স্বপ্নতরী (পর্ব-14) ♡আরশিয়া জান্নাত

0
658

#স্বপ্নতরী (পর্ব-14)

♡আরশিয়া জান্নাত

নীরা সিঙ্গাপুর গেছে প্রায় পনেরোদিন হয়ে গেছে। এই পনেরোদিন পনেরো কোটি বছরের মতো লেগেছে আলিফের কাছে। প্রতিটা মুহূর্ত সে নীরাকে অসম্ভব মিস করেছে। মনকে ব্যস্ত রাখার জন্য কত কিছুই না করলো অথচ ঘুরেফিরে মন নীরাতেই আবদ্ধ হয়ে যায়। রিয়া আলিফের সঙ্গে কথা বলতে সরাসরি ওর ক্লাবে আসে। ওদের গ্রুপের সব ছেলেরা এই ক্লাবে বসেই আড্ডা দেয় গেইম খেলে। আলিফ এখন এখানেই বেশি সময় কাটায়। তাই রিয়া এখানেই এসেছে।
রিয়াকে দেখে আলিফ কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করলেও প্রকাশ করলো না। রিয়া বরাবরের মতো আলিফের পাশেই বসলো, তারপর ওর দিকে ফিরে বললো, আলিফ আমার তোমাকে একটা বিষয়ে কনফেস করার ছিল। অনেকদিন ধরেই বলবো বলবো করে বলা হয় নি। ভার্সিটিতে একটা ওপেন সিক্রেট টপিক ছিল আমি তোমাকে ভালোবাসি। যেহেতু আমরা খুব ভালো ফ্রেন্ড ছিলাম তাই এটা বিশ্বাস করতে কারোই বিশেষ কনফিউশন ছিল না। সে যাই হোক এইসব গুঞ্জনে তুমি প্রভাবিত ছিলেনা কখনোই। না কখনো আমাকে জিজ্ঞাসা করেছ বা বলার সুযোগ দিয়েছ এইসব সম্পর্কে। যদি জিজ্ঞাসা করতে হয়তো আমার জন্য বলা সহজ হতো আমি তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি!

আলিফ মিষ্টি করে হেসে বলল, রিয়া তুমি আমার অনেক ভালো বন্ধু। এর বাইরে অন্যকিছুই ভাবিনি তোমাকে। তোমার ভালোবাসার অনুভূতির উপর শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তুমি ভালোবাসতেই পারো এবং সেটা প্রকাশ ও করতে পারো সেই অধিকার তোমার আছে। কিন্তু আমি অন্য একজনের সঙ্গে এঙ্গেজড। তাই আমার থেকে কিছু আশা রেখো না।

আমি জানি। তুমি হয়তো জানোনা তোমার সবকিছুই আমার নখদর্পণে থাকে। তাই তোমার কোনো ইনফরমেশন মিস যায় না। ট্রাস্ট মি আমি তোমার থেকে পজিটিভ কিছু শুনবো এই এক্সপেক্টেশন রেখে আসিনি। আমার মনে হয়েছে তোমাকে সরাসরি বলা উচিত। বাই দ্য ওয়ে আমি ইউকে চলে যাচ্ছি। আর হয়তো বাংলাদেশে ফেরা হবে না।

হঠাৎ?

এই দেশে থাকার একমাত্র কারণ ছিলে তুমি। আমার মনে হলো এখন আমার এখানে থাকাটা অপ্রয়োজনীয়। আর আমি নিজেকে যতটুকু চিনি আমি তোমার পাশে নীরাকে সহ্য করতে পারবো না, এখানে থাকলে আমি এমন কিছু করবো যা কারোই কাম্য নয়। তার চেয়ে বরং আমি দূরে চলে যাই এটাই শ্রেয়।

আলিফ আর কিছুই বললো না, রিয়া কিছুক্ষণ চোখের পানি বিসর্জন দিয়ে চোখমুখ মুছে হাসিমুখে বললো,Wish u a very happy and successful life with Nira… All the best my friend.

রিয়া পিছু না ফিরেই চলে গেল।
🌼🌼🌼
রিমির টুইনস হয়েছে। একটা ছেলে একটা মেয়ে। সবাই আগেই জানতো ওদের টুইনস হবে। তাই আনন্দের ফোয়ারা বয়ে গেল আহমেদ’স ম্যানশনে। তাশফিক বুঝতেই পারছে না ও কাকে আগে আদর করবে মেয়েকে নাকি ছেলেকে। এতো ছোট বাচ্চা কোলে নিতেও তার ভীষণ ভয় হচ্ছে। তাই সে কটের পাশে দাঁড়িয়ে একবার বাচ্চাদের দেখছে তো একবার রিমিকে দেখছে। ওর এমন কনফিউজড চেহারা দেখে রিমি হেসে বললো, তুমি আসলেই স্টুপিড। কখন কি করতে হয় একটুও সেন্স নেই তোমার!
তাশফিক অসহায় মুখ করে বললো, তুমি এই শরীরেও এমন রাগ দেখিয়ে বকছো! কিন্তু আমি কিচ্ছু মনে করিনি সত্যি। আমাকে এতো সুন্দর দুটো ফুল গিফট করেছ রিমি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
কথাটা বলে কপালে চুমু দিতে হয় এইটুকুও বুঝে না। সবকিছু উনার থেকে চেয়ে চেয়ে নিতে হয় আমার! তুমি আসলেই আনরোমান্টিক।

পুজা টিপ্পনি কেটে বললো, আনরোমান্টিক বলে বলে টুইনস হলো। রোমান্টিক হলে না জানি কয়জন আসতো!

তাশফিক লজ্জায় লাল নীল হয়ে বাচ্চাদের দিকে ফিরে গেল। এতো লজ্জা ওর আসে কোত্থেকে হাহ!

ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিউশনে নীরার আঁকা দশটি ছবি প্রদর্শনী হয়েছে। নীরার মনটা তবু ভীষণ খারাপ ছিল, এমন সুন্দর একটা ঘটনা তার জীবনে ঘটতে চলেছে অথচ বাবা-মা বা দাদী কেউ নেই। যদিও ছোট ভাই আছে তবুও। নীরার ভাই অবশ্য সবকিছু তাদের লাইভে দেখাচ্ছে। নীরা মনে মনে আরেকজনকে খুঁজছে। কি হতো যদি এই মোমেন্টটা আলিফ ও দেখতো?

হাতে ক্রেস্ট আর ফুল নিয়ে অনেকটা মনমরা হয়েই নীরা পার্কিং লটে যাচ্ছিল তখনই পেছন থেকে একজন বললো, হেই মিস আর্টিস্ট! তুমি যে আন্ধি আর কতবার প্রমাণ করবা হু??
নীরা চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখে আলিফ দাঁড়িয়ে আছে, সেই চিরচেনা ভঙ্গিতে মুখে হাসি রেখে নীরার দিকে চেয়ে।
নীরা দৌড়ে গিয়ে আলিফকে জড়িয়ে ধরলো। এই অচেনা দেশের অচেনা শহরে এক ঝাঁক অচেনা মানুষের ভীড়ে ভালোবাসার মানুষকে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখার অভিব্যক্তি বুঝি এমনই হয়? আলিফও যেন বহুবছর পর তার প্রিয়দর্শিনির মুখ দর্শন করে ভুলে গেল ইহজগত বলে কিছু আছে!
হুশ ফিরতেই নীরা লজ্জায় লাল হয়ে আলিফকে ছেড়ে দিলো। চারদিকে তাকিয়ে বললো, তুমি এখানে কিভাবে সম্ভব? কখন এসেছ আমাকে তো কিছুই বলোনি?

বলে দিলে এই অসম্ভব ঘটনা সম্ভব হতো?

ভাইয়া যদি দেখে ফেলতো কি কেলেঙ্কারি হতো খবর আছে?

কিছুই হতো না। তোমার ভাইয়া কিছুই বলতো না।

মানে?

মানে দেশে চলেন এরপর আপনাকে বুঝাচ্ছি।

বলো না আগে

উহু বলবো না।

প্লিজ বলো?

বলবো এক শর্তে।

কি শর্ত?

Hug me again..

লাগবে না বলার।

হাহাহা

এভাবে হাসির কিছু নেই

অবশ্যই আছে।

নীরার ভাই সাহেদ এসে বললো, তুমি এতোক্ষণ কোথায় ছিলে? আমি তো কতজায়গায় খুঁজলাম তোমাকে!

আলিফ বললো, কনভেনশন হলের অপজিটে ছিলাম তাই বোধহয় দেখেন নি।

নীরা চোখ গোল গোল করে বলল, ওকে তুমি চিনো ভাইয়া? আর ও যে আসবে জানতে?

সাহেদ, হ্যাঁ। শুধু আমি কেন বাসার সবাই ওকে চিনে। আর ও যে আসবে সবাই জানতো
তোমরা আসো আমি গাড়ি বের করতে বলছি।

নীরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আলিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আলিফ সেসব তোয়াক্কা না করে নীরার হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চলতে শুরু করলো আর গুনগুন করে গাইতে লাগলো,
“চলতে চলতে দেখা হলো
তোমাকে লাগছে ভালো তাই তোমাকে আমি দেখছি
যতো দেখছি ততো লাগছে ভালো
যতো দেখছি ততো লাগছে ভালো,,,,,,,,”
🌾🌾🌾🌾🌾🌾🌾
পরিশিষ্ট: জাহানারা বেগম তার লাঠি দিয়ে আলিফকে টেনে তার সামনে বসিয়ে বললো, নাতজামাই শুনো, আমার নাতনিরে কিন্তু চোখে চোখে রাখবা। এক মায়ের এক ঝি তো আলগা বাতাস বেশি লাগে। ওরে কিন্তু আল্লাহর হাওলা করে তোমারে দিতাছি, ঠিকঠাক যত্ন যদি করতে না পারো এই বুড়ির লাঠি দেখছো লাঠির জোর দেখো নাই!

আলিফ জাহানারা বেগমের হাতের উপর হাত রেখে বলল, দাদীজান আপনার নাতনি আপনার কাছে যেমন মূল্যবান আমার কাছেও তেমনি মূল্যবান। দোআ করবেন যেন ওর যত্ন নিতে পারি আর আপনাদের অভিযোগ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ যেন হয়।

জাহানারা বেগম আলিফের মাথায় হাত বুলিয়ে চুমু খেলেন। তার অতি আদরের নাতনি যেন সুখী হয় এই দোআ করেই চোখ মুছলেন।

অভি সেই কখন থেকে গুড্ডুর কান্না থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ছেলের কান্না তো থামেই না। ওদিকে পুজা গিয়ে বসে আছে নীরার পাশে। ঘরভর্তি মেয়েদের মধ্যে যেতেও অভির অস্বস্তি লাগছে একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে পুজাকে ডাকলো অভি। পুজা উঠে এসে বলল, খুব তো বলেছিলে বাচ্চা সামলানোর দায়িত্ব তুমি নিবে। এখন পারছো না কেন?

বাচ্চা সামলানো এতো কঠিন আগে জানলে ভুলেও বলতাম না।

পুজা ওর মুখ দেখে হেসে ফেলল। ওর হাসি দেখে গুড্ডুও কান্না থামিয়ে হাসতে শুরু করলো।

অবশেষে বিয়ে নামক বন্ধনে বাঁধা পড়লো নীরা আর আলিফ। সূচনা হলো স্বপ্নতরীর পথচলা নতুন এক গল্পে!

¤সমাপ্ত

(গল্পটা বহুদিন গ্যাপ দিয়ে দিয়ে লেখার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কেমন হয়েছে স্বপ্নতরী কমেন্ট করে জানাবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমাপ্রার্থনা।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here