শুভ্রময়_পুরঁজন পর্ব_৩১(অন্তিম)

0
633

#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_৩১(অন্তিম)
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

৩১.
লাল টুকটুকে রঙের বিছানার উপর নীলাভ সবুজ বেনারসি ও ভারি গহনার সাজে সজ্জিত হয়ে একজন বসে আছে। সেই একজন হলো নববধূ। নববর্ষের নবমুকুলের মতো আজ তার মুখখানা। বতোর দিনের অঙ্কুরিত কচি পল্লবের মতো তার হাসিটি। পাশ থেকে গোলাপের পাপড়ি নিক্ষেপিত হলে সে চমকে ওঠলো। বারবার স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। রজতনিভ স্বপ্নদর্শী তার স্বপ্ন দর্শনে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে আশেপাশের ব্যক্তিবর্গের নানা লজ্জামাখা কথার তোড়ে।
দানীনের বড় খালাতো বোন হাত তালি দিতে দিতে বললো,
“পার দেশী, পার দেশী জানা নেহি। মুছে ছোরকে, মুছে ছোরকে।”
তার ছোটবোন অনন্যা গেয়ে ওঠলো,
“তুজকো বানা কারকে লে যায়েঙ্গে শুভ্র কী দুলহানিয়া।”
সবাই তার সঙ্গে সুর মেলালো।
ইউসরা তখন হাত উঠিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিলো।
“গাইজ, গাইজ। আমার কিছু বলার আছে।”
সবাই একসঙ্গে জিগ্যেস করলো,
“কি?”
ইউসরা দানীনের দিকে খানিক ঝুঁকে জিগ্যেস করলো,
“আপু, তুমি কী সত্যিই বিয়ে করে বিবাহিত জীবন বরণ করতে চাও?”
দানীন তার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালো।
বাকিরা বললো,
“চায়, চায়, চায়।”
ইউসরা হতাশভাবে বসে পড়ে বললো,
“তাহলে তোমাদের একটা কাহিনী শুনাই গানে গানে। ফারিহ ভাইয়া!”
ফারিহ, নাকিদ, দানীনের আরেকজন ভাই আফাফ। হাত ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হলো। একটা নিচু টেবিল টেনে এনে তার উপর ঢোল, চামচ, বাটি, ডেচকি, থালা রাখলো। সবার হাতে হাতে একটা একটা ধরিয়ে দেওয়া হলে ফারিহ শুরু করলো,
“পে পে পে পে, পে পে পে পে পে।”
ইউসরা গাইলো,
“জোরকা ঝাটকা হায় জোরোসে লাগা, হায় লাগা। শাদি হয়ে গেছে সারাজীবনের সাজা, হায় সাজা।”
অনন্যা বললো,
“শাদি ছে আচ্ছা তুম লে লো ফাঁসি। লাখো দুঃখের হতি হে এ বাজাহ, হায় বাজাহ।”
কপালে হাত রেখে দানীনের বিবাহিত বোন পারিশা গাইলো,
“না কর শাদি, এই বরবাদি। পরে না তুই পচতাবি। শাদি কী আসর থেকে তুই খুদকো ভাগা, হায় ভাগা।”
দানীনের ভাবি তখন এন্ট্রি নিলো। তাকে দেখে সবাই গান থামিয়ে দিলো। তার ভাবি তার পাশের দাঁড়িয়ে সবার দিকে চোখ বুলালো।
এরপর নাকিদের দিকে তাকিয়ে সুর তুললো,
“সবার পহেলা শাদিটা, দুই জাহানে যে প্রথম কিয়া। তাকে পাকড়ো। মারো, পিটো। গালতি ওসনে কি, হায়। ওয় ছিল পাগল, খাঁটি কসাই।”
নাকিদের গলা টিপে বললো,
“পানি না মিললে মারো এসি জায়গা, হায় জায়গা।”
সবাই সমস্বরে গেয়ে ওঠলো,
“জোরকা ঝাটকা হায় জোরোসে লাগা, হায় লাগা।”

হঠাৎ বাহির থেকে ভেসে এলো,
“বর এসেছে। বর এসেছে।”
দানীনের সঙ্গে থাকা সবাই আর্তচিৎকার করে ওঠলো,
“ইয়া আল্লাহ, জামাই আইছে! জামাই আইছে!”
বর আগমনের উত্তেজনা মুহূর্তে সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো। আর দানীন? খবরটি শ্রবণ হতেই যেনো বরফের মতো জমে গেলো। মুহুর্তেই তার সম্মুখে এসে উপস্থিত হলো নতুন অনেকগুলো মুখ। দানীন মাথা তুলে উদ্বেগ হয়ে তার মাকে খুঁজতে লাগলো। তার বিচলিত দৃষ্টি লক্ষ্য করে তার বোন পারিশা তার কাছে এগিয়ে এলো।
“আপু? কি হয়েছে?”
দানীন উদ্বেজন নয়ন দ্বারা তার বোনকে নীরিক্ষা করলো। তার এখন নিজেকে অনেক ছোটো বলে বোধ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে পারিশার গলা জড়িয়ে হাউ মাউ করে কান্না জুড়ে।
পারিশা তার গালে করতল ঠেকিয়ে নমনীয় গলায় জিগ্যেস করলো,
“এই আপু, কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?”
“মাকে একটু ডেকে দে। আর সবাইকে ঢুকতে দিস না।”
পারিশা হেসে তার কানের নিকট এসে বললো,
“চিন্তা করো না আপু। কেউ প্রবেশ করবে না। এমনকি দুলাভাইয়ের কপালেও তোমাকে দেখার সৌভাগ্য জুটবে না।”
বোনের আশ্বস্ত বাণীতে দানীন স্বস্তি বোধ করলো এবং সেইসাথে হাসলো।

কনের পাশে বরকে এনে বসানো হয়েছে। বড় একটা রঙিলা ওড়না দ্বারা দানীনের হাটু অবধি ঢেকে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ বাদে কাজী এসে শুভ্রর কবুল নিলো। দানীনকে কবুল বলতে বললে সে চুপ করে রইলো। অনেক্ষণ অবধি চুপ করে থাকার পর শুভ্রর এক দাদী বলে ওঠলো,
“কিরে শুভ্র, মাইয়ারে কী জোর কইরা বিয়া দেই?”
শুভ্র নিচু হয়ে ঘোমটার আড়ালে দানীনের মুখ দেখার চেষ্টা করলো। দানীন তা বুঝে ঘোমটা খানিক সরিয়ে চোখ মারলো। শুভ্র চমকে ওঠলো।বোঝা গেলো জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। তবে কনের মনে অন্য কোনো মতলব আছে। শুভ্র মনে মনে ঢোঁক গিললো। সে এখন নাগিন ডান্স কিভাবে দেবে? অন্য সময় হলে না হয় দেওয়া যেতো। কিন্তু বর বেশে!
শুভ্র আদ্রিয়ানকে ডাকলো। দুই ভাই ফুসুর ফুসুর করলো কতক্ষণ। দানীন আবার ঘোমটা খানিক সরিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে দুই ভাইয়ের ফিসফিসানি আলাপ-আলোচনা দেখলো।
দানীনের নয় বছরের ভাই বললো,
“ও দুলাভাই বোধহয় পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলছে। আমি ক্রাইম পেট্রোলে দেখেছি, ছেলে ছেলেকে পছন্দ করে বলে..”
এতটুকু বলতে সবাই হেসে ওঠলো।
শুভ্র চোখ পাকিয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে অনুচ্চ স্বরে বললো,
“তিনটা কবুল শব্দের জন্য বউ পেয়েও পেলাম না। আর নাকি ছেলে হয়ে ছেলেকে, ছিঃ, ইয়াক!”

তখন জোরে গান বেজে ওঠলো।
কয়েকটা ছেলে সামনে দাঁড়িয়ে নাচছে। এরা কেউ শুভ্রর কাজিন, বন্ধু নয়তো দুলাভাই। কাপড়, ওড়না যা পেয়েছে শরীরে পেঁচিয়েছে। সবাই সাপের মতো কোমর ডানে-বামে নিয়ে বেলি ডান্স দিচ্ছে।
শুভ্রর ফুফাতো বোনের জামাই নিতম্ব খানিক উঁচু করে দাঁড়ালো। আরেকজন নিতম্বে থাপ্পড় মেরে ঘর মোছার কাপড় কোমরে পেঁচিয়ে দিলো।

নাচ শেষ হতে শুভ্র দানীনের কাছে একটু এগিয়ে এসে বললো,
“এটাতে আজকে খুশি হয়ে যাও জান। চার দেওয়ালের ভেতরে তুমি যেভাবে বলবে সেভাবে নাচবো। প্রমিস।”
তখন কাজি কবুল বলতে বললে দানীন বললো।
বিয়ে সম্পন্ন হতে বেয়াই বেয়াইকে মিষ্টি খাইয়ে দিলো।
শুভ্রর একটা কাজিন বললো,
“মেয়ের ঘোমটা সরাও। ছবি তুলবো।”
শুভ্র সবার সম্মুখেই তাকে চোখ রাঙালো। শুভ্রর আরেক বড় বোনের স্বামী টিটকারি করে বলে ওঠলো,
“বউকে এখন থেকেই দেখতে দিচ্ছো না শালাবাবু। আমাদের কথা না হয় বাদ, অন্তত বাচ্চা-কাচ্চা যারা আছে তাদের তো ভাবি দেখার হক আদায় করতে দাও।”
শুভ্র দানীনের ওড়না মুঠো করে ধরে মাথা চুলকালো। উপস্থিত সবাই তখন সমস্বরে হেসে ওঠলো।

খানিক দূরে ইউসরা, ফারিহ আর তার কাজিনরা মিলে ছেলে পক্ষকে শুদ্ধ ভাষায় গালাগালি করার কর্মে নিরত।
“ফকিরের লেদাগুলো। গেইটে মাত্র সাত হাজার দিলো। এতো আদর করে হাত ধোয়ালাম, ওই কালা বান্দরটা নাম যেনো কি? মাত্র এক হাজার টাকা হাতে গুঁজে দিলো।”
ফারিহ’র সঙ্গে তার বাকি কাজিনরা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি প্রদান করলো।
ফারিহ’র কাজিন অনন্যা ফিসফিসিয়ে বললো,
“মরারগুলো বউ নিয়ে বিদেয় হচ্ছে না কেন। তাহলে তো জুতোর ছুঁতোয় আরও কিছু পাই।”
ইউসরা পাশ ফিরে বলে ওঠলো,
“অনন্যা, তোমাকে না বললাম জুতা পাহারা দিতে। এখানে কি করছো?”
অনন্যা ডেম কেয়ার ভাব প্রকাশ করে বললো,
“আরে চিন্তা নেই। বাটি চালান দিয়েও কেউ জুতার সন্ধান পাবে না।”

জুতো পরার সময় দেখা গেলো বর-কনে উভয়ের জুতোজোড়াই গায়েব। এই নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল গলাবাজি আরম্ভ হলো।
ইউসরা শুভ্র ও দানীনের পাশে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে বললো,
“মেয়ের কোনো জুতা লাগবে না। যার জুতার সঙ্কট তাকে দান করা হলো। আপুকে দুলাভাই কোলে করে নিয়ে যাবে। তাই না দুলাভাই? বউকে আদর করে, পেয়ার করে কোলে তুলে নিয়ে যাবেন না?”
শুভ্র মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
“বউয়ের জুতা নেই তাই কোলে নেব সেটা কোনো সমস্যা না। কিন্তু আমাকে কে কোলে নেবে।”
শুভ্রর কথা শুনে দানীন ঘোমটার আড়ালে ফিক করে হেসে ওঠলো। তার হাসির ধ্বনি কানে প্রবেশ করতে শুভ্রও হেসে ওঠলো। শুভ্রকে হাসতে দেখে বাদবাকি সবাই হেসে ওঠলো। বাকতাল্লার পর্বের সমাপ্তি ঘটিয়ে পরিবেশ আবারও ঠান্ডা, ফুরফুরে ও আমোদজনক হয়ে ওঠলো।
শুভ্র পকেট থেকে একটা বান্ডিল বের করে ইউসরার হাতে গুঁজে দিয়ে বললো,
“ধন্যবাদ শালিকা।”
“মাই প্রেজার দুলাভাই।”
বলে ইউসরা চোখ টিপলো।
দুই পক্ষ দুই উদ্দেশ্যে সমস্বরে আবার হৈ-চৈ করে ওঠলো। এরমধ্যে শুভ্র দানীনকে চট করে পাজাকোলে নিয়ে হাটা দিলো। সেইসঙ্গে চিৎকারের আওয়াজ ঊর্ধ্বস্থিত হলো এবং ক্লিক ক্লিক করে হাজারটা শব্দ হলো।
দানীন ঘোমটার খানিক পিছনে টেনে উঁকি দিলো। শুভ্রকে চোখ পাকিয়ে বললো,
“আরে আরে কি করছেন! বাবা-মা, ভাইবোন থেকে বিদায় নেবো না? দোয়া নেবেন না?”
শুভ্র উল্টো তাকে চোখ রাঙিয়ে বললো,
“বরিশাল থেকে ঢাকা যেতে কতক্ষণ লাগবে জানো ইউ বরিশাইল্লা? তোমার জন্য আমি আমার বাসরঘর মিস করবো নাকি হুহ!”
শুভ্রর এমন কথা শুনে দানীন হতভম্ব। সিরিয়াসলি, কি বলে এই ছেলে!

*********

বাথরুম থেকে ডুবুর ডুবুর শব্দ ভেসে আসছে। মনে হচ্ছে যেনো কেউ পুকুরে নেমে হাপুস হুপুস করে গোসল করছে। দানীনের অবসাদগ্রস্ত মুখে হাসি ফুঁটে ওঠলো। শুভ্রটা যে কি। আজ কি একটা লজ্জা পেতে হলো। আদ্রিয়ান স্যার এখন তার দেবর! সে কিভাবে যে মুখ দেখাবে আল্লাহ জানে।
শুভ্র বাথরুমে প্রবেশ করার পর দানীন ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে বসেছে। মন্থর গতিতে ভারি গহনার চাপা হতে তার ক্ষুদ্র দেহকে নিষ্কৃতি দান করছে। গলার বড় হারটা খুলে সে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বে দৃষ্টি স্থাপন করলো। সে এখন বিবাহিত। ব্যাপারটা যেনো এখনও তার বিশ্বাস হচ্ছে না।

মানুষের জীবনে ভুল হওয়া উচিত। বিপদেও পতিত হওয়া উচিত। অন্যথায়, জীবনের অনন্য মহত্ত্বের সাধ মেলে না। মেলে না সস্তা কাচের মধ্যে লুকিয়ে থাকা হীরকতুল্য বস্তুটি। একবার তার সান্নিধ্য লাভ করলে বুঝা যায়, জীবন কতো সুন্দর। তখন ভাঙাচোরা, গন্ধযুক্ত বসবাসের গৃহ হয়ে ওঠে নিউ ইয়র্কের ফুলে পরিবেষ্টিত সবচেয়ে সুন্দর স্থানটি। একলাটি ও শব্দহীন-নিস্তব্ধতার মতো ভয়ঙ্কর অনুভূতি দ্বারা আচ্ছাদিত জীবনে বেজে উঠে সুরেলা সুউচ্চ সুতান। অন্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়ে জমকালো রঙ-বেরঙ আলোর তীর্যকরেখা আকাশচুম্বী দালানের অন্তরে অন্তরে নির্মাণ করা সবুজাবৃত বাগানের মতো সজীবতা অঙ্কন করে। বারান্দার সেই ছোট্ট বাগানবিলাসের মতো তার জীবন নতুন করে জীবিত হয়, নতুন করে প্রাণ সঞ্চারিত হয়। খানিক যত্নে এই বাগানবিলাস আকাশচুম্বী দালানকেও অভিরামে অতিক্রম করে তার শোভনতা চতুর্দিকে প্রসারিত করে। তখন অনুভূত হয় সুখ আর সুখ..
গালে ঠান্ডা স্পর্শে দানীন চমকে ওঠলো। ঘাড় হালকা কাত করে দেখলো শুভ্র। তার শুভ্র।
দানীন তাকাতে শুভ্র তার ভেজা আঙ্গুলটি তার গাল থেকে সরিয়ে নিলো।
“মাহবুব তোমাকে কখনো জড়িয়ে ধরেছে?”
শুভ্র ঠান্ডা কণ্ঠে জিগ্যেস করলো। আর তার ঠান্ডা চাহনি দানীনের মুখের উপর নিশ্চল।
দানীনের অবসন্নতা ছুটে গেলো। সে শুধু অবাক নয়; অনেক বেশিই অবাক। ভুল শুনেছে কিনা তা নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে কিছু বলার পূর্বে শুভ্র আবার প্রশ্ন করে ওঠলো।
“মাহবুব তোমাকে কখনো এভাবে দেখেছে? তোমার খোলা চুল? তোমার উন্মুক্ত গলা? শাড়ি পরিহিত প্রতিকৃতি?”
দানীনের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। মাংসপেশী টান করে বসে নিজের দুর্বলতা প্রদর্শন না করার প্রচেষ্টা করছে। আর এই দুর্বলতা হলো তার চোখের জল। আর কতো কাঁদবে সে? কান্না কী এই জীবনে তার আর ফুরোবে না?

শুভ্র ঝুঁকে দানীনকে জড়িয়ে ধরলো।
“মাহবুব থাকাকালীন দানীন আর আজকের দানীনের মধ্যে তোমার নিকট কোনটা ভালো? আমি কিন্তু বর্তমান দানীনকেই দশে দশ দেব। পূর্বের দানীনকে আমি দেখিনি। কিন্তু এই দানীন! এ দানীন শুধু একজন নারী। শক্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন নারী যে তার সম্মান সম্পর্কে সদা অবহিত। সে বিদিত, কিভাবে সহজলভ্য না হয়ে সর্বসেরা হয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়। সে জানে কিভাবে রত্ন জহর হিসেবে অভ্যন্তরীণ সুপ্তাবস্থায় বিদ্যমান সত্তাকে নির্মাণ করতে হয়। যার প্রতিফলিত আলোক প্রতিবেশের সবাইকে আলোকিত করে।”
শুভ্র দানীনের গালে আলতো ঠোঁটের স্পর্শ প্রদান করে বললো,
“জানো দানীন। মানুষের জীবনে ভুল হওয়া উচিত, বিপদেও পতিত হওয়া উচিত। অন্যথায়, আসল জীবনের স্বাদ আস্বাদন হয় না।”
দানীন অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকালো। আয়নায় দৃষ্টিপাত করতে শুভ্রর আঁখির সঙ্গে তার আঁখি মিলন ঘটলো। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। তবে এই জল দুর্বলতার নয়, প্রাপ্তির জল। জিতে যাওয়ার নিদর্শন।
সে ক্ষণকাল পূর্বে তো এটাই ভাবছিলো। জীবনে এরকম ভুল হওয়া উচিত। নয় তো শুভ্রর মতো স্বামী পেতো কি করে? স্বামী নয়; এ যে তার প্রেমিক স্বামী।
শুভ্র দানীনকে ঘুরিয়ে তার দিকে আনলো। দুই হাতে চোখের জল মুছে তার কপালে চুমু খেলো। এরপর দানীনের পিছনে হাত দিয়ে কিছু একটা ড্রয়ারে খুঁজলো। তার ঠোঁটে হাসি। সেই শুভ্রময় হাসি। যেই হাসি দেখে দানীন বহু বছর পর অচেনা এক পুরুষকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো। বারবার চিন্তায় এই ভেবে নিমগ্ন হয়েছিলো যে, এতো শুভ্রময় হাসি, নিষ্পাপ চাহনি কেন, কেন মাধুর্যতায় ভরপুর। তার পুরঁজনও এরূপ শুভ্রময় বলে কী?
শুভ্রর অধরের হাসি বিস্তৃতি লাভ করলো। সে দু’হাত পিছনে স্থাপন করে দানীন থেকে খানিক পিছনে গিয়ে অবস্থান নিলো। ঠোঁটে রহস্যময় হাসি, সেই রহস্যাবৃত হাসি লুকানোর প্রযত্নে কিছুক্ষণ পরপর ঠোঁট কামড়ে ধরছে। দানীনের ইচ্ছে করছে সেই ঠোঁট আলতো স্পর্শ করে তার কামড় থেকে রক্ষা করে। শুভ্রর হাসি হ্রস্বীভূত হলো। এখন ঠোঁট নয়, তার চোখ হাসছে। সুখের হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠছে। সে হাসি যেনো চিৎকার করে অনেক কথা বলতে চাইছে।

শুভ্র দানীনের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার ডান হাতটি প্রসারিত করলো। দানীন দেখলো তার হাতে তাজা লাল গোলাপ। যার বৃত্তাকার অঙ্গ এখনই গাছের শাখা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে বলে বোধ হচ্ছে।
শুভ্র তার নিরঁজন কণ্ঠে নির্মলতা প্রস্ফুটিত করে বলে ওঠলো,
“সম্মুখে উপস্থিত এই কৃষ্ণপরিচ্চছধারী চমৎকার মেয়েটিকে ভালোবাসি। এক আকাশ অদৃশ্য মেঘে আবৃত মেঘাচ্ছন্ন কেশের অধিকারী মেয়েটিকে ভালোবাসি। যামিনীর তিমিরে আচ্ছাদিত রাশভারী তমসাচ্ছন্ন সুকেশীনিকে ভালোবাসি। তুখোড় প্রতিভাসম্পন্ন বুদ্ধিমতী এই রমণীটিকে ভালোবাসি। এতো বেশিই ভালোবাসি যে বিনিময়ে তার ভালোবাসা না পেলে বেঁচে থাকা অসহনীয় হয়ে ঠেকছে। সে-ও কী তার সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসা এই নগণ্য মানুষটিকে ভালোবাসবে?”
দানীন উত্তর প্রদানে এক মিনিটও দেরি করলো না। শুভ্রর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে ওঠলো,
“সে-ও সম্মুখে উপস্থিত এই ব্যক্তিটিকে ভালোবাসে।”

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here