল্লাহ সাক্ষী।
কহিনুর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আবারও বিছানায় গিয়ে বসলো। খুব কথা বলতে ইচ্ছা করছে এই ছেলেটার সঙ্গে কিন্তু বলা নিষেধ। ছেলেটার পরিচয় পযর্ন্ত জানা নেই। বাবা মা ছেলেটাকে এখানে দেখলে কি ভাববে নানারকম চিন্তা ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর ভাবনার অবসান ঘটিয়ে ছেলেটা বলে উঠলো,
> আমার চিকিৎসক বলেছেন তুমি কথা বলবেনা আমার সঙ্গে। বিশেষ নিষেধ আছে। বলতে হবে না আমি তোমার মনের কথা বুঝতে পারি। আমাকে নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমার নাম আউয়াল সাঈদ। তুমি আমাকে সাঈদ বলে ডাকতে পারো। জ্বীন সম্প্রদায়ের মধ্যে আমি আল্লাহের একজন অতিক্ষুদ্র বান্দা। আমি এতিম,একমাত্র আপনজন আম্মি ছিলেন কিন্তু হঠাৎ উনি নিখোঁজ তারপর থেকে এই কক্ষে একা থাকি। আর তোমাকে বিরক্ত করবো না কথা দিচ্ছি।
কহিনুর কিছু একটা ভেবে ছেলেটাকে পাশের কক্ষটা দেখিয়ে ইঙ্গিত করে বুঝিয়ে দিলো সাঈদ ইচ্ছে করলে সেখানে থাকতে পারে। ছেলেটা খুশী হয়ে কিছু বলতে চাইলো ঠিক তখনই বাইরে থেকে অধরা ডেকে উঠলো। কহিনুর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে আসলো। জুবায়ের আর অধরা দুজনেই মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। ভোরবেলা সূর্যোদয়ের সময় হাটাহাটি করবে বলে। কহিনুর বাইরে আসতেই জুবায়ের মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল,
> চলো পিউ বাইরে অপেক্ষা করছে আমাদের জন।
অধরা হাসিমুখে মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসলো। আসার সময় কহিনুর একবার পেছনে ফিরে সাঈদকে দেখে নিলো। ছেলেটা মাথা নিচু করে কিছু ভাবছে। এই অচেনা ছেলেটাকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে কি ওর জানা নেই তবে কহিনুরের ভেতরে থেকে কেউ একজন বলল,” কিছু হবে না। তুই মানুষ,আল্লাহ সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ জীব। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পাবি না।
____________
থম মেরে বসে আছে আধার। মেজাজ চরম খারাপ। জার্মানিতে এসেছে কিছু দিন পেরিয়ে গেছে কিন্তু প্রিয়তমার খোঁজ মেলেনি। কোথায় আছে জানার জন্য যতরকমের চেষ্টা করেছিল সব ব্যার্থ। লোকজন লাগিয়েছে। রাগ শরীরের শিরা উপশিরাতে ধাবিত হচ্ছে। এর মধ্যে জুটেছে আরেক ঝামেলা। খান ভিলার এক বিশেষ কক্ষের দায়িত্ব ওর উপরে ছিল সেই কাজে ও অবহেলা করেছে। প্রথমবার ড্যাডের ঝাড়ি খেয়ে মাথায় কাজ করছে না। একবার শুধু মেয়েটাকে হাতে পেলে ও হাড়েহাড়ে বুঝিয়ে দিবে পালিয়ে যাওয়ার শাস্তি কাকে বলে। শরীর জ্বলছে রাগে। কতদিন হচ্ছে কোনো নারীকেই ওর সহ্য হচ্ছে না। দেখলেই খু/নের নেশা চেপে বসে। যে হৃদয়ে আগে প্রতি সেকেন্ডে নারীর প্রতি প্রেম আর কামনারা উঁকিঝুঁকি কাটতো আজ সেখানে শুধুই অরুচি আর ঘৃণা বাসা বেঁধেছে। সব হয়েছে কহিনুরের জন্য। দাদুর থেকে জানার জন্য খান ভিলাতে গিয়েছিল কিন্তু সাহস হয়নি। দাদু আগেই বলেছিলেন যায় করো কখনও কাউকে হৃদয় থেকে গ্রহণ করোনা। বিয়ের স্বপ্ন দেখোনা। খান ভিলাতে কোনো মেয়ে প্রবেশ করতে পারেনা। সেখানে শুধু পুরুষের আনাগোনা। নিজের মা পযর্ন্ত আলাদা থাকে। অভিশাপ আছে, এই বংশের পতন কোনো নারীর হাতেই হবে তাই এই বিশেষ সতর্কতা। আধার বুঝতে পারেনা কার এমন ক্ষমতা আছে যে খানদেরকে ধ্বংস করবে? ও বিশ্বাস করেনা। ঘনঘন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যায়। আধারের ধ্যান ভাঙলো কারো ফিসফিস আওয়াজ শুনে। পেছনে ফিরে দেখলো ওর গুপ্তচর দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা ভয়ে ভয়ে বলল,
> ক্ষমা করবেন স্যার আপনার বর্ণনা করা মেয়েটার কোনো অস্তিত্ব এই শহরে নেই। হয়তো উনি অন্য কোনো রাষ্ট্রে আছে।
আধার বিরক্ত হয়ে হাত নাড়িয়ে ওকে চলে যেতে বলে আবারও ধ্যানমগ্ন হলো। হতে পারে জুবায়ের ফারুকী চালাকি করে জার্মানি আসার নামে অন্য কোথাও আছে। সম্ভাবনা আছে ভেবে ও বেরিয়ে পড়লো হোটেল রুম থেকে। বসে থাকা সম্ভব না।
******
অফিসের ঝামেলা আর আবহাওয়া চেঞ্জ করতে বাবা মা আর ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে রিলিফ পেতে ঘুরতে এসেছে পাথর। ড্যাডের কথামতো শক্ত হাতে ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছে। এ বছর বেশ ভালো মুনাফা হয়েছে। নতুন নতুন কোম্পানির সঙ্গে ডিল হয়েছে। তাছাড়া প্রডাক্ট ভালো হলে বাজারে সুনাম এমনিতেই এসে যায়। সুলতান কোম্পানির সঙ্গে কোনো ঝামেলা করতে চাইছে না বিধায় নিজেদের মতো কাজকর্ম করছে। বেলাল ছুটি শেষ করে ফিরে এসেছে। সেই থেকে ছেলেটার মন খারাপ ছিল। তাই ওকেও সঙ্গে এসেছে পাথর। গতকাল বোনকে নিয়ে ঘুরতে গিয়ে এক রমনীর সৌন্দর্যে ওর কোমল হৃদয় আহত হয়েছে সেটা কক্ষে ফিরে এসেছে বুঝতে পেরেছে। প্রতি মূহুর্তে চোখের সামনে সেই মুখটা ভেসে উঠছে। কি এক যন্ত্রণা। মনে হলো ড্যাডের থেকে নিজের স্ত্রীর ছবিটা চেয়ে নিতে পারলে ভালো হতো। তাহলে অন্তত বাইরের কোনো মেয়েকে দেখে ঘায়েল হতে হবে না। যেখানে স্ত্রীর নাম পর্যন্ত শোনা হয়নি। আহাম্মক লাগছে নিজেকে। ভেবেছিল আজ আর বাইরে যাবে না তবুও হোটেল রুম থেকে কাউকে কিছু না বলে চুপিসারে বেরিয়ে আসলো। ঘুরতে ঘুরতে আবারও সেই নদীর তীরে এসে থামলো। আজ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতে পারলো না। বেহায়া চোখদুটো সেই কিশোরীকেই খুঁজে চলেছে।। কিন্তু ভাগ্য আজ সঙ্গ দিলো না। তাঁকে পাওয়া গেলো না। মন খারাপ হলো। সেই সঙ্গে মনের মধ্যে রাগ জেগে বসলো। হঠাৎ খিলখিল হাসির শব্দে ওর ধ্যান ভাঙলো। দ্রুত পেছনে ফিরে দেখলো দূরে গতকালের দেখা মেয়েদুটো বসে আছে। একজন চুপচাপ আরেকজনের মুখে হাসির ফোয়ারা। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় পাথর মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলো। এক মন বলল যাসনে আরেকমন বলল যা। দোটানায় পড়ে যেতেই হলো কিন্তু আবারও গতকালের ঘটনার রিপিট হলো। মেয়েটা কিছু বুঝেছে কি জানা নেই তবে সে লাফ দিয়ে নেমে হাঁটা ধরেছে বিপরী দিকে। সঙ্গের মেয়েটা পিছু পিছু দৌঁড়ে যাচ্ছে। পাথর হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করে ভাবলো সবটা। মনে হলো মেয়েটা ওকে দেখে ইচ্ছে করেই চলে গেলো। প্রচণ্ড অপমানবোধ পাথরকে ঘিরে ধরলো। পা থমকে গেলো। অজানা কারণে কষ্টে বুক ধড়াস করে উঠলো। নিজেকে ছোট লাগলো। মন বিদ্রহ করে বসলো। ভাবলো দরকার নেই কোনো অহংকারী মেয়ের রূপের মোহে নিজের আত্মসম্মানে আঘাত করার। নিজের তো স্ত্রী আছে তাহলে কেনো ও পর নারীতে আকৃষ্ট হচ্ছে? একদম ঠিক হচ্ছে না। কথাটা ভেবে ও পিছিয়ে আসলো। ভাবলো আর কখনও এই নদীর তীরে ও আসবে না। বেলালকে বলবে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে।
***
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলেছে কহিনুর। পিউ খুব অনুরোধ করে ওকে নদীর তীরে ঘুরতে নিয়ে এসেছিল কিন্তু হঠাৎ কেনো জানি এখানে আর বসতে ইচ্ছা করলো না। তাছাড়া তীব্রভাবে অনুভব করেছে কেউ ওকে অনুসরণ করছে আর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছে।। অস্বস্তি লেগেছে অশান্ত মন নিয়ে এখানে থাকার কোনো মানে হয়না। সেই সঙ্গে পিউ অনবরত বকবক করছে আর সঙ্গে জুটেছে সাঈদ। একজন থামলে আরেকজন অদৃশ্য থেকে শুরু করছে। কহিনুর বেশ কয়েকবার ইশারায় সাঈদকে অনুরোধ করেছে ওর থেকে দূরে থাকতে কিন্তু ছেলেটার কানে কথা যাচ্ছে না। কহিনুর রেগে মনে মনে খুব বকেছে। ফলে আসার সময় সাঈদ গাল ফুলিয়ে বলল,
> আম্মি বলতেন উপকারীর উপকার স্বীকার করতে হয়। তাছাড়া ওই কক্ষে আমি এমনি এমনি নেই। আম্মি রেখে যাওয়ার আগে বলেছিলেন আমার জন্ম হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য পালনের জন্য। এই কক্ষে অবস্থান করতে হবে। হয়তো তোমার জন্যই আম্মি আমাকে রেখে গেছেন। উনি যতিবিদ্যাতে পারদর্শি ছিলেন। ভবিষ্যত সম্পর্কে ধারণা রাখতেন। বলেছিলেন আমার আপন একজনের করা পাপ আমাকে শোধন করতে হবে। আমি জানিনা সেসব তবে এইটুকু জানি আমি তোমাকে উপকার করতে চাই। সব সময় সঙ্গে থাকতে চাই। বন্ধু না আমাকে ভাই ডাকতে পারো। দয়াকরো প্লিজ!
কহিনুর কপাল চাপড়ালো। এই ছেলেটা উল্টোপাল্টা লজিক দেখিয়ে ওকে দমিয়ে দিচ্ছে। কহিনুর নিরাশ হয়ে কক্ষে ফিরে আসলো।
*********
গরলিটজ আসার সপ্তাহ খানের হচ্ছে পাথর এখানে অবস্থা করছে চলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু যাওয়া হয়নি। প্রথম দুদিন মন অস্থিরচিত্তে কাটলেও এখন বেশ শান্ত। কোনো ঝামেলা নেই। তাছাড়া জমিয়ে ঘোরাঘুরি হয়েছে। আজ সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে যখন কক্ষে ফিরলো হঠাৎ মনে হলো কিছু দরকারি জিনিসপত্র কিনতে হবে। বেলালকে বললে হবেনা। নিজের জিনিস নিজেই কিনবে ভেবে ও বেরিয়ে পড়লো। আকাশ মেঘলা ভেবে সঙ্গে ছাতা নিয়ে হোটেল থেকে রাস্তাতে পা ফেলে বুঝতে পারলো ভূল করে ফেলেছে। তুষারপাত হবে। একবার ভাবলো ফিরে আসবে কিন্তু মন সাড়া দিলো না। কয়েক মিনিটের রাস্তা ঠিক মার্কেটে পৌঁছে যেতে পারবে। গাড়ি নিয়ে বের হলে সমস্যা হবে ভেবে হাটা ধরলো রাস্তা ধরে। আগে থেকে ফোনচেক করলে আবহাওয়া জানা যেতো সমস্যা হতো না। পাথর দ্রুত মার্কেট থেকে দরকারি জিনিসপত্র কেনাকাটা শেষ করে রাস্তায় পা ফেলে চমকে গেলো। বরফ জমে গেছে। মনে হলো কয়েকদিন ধরে ঘনঘন তুষারপাত হচ্ছে। শরীর জমে যাচ্ছে শীতে। ফর্সা পা দুখানা নীল বর্ণ ধারণ করলো। পাথর থামলোনা তুষারের উপরে নিজের পা রাখলো। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে পাথরের পা ফেলতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ভেবেছিল পা আটকে যাবে কিন্তু কিসের কি পা তো তুষারের মধ্যে যাচ্ছেই না। কেমন নিজেকে হালকা হালকা মনে হচ্ছে। দীর্ঘ পঁচিশ বছর জীবনে এই প্রথমবার মনে হচ্ছে ওর সঙ্গে কিছু চমৎকার হচ্ছে। ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তাটা কেমন জানি দিনের আলোর মতো পরিস্কার। শীতটাও কমে এসেছে। হোটেলে থেকে মার্কেট পযর্ন্ত আসতে পনেরো মিনিটের রাস্তা অথচ ফেরার সময় ওর চার মিনিটও লাগলো না। হাত পা থরথর করে অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠলো। পাথর কক্ষের দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ দম নিলো। কিছু একটা ভেবে টেবিলের উপরে রাখা খ/ঞ্জ/রটা তুলে নিয়ে হাতের কব্জি বরাবর চোখ বন্ধ করে টান দিতে দিতে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো, “খ/ঞ্জ/র আমার শরীরে আঘাত করোনা। সাহস রেখোনা,আমাকে কষ্ট দিলে ধ্বং/স হয়ে যাবে। নিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
কয়েক সেকেন্ড পর পাথর চোখ খুঁলে চমকে উঠলো। খ/ঞ্জ/রের হাতলটা ওর হাতের মুঠোয় বন্ধি থাকলেও অবশিষ্ট ধা/রা/লো অংশ ওর পায়ের কাছে শতাধিক টুকরো হয়ে পড়ে আছে। হাতে এক বিন্দু লাল টকটকে র/ক্ত। পাথর হাতলটা ফেলে দিয়ে র/ক্তটুকু আঙুলের ডোগা দিয়ে মুছে নিয়ে ভাবলো, এ কেমন শক্তির অস্তিত্ব আমার মধ্যে? কই আগে তো এমন অনুভব করিনি তবে এখনই কেনো? এই রহস্যের মানে কি?
*************
দাদুর সামনে মাথা নত করে বসে আছে জামসেদ। কিছুক্ষণ আগে ওকে কফির অফার করা হয়েছে জামসেদ সেটা সংকোচ ছাড়া নিষেধ করছে। বলেছে পরে খাবে। ওর মন বলছে এই কফিতে কিছু মেশানো আছে। জুবায়েরের মতো এই বাড়ির খাবার ও দুদিন আগে থেকে পরিত্যাগ করেছে। এখন মনে হচ্ছে জুবায়ের উচিৎ কাজ করেছিল। ড্যাড আর মম জার্মানি ফিরে গেছে এখন দাদুর ইচ্ছেও তাই। জামসেদ বুঝতে পারছে না কি করবে। মীরাকে নিতে হলে ভিসা করা জরুরী। অফিসের সঙ্গে কথা বলেছে কিন্তু দুটোদিন সময় লাগবে। নিজেরা তো ইচ্ছা মতো যেতে আসতে পারে। ওখানকার নাগরিকত্ব আছে। তাছাড়া মীরার ভিসার মেয়াদ আগেই শেষ, নতুন করে পাসপোর্ট করতে হবে। মীরার জন্ম বাংলাদেশে। দশ বছর বয়সে জার্মানি পাড়ি দিয়েছিল যখন আত্মীয় স্বজন হারিয়েছি তখন। কিন্তু দাদুর কথা রাতের ফ্লাইট ধরে যেতে হবে। জামসেদর কিছু একটা ভেবে বলল,
> দাদু এখানকার ব্যবসার কাজকর্ম ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দিতে হলেও তো সময় লাগবে তাইনা? তুমি যাও আমি দুদিন পরে আসছি পাক্কা প্রমিজ। তাছাড়া জুবায়ের নেই ওর ভাগের কাজকর্ম আমাকে দেখতে হচ্ছে। ওর অফিসের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে জুটেছে। প্লিজ দাদু।
ভদ্রলোক বুঝলেন জামসেদের এখানে থাকাটা জরুরী কিন্তু জার্মানি না গেলে উনি বিশেষ কিছু করতে পারছেন না। কহিনুরকে উনার বড্ড প্রয়োজন। বয়স কেমন জানি তাড়াহুড়ো করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে চললে বেশি দেরী নেই মৃ/ত্যুর। না না এমন কিছুই হবে না। কতগুলো বছর,না বছর না কতগুলো যুগ চোখের পলকে পেরিয়ে গেছে। দশ পেনেরো নাকি বিশ যুগে সাক্ষী হলেন উনি ভেবে ভাবনায় ঢুবে গেলেন। জামসেদ ডেকে উঠলো,
> দাদু কি ভাবছো এতো?
ভদ্রলোক চমকে উঠে বললেন,
> কিছু না। তুমি যাও আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করো।
জামসেদ বেরিয়ে আসলো সুলতান ভিলা থেকে। মীরা কক্ষে একা আছে। মেয়েটা প্রচণ্ড ভীতু। একা হয়তো গাল ফুলিয়ে আছে। কথাটা ভেবেই জামসেদের ওষ্ঠে হাসি ফুঁটে উঠলো। কি মায়া যে ওই মুখে কে জানে। শতবার দেখেও তৃপ্তি মেটেনা। ভালোবাসা বুঝি এমনিই। বয়সের ছাপ বা সৌন্দর্য সেখানে মলিন।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।