#রহস্যময়_সারপ্রাইজ
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
#পর্ব- ১৩ (শেষাংশ)
তুরাগ বলা শুরু করল,
” বাবার একটা মেয়ে ছিল। নাম, শতাব্দী মেহেক বর্ণা। বাবা মায়ের মৃত্যুর বর্ণা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। আমাদের সাথে তার স্থান হয় এতিমখানায়। এর দিন কয়েক বাদেই বর্ণাকে দত্তক দিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। বর্ণার সাথে চঞ্চলের ভাব ছিল ভীষণ। বোনকে হারিয়ে চঞ্চল পাগলপ্রায় হয়ে যায়। তাকে রাখা দায় হলে তাকেও দত্তক দিয়ে দেয়া হয়। আমি একা হয়ে যাই। বর্ণার যাওয়া মানতে পারলেও চঞ্চলের যাওয়া মানতে পারিনি আমি। একপ্রকার হতাশায় চলে যাই। চঞ্চলকে খুঁজতে থাকি। চাচার কাছে জানতে পারি চঞ্চলকে যারা দত্তক নিয়েছে তারা ঢাকা থাকে। আমার ছোট্ট মস্তিষ্কে কী খেলেছিল জানি না সেদিন। ওকথা শুনে এতিমখানা ফিরে নিজের জমানো ১২৭২টাকা নিয়ে রাতের আঁধারে চিরতরে এতিমখানা থেকে বেরিয়ে পড়ি। আমার বয়স তখন দশ। ক্লাস ফাইভে পড়ি। ছোট হলেও বুদ্ধিমত্তা ছিল বেশ। সেই বুদ্ধিমত্তার জোরেই রাজশাহী থেকে ঢাকায় চলে আসি। এসে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকি। কিছুই চিনিনা। যাকে দেখতাম তাকেই জিজ্ঞেস করতাম, আমার চঞ্চলকে দেখেছেন কোথাও? কেউ ইতিবাচক উত্তর দিতে পারতো না। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম। কোন আশ্রয়স্থল ছিল না। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে শুধু চঞ্চলকে খুঁজতাম। আমি হয়ে গেলাম পথশিশু। দিনে একবার ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খেতাম আর সারাদিন চঞ্চলকে খুঁজতাম। রাতে ফুটপাতে কিংবা পিচঢালা রাস্তার একপাশে প্লাস্টিক বিছিয়ে ঘুমাতাম।”
তুরাগ থামল। এক নজর অভিলাষের দিকে তাকাল। দেখল অভিলাষ ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হতে পারে এসব ঘটনা অভিলাষ জানতো না। তুরাগ তারজন্য এত কষ্ট সহ্য করেছে তা হয়তো তার অজানা ছিল। তুরাগ অভিলাষ থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার বলা শুরু করল,
” এভাবে কতদিন কেটেছে জানি না। কারণ আমার তখন সময়জ্ঞান ছিল না। আমার জ্ঞানধ্যানে ছিল শুধুই চঞ্চল,আমার ভাই, তাকে এক নজর দেখা, একবার বুকে জড়িয়ে নেয়া। এরপর একদিন এক সেচ্ছাসেবক আমাদের কয়েকজনকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আজিমপুরের স্যার সলিমুল্লাহ মুসমিল এতিমখানায় আশ্রয় দিলেন। তারপর থেকে আমি সেখানকার বাসিন্দা হয়ে গেলাম। আমি কুঞ্জন থেকে হয়ে গেলাম তুরাগ। আমি বড় হতে থাকি। হতে থাকি গম্ভীর আর জেদি। আমার মনে আক্রোশ জমতে থাকে। আমি আমার একাকীত্বের জন্য, আমার পরিবার হারানোর জন্য প্রভাত মির্জাকে দায়ী করতে থাকি। আমার সব রাগ গিয়ে পড়ে তার উপর। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই যেভাবেই হোক প্রভাত মির্জাকে মেরে আমার বাবা মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিব। এ ভাবনা মাথা থাকতেই আমি বয়সের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকি। সেই সাথে পড়ালেখা আর চঞ্চলকে খুঁজতেও সময় ব্যায় করি।”
” অভিলাষ আর স্বরূপাকে পেলেন কবে?আর কিভাবে পেলেন?”
উদ্ধিগ্ন কন্ঠে বলল অধরা। এতক্ষণে সে তুরাগের অভিলাষকে বাঁচানোর অর্থ বুঝেছে। ভাই এরা!
তুরাগ উত্তর দিল,
” চঞ্চলকে পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে। সেকেন্ড সেমিস্টারে পড়তাম তখন। চঞ্চল তখন দ্বাদশ শ্রেনীতে পড়ে। হারিয়ে যাওয়ার পর চঞ্চলের সাথে আমার প্রথম দেখা মতিঝিলের এক টং দোকানে। ছোট বেলায় একবার চঞ্চল পড়ে গিয়ে বাঁ হাতের কব্জির উপরে লম্বালম্বিভাবে কেটে গিয়েছিল। যার পরে দাগ হয়ে গিয়েছিলো। হুবহু ওই দাগটাই দেখলাম আমার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটার হাতে। আমার খটকা লাগল। নিশ্চিত হতে মৃদুলকে পাঠিয়ে আমি ছেলেটাকে ফলো করলাম। ছেলেটার বাসা চিনে নিলাম। ছেলেটার ব্যাপারে কিছু ইনফরমেশন ও জোগাড় করলাম। দু’দিন পর একদিন ছেলেটা কলেজ থেকে ফেরার সময় একা পেয়ে আমি ডাক দিই। আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলাম,’তুমি কি চঞ্চল? কুঞ্জনের চঞ্চল?’
ছেলেটা খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
‘আপনি কে?’ আমি বললাম, ‘আমি কুঞ্জন।’ ব্যাস আবারো দুভাই মিলে গেলাম। ”
“স্বরূপাকে কিভাবে খুঁজে পেলেন?”
ফোঁড়ন কাটল অধরা। নিতিন কাঠের তৈরি সোনালী রঙের চেয়ারের হাতলের উপর হাত রেখে হাতের তালুতে থিতুনি রেখে বেশ মনোযোগ দিকে তুরাগের কথা শুনছে। তুরাগ একবার স্বরূপার দিকে তাকাল। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
” দূর্লভপুর এতিমখানায় গিয়ে পুরো ফাইল ঘেঁটে সেখান থেকে বর্ণার দত্তকের কাগজ খুঁজে নিয়ে তারপর সেই ঠিকানা পেয়ে গেলাম। জানতে পারলাম,চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি হাসান আলী বর্ণাকে দত্তক নিয়েছে। তারপর ঠিকানা ধরে খুঁজে বের করি বর্ণাকে। সে তখন ক্লাশ নাইনে পড়ত। প্রমাণ সমেত সত্যতা প্রমাণ করলাম। আমরা আবার এক হলাম। সেখান থেকেই নতুন করে পরিচয়, প্রণয়। বর্ণার একাদশের শুরুতে আমরা বিয়ে করি। আমাদের ব্যাপারটা বর্ণার মা বাবা জানতো না। এখনো জানে না। বিয়ের পরই বর্ণা জানতে পারে বাবা মায়ের খুনের কথা। আগে ভুলে গিয়েছিল। জানার পরই সেও আমাদের সাথে যোগ দেয়। আমরা তিনজন মিলে পরিকল্পনা আঁটলাম। সেই অনুযায়ী বর্ণা বাবা মায়ের কাছে জেদ ধরে বদলি নিয়ে পরিবার সহ ঢাকা চলে আসে।”
“তারপর প্রতিভার সাথে বন্ধুত্ব করার নাটক শুরু করে, তাই তো?”
নিতিন বলল। তুরাগ উত্তর দিল,
“হ্যাঁ। ”
অধরা অভিলাষের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,
“মি. অভিলাষ, শুধু মাত্র প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই প্রতিভাকে উত্ত্যক্ত করতেন? ”
“হ্যাঁ, প্রভাত মির্জার করা পাপের প্রতিশোধ নিতেই ভাইয়ার আগে আমি প্রভাত মির্জাকে খুঁজে বের করি। তারপর প্রতিভাকে টার্গেট করি। আমি চেয়েছিলাম প্রতিভাকে দিয়ে প্রভাত মির্জাকে কষ্ট দিতে। তাই ক্লাস নাইন থেকেই টিজ করা শুরু করি। প্রতিভার প্রতি ভালোবাসা তো দূরে থাক ঘৃণা ও আসে না আমার। ” চাপা রাগে বলল অভিলাষ।
“তুরাগ আসার পূর্বে আপনার পরিকল্পনা কী ছিল?”
“প্রতিভাকে প্রেমের জালে ফাঁসানো। তারপর বিয়ে করে প্রতিভাকে তিলে তিলে মারার মাধ্যমে প্রভাত মির্জাকে কষ্ট দেয়া। কিন্তু ভাইয়াকে খুঁজে পাওয়ার তা বাতিল করে নতুন পরিকল্পনা করলাম। নিখুঁত পরিকল্পনা। ”
“কী পরিকল্পনা?”
অভিলাষ বলা শুরু করল,
“আমি আর ভাইয়া মিলে পরিকল্পনা আঁটলাম। পরিকল্পনা করেছিলাম আমার পুতুলবোন মানে বর্ণাকে পাওয়ার পর। সে হিসেবে সেও যুক্ত ছিল। পরিকল্পনা মাফিক, প্রতিভার চোখ আমি হব সবচেয়ে খারাপ লোক। আর ভাইয়া আর পুতুলবোন হবে সবচেয়ে ভালো লোক। আমরা সবাই এমন অভিনয় করব, যেন প্রতিভাকে খুন করার পর সব দোষ আমার ঘাড়ে এসে চাপে। তাদের কেউ সন্দেহ না করে। যেহেতু আমি ইভ-টিজার তাই কাজটা সহজ হবে। সবাই আমাকে খুনী ভাববে। আমাকে নিয়ে পড়ে থাকবে। এই ফাঁকে ভাইয়ারা বাকি কাজ করবে। পরিকল্পনা মাফিক আমি প্রতিভাকে টিজ করতে লাগলাম নিয়মিত। আর বর্ণা ট্রান্সপার নিয়ে এসে নাটক করে ফাঁদ পাতল যেন প্রতিভা যেসে তার সাথে বন্ধু করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলো, প্রতিভা বর্ণার সাথে বন্ধুত্ব করল। বর্ণা মুখোশ ধারীর মতো প্রতিভার সাথে ভালো আচরণ করতে লাগলো। যেহেতু আমাদের পরিকল্পনা বড় এবং কাজ নিখুঁত তাই আমাদের তিনজন ছাড়া আরো মানুষের প্রয়োজন ছিলো। আমরা চিন্তায় পড়ে গেলাম। তখন ভাইয়াই মৃদুল, হৃদিতা এবং ডাঃকৌশিকের কথা বললেন। হৃদিতাকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব পড়ল আমার উপর। আর বাকি দুজনকে ভাইয়া রাজি করাবেন। ভাইয়া পরিকল্পনা করলেন বাকি তিনজনের কাছে এটা হবে একটা সম্পত্তির হাতানোর জেরে খুন। তাদের সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে ভাগে আনতে হবে। তারা কেউ জানবেনা যে এটা প্রতিশোধমূলক খুন। ভাইয়ার পরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে তিনজনকে ভাগে আমলাম। এস আই ভি টিম গঠিত হলো। তারপর মৃদুলকে প্রতিভার সামনে পাঠানো হলো বর্ণার বয়ফ্রেন্ড হিসেবে। এমনটা করা হয়েছে যেন বর্ণা আর ভাইয়ার রিলেশনের কথা কেউ জানতে না পারে। মৃদুল প্রতিভার সামনে বর্ণাকে কী কী বলবে তা বর্ণা শিখিয়ে দিতো। বর্ণার শিখানো কথা মৃদুলের মুখ থেকে শুনে প্রতিভা বিশ্বাস করে নিলো সব। এদিকে দিন যত যাচ্ছে বর্ণা প্রতিভার সম্পর্কে তত বেশি জানতে শুরু করেছে। বেস্টফ্রেন্ড মানতো বলে নিজের এবং পরিবারের কথা সবটাই শেয়ার করতো প্রতিভা।”
কথা টেনে অধরা বলল,
“আর প্রতিভার সেই সরলতা আর ভালোমানুষির সুযোগ নিল সরূপা! একটা মানুষ এতটা বিশ্বাসঘাতকতা কিভাবে করতে পারে! ” অধরা চোয়ালে অবিশ্বাস, চোখে রাগ। অভিলাষ সায় জানিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, বর্ণা সেসব থেকে কিছু পয়েন্ট নোট করে নিতো। এর পর আড়াই বছর আগে সুযোগ বুঝে তুরাগ প্রতিভার সামনে যায়। দিয়াবাড়িতে গিয়ে এমনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে যেন প্রতিভা প্রেমে পড়তে বাধ্য হয় । হলো ও তাই। প্রতিভা ভাইয়ার পাতানো জালে আটকে গেলো। ভাইয়া অভিনয় জগতে পা দিলেন। গম্ভীর রাগী,জেদী মানুষটাও হাসিমজা করার অভিনয় শুরু করলেন। ভাইয়ার অভিনয়ের জোরেই প্রথম দেখায় ভাইয়াকে ভালো লেগে যায় প্রতিভার। বর্ণা প্রতিভার ভালো লাগা মন্দ লাগা সম্পর্কে জানতো এবং সে হিসেবেই ভাইয়াকে চলতে বলতো। যাতে প্রতিভার ভালোলাগাটা বাড়তে থাকে। তেমনটাই হলো। দিয়াবাড়িতে প্রথম দেখায় পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, অতঃপর ভালোবাসার নাটক। সবকিছুতে এগিয়ে ছিল প্রতিভা’ই। ভাইয়াকে তেমন কিছু করতে হয় নি। শুধু বর্ণার লেখা স্ক্রিপ্টের কয়েকটা কথা আর স্ক্রিপ্টের লেখা প্রতিভার কয়েকটা পছন্দনীয় কাজ করতে হলো। ভাইয়া মাস্টার্স কমপ্লিট করে চাকরি নেয়। এবং কিস্তিতে ফ্ল্যাট নেয়। সেখানে ভাইয়ার ফ্ল্যাটে কাজের মেয়ে সেজে উঠে হৃদি। তার উপর তলায় উঠি আমি, আমার পরিবার। সবাই জানতো, হৃদি ভাইয়ার কাজের মেয়ে। অথচ গোপনে সে আমার স্ত্রী ছিল। ততদিনে আমরা বিয়েও করে নিয়েছি। লুকোচুরির সংসারটা বেশ যাচ্ছিলো আমাদের। এত কিছুর মাঝেও আমি ইভটিজারের ভূমিকা পালন করতে ভুলি নি। আমি প্ল্যান মোতাবেক এগুচ্ছিলাম। বর্ণা আর ভাইয়া ও মুখোশ পরে প্রতিভার সাথে গভীর একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ভাইয়ার চাকরির পর আমি প্রতিভাকে বিরক্ত করা বাড়িয়ে দিলাম। একসময় তারা আমাকে জেলে দিলো, এবং তাড়াহুড়ায় ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিয়ে দিল। আমাদের পরিকল্পনা বিফলে যায় নি।”
এ পর্যায়ে থামল অভিলাষ। চোখে মুখে জয়ের রেখা তার। যেন নিজেদের বুদ্ধিমত্তার উপর নিজেই মুগ্ধ। স্বরে রাগ মিশিয়ে অধরা বলল,
“আপনি জেলে গেলেন। অনেকটা ইচ্ছে করবেই। আপনার জেলে থাকার সময়ে প্রতিভার সাথে তুরাগের মুসলিম ধর্ম মতে বিয়ে হলো। তুরাগ এবার প্রেমিক থেকে স্বামীর অভিনয় শুরু করল। আপনি থাকতেন উপরতলায়, আপনার স্ত্রী তুরাগের বাসায়। আপনাদের তিনজন ছাড়া আমার পরিবার, আশেপাশের মানুষ, প্রতিভার কাছে ছিলো শিলা কাজের মেয়ে। । প্রতিভাকে সময় দেয়ার বাহানায় স্বরূপা ও আসতো। এভাবে সব ঠিকঠাকই চলছিলো। আপনি জেল থেকে বের হলেন। প্রতিভাকে আবার টিজ করা শুরু করলেন। লোকলজ্জায় প্রতিভা কাউকে বলতো না। আপনার জেল থেকে বের হওয়ার পর তুরাগ এক্সিডেন্টের শিকার হলো। এক্সিডেন্টে হয়নি। ওটা বাহানা ছিল। তুরাগের সব ট্রিটমেন্ট করেছে আপনাদের আগে থেকেই ঠিক করা ডাঃ কৌশিক। কয়েকদিন মিথ্যা বাহানায় হাসপাতালে রাখলো। তারপর পায়ের হাড় ভেঙে গেছে বলে হুইলচেয়ারে বাড়ি পাঠাল। খালাতো ভাইয়ের কথা প্রতিভা অবিশ্বাস করলো না। মেনে নিলো। তুরাগ এবার ল্যাংড়া হওয়ার অভিনয় করতে লাগল। তার নিয়মিত চেকাপ করতো কৌশিক। তাই তেমন সমস্যা হতো না। মিথ্যা রিপোর্ট বানিয়ে দেখাতো। মিথ্যা মেডিসিন দিতো। প্রতিভা মুখে তুলে দিলে প্রতিভার অগোচরে ফেলে দিত। তুরাগ সব কিছু এমন ভাবে করতো যে প্রতিভা কোন সন্দেহ করার স্কোপ পেতো না। প্রতিভা জানতো তুরাগ প্রতিভাকে খুব ভালোবাসে। অভিনয়ে অন্তত তাই বলতো। এতটুকু জানা আছে আমার। এর পরের অংশ বলুন। ”
অধরা বিশদভাবে দেয়া বর্ণনায় অবাক হলো অভিলাষ। বিস্ময় ঠেলে বলল,
” প্রতিভার মার্ডারের পরের কথা ভেবেই ভাইয়া আর প্রতিভার বেডরুমে ওই বোর্ডটা টাঙানো হয়। এবং অনুভূতি আদান প্রদান হয়। প্রতিভা যখন ভাইয়ার সেবায় মগ্ন তখন আমি ব্যাস্ত প্রতিভাকে ব্ল্যাকমেইল করতে। আমি এডিট করে প্রতিভার অশ্লীল ছবি বানিয়ে ওকে ব্ল্যাকমেইল করতাম। প্রতিভা ভয়ে, লজ্জায় বলতো না কাউকে। এভাবে ক’দিন গেলো। এসে গেলো আমাদের সেই মুহুর্তে। ভাইয়ার জন্মদিনের আগের দিন। যে দিন আমরা প্রতিভাকে খুন করব। প্ল্যান অনুযায়ী বিকেলে আমি আর মৃদুল সন্ত্রাসী সেজে প্রভাত মির্জার উপর হামলা চালাই। এতে তিনি আহত হন। চিকিৎসা শেষে বাসায় আসেন। বাবার অসুস্থতার কথা শুনে প্রতিভা ছুটে গেলো সেখানে। এই ফাঁকে আমি ভাইয়ার ফ্ল্যাটে গেলাম। আগের দিন বর্ণার দেয়া প্রতিভার নাম দিয়ে লেখা ডায়েরিটা ভাইয়ার ফ্ল্যাটে রেখে যাই। বর্ণা হ্যান্ড রাইন্টিং এক্সপার্ট। সবার লেখা নকল করতে পারে। তাই সে অনায়েসে প্রতিভার লেখা নকল করে মন গড়া একটা কাহিনী লিখে দিয়েছিল ডায়েরিতে। এটা মূলত পুলিশের জন্যই ছিলো। বর্ণা তখন মির্জা হাউজে। তারপর ভাইয়া, হৃদিতা ভুঁইয়া ভিলার ছাদ টপকে ফরিদ ভিলা হয়ে বাইরে চলে যায়।”
“কোথায় যায়? প্রতিভাকে কোথায় হত্যা করা হয়েছে?” উদ্ধিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল অধরা। তুরাগ উত্তর দেয়,
“ধানমন্ডির চঞ্চলের ফ্ল্যাটে। যেখানে চঞ্চল আর হৃদি সময় কাটায়। সেখানে আগে থেকে খুনের সব সরঞ্জাম এবং ডাঃকৌশিক, আর মৃদুল উপস্থিত ছিল। আমরাও গিয়ে যোগ দিলাম। ”
নিতিন ভ্রু কুঁচকে বলল,
“হত্যাকার্য শুরু হলো কখন এবং কিভাবে? বিস্তারিত বলুন। ”
অভিলাষ লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
” প্রতিভাকে মার্ডার করার দুদিন আগে মৃদুল গিয়ে প্রতিভার গায়ের বারবি গাউন আর ডায়মন্ড সেট কিনে নিয়ে আসে। র্যাপিং পেপার, ট্রাভেল ব্যাগ, নেম কার্ড সব কিছু আগেই রেডি ছিলো। নেম কার্ড আর চিরকুট বর্ণা আগেই লিখে রেখেছিলো। হৃদি পার্লারে কাজ করেছে বিধায় সাজানোর ভার পড়েছিলো তার উপর। রাতের খাবার খেয়ে প্রতিভা বাবার বাসা থেকে বের হয়ে যায়। প্রতিভা যাওয়ার পরপরই বর্ণা বারান্দায় দিয়ে দড়ি বেধে অতি সচেতনার সাথে নিচে নেমে প্রতিভার পিছু নেয়। বর্ণার সেদিন মির্জার হাউজে থাকার কথা। প্রতিভা যাওয়ার পর বর্ণা রুমে ডুকে দরজা লক করে। তাই মির্জা হাউজের কেউ টের পায় নি। গুটগুটে অন্ধকার থাকায় সিসিটিভি ক্যামেরায় ও আসেনি কিছু। সেদিন কায়দা করেই লোকাল গাড়িতে পাঠিয়েছে ভাইয়া প্রতিভাকে। তাই প্রতিভা ভাইয়ার ফ্ল্যাটে ফেরার জন্য গাড়ির অপেক্ষা করে বাড়ির সামনে। তখনি বর্ণা প্রতিভার সামনে আসে আর বলে, তুরাগ আর প্রতিভার জন্য সে সারপ্রাইজ রেড়ি করেছে। সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য তার সাথে যেতে। সারপ্রাইজের কথা বলে কনভেন্স করার পর মৃদুলকে ম্যাসেজ করে বর্ণা। ম্যাসেজ পেয়ে মৃদুল গিয়ে প্রতিভার আড়ালে প্রতিভার ফোন নিয়ে যায়। ফোন নিয়ে ধানমন্ডি লেকে চলে যায়। রাত বারোটায় শিলাকে সেই ম্যসেজ করে। ”
ফোঁড়ন কাটে নিতিন,
“ফোন লোকেশন অনুযায়ী আপনাদের সবার ফোন ঘটনার দিন রাতে নিজ নিজে বাসায় ছিল। তাহলে যোগাযোগ হলো কিভাবে?”
“আমরা সবার লোকাল ফোন নিজ নিজ গন্তব্য এ ছিল। আমাদের সাথে ছিলো না। আমাদের সাথে ছিলো আমাদের গোপন ফোন। যার নাম্বার আমরা ছ’জন ছাড়া কেউ জানেনা। বর্ণা প্রতিভাকে আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। সেখানে প্রতিভাকে চোখ বেধে সাজিয়ে দেয় বর্ণা আর হৃদি। সাজানো শেষে চোখ বেধেই বর্ণা কথা বলতে বলতে আমাদের গেস্ট রুমে নিয়ে যায়। গেস্ট রুমের সিলিংয়ের সাথে দড়ি বাধা ছিলো। প্রতিভাকে চোখ বাধা অবস্থায় দড়ির সামনে নিয়ে একটা মোড়ার উপর দাঁড় করানো হয়। প্রতিভা সারপ্রাইজ ভেবে চুপ ছিলো। প্রতিভার মাথায় দড়ি ঢুকায় বর্ণা। তারপর প্রতিভার চোখের বাধন খুলে দেয়। ”
“আপনারা তখন কোথায়?”
“আমরা সবাই প্রতিভার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম।”
“আপনাদের ভয়ানক রুপ দেখে প্রতিভার মুখভঙ্গি কেমন ছিল?”
” প্রতিভা চোখ খুলে দেখে তুরাগ দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে খুব অবাক হয়। তারপর তুরাগের পাশে আমাকে দেখে আরো অবাক হয়। সবচেয়ে বেশি অবাক হয় তার গলায় দড়ি দেখে। প্রতিভা অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকায়। তখন আমরা ছ’জন সমস্বরে হেসে উঠি। ভাইয়া বলে উঠে,
‘ওপারে ভালো থেকো আমার অভিনয়ের স্ক্রিপের স্ত্রী। আজ আমার প্রতিশোধ পূর্ণ হলো।’
প্রতিভা অবাক হয়ে বললো,
‘প্রতিশোধ! তুমি!’
‘হ্যাঁ আমিই। আমি তোকে খুন করার জন্যই তোর সাথে এতদিন নাটক করেছি। শুধু আমি না, আমরা সবাই নাটক করেছি। এই যে দেখছিস তোর বান্ধবী স্বরূপা, ও আমার স্ত্রী। তোর আগে থেকে। আর অভিলাষ আমার ভাই। তোর সাথে আমি আর বর্ণা মানে স্বরূপার যা সম্পর্ক ছিলো সবটা ফেক। ওটা আমাদের প্রতিশোধের জন্য ছিলো।’
ভাইয়ার কথা শুনে প্রতিভার চোখে মুখে আকাশচুম্বী বিস্ময় দেখা গেলো। সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। ঠিক তখনি বর্ণা গিয়ে প্রতিভার পায়ের নিচের মোড়া ফেলে দিল। কিছু বুঝে উঠার আগেই শ্বাস আটকে মারা গেল প্রতিভা।”
অভিলাষ থামল। অধরা ঘৃণার সুরে বললো,
“আপনারা কি মানুষ! ছিঃ আমার ভাবতেই রাগ লাগছে।”
অধরার কথার জবাব এলো না। নিতিন বলল,
“বাকি কাহিনী বলুন তুরাগ। ”
চলবে…