কাগজের_তুমি_আমি #দ্বিতীয়_অধ্যায় #২২তম_পর্ব

0
370

#কাগজের_তুমি_আমি
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#২২তম_পর্ব

ধারাকে বাসায় রেখে ডিউটিতে আসে অনল। মনটা আজ খুব ভালো অনলের; বাবাকে ফিরে পেয়েছে, ধারার শরীরটাও ভালো। এখন শুধু ডেলিভারিতে ঝামেলা না হলেই হয়। হঠাৎ একজন অচেনা পুরুষ তার সামনে দাঁড়ায়। পুরুষ বললে ভুল হবে, সাতাশ-আঠাশ বছরের যুবক। কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকে খুতিয়ে দেখে নিলো অনল। শ্যাম বর্ণের একটি যুবক, চুলগুলো উসকো খুসকো হয়ে আছে। চোখযুগল লাল বর্ণ হয়ে ফুলে আছে, চোখের নিচে কালি স্পষ্ট। চোখে মুখে মারাত্নক বিসন্নতা ভর করে আছে যুবকটির। অনল ভাবলো কোনো রোগীর এটেন্ডেন্ট হয়তো। যুবকটি অনলের কৌতুহলী দৃষ্টি দেখে শান্ত স্বরে বললো,
– অনল মাহমুদ?
– জ্বী, কিছু বলবেন?

যুবকটি মলিন হাসি হেসে বলে,
– বলার তো অনেককিছু আছে কিন্তু এই জায়গাটা কথাগুলো বলার জন্য সঠিক নয়। আপনার কি একটু সময় হবে? তাহলে কোথাও বসে কথা যেতো
– আমি আপনাকে চিনতে পারছি না, আপনি কি কোনো প্যাশেন্টের রিলেটিভ?
– জ্বী না, আমি আপনার সাথে কিছু ব্যক্তিগত কথা ছিলো। একটু কি বাহিরে যাওয়া যায়?
– সরি, আমি ভেবেছিলাম আপনি রোগীর কেউ। আমি একটু ব্যাস্ত আছি। আমার মনে হয় না আপনার সাথে আমার কোনো জরুরি কথা থাকতে পারে।

বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই যুবকটি একটা কথা বলে যা অনলের পা আটকে দেয়।
– আমি দিগন্ত। ধারার গর্ভে আমার সন্তান ই বেড়ে উঠছে।

দুপুর ১২টা,
কফি শপে মুখোমুখি বসে রয়েছে দিগন্ত এবং অনল। অনলের চোয়াল শক্ত, মুখে তার কোনো কথাই নেই। কি বলবে বুঝছে না। দিগন্ত কফির কাপে একটা চুমুক দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে নীরবতা ভেঙ্গে অনল বললো,
– যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন, আমার সময় নেই।
– ধারাকে আপনি ডিভোর্স দিন।

দিগন্তের ভাবলেশহীন ভাবে বলা কথা শুনে মূহুর্তেই অবাক হয়ে যায় অনল। রাগে গা রি রি করছে। ইচ্ছে করছে দিগন্তে ধরে কিছুক্ষণ কেলাতে। নিজেকে খুব কষ্ট করে সামলে জিজ্ঞেস করে,
– মাথা ঠিক আছে? নেশা টেশা করেন নাকি মশাই। সকাল সকাল মশকরা করছেন কেন?
– আমি মশকরা করছি না, আমি ধারাকে ফিরে পেতে চাই। আমার বাচ্চাকে ফিরে পেতে চাই। জানি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু সময় তো এখনো চলে যায় নি। তাই আপনার কাছে অনুরোধ করতে এসেছি। প্লিজ আমার ধারা আর বাচ্চাকে ফিরিয়ে দিন।
– আপনি যাকে নিয়ে কথা বলছেন সে আমার ওয়াইফ। আর কোন বাচ্চার কথা বলছেন বলুন তো? ধারার গর্ভের বাচ্চাটিও আমার। সুতরাং অহেতুক নিজের সময় নষ্ট করবেন না।

বলে উঠে যেতে নিলে দিগন্ত বলতে লাগে,
– ধারার গর্ভের বাচ্চার ছয় মাস দু সপ্তাহ চলছে। আর আপনাদের বিয়ের তো ছয় মাস হয়েছে। তাহলে সেটা আপনার বাচ্চা কি করে হয়? অন্যের পাপের ফসলকে নিজের দাম দিতে একবার ও খারাপ লাগছে না আপনার। যাক গে হয়তো ধারার প্রতি দূর্বল হয়ে এই কাজ করছেন। ভেবেছেন এতে করে ধারা হয়তো পটে যাবে। আসলে আমিও তো পুরুষ আমি জানি। আর এতো কিসের স্বামী স্ত্রী হবার বড়াই করছেন? সম্পর্কটা তো কাগজের একটা ঠুনকো সম্পর্ক। না ধারা আপনাকে ভালোবাসে না আপনি। ধারার মতো মেয়েকে কোনো ভদ্র ছেলে ভালোবাসতে পারবে না এটা আমি…..

কথা শেষ করার আগেই অনল বাঘের মতো হিংস্র হয়ে একটা ঘুষি দিয়ে বসে দিগন্তকে। দিগন্তের ঠোঁট ফেটে যায়। অনলের রুদ্র রুপ দেখে একটু ভড়কে যায় দিগন্ত। কফি শপের সবাই তাদের দেখছে। তারা আগ্রহের সাথে এমন ভাবে দেখছে যেনো কোনো নাটকের শুটিং চলছে। কলারটা টেনে দিগন্তকে দাঁড় করায় অনল। বজ্র কন্ঠে বলে,
– একটা বাজে কথা আর নয় দিগন্ত। নয়তো এখানেই পুতে ফেলবো। আজ তোদের মতো ছেলের জন্য না জানি কতো মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যায়। কিছু মেয়ে ব্যতীত সব মেয়েরা আবেগের বশে বিশ্বাস করে নিজের সবচেয়ে দামী জিনিসটা বিসর্জন দেয়৷ কিন্তু যখন তোদের অকামের ফল তাদের গর্ভে বেড়ে উঠে, তখন দায়িত্ব নিতে তোরা ভুলে যাস। ফলটা ওই মেয়েটা আর আর তার পরিবারকে ভুগতে হয়। হয় তাদের আত্নহত্যার পথ বেঁছে নিতে হয় নয়তো ডাস্টবিনে কিছু অপরিণত শিশুর ফিটাস দেখি। আজ আমাকে সে কথাগুলো বলছিলি সেটা ছয় মাস আগে কেনো মনে ছিলো না। যখন ধারা তোকে বলেছিলো তার গর্ভে তোর সন্তান আছে। তোদের কিছু সময়ের ফুর্তি একটা মেয়েকে কলঙ্কিনী করে দেয়। সারা সমাজের ধিক্কার শুনতে হয়। সেদিন আমি ধারার হাত না ধরলে এখন ওর জীবনটাও তেমন হতো। এখন কোন মুখে আমার সামনে এই কথা বলছিস। আর একটা কথা আবার বলছি, আমি তোর মতো শরীরের খাঁজে ভালোবাসা খুজি না। আমি ধারাকে ভালোবাসি, শুধু তাই নয় যে আসছে তাকেও আমি মাথায় করে রাখবো ইনশাআল্লাহ। আমি ওদের আমার কাছ থেকে দূর হতে দিবো না। তাই অহেতুক সময় নষ্ট করবেন না।

বলেই দিগন্তের কলারটা ছেড়ে দেয় অনল। রাগে গা রি রি করছে। দিগন্তের ঠোঁট থেকে রক্ত পড়ছে। ঠোঁটের রক্ত মুছে দিগন্ত বাঁকা হাসি হেসে বলেন,
– ধারার সব ডিসিশন দেখছি আপনি ই নিচ্ছেন। আমি তো আমার ভুল স্বীকার করছি৷ আর আমি ধারাকে অসম্ভব ভালোসি নয়তো ফিরে আসতাম না। সে এই ছয়মাস আপনার ওয়াইফ ছিলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আর আমিও জানি ধারা আমাকে ভালোবাসে। তাই আপনার মনে হচ্ছে না নিজের মহত্ব দেখিয়ে আমাদের দুজনের মাঝে দেয়াল তৈরি করছেন আপনি। আর বাচ্চাটা আমার, আমার রক্ত। একজন বাবাকে তার বাচ্চা থেকে আলাদা রাখার অধিকার কি আপনার আছে? রক্তের একটা টান আছে। পালক বাবা পালক ই হয়।

দিগন্তের কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় অনল। কোনো কথা না বলে কফি শপ থেকে বেড়িয়ে যায়। সে কি কোনো ভুল করছে! ধারাকে দিগন্তের কাছে ফিরিয়ে দেওয়াটাই কি উচিত হবে? উফফফ মাথাটা এলোমেলো হয়ে আছে তার। ধারাকে নিজের থেকে আলাদা করার চিন্তায় মাথা আরো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বুকে একটা অজানা চিনিচিনে ব্যাথা হচ্ছে। হাহাকার করছে বুকটা। খুব কষ্ট হচ্ছে কি করবে কিছুই বুঝে উঠছে না, মানুষ নিজের মনের দ্বিধা দ্বন্দ্বে নিজেই আকড়ে যায়। এ থেকে নিস্তার পাওয়াটা খুব কষ্টকর।

সন্ধ্যা ৭টা,
বাসায় কেবল তিনটে প্রাণী, রাজ্জাক সাহেব, সুভাসিনী বেগম আর ধারা। মহুয়া এবং সুমনা বেগম চলে গিয়েছেন বিকেলে। রাজ্জাক সাহেবের সাথে কোনো কথাই বলেন না সুভাসিনী বেগম। ধারা তাদের মাঝে একটা সেতুবন্ধনের ন্যায় কাজ করছে। রাজ্জাক সাহেবের সাথে অবশ্য ধারার বেশ খাতির হয়েছে। সুভাসিনী বেগমের রাগ ভাঙ্গাতে সব চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। আজ বেলীফুলের মালা নিয়ে এসেছিলেন। যদিও সুভাসিনী বেগম সেটাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছেন। রাজ্জাক সাহেব তবুও হার মানবেন না। ছাব্বিশ বছরের রাগ বলে কথা! ড্রয়িংরুমে বসে এইটা নিয়েই চিন্তা করছিলো ধারা। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে ধারার ধ্যান ভাঙ্গে। ধীর পায়ে যেয়ে দরজাটা খুলতে দেখে দরজার ওপারে অনল দাঁড়িয়ে আছে। প্রচন্ড বিধ্বস্ত লাগছে তাকে। কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই ধারার পাশ কাটিয়ে নিজ রুমে চলে যায় সে। ধারার মনে অসংখ্য কৌতুহল জাগে কিন্তু চুপ থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে হচ্ছে।

রাত ১১টা,
ধোঁয়ায় নিজের চিন্তাগুলো উড়াচ্ছে অনল। বারবার দিগন্তের বলা কথাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। যতই অস্বীকার করুক বাচ্চাটা তো তার, তার রক্ত। রাজ্জাক সাহেবের এতো বড় অন্যায়ের পর ও রক্তের টানকে অস্বীকার করতে পারে নি সে। আচ্ছা ধারা কি এখনো দিগন্তকে ভালোবাসে? হতেই পারে, যার জন্য এতো বড় স্টেপ নিতে সে একবার চিন্তা করে নি। মাথাটা দপদপ করছে। ধারাকে হারাবার কথায় আরো বেশি এলোমেলো হয়ে পড়ছে দিগন্ত।
– কি নিয়ে চিন্তা করছো?

ধারার কথায় হুশ ফিরে অনলের। অনলের করুণ মুখটা দেখে বুকে কামড় পড়ে ধারার। শত যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে সে। অনল একবার বলতে চেয়েছিলো তার পর ও কিছু বললো না। মলিন হাসি হেসে বললো,
– কিছু না, এমনেই কাজ নিয়ে একটু স্ট্রেসড আছি।
– সত্যি?
– হু, তুই ঘুমাতে যা রাত হয়েছে।

কেনো যেনো অনলের কথাতে আশ্বস্ত হতে পারে না ধারা। এগিয়ে যেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কেনো লুকাচ্ছো, যেখানে এতো স্ট্রেসের পর ও সিগারেট ধরাও না আজ কি এমন হলো সে একটার পর একটা সিগারেট জ্বালাচ্ছো? কি হয়েছে আমাকে বলো
– আচ্ছা ধারা, রক্তের টান কি সব কিছুর উপরে হয়?
– হঠাৎ এ প্রশ্ন?
– এই যে দেখ বাবা এতো বড় ভুল করা সত্ত্বেও আমি তার সামনে যেতেই দূর্বল হয়ে পড়লাম। নিজের রক্ত যদি ভুল করে তবুও কি তার টান মানুষ অগ্রাহ্য করতে পারে?
– অবশ্যই পারে না। যতই হোক রক্ত তো। আর নিজের বাবা-মা ভুল করলেও সন্তান হিসেবে তাদের দোষ ধরাটা আমাদের উচিত নয়। আফটার অল মা-বাবা তারা। তাদের কিছু সিদ্ধান্ত হয়তো আমাদের পছন্দ হয় না, কিন্তু তাদের নিজেরও কিছু এক্সপ্লেনেশন থাকে। আমাদের নিজের দিকটা সবসময় না দেখে তাদের দিকটাও দেখা উচিত। ঠিক না? তুমি ফুপি-ফুপাকে নিয়ে চিন্তা করো নাতো। চলো ঘুমাতে।

বলেই নিজ রুমে চলে যায় ধারা। ধারার কথাগুলো যেনো আরো ঘেটে দেয় অনলকে। একজন বাবা আর সন্তানকে আলাদা করাটা কি সত্যি উচিত হবে। কিন্তু দিগন্ত যা করেছে তার পরে ধারাকে তার কাছে ফিরে যেতে দেওয়া মানে বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। তবুও একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে অনলের, বাচ্চাটার জন্য এবং ধারার জন্য।

পাঁচ দিন পর,
একটা পার্কে ঘুরতে নিয়ে এসেছে অনল ধারাকে। বিকেলের দিকে পার্কে এসে ধারার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে। তখন অনল হাটু গেড়ে বললো,
– প্রিন্সেস বাবা যা করছে তোমার এবং তোমার মাম্মামের জন্য। তোমার মাম্মাম যা সিদ্ধান্ত নিবে তোমার বাবা সেটা মেনে নিবে। একটা জিনিস মাথায় রেখো সোনা, তুমি আমার কাছে থাকো বা নাই থাকো আমার কাছে তুমি সবসময় আমার বাচ্চাই থাকবে।

অনলের কথার আগা-মাথা কিছুই যেনো বুঝলো না ধারা। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই……..

চলবে

[ সরি লেট হবার জন্য। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আজ রাতে দিবো। দয়া করে কার্টেসী ব্যাতীত কপি করবেন না]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here