#স্বপ্নতরী (পর্ব-11)
♡আরশিয়া জান্নাত
অক্টোবর মাসটা অসম্ভব সুন্দর মায়াময় একটা মাস। এই সময়ে হালকা হিম পড়ে দূরে আবছা কুয়াশার মতো একটা আবরণ সৃষ্টি হয়। বিকেলটা তাই অনেক আদুরে মনে হয়। কেমন জানি দূরে কোথাও ঘুরে আসার হাতছানি।
নীরার মনটাও সেই হাতছানিতে সাড়া দিতে চাইছে।
যদিও মাসের শেষের দিকে তার ফ্লাইট। মাঝের সময়টা সে তার দাদীর সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে কাটাতে ইচ্ছুক। ঢাকা শহরের বন্দীজীবনে তার দাদী যে অনেক হাঁপিয়ে উঠেছে সেটা নীরার নজর এড়ায় নি। তাই সে মোহাম্মদপুর যাওয়ার প্ল্যান করেছে।
–বুবুন তুই আমারে ভুলাইতে এহন বাড়িতে নিতাছোস তাই না?
–কি যে বলো তুমি! ভোলানোর কি আছে?
–তুই যে বিদেশ যাইবি আমারে ফালাইয়া, আমি যাতে রাও করবার সুযোগ না পাই হেইর লাইগা?
–দাদীজান তুমি আমার একমাত্র কলিজার টুকরা। আমার পরিধি যত দূরেই হোক না কেন কেন্দ্রবিন্দু তুমিই থাকবা।
জাহানারা বেগম জানালার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন তার চিরচেনা সেই মেঠোপথ। তার বৈবাহিক জীবনের শুরু যেই পথটা ধরে, কত স্মৃতি ভেসে উঠে মানসপটে।
মোহাম্মদপুরে নীরার দাদার ভিটা। যদিও এখানে এখন কেউই থাকে না। বছরে দু’একবার তার বাবা বা ভাই এসে সবকিছু দেখেশুনে যায়। একজন বয়স্ক লোক অবশ্য এ বাড়ির দেখাশোনা করে। বহুদিন পর কেউ বেড়াতে আসছে জেনে সকাল থেকেই লোক লাগিয়ে পুরো বাড়ি পরিষ্কার করানো হয়েছে। নীরার সবচেয়ে প্রিয় জারুল গাছের নীচে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট সবার আগে পরিষ্কার করা হয়েছে।
নীরাদের গাড়ি ঢোকার সাথে সাথেই গ্রামের অনেকেই তাদের ঘিরে ধরলো। আব্দুল নামক লোকটা জাহানারা বেগমকে কদমবুসি করে বললো, আম্মা এতো দিন পরে আমনে আইলেন! আমার যে কি আনন্দ লাগতাছে!
–তোমার কি খবর আব্দুল? বাড়ির সবাই ভালা তো?
–আল্লাহ রাখছে আম্মা। পথে কোনো সমস্যা হয় নাই তো? এইডা আমগো নীরা মনি? মাশাআল্লাহ মেলা বড় হইছে। কতবছর পর দেখছি!
— আস্সালামু আলাইকুম চাচা। ভালো আছেন?
–ওয়ালাইকুমুস্সালাম ভালো আছি মা তুমি কেমন?
–আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো। চাচা আমিনা কোথায় দেখছি না যে?
— হের তো গেল মাসে বিয়া হইছে এহন শ্বশুরবাড়িত। তোমরা আইছো শুনলে ঠিকই চইল্লা আইবো। আম্মা বেয়াদবি নিবেন না হঠাৎ কইরা বিয়া দিছি কোনো বিশেষ আয়োজন করিনাই বইলা কাউরেই কই নাই।
–আরেহ না না কি যে কও। দেখি ঘরে চলো আমার শরীরডা ভালা লাগতাছে না। এতোদিন পরে সফর করছি সইতাছে না।
নীরা ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলো। তখনই রিমির কল আসে।
–হ্যালো নীরা কই তুই?
–আছি এক জায়গায়। কেন বলতো?
— তোর ফ্লাইট তো বিশ তাং এখুনি চলে গেছস নাকি?
–আরেহ না বাড়িতে আসছি দাদীর সাথে।
–একটু বললিও না! কত শখ ছিল তোদের ওখানে যাওয়ার।
–বলিনাই কারণ তুই যে পজিশনে আছিস তোর জামাই ভুলেও একা ছাড়বেনা।
–হুহ তবুও।
–তুই জানলি কিভাবে আমি বাসায় নাই?
রিমি টপিক ঘুরিয়ে বললো, পুজা বলতেছিল তোকে নিয়ে বাসায় আসবে সবাই আড্ডা দিবো। তা ফিরবি কবে?
–থাকবো এখানে কয়টা দিন। বলা যাচ্ছেনা আপাতত।
–তোর কি মতলব আছে ঐখান থেকেই সিঙ্গাপুর যাওয়ার?
–কি যে বলোস! তা হবে কেন?
–আচ্ছা শোন কমপক্ষে এক সপ্তাহ হাতে নিয়ে ফিরিস।
–কেন?
–এতো প্রশ্ন করোস কেন? রাখছি আসলে দেখা হবে।
নীরা ফোনের দিকে তাকিয়ে বেকুব হয়ে গেল। রিমির কল হুটহাট আসে যায়। মেয়েটা আসলেই পারে বটে!
রিমি ফোন রেখে বলল, ম্যাডাম তো প্রকৃতিবিলাস করতে গেছে। আপাতত দশ পনেরোদিন তার নাগাল পাবা বলে মনে হচ্ছে না দেবরজী!
–ভাবি তোমার বান্ধবীর এখনই যাওয়ার ছিল?
–কি বলি বলো তো?
–ধুরর ভাল্লাগেনা।
আলিফ ভোঁতা মুখ করে চলে গেল। তাশফিক ভাইকে এমন চেহারা নিয়ে যেতে দেখে বললো, কি ব্যাপার বলো তো আলিফের কি হলো?
রিমি হেসে বললো, Char gaya peyar ka bukhar…
🌼🌼🌼🌼
“মিস আর্টিস্ট পৃথিবীর সব রং তুমি চেনো অথচ আমার মনের রং টা তোমার তুলিতে আচড় কাটে না! যখনই ভেবেছি জানান দিবো তখনই পালিয়ে গেলে। ভালো লাগছেনা একটুও। এখন মনে হচ্ছে না বলে থাকা অসম্ভব কঠিন কাজ। অথচ এতোদিন কত সহজেই গোপনে ভালোবেসেছি!”
আলিফ ফোনের স্ক্রিনে নীরার ছবির দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। নীরার কয়টা ছবি আছে তার ফোনে সেই ডিজিট কি নীরা কখনোই জানবে?? এই যে তার ফোনের পিনকোড নীরার বার্থ ডেট, প্রতিটা পাসওয়ার্ড ঘুরেফিরে নীরাতেই সীমাবদ্ধ। তার ঘুম ভাঙে নীরার মুখ দেখে, তার এলার্ম টিউন নীরার রেকর্ডিং। আজ পর্যন্ত নীরার সাথে যতোবার দেখা হয়েছে তার কথা কতোটা গোপনে রেকর্ড করেছে নীরা জানবে?
হয়তো জানবে অথবা জানবে না। আচ্ছা এসব জানলে কি নীরা খুব আপ্লুত হবে নাকি বিরক্ত হবে অযাচিত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে?
নীরা! নীরা হচ্ছে আলিফের জীবনে হঠাৎ করে আসা সাতরঙা রংধনু। যাকে দেখে আলিফের মনে হয়েছে এর জন্যই বুঝি সে জীবনের এতোগুলো বছর অপেক্ষা করেছিল। কতো মেয়েকেই তো দেখেছে সে, কত মেয়ে তার জন্য হাত কেটেছে, তার মন পেতে কত কি করে। অথচ তার মন কেড়ে নিলো এমন একজন যার ধ্যানধারণায় এক কোণেও আলিফ ছিল না। আলিফ যতো সময় নিয়ে তাকে পর্যবক্ষেণ করেছে ততোই নতুন করে প্রেমে পড়েছে। দুই বছর ধরে নীরার পেছনে ছায়ার মতো ছিল নীরা কি সেটা টের পেয়েছে? পাওয়ার কথা না সে তো অন্যজগতের মানুষ। তার কল্পনার জগত ভিন্ন। তবে মেয়েদের কথা বলা যায় না এরা কিছু লক্ষ্য করেনা বললেও অনেক কিছু লক্ষ্য করে। এদের থেকে কিছু লুকানোর সাধ্যি কারোই নেই। আলিফ মনকে বুঝ দিতে বললো, ডোন্ট ওরি আলিফ তোর যেই গ্লেস যে কাউকেই প্রপোজ করলে অনায়াসে এক্সেপ্ট করবে। নীরাও করবে বি ব্র্যাভো ম্যান!
পরক্ষণেই বললো, হবে না হবে না। নীরার মতো মেয়ে কিছুতেই রাজী হবেনা। নির্ঘাত ও আমায় ঝাটাপেটা করে তাড়াবে। এমনিতেই যেভাবে ঝাঁজ দেখিয়ে কথা বলে!!
নানান যুক্তিতর্কে হয়রান হয়ে অবশেষে অশান্ত মস্তিষ্কেই তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে।
ঐদিকে নীরা ফেবুতে স্ক্রল করতে থাকে আলিফের প্রোফাইলটা। সেখানে কে কি কমেন্ট করলো, আলিফ কাকে কি রিপ্লাই করলো সবকিছুই খুটিয়ে দেখা তার এখন অনাকাঙিক্ষত অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। সে আলিফের সবকিছু কেমন গোয়েন্দার মতো ফলো করছে যেন! নীরা বুঝে পায় না এসব কেন করছে। এমন অভ্যাস তো তার ছিল না। তবে কি কোনো না কোনো ভাবে সেও নারীসুলভ আচারণে প্রভাবিত হয়ে এমন করছে? নাকি এখানে বিশেষ কোনো উদ্দীপক আছে যা তাকে এসব করাচ্ছে?
সেইম এইজ রিলেশনশীপ নিয়ে ও ব্যক্তিগতভাবে বিরোধীতা করে অথচ সে নিজেই কি না সেইম ক্লাসের কারো প্রতি আগ্রহী? না না এমন করাটা ঠিক হচ্ছে না। নীরা চটজলদি লগআউট করলো। সে আলিফের আইডিতে আর কখনো যাবে না। আলিফের কথাও ভাববেনা। তাছাড়া আলিফ তো অলরেডি অ্যাঙ্গেজড ওর কথা ভাবার প্রশ্নই উঠে না।
কিন্তু ভালোবাসা কি কিছু মানে? যা হবার তা তো হয়েই গেছে জানায় কিংবা অজানায়। এখন কেবল প্রকাশের অপেক্ষায়,,,,,,,
চলবে,