#স্বপ্নতরী (পর্ব-2)
♡আরশিয়া জান্নাত
নীরার বড় ভাই সোহান আর তাঁর স্ত্রী অনন্যা গতকাল ঢাকায় এসেছে।সোহান চাকরিসূত্রে ফেনী থাকে।সোহানের মেয়ে অন্তরা একমাত্র ফুপীকে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে।এক মুহূর্তের জন্য নীরার সঙ্গ ছাড়ছেনা।নীরাও তাঁর আদরের ভাইজীকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।ঘুম থেকে উঠে নীরা ঠিক করলো আজ সে ক্লাসে যাবেনা,অন্তরাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে সারাদিন।কিন্তু তাঁর ভাবনায় রিমি পানি ঢেলে দিলো,অনেকটা বাধ্য হয়েই রেডি হলো বাইরে যেতে।
পুজা সেই কখন থেকে হিজলতলায় বসে আছে।রিমি আর নীরার খবর ই নেই,মনে মনে বেশ রেগে আছে সে।আজ তাঁর জন্মদিন অথচ তাঁর দুই বান্ধবীর একজনও তাঁকে উইশ করেনি।অন্য সময় আর্লি ক্লাসে আসে আজ আসতেও লেট।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে শেষে ক্লাসে চলে গেল পুজা।
ক্লাস টাইমে নীরাকে আর রিমিকে দরজায় দেখে অনেকটা অবাক হলেন আরতি দেবী।নীরা হেসে বললো,আন্টি আজ তো পুজার জন্মদিন তাই ওকে সারপ্রাইজ দিতে আমরা চলে এসেছি।
আরতি ওদের ভেতরে ঢুকিয়ে বললো ,পুজাতো আজ তোদের উপর রেগে আগুন।সকালে গাল ফুলিয়ে বেরিয়েছে।
রিমি–রাগবেই তো আমরা কেউ ওকে এখন পর্যন্ত উইশ করিনি।
নীরা কেকের বক্সটা ফ্রিজে রেখে ঘর সাজানো শুরু করলো।
দুটো ক্লাস একা একা করে পুজা বাসার উদ্দেশ্যে বের হলো,কিছুই ভালো লাগছেনা তাঁর।গেইট অবধি যেতেই অভিজিৎ পুজাকে ডাকলো;দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি কানে শুনতে পাওনা??
পুজা যেন আকাশ থেকে পড়লো কখন ডাকলো সে তো শুনতেই পায়নি।
অভি লাল গোলাপ দিয়ে বলল,বাইজেনটাইন সম্রাজ্ঞীর মতো তোমাকে ঘিরে থাক পৃথিবীর সমস্ত সুখ।তুমি অনিন্দ্য সুন্দরী হয়ে উঠো তোমার সৃষ্টিতে।শুভ জন্মদিন,,,,
“অসংখ্য ধন্যবাদ অভিদা।”
“You’re most welcome. তুমি আজ একা যে বাকি দুজন কোথায়?”
“ওদের কথা বলোনা। দুইটার একটাও আজ আসেনি। এখন পর্যন্ত ফোন তো দূর টেক্সট পর্যন্ত করেনি। আমার জন্মদিনে কথা তো ভুলেই গেছে,,,”
“বাব্বাহ ম্যাডাম তো আজ রেগে আগুন! চলো তোমার ফেভারিট ফুচকা স্টলে। আমার পক্ষ থেকে ট্রিট!”
ফুচকার ক্ষেত্রে পুজা কখনোই না বলতে পারেনা। তাই খুশিমনে ফুচকা খেতে রাজী হয়ে গেল। এই মেয়েটা এতোটাই বোকা সে কখনোই বুঝতে পারেনা অভি তাকে কতোটা পছন্দ করে। নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে কে জানে?
🍁🍁
নাতাশার বাবা মোস্তফা হাকিম একজন ন্যায়বান মানুষ। জীবনে অনেক স্ট্রাগল করে আজ সমাজে বরেন্য ব্যক্তি। লোকে তাকে মন থেকেই শ্রদ্ধাভক্তি করে। গরীব ঘরের ছেলে ছিলেন বলে গরীবদের প্রতি তার আলাদা সহমর্মিতা কাজ করে। জনগণের সেবা করার উদ্দেশ্যেই তিনি পলিটিক্সে এসেছেন। কিন্তু তাঁর বড় আফসোস এই সে তার ছেলেমেয়েকে ঠিকঠাক মানুষ করতে পারেননি। বিশেষ করে তার মেয়ে নাতাশা। মোস্তফা সাহেব সবসময় বলেন আমার ক্ষমতার অপব্যবহার করবেনা। কিন্তু তারা এক কানে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। অবশ্য এর পেছনে তিনি তার মা-কে দায়ী করেন। তার মায়ের অতি আদরের নাতিনাতনিদের কখনোই শাসন করা যায়নি। নাতাশার ভার্সিটিতে কি ঘটেছে তা নিয়ে তার বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু নাতাশা যখন কেঁদেকেটে বাবার কাছে সবটা বললো, মোস্তফা সাহেব লোক লাগিয়ে পুরো ঘটনা জানলেন। এই বিষয়ে কাউকে আর কিছুই বলেন না, কিন্তু মনে মনে কিছু একটা ভেবে নিলেন।
আলিফের ঘুম ভাঙে তার মায়ের ডাকে। যতো গুরুত্বপূর্ণ কাজই থাকুক না কেন সে কখনোই ফোনে এলার্ম সেট করেনা। তার মাকে বলে দিলেই তার কাজ শেষ। মায়ের চেয়ে বড় এলার্ম আর কি হতে পারে? আলেয়া যখন রুমে এসে বিছানায় বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকতে থাকে আলিফের মনটাই ভালো হয়ে যায়। মনে হয় জীবনটা দারুণ!
এই পৃথিবীতে তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হলো তাঁর মা। মায়ের জন্য সে সবকিছু করতে রাজি। তাঁর বাবা ভাই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে বলে মা একা পড়ে যায়। শুধুমাত্র এই কারণে সে কোথাও গিয়ে এক রাতের বেশি থাকেনি। ছোট থেকেই সে মা-ভক্ত, স্কুলে ট্যুরে যাওয়ার সময় ও সে মা কে সঙ্গে নিয়েছিল। দূরে যেখানেই বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে হয় মা-ই তার সঙ্গী। এ নিয়ে আগে বন্ধুরা ক্ষেপালেও এখন কেউই কিছু বলার সাহস দেখায়না।
শিরীষতলায় রোজকার মতো আড্ডায় বসেছে আলিফ আর তার বন্ধুরা। আলিফের পুরো নাম মুনতাসির রহমান আলিফ। ফিজিক্সে অনার্স থার্ড ইয়ারের টপ স্টুডেন্ট। লম্বায় 5’10”-র ছেলেটা শুরুতেই যে কারো চোখে পড়ার মতো সুদর্শন। আশেপাশের সবাই তাকে রাগী বলে চিনলেও চেনা মানুষদের কাছে সে পরম আপনজন। বন্ধুদের যেকোনো বিপদে সে সবার আগে উপস্থিত থাকে। সারাবছর পড়াশোনায় আছি আছি নাই নাই ভাব দেখালেও আজ অবধি কেউ তাকে টপকাতে পারে নি। তার ক্লাসমেট রিয়া ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই আলিফকে পছন্দ করে। আলিফের সাথে ওর মোটামুটি সখ্যতা থাকলেও মনের কথা বলার সাহস কখনোই হয়নি। তার উপর দুইদিন পরপর যেসব কান্ড ঘটে রিয়া ধরেই নিয়েছে আলিফ প্রেমবিদ্বেষী পুরুষ! এখন তো তাও দেখা হলে হায় হ্যালো করে প্রপোজ করলে ভুলেও ফিরে তাকাবেনা। তবুও সে আশায় থাকে কোনো একদিন হয়তো তাকে বলতে পারবে।
দুইদিন পর মুকিম এসে বসলো আলিফের পাশে। আলিফ তখন একা বসে কিটক্যাট খাচ্ছে।
“দোস্ত সেই মেয়েটার ইনফরমেশন কালেক্ট করেছি। ওর নাম নীরা। আমাদের সাথেই ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টের।”
“আর কিছু?”
“তুই চাইলে কনট্যাক্ট নাম্বার,,,,”
আলিফ থামিয়ে বললো, না থাক আর কিছু লাগবেনা। ও কি করে না করে রোজকার রুটিন আমার চাই। তুই লোক লাগা। আর শোন এটা যেন কেউ না জানে সিক্রেট রাখিস।
“শালা তোর কোনোকিছু কাউকে বলছি কখনো? কিন্তু কিউরিয়াস মাইন্ড জানতে চায় মিস্টার আলিফ কেন হঠাৎ কোনো মেয়ের খোঁজ নিচ্ছে? রহস্য কি?”
আলিফ মনে মনে বললো, রহস্য কি আমি নিজেও জানিনা। তবে কিছু একটা তো আছেই,,,,
🍁🍁🍁🍁
“আমি বুঝে পাইনা তোকে আমি শ্বশুরবাড়ি পাঠাবো কি করে। একটা রান্নাও তুই ঠিকঠাক করতে পারিস না। মেয়েদের আসল গুণ হলো রান্না, আর তুই এইদিকেই জিরো!”
“আহা বৌমা এতো বইকো না তো। মা হইছো এখনো ধৈর্যশীল হইতে পারলানা। শিখতে সময় লাগবোতো নাকি?”
“মা আপনি সবসময় আপনার নাতনির পক্ষ নেবেন না। কোনদিকে আছে ও বলুন তো? সেলাই শেখাতে গেলে সুঁই ভেঙে ফেলে, রান্না করতে এলে লবণের জায়গায় চিনি দেয়। এতোবার দেখানোর পরো সে চিনি আর লবণের পার্থক্য বুঝেনা! অন্য মশলার কথা তো বাদই দিলাম। ও না ক্যারিয়ারে ফোকাস না সংসারে। নাহয় বলতাম বিয়ে দিয়ে দেই অন্তত সংসারটা গুছিয়ে করবে! ওরে যে কোন কপালপোড়া বিয়ে করবে আল্লাহ জানেন। একটা মেয়ের চিন্তায় আমার চুল পেকে যাচ্ছে,,,”
নীরা মায়ের একগাদা বকুনি শুনে রুমে এসে বসে রইলো। মাঝেমধ্যে মায়ের বকা শুনে মনে হয় সে তার আপন মা না সৎমা। অথবা নিশ্চয়ই তাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছে। হলুদ একটু বেশি দেওয়ায় যে এতো কথা শোনাতে পারে সে আপন মা হয় নাকি? এখন তো শ্বাশুড়িও এতো দজ্জাল হয়না। সবসময় যেন উৎ পেতে থাকে কখন সে দোষ করবে আর দুনিয়ার কথা শোনাবে। অবশ্য নিজের ছেলের বৌদের কিচ্ছু বলেনা। সবাইকে খুব আদর করে। মা হিসেবেই সব ঝাঁজ মিটালেও শ্বাশুড়ি হিসেবে তিনি দেশসেরা।হুহ!
জাহানারা বেগম নাতনির ঘরে এসে বললেন, বুবুন মন খারাপ করিস না। মাইয়ামানুষ হইছে মায়ের প্রতিচ্ছবি। তোর ভালোমন্দ সব তোর মায়ের উপর যাইবো লোকে তার দিকেই আঙুল তুলবো। হের লাইগা তোর মায়ে তোরে ভালামতো গড়তে চায়। মনে রাখিস মায়ের মতো আপন কেউ হয়না।
“আমারে বুঝ দিবা না। তোমার বৌমা আমারে একটুও দেখতে পারেনা। আমি ডিএনএ টেস্ট করাবো। আমি উনার মেয়ে না এটা বোঝাই যায়।”
“ধুরর পাগল কি কস এসব। পরের বাড়িতে গেলে বুঝবি, এখন মায়ের কথা খারাপ লাগলেও তখন মনে হইবো ক্যান যে মায়ের থেইকা ভালা কইরা শিখলাম না!”
“তুমি দেখিও আমার শ্বাশুড়ি অনেক ভালো হবে, তোমার ছেলের বৌ যেমন তার বৌমাদের ভালোবাসে আমারেও আমার শ্বাশুড়ি ভালোবাসবে।”
“তা তো হইবোই। তুই যে আমার সোনার টুকরা সাত রাজার ধন। তোরে ভালো না বাইসা কেউ থাকতেই পারবোনা। আল্লার কাছে দোআ করি তুই অনেক সুখী হ। দেহি এবার উঠ আমার সুপারি কাইট্টা দে।”
নীরা চোখমুখ মুছে দাদীর সুপারি কাটতে চলে গেল। এই কাজটা করতে তার ভীষণ ভালো লাগে।
শুধুমাত্র দাদী আর বাবার দিকে চেয়ে সে এখনো এই বাড়িতে পড়ে আছে। নাহয় কবেই যে বের হয়ে যেত, হুহ!
চলবে,,