#কাগজের_তুমি_আমি
#৮ম_পর্ব
রাত ১১টা,
কলিংবেলের আওয়াজ পেতেই ঘুম ভেঙে গেলো ধারার। ঢুলুঢুলু চোখে দরজা খুলতেই দেখলো অনন্যার কাধে ভর দিয়ে অনল দাঁড়িয়ে আছে। অনন্যার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাতেই সে গরগর করে বলতে লাগলো,
– আমার কোনো দোষ নেই ধারা, আজ তোমার বরের দেবদাসগিরির মাত্রাটা একটু বেশি ছিলো তো। একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে। আন্টি কই?
– ফুপু, বাবা সবাই ঘুম।
– এটাকে কই রাখবো?
– এখানে ফেলে রাখেন সকালে নেশা কাটলে নিজে হেটে হেটে যাবে রুমে।
বিরক্তির স্বরে ধারা বলে উঠে। ধারার হাবভাব শুনে অনন্যা বলে,
– এভাবে বলো না বেচারার আজ মনটা ভালো নেই। তুমি একটু সাপোর্ট দিলে রুমে ফেলে আসতে পারি।
– ঠিক আছে আপু।
দাঁতে দাঁত চেপে অনন্যার কথায় রাজী হয় ধারা। কোনোমতে বেড অবধি এনেই অনলকে শুইয়ে দিলো তারা। মোটামোটি খবর হয়ে গিয়েছিলো অনন্যা এবং ধারার, একটা ছয় ফুটের সুঠামদেহী পুরুষ বলে কথা। অনন্যা আর দেরি না করে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। অনন্যা যাবার পর কি মনে করে আবার অনলের রুমে আসলো ধারা। এসেই দেখে সে চুপচাপ বসে রয়েছে। অনলকে বসে থাকতে দেখে খানিকটা চটে গিয়ে ধারা বলে,
– যদি সোবার ই থাকেন তবে অহেতুক ঢং করার কি প্রয়োজন?
– ……………
– কি হলো উত্তর দিচ্ছেন না যে?
– একটা শেষ সুযোগ কি আমার প্রাপ্য নয় ধারা?
অনলের নির্বিকার প্রশ্ন শুনে ধারা খানিকটা থমকে যায়। অনল তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, অনলের চোখ চিকচিক করছে। এক পলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নেয় ধারা। এই চোখ জোড়া বড্ড ভয়ানক। সাড়ে পাঁচ বছর আগে এই চোখের মায়ার সাগরে নিজেকে তলিয়ে ফেলেছিলো সে। আজ আবার সেই চোখের মায়া তাকে নিজের জালে ধারাকে তলাতে প্রস্তুত। অন্যদিকে ফিরে কাঁপা কন্ঠে বললো,
– রাত হয়েছে, রেস্ট করুন। এসব কথা বলার কোনো মানে হয় না।
কথাটা বলে চলে যেতে নিলেই হাত টেনে ধরে অনল। হ্যাঁচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে। আলতো হাতে ধারার মুখটা দু হাতে ধরে উচু করে সে। কোমল কন্ঠে বলে,
– আমাকে একটাবার নিজের কথা বলার সুযোগটুকু ও দিবি না? ফাঁসির আসামীকেও নিজের কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়। কাল থেকে তোর সাথে কথা বলার চেষ্টা করছি। তুই একটা সুযোগ ও দিচ্ছিস না?
– কি বলবে তুমি? কি বলার আছে? পাঁচ বছর আগে আমাকে সুযোগ দিয়েছিলে তুমি? আমিও তো একটা সুযোগ চেয়েছিলাম। দিয়েছিলে?
কাঁপা কাঁপা স্বরে ধারা বলে উঠে। নোনাজলের রাশি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে। আজ ধারার কন্ঠে অভিমানের ছাপ। অভিমানের পাহাড় যা বিগত পাঁচ বছর ধরে জমে আছে। অনলের শার্টের কলার ধরে বলতে লাগলো,
– কি হলো চুপ করে আছো যে, খুব তো বলেছিলে কথা বলবে। বলো, কেনো চলে গিয়েছিলে? কেনো আমাকে একটা সুযোগ দাও নি। আমার কি দোষ ছিলো? কি দোষ ছিলো আমার? তোমাকে ভালোবাসা আমার দোষ ছিলো? কেনো একা ফেলে গেলে আমাকে। বিইয়ের পর থেকে আমার সাথে তুমি যা যা করেছো আমি সব মেনে নিয়েছি। তোমাকে সময় দিতেও আমি রাজী ছিলাম। তাহলে কেনো চলে গিয়েছিলে?
– তুই তো ভালোভাবেই জানিস আমি কেনো গিয়েছিলাম, যাতে আমার দ্বারা তোর কোনো ক্ষতি না হয়। যাতে তুই কষ্ট না পাস। আমি না গেলে মা তোকে নিয়ে আলাদা হয়ে যেত
– আমার হয়ে সব ডিসিশন তোমরাই নিয়ে ফেললে? একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে আসলে আমি কি চাই? আমাকে কষ্ট না দিতে গিয়ে সবথেকে বড় কষ্ট দিয়ে ফেললে তার বেলায়?
– আই এম সরি। কিন্তু কি করতাম বল? আমার ঘা গুলো এতো তাজা ছিলো যে তোর ভালোবাসাটা মলম হলেও খুব যন্ত্রণা দিতো। প্রতি নিয়ত আমাকে যুদ্ধ করতে হতো। আমি যে পারছিলাম না, ভয় পেতাম। যদি তখন মিথ্যা আশায় তোকে রাখতাম সেটা কি খুব ভালো হতো। যেখানে আমি জানতাম তোকে ভালোবাসাটা আমার জন্য খুব সম্ভব হতো না। মাহির স্মৃতিগুলো কঁটার মতো আমাকে প্রতিনিয়ত ফুট ছিলো। সেখানে তকে জড়ানোটা কি খুব ভালো হতো? সেটা কি অন্যায় হতো না? তোর মাঝে আমি মাহিকে খুঁজতাম, তোকে মাহির জায়গায় ফিট করার চেষ্টা করতাম। সেটা অন্যায় হতো না? তোকে মিথ্যা ভালোবাসার মাঝে, মিথ্যা সম্পর্কের মাঝে কিভাবে রাখতাম বল? তাহলে আমার মাহির মাঝে পার্থক্য কি থাকতো। তখন তুই এই সম্পর্কটাকে টানতে টানতে টায়ার্ড হয়ে পরতি। খুব ভালো হতো সেটা। আমাদের সম্পর্কটা ভুল ছিলো না, সময়টা ভুল ছিলো।
– বেশ মানলাম, সম্পর্কের চাপ তুমি নিতে পারো নি, তাই পালিয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু ডিভোর্স পেপারটা। সেটা কেনো সাইন করে গিয়েছিলে? উত্তর দাও
দৃঢ় কন্ঠে ধারা উত্তর চাচ্ছে অনলের কাছে। ধারা কাঁদছে, কিছুতেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। বারবার ঢুকড়ে ঢুকড়ে কেঁদে উঠছে সে। অনল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার। ধারার অশ্রুগুলো অনলকে বড্ড অসহায় করে নিচ্ছে, দূর্বল করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কলিজাটা কেটে যদি তাকে দেখাতে পারতো হয়তো তাহলে নিজের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত হতো। ধারার চোখের পানিতে অনলের শার্টের খানিকটা ভিজে গেছে। ধারার চোখ দুহাতে মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,
– আমি খুব দোটানায় ছিলাম ধারা। আমি কি করতাম তখন? তোর সাথে বিয়েটা আমি মেনে নিতে পারবো কিনা! তোকে কোনোদিন স্ত্রীর মর্যাদাটা দিতে পারবো কিনা সেটাই আমার জানা ছিলো না। সেখানে তোকে একটা খোকলা সম্পর্কে বেধে রাখা আমার নীতির মধ্যে পড়ছিলো না। আমি তোর প্রতি অনুভূতিগুলো কোনো আকার দিতে পারছিলাম না। তখন আমি আমার ভেতর ছিলাম না।
– তাহলে চলেই যখন গেছিলে, ফেরত কেনো এসেছো। কেনো আমার মনটাকে আবার স্বপ্ন দেখিয়ে আবার গুড়োগুড়ো করে ভেঙে দেবার জন্য? এখন কেনো আমাকে মুক্তি দিচ্ছো না।
– ভালোবাসি তোকে তাই। খুব ভালোবাসি, এই পাঁচটা বছর একটা দিন যায় নি আমি তোর কথা ভাবি নি। ভুল করেছিলাম, আমার এলোমেলো অনুভূতি গুলোকে প্রথমে বুঝতে দেরি করেছি, তারপর বুঝার পর সেটাকে মানতে দেরি করেছি। এই ভুলগুলো আমাদের জীবন থেকে পাঁচটা বছর কেঁড়ে নিয়েছে।
– পাঁচ বছর চার মাস এগারো দিন। জানো কতোগুলো দিন হয়, এক হাজার নয়শত আঠাশ দিন। প্রতিটা দিন আমি অপেক্ষা করতাম। এই ভেবে তুমি হয়তো ফিরবে, এই বুঝি আমার কাছে ফিরবে। কতোগুলো রাত নির্ঘু, কেঁটেছে আমার। ফিরিয়ে দিতে পারবে তুমি? আমার প্রতিটা নির্ঘুম রাত ফিরিয়ে দিতে পারবে? আমাদের বিয়ের আজ পাঁচ বছর দশ মাস সতেরো দিন। পারবে এই দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে। আমার জীবনের এই দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবে? সেই কিশোরী মনের নিস্পাপ ভালোবাসাটাকে আবার জাগাতে পাঁরবে? পারবে না কিচ্ছু পারবে না। আমি থাকবো না তোমার সাথে। থাকবো না। আর কষ্ট নেওয়ার অবস্থায় আমি নেই।
এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি ধারা। অনলের বুকে মাথা ঠেকিয়ে হিচকি তুলে কাঁদছে সে। বিলাপের পরিমাণ বাড়তেই থাকলো। এতোদিনের অভিমানের পাহাড় আজ গলতে শুরু করেছে। কঠিন থাকতে থাকতে আজ ধারা ক্লান্ত। নিজের সকল অভিযোগ আজ সে অনলকে জানাবে। অনলও পরম যত্নে ধারাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো। পুরুষের নাকি কাঁদতে নেই। তাদের কান্না আসে না, কিন্তু যখন কাঁদে সব উলট পালট করে দিতে সক্ষম। আজ অনল কাঁদছে। নিজের ভুলের মাশুল দিচ্ছে। কারণ ধারার প্রতিটা অশ্রুফোঁটা তাকে ভোঁতা ছুরির মতো আঘাত করছে। পারছে না ধারাকে নিজের বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলতে। একটা সময় কাঁদতে কাঁদতে ওনলের বুকেই ঘুমিয়ে পড়লো। ধারার কোনো আওয়াজ না পেলে ধারার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আস্তে করে তাকে কোলে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিলো তাকে অনল। ভেজা শার্টটা খুলে ধারার পাশেই মুখ করে শুয়ে পড়লো। নিপুন দৃষ্টিতে ধারাকে দেখে যাচ্ছে অনল। কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলে রয়েছে তার। চোখের নোনাজল এখনো শুকায় নি; চোখের নিচে লেগে রয়েছে। আস্তে করে ধারার মাথাটা নিজের বুকের উপর রেখে তাকে পরম যত্নে আগলে ধরলো অনল। মেয়েটাকে আর কোনোদিন কাঁদতে দিবে না সে। এটা তার কাছে স্পষ্ট মেয়েটা কাঁদলে বড্ড বেশি অসহায় লাগে, মনে হয় পুরো দুনিয়াটা উলট পালট হয়ে যাচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতে অনল ও ঘুমের অতল সাগরে তলিয়ে যায়।
সকাল ৭টা,
পাখির কিচিমিচি কানে যেতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো ধারা। মনে হচ্ছে খুব শক্ত কিছুর উপর উবু হয়ে আছে সে। মাথা ব্যথা করছে, চোখ খুলা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। কিসের উপর শুয়ে আছে বুঝার জন্য হাত দিয়ে হাতড়ে যাচ্ছে। চুলের মতো কিছু হাতে পড়লে সেটা টানার চেষ্টা করতে লাগলো সে। হঠাৎ কারোর গগণবিদারী চিৎকার শুনতে পারলে এক লাফে উঠে পড়ে সে। চোখ খুলতেই দেখলো………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি