কাগজের_তুমি_আমি #১০ম_পর্ব

0
724

#কাগজের_তুমি_আমি
#১০ম_পর্ব

হঠাৎ অনলের মোবাইলটা বেজে উঠে, মোবাইলের নাম্বারটা চোখে ভাসতেই চোখ মুখের রঙ বদলে গেলো অনলের। তখনই ধারা জিজ্ঞেস করে উঠে,
– ফোনটা বাজছে তো ধরছো না কেনো?

ধারার হঠাৎ প্রশ্নে খানিকটা চমকে উঠলো অনল। পরমূহুর্তে নিজেকে শান্ত রেখে বলে উঠলো,
– অদরকারি ধরে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। বাজতে থাকুক, বাজতে বাজতে থেমে যাবে।

অনলের উত্তরে ধারা আর কথা বাড়ালো না। অনল ফোনটা সাইলেন্ট করে যথারীতি সুরাইয়া বেগমের সাথে আড্ডায় মেতে উঠলো।

রাত ১০টা,
খাওয়া দাওয়া শেষে আড্ডার আসর বসলো ধারাদের বাসায়। সুভাসিনী বেগমের এতোদিন পর আগমনে বাড়ি গমগম করছে। সব চাচাতো ভাইবোনেরা মিলে বেশ আড্ডার রমরমা পরিবেশ তৈরি হয়েছে বাড়িতে। বেশ খানিক বছর পর আজ এই আড্ডায় অনল যোগ দিয়েছে। আড্ডার মাঝেই হুট করে অনলের এক মামা বলে উঠলেন,
– বুঝলা ভাগ্না, এখনই যা জীবন উপভোগ করার এই কয়দিনে করে নেও। আর কিছুদিন পর চাইলেও আর নিজেদের মতো বাঁচতে পারবা না। পাঁচ বছর পর আসলা, এখন বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে নিবা এইটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেখো বাচ্চা বড় হইতে হইতেই বুড়ো হয়ে গেলাম। নিজেদের জন্য বাঁচার যে আক্ষেপটা থেকেই গেলো।
– এখনো বাচ্চা নেবার কথা চিন্তা করি নি মামা। ধারার বয়স ই বা কি! এখন বাচ্চা নিলে ওর জীবনটা ওখানেই থেমে যাবে। ও নিজের মতো নিজেকে গড়াক। মাত্রই তো চাকরি পেয়েছে।
– সে কি কথা! এখন যদি এতো চাকরি নিয়ে পরে থাকে সংসার করবে কখন? আর দেখতে গেলে তোমার ও বয়স তো কম হলো না।
– মামা, ধারা ওনেক ছোট এখনো। সবে চব্বিশে পা রেখেছে। এখন তো ওর জন্য পুরো দুনিয়ে পড়ে রয়েছে। এখন যত এক্সপ্লোর করবে ওর জ্ঞান তত বাড়বে, কতোকিছু শিখার জানার আছে ওর। সংসার তো থাকবেই, কিন্তু এখন যদি নিজের জীবনটা না সাজায় তবে সারাজীবন আফসোস থেকে যাবে। আমি চাই না, শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে আমি ওর ফিউচার নষ্ট করতে।
– দেইখো ভাগ্না, সময় চলে গেলে চাইলেও বাচ্চা হওয়াতে পারবা না।
– দরকার হলে এডোপ্ট করবো, একটা দম্পতির জীবনে বাচ্চার বাবা-মা হওয়াটাই সবকিছু না। এখনো আমাদের নিজেদেরকেই চিনা বাকি। আপাতত এসব নিয়ে চিন্তা করছি না। আপনারা গল্প করুন আমি উঠছি।

বলেই অনল সেখান থেকে চলে এলো। এতোক্ষন আড়ালে ধারা সবকিছু শুনেছে। আজ কেনো জানে লোকটার প্রতি সম্মানটা বেড়ে গেলো ধারার মনে। ধারা ভেবেছিলো অনলের হয়তো ধারার ভবিষৎ নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ নেই। ধারার চিন্তাকে ভুল প্রমাণ করে দিলো অনল। সবার সামনে নিজের বউ চাকরি করবার কথা এতো দৃঢ় গলায় বলতে পারে এমন স্বামীর সংখ্যা যে খুব একটা বেশি নয় একথা কারোর অজানা নয়। আজ অনলের কথাগুলো ধারার মনে অন্যরকম শান্তি দিচ্ছে। যা বলার মতো ভাষা ধারার নেই।

তিনদিন পর,
বিকেল ৪টা,
ভাদ্র মাসের আকাশে ধবধবে সাদা মেঘ উড়ছে। রোদের প্রখরতা ততোটা নেই। বরং খুব ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সেই বাতাসের সাথে সাথে ধারার অবাধ্য চুলগুলো পাল্লা দিয়ে বেহায়ার মতো উড়ে যাচ্ছে। ঘাটলার সবথেকে নিচের সিড়িতে বসে ঠান্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে সে। ধারাদের বাড়ির এই পুকুরটা বাড়ির ঠিক পেছনে। বাড়ির রুম থেকেই সরাসরি পুকুরের ঘাটলা। কিশোরী থাকতে প্রায় এখানে বসে সময় কাটাতো সে। পুরোনো দিনের স্মৃতি গুলো যেনো চোখের সামনে ভাসছে। হঠাৎ করে কেউ চুলে হাত দিলে কেঁপে উঠলো ধারা। পাশে ফিরে দেখলো বেশ কিছু শিউলি ফুল হাতে নিয়ে অনল বসে রয়েছে তার পাশে, একটা ফুল কানে গুজে দেবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছে। অবাধ্য চুলের দাপটে ফুলটা খুলে যাচ্ছে বারবার। শেষমেশ খানিকটা চটে গিয়েই বললো,
– পেত্নীর মতো চুল খুলে রেখেছিস কেনো? খোপা করে রাখতে পারিস না?
– তো আমার চুল তোমার কোন পাকা ধানে মই দিচ্ছে?
– জানিস কতো কষ্ট করে ফুলগুলো জোগাড় করেছি? ভেবছিলাম খোপায় পড়িয়ে দিবো
– বুড়ো বয়সে এসব উটকো শখ কোথা থেকে পাও তুমি?
– বয়সটা না শুধু শরীরের হয় মনের না। আচ্ছা খোপা কর।
– ইচ্ছে হলে নিজে করে দেও।
– বেশ

বলেই কোনোমতে খোপাটা বেধে ফুলগুলো খোপায় গুজে দিলো অনল। বাকি ফুলগুলো ধারার হাতে দিয়ে বললো,
– তোকে প্রেম নিবেদন করি প্রতিনিয়ত
প্রতি ক্ষণে,প্রতি মুহূর্তে,প্রতি বেলা।
কারণ,
আমি তোর প্রেমে পরি প্রতি ভোরে
প্রতি সকালে সোনালি রোদ যেমন উঠে
তেমনি আমিও তোর প্রেমে পরি।
আমি তোর প্রেমে পরি সকালের সূর্য্য যেমন খাঁড়া উপরে উঠে প্রতিদিন,
কিরণে পোড়াতে চায় পথ ঘাট,ফাটাতে চায় মাটি
আমিও প্রতি দুপুরে তোর প্রেমে পড়ে পুঁড়ি
তোর প্রেমে পরে বুক ফেঁটে খণ্ড খণ্ড হয়ে যাক
তবু শান্তি পাই।
আমি তোর প্রেমে পরি শেষ বিকেলে
সূর্য যখন হেলে পড়ে পশ্চিমে
আমিও প্রেম নিবেদন করে তোর বুকে হেলে পড়তে চাই।।

– আজকাল তুমি বুঝি কবি হয়ে গেছো?
– প্রেমে পড়ে বড় বড় মানুষ কবি হয়ে গেলো আমি তো সাধারণ মানুষ মাত্র। সবাই তো গোলাপ দিয়ে প্রেম নিবেদন করে আমি নাহয় শিউলি দিয়েই করলাম।

ধারা কিছু না বলে পরম যত্নে শিউলিগুলো গুছিয়ে রাখলো। অনলের অগোচরেই চোখজোড়া মুছে নিলো। কেনো জানে অনলের বলা প্রতিটা লাইন মনের মাঝে গেঁথে গেছে। নিজেকে আজ খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে ধারার। এতোদিনের ধৈর্যের ফল হয়তো এটা। আজকাল বেহায়া মনটা কেনো যেন আবার নতুন করে এই লোকটার প্রেমে পড়তে চাইছে। হয়তো এতোদিনের ঘাগুলো শুকাতে শুরু করেছে।

রাত ১০টা,
খাওয়া দাওয়ার পর রুমে এসেই দেখলো অনল রুমে নেই। বিছানার উপর শুধু একটা নীল শাড়ি আর এক গোছা রংধনুর মতো চুড়ি রাখা আছে। ধারার বুজতে পারি নেই এই কাজটা কার। পাশেই একটা চিরকুট রাখা। চিরকুটটা খুলতেই চোখে পড়লো,
“ বিয়ের পর তোকে নিয়ে জ্যোৎস্না বিলাশ করার লোভ আজ আর সামলাতে পারছে না তোর এই অপদার্থ বরটা, ঘাটলায় অপেক্ষা করছি। শাড়িটা পছন্দ না হলেও পড়ে আছিস।“

চিরকুটটা পড়ে অজানা একটা আনন্দে চোখমুখ ঝলমল করছিলো ধারার। ঠোঁটে না চাইতেও হাসি ফুটে উঠলো। এই তিনদিনে এমন কিছুই বাদ রাখে নি অনল করতে। প্রতিনিয়ত নতুন করে প্রেমে ফেলবার ধান্দায় রয়েছে সে। এই কয়েক বছরের সুখগুলো যেনো একসাথেই মুঠো করে ধারার আঁচলে ঢেলে দিতে চাইছে সে। আচ্ছা এতো সুখ সহ্য হবে তো ধারার কপালে!

ঘাটলার সিড়িতে বসে রয়েছে অনল। সামনে ডিঙি নৌকা, আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। আজ নৌকায় করে ধারাকে নিয়ে জ্যোৎস্না বিলাসের আয়োজন করেছে সে। গ্রামে না আসলে হয়তো এ সুযোগটা পেতো না। ধারাদের বাড়ির পুকুর দিয়েই এই সময়টা নৌকা করে ঘুরে বেড়ানো যায়। বর্ষার পানি এখনো নামে নি, যার জন্য আশপাশের মাঠ গুলো তলিয়ে আছে। একটা সময় মাহিকে নিয়ে এসব পাগলামির কথা চিন্তা করতো অনল। কিন্তু এখন তার সবটুকু জুড়ে কেবলই ধারার বসবাস। এই কবছরের সব প্রাপ্য সুখগুলো কুড়িয়ে ধারার ঝুড়িতে দিতে চায় অনল। যে দিন গেছে তা ফেরাবার সাধ্য তার নেই, কিন্তু সামনের দিনগুলো রঙ্গিন করার চেষ্টা তো করাই যায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছিলো হঠাৎ চুড়ির শব্দে ধ্যান ভাঙলো তার। সামনে তাকাতেই দেখলো নীল শাড়িতে একটা পরী তার দিকে এগিয়ে আসছে। হাত নাড়ানোর সাথে সাথে রুনঝুন আওয়াজে রাতের নীরবতা গুলো মুখরিত হয়ে উঠছিলো। অনল খেয়াল করলো হৃদস্পন্দন গুলো যেনো খুব বেড়ে গিয়েছে তার। সামনে থাকা নারীর প্রেমেই তো সে অজ্ঞান, এই তো সেই নারী যে তাকে আবার ভালোবাসতে শিখিয়েছে আবার বাঁচতে শিখিয়েছে। একটু এগিয়ে হাত বাঁড়িয়ে বললো,
– তোমায় নিয়ে প্রেমের তরী ভাসাতে চাই, আছে কি অনুমতি?

অনলের মুখে তুমিটা শুনে ধারার বেশ লজ্জা লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো আজ যেনো নতুন করে দুজন মানুষের প্রেমের অজানা কাব্য রচনা হচ্ছে। সুখগুলো একসাথে ধারার আঁচল ভরিয়ে দিচ্ছিলো। মুচকি হেসে হাত বাঁড়িয়ে দিতেই……………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here