#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_২২
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
২২.
অনপেখিত অংশুমালীর আগমনের আকস্মিক উত্তাপে আশেপাশের সবাই খানিক বিরক্ত। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সড়কদ্বীপে নির্মিত সোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যের সামনে একদল ছাত্র-ছাত্রী আড্ডায় মগ্ন। সবাইকে বাহ্যিকভাবে নিরীক্ষণ করে ভালো ঘরের ছেলে-মেয়ে কিংবা হাই ক্লাস সোসাইটির অন্তর্ভুক্তই বলা যায়। তার মধ্যে একজন মেয়ে শ্যামবর্ণা, আর একজন ছেলে সঙ্গের সুদর্শন বন্ধুদের তুলনায় খাটো ও মোটা।
সবচেয়ে সুদর্শন ও দেহ নির্মাতা ছেলেটিকে তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো লতানো শরীরের রমণীতে বলছে,
“তুই দিন দিন এতো লম্বা কেন হচ্ছিসরে শ্রাবণ। তোর রূপের অহমিকায় তো আমরা মেয়েরাও লজ্জায় লজ্জাবতী গাছের মতো নুইয়ে পড়ছি।”
সঙ্গের আরেকটা রমণী যে এই দলটির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর তরুণী, সে বলে ওঠলো,
“আমার কি মনে হয় সিদ্রা জানিস?”
সবাই তার দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকালো।
“আমার মনে হয় শ্রাবণকে কোনো পরী আছর করেছে। তাই তার সৌন্দর্য-সৌষ্ঠব তরতর করে বাড়ছে।”
পাশ থেকে আরেকজন ছেলে বলে ওঠলো,
“ও, আচ্ছা। তাহলে তো বলতেই হয় তোর উপর কোনো জ্বীন ভর করেছে। যেভাবে ভূতের মতো ফর্সা তুই তা তো সাধারণ মানুষের লক্ষণ হতে পারে না সুন্দরী। কখনোই না।”
সবাই উচ্চহাস্যে ফেটে পড়লো।
সুদর্শন ছেলে ও সুন্দরী মেয়েটির মুখে তৃপ্তি ও প্রাপ্তির হাসি।
হঠাৎ শ্রাবণ তার মোটা বন্ধুটির উদ্দেশ্যে বলে ওঠলো,
“আর আমাদের আসিবুল স্যার প্রতিজ্ঞা করেছে ভার্সিটি লাইফ শেষ হওয়ার আগে জলহস্তীর সার্টিফিকেট অর্জন করে বের হবে। কিরে মুটকু আসিব ভুটকু আসিব। সত্যি বললাম না লিলিপুট?”
শ্যামবর্ণা মেয়েটির চোখ-মুখ শুকিয়ে এলো। তার এক্ষণই বিদায় নেওয়া উচিত। কারণ এই হাসি-তামাশার পরবর্তী প্রতীক সে হতে যাচ্ছে। সবসময় হাসিমুখে সহ্য করলেও আজকাল তার কাছে এসব বড্ড অসহনীয় ঠেকে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য মুখের ওপর কাঠ কাঠ গলায় কিছু বলাও যায় না।
অতি সুন্দরী রমণীটি মেয়েটির বলে ওঠলো,
“কিরে কাল্লু, চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছিস কেন? এভাবে আছিস যেনো মুখে কেউ করলা ঠেসে দিয়েছে।”
আবারও হাসাহাসির রোল পড়লো।
মেয়েটি তার মোটা বন্ধুটিকে আড়চোখে দেখে ঠোঁট গোল করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সুন্দর চেহারা, উচ্চতা, ওজন– এসব কি আসলেই যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে? কথায় নাকি বলে, “আগে দর্শনধারী, পরে গুণ বিচারী।” দর্শন কী সদাচরণ, সুষ্ঠুভাবে মুখ দ্বারা বাক্য নির্গমন, শালীন পোষাক পরিধান হওয়ার কথা ছিলো না? তবে কেন প্রথম দর্শনে এসব নূন্যতম লৌকিকতার অন্তর্ভুক্ত কার্যকারিতা উপেক্ষা করে মানুষ শারীরিক গঠনের দিকে লক্ষ্য করে? গুরুত্ব প্রদান করে কেন? দর্শনধারীর আকর্ষণীয় বস্তু কী কখনো এসব ফর্সা ত্বক, সুউচ্চ দেহায়ব হতে পারে?
আচমকা কয়েকটা বাইক এসে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। চেহারা হেলমেটে আবৃত বলে কে বা কারা ঠাহর করা যাচ্ছে না।
সিদ্রাতুল নামের মেয়েটিকে নোংরা অঙ্গ-ভঙ্গি দেখিয়ে বললো,
“বাইকে উঠবে নাকি সুন্দরী? আসো সেক্সি, কঠিন আদর দিয়ে যাই তোমাকে।”
বলেই বাইকগুলো অন্য পথে ছুটে গেলো।
আর বন্ধুমহলের অন্যান্য সদস্যরা রাগে ফেঁটে পড়লো। তাদের বন্ধুকে কেউ এরকম অসম্মান করার সাহস যে দেখিয়েছে তার ঠিক জিব টেনে ছিঁড়তে উদ্যত।
শ্রাবণ নামের ছেলেটি রক্তবর্ণ চোখে বাইকের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে ওঠলো,
“শালা, জানোয়ারের বাচ্চাগুলো! ঘরে মা-বোন নেই? বাপ-মা শিক্ষা দেয়নি! একবার বাইক থামিয়ে দেখ বেজন্মাগুলো!”
আকস্মিক ঘটনায় সবাই-ই বিহ্বলতায় পতিত হলো। হাস্যোজ্জ্বল আড্ডার মাঝখানে হুট করে কি ঘটে গেলো!
অনেক্ষণ যাবৎ দানীন বন্ধুমহলের প্রাণোচ্ছল আলাপচারিতা দৃষ্টি ভরে দেখছিলো। তারা নজরে আসতেই তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে গিয়েছিলো। আকস্মিক ঘটনায় সে-ও খানিক বিব্রত। দানীন তাদের দিকে এগিয়ে গেলো।
শ্রাবণ নামের ছেলেটিকে ডেকে বললো,
“তোমার নাম কি?”
শ্রাবণ ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
“শ্রাবণ। কেন? আপনি কে?”
“আমি টিচার।”
“ওহ, দুঃখিত ম্যাম।”
দানীন মৃদু হাসলো। হেসে বললো,
“দুঃখিত, তাই না? তোমার মতো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দুঃখিত শব্দটা কোনোভাবেই যায় না। তবুও আমি খুশি।”
কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনা যেনো একলহমায় ভুলে শ্রাবণসহ সবাই উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে দানীনের দিকে তাকিয়ে রইলো।
“তোমার পেটানো বলিষ্ঠ দেহ এবং রূপবতী বান্ধবীকে দেখে আশেপাশের মানুষজন তোমাকে, ‘তুমি সুদর্শন।’ ও তোমার বান্ধবীকে, ‘তুমি অনেক সুন্দর, প্রিটি।’– বললে প্রত্যুত্তরে তোমরা মিষ্টি হাসি উপহার দাও। তোমার বান্ধবীর লতানো শরীরের চিকন কোমরের ভাঁজ দেখে কিছু মানুষজন, ‘হেই, সেক্সি। বুকে আসো’ বলে আহ্বান করলে তোমরা রেগেমেগে প্রশ্ন করো, ‘ঘরে মা-বোন নাই?’ অথচ তুমি তোমার অন্যান্য মোটা, কালো, খাটো বন্ধুকে সম্বোধন করো, এই ভোটকা, এই কাইল্লা, এই বাইট্টা লিলিপুট নামে। অলরাইট। তোমার এই ব্যবহার তোমার সম্পর্কে কিছু বলে না। বলে তোমার পরিবার একটা থার্ড ক্লাস ফ্যামিলি, মূর্খ, অশিক্ষিত। কুকুরের বাচ্চার মতো কয়টা জন্ম দিয়ে ফেলে রেখেছে। কুকুরছানাগুলোর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে বাবা-মা তার ছানাগুলোকে সুশিক্ষা দিতে পারেননি।”
দানীন অবজ্ঞাজনক হাসি দিয়ে বললো,
“খারাপ লাগছে? লাগলে লাগুক। কিন্তু এটাই ফ্যাক্ট তোমার ব্যবহার তোমার থেকে অধিকতর তোমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডকে হাইলাইট করে। কারণ একজন ব্যক্তির তার পরিবারের সঙ্গে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। পরিবার থেকেই সমাজ, রাষ্ট্রের শুরু। তাই তোমার ভিত্তি যেরকম তা তোমার ব্যবহার দ্বারা প্রতিফলিত হয়ে সুস্পষ্ট হয়।”
শ্রাবণ ছেলেটি কঠিন মুখায়বে কিছু বলতে উদ্যত হলে দানীন থামিয়ে দিলো। বললো,
“এখন বলতে পারো তোমার পরিবারকে না টানতে। তোমার পরিবারের সঙ্গে তোমার সেরকম কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে কী ধরে নেব তুমি এতিম? তুমি যদি এতিম হও তাহলে তোমার থার্ড ক্লাস মনোভাব ও ব্যবহার নিয়ে কেউ কিছু বলবে না বিশ্বাস করো। কারণ তুমি শিক্ষাই পাওনি। তোমার শিক্ষার ভিত্তিই নড়বড়ে। ফলে রাস্তায় হামাগুড়ি দেওয়া ল্যাংড়া কুকুরের মতো তুমি ঘেউ ঘেউ করবেই; আমরা তা বুঝি তো বাবা। উই নো দ্যাট ইউ আর অ্যান অরফান। এন্ড ইউ আর এলাইক অ্যা ডগ। আমারা কিন্তু তোমাকে কিছু বলবো না। আমরা কী তোমার মতো এতিমকে কিছু বলতে পারি সোনা? উঁহু।”
দানীন হেসে ঘুরে দাঁড়ালে দুজন বাদে সবার চেহারা মুহূর্তে থমথমে হয়ে গেলো। আর বাদবাকি দুজনের মধ্যে একজনের অধরে ফুটে ওঠলো মুচকি হাসি আর শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ শিরদাঁড়া টান হয়ে ওঠলো। অপরজনের দৃষ্টি আগাগোড়া অনাকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার পরশ উপলব্ধ হয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠলো। মাতৃস্নেহের পরম স্পর্শ সমগ্র মননে বিরাজ করলো।
ইউসরা পাশ থেকে দানীনের উদ্দেশ্যে বললো,
“এটা কি হলো?”
দানীন পাশে তাকিয়ে বললো,
“কি হলো? কিছুই তো না। আর তুই এভাবে ভূতের মতো ঠুসঠাস এসে কথা বলিস কেন? আমি তো ভয়ই পেয়ে যাই।”
ইউসরা চিকন হাসি দিয়ে বললো,
“কাউকে জ্বীন লাগে, কাউকে ভূত। সামথিং ইজ ভেরি ফিশি।”
দানীন হাসি লুকিয়ে বললো,
“এবার মারবো এক থাপ্পড়।”
ইউসরাও হাসলো। দুজন একটা সিএনজি দেখে উঠে নিলো। সিএনজি চলার খানিক বাদে ইউসরা বললো,
“আপু, তাদের যে তুমি কতগুলো কথা শুনালে, উল্টাপাল্টা কিছু করে বসলে? বড়লোকের পুত্র বলে কথা আবার।”
দানীন হাত দিয়ে কথা উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বললো,
“করলে করবে। শোন। তারা ধর আমাকে মেরেই ফেললো। জঘন্যভাবে মারলো। তারা মানুষ না হোক, অনন্ত তাদের মতো উঠতি বয়সের অনান্য যুবক-যুবতী মানুষ হবে। সাদা চামড়া দেখলে জিহ্বায় ধার দিয়ে কেন চাটতে হবে, কালো হলে কেন বাপ-মা বিষ খেয়ে মরতে বলে তা নিয়ে একবার হলেও ভাববে।”
ইউসরা মৃদুভাবে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম।”
“আমরা সুন্দরভাবে সুন্দর জিনিস গ্রহণ করার জাত না। ধ্বংসলীলার মাধ্যমে বিদীর্ণ, বিমর্ষ হলেই তবে আমাদের টনক নড়ে। এক দানীন মরলে আরও দানীন জাগ্রত হবে।”
দানীন আর ইউসরা শপিংমলে এসেছে। কিছুদিন পূর্বেই তার ছোটো বোন পারিশার আরেকটা ছেলে বাবু হয়েছে। শপিংয়ে এসেছে তার বোন ও বোনপোর জন্য কেনাকাটা করা। প্রায় এক বছর আট মাস পর তার বোনের সঙ্গে দেখা হবে। বিয়ের দিন ছাড়া দানীন কখনো তার বোনের শ্বশুরবাড়ি যায়নি। সবসময় এক অবিদিত লজ্জার পরিবেষ্টক তাকে পরিবেষ্টিত করে রাখতো। স্নেহার্দতায় পরিপূর্ণ চার দেওয়ালের আবরূর চরিতার্থতার সংসারে তার কিছুকালের দৃশ্যমানতাও বড্ড বেমানান মনে হতো।
দানীন বেবিশপে বাচ্চাদের জামা-কাপড় দেখছিলো। হঠাৎ ইউসরা দেখলো আরসালান খানিক দূরে কিছু একটা নেড়েচেড়ে দেখছে। সে দানীনকে কনুই দ্বারা মৃদু নাড়িয়ে বললো,
“আপু, আপু। তোমার প্রেমিক।”
দানীন এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠে তার দিকে তাকালো। আরসালান নজরে পড়তে সে ইউসরার উদ্দেশ্যে চোখ পাকালো।
ইউসরা মনে পড়ার মতো ভঙ্গি করে বললো,
“ওহ, স্যরি। তোমার কিডন্যাপার আরকি।”
দানীন আরসালানের দিকে তাকালো। হাতের ছোটো গেঞ্জিটা নিংড়িয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“ওরে আমার পাগলা ঘোড়ার ভাইরে! আমি যেখানে দৃশ্যমান তুই সেখানে প্রতিয়মান হবি না আমি তা ভুলে গেলাম কি করে। আয় আয়, কার বাচ্চার জামা কিনতে এসেছিস বলে যা। দাওয়াত দিয়ে যা। ডলফিনের পাদ, জলহস্তীর গোস্ত!”
ইউসরা কান পেতে তার বিড়বিড় করা শোনার চেষ্টা করলো।
দোকানদার বিস্ময়বিহ্বল গলায় দানীনকে ডাকলো,
“ম্যাম আর ইউ ওকে?”
দানীন সচকিত হয়ে দোকানদারের দিকে তাকালো। এরপর মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করে বললো,
“না, ঠিক নেই। কোনো সমস্যা?”
দোকানদার হতবুদ্ধি হয়ে ডানে-বামে মাথা নাড়ালো। এর মধ্যেই আরসালান দানীনের পাশে এসে দাঁড়ালো।
তার সর্বজনীন শুভ্রময় হাসি উপহার দিয়ে লৌকিকতা প্রদর্শন করে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“হেই দানীন, কেমন আছো?”
আরসালানের এমন ঢঙময় তুমি সম্বোধন শুনে দানীন দোকানদারের দিকে চোখ দ্বারা আগুন নিক্ষেপ করে ভষ্ম করে দেবে, এমন দৃষ্টিতে তাকালো। বেচারা দোকানদার বুদ্ধিভ্রষ্ট মুখায়ব নিয়ে আরসালানের দিকে তাকালো।
আরসালান ইউসরার উদ্দেশ্যে বললো,
“তুমি ভালো আছো? কি যেন নাম তোমার?”
ইউসরা মৃদু হেসে জবাব দিলো,
“ইউসরা। আপনি ভালো আছেন স্যার?”
“হ্যাঁ,আলহামদুলিল্লাহ। আর আমাকে স্যার ডাকার দরকার নেই।”
ইউসরা আগ্রহী কণ্ঠে বললো,
তাহলে কি ডাকবো? ভাইয়া নাকি দুলা প্লাস ভাইয়ের সন্ধি শব্দ?”
দানীন ইউসরাকে ধমকে ওঠলো।
আরসালান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
“ধীরে ধীরে এগোয় শালিকা। আই মিন বোন। নাহলে জুতাপিটা দুজনের পিটেই পড়বে।”
দানীনের প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে চুপচাপ জামাকাপড় দেখতে লাগলো। ইউসরা বাথরুমের যাওয়ার কথা বলে সেখান থেকে প্রস্থান নিলো।
আরসালান দানীনের হাত থেকে জামাটা নিজের হাতে নিয়ে জিগ্যেস করলো,
“এটা তো খুব ভারী। সামনে গরম আসছে। বাচ্চা মানুষ সামলাতে পারবে? বাই দ্য ওয়ে, বাচ্চা ছেলে না মেয়ে? সম্পর্কে তুমি বাচ্চার কি হতে যাচ্ছো দানীন?”
দানীন ছোট ছোট জামা-প্যান্টের সেট, টাওয়েল, গামছা এক এক করে দোকানদারের মুখ বরাবর নিক্ষেপ করছে আর প্যাকিং করতে ইশারা করছে। পাশে উপস্থিত ফটর ফটর করা হাগা মুছার তেনা বাবার সঙ্গে সে কথা বলবে না। তুমি বলুক না তুই করে বলুক বা আপনি বলতে বলতে আম্মা ডাকা শুরু করুক।
তওবা তওবা!
যাইহোক, তবুও সে এই লেজ ছাড়া খরগোশ, ঠোঁট কাটা ড্যাবড্যাব করে তাকানো গরুর সঙ্গে কথা বলবে না। প্রথম সাক্ষাতে তাকে অপহরণের যে ভয়াবহ হুমকি দিয়েছে দানীন কী তা ভুলে গিয়েছে? উঁহু। এখন হাফ প্যান্ট পরে ড্রেনের পানিতে গোসল করে স্যরি বললেও কোনো ক্ষমা হবে না। সর্বপ্রথম ওই তেনা-তুনা বিশেষজ্ঞের চামচিকাকে ধুতে হবে। চুলা থেকে উত্তোলিত ছাই দিয়ে মেজে মেজে ধুতে হবে। তারপরেই এই দুই চিড়িয়াখানাবাসীর শিক্ষা হবে।
দানীন ঝটপট টাকা পরিশোধ করে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে আসবে তখনই আরসালান ধমকে ওঠলো,
“তুমি কী বধির নাকি দানীন? সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি-ঝাপাঝাপি করে কী কানের ফুটোতে ধুলো জমিয়ে ফুটো দুটো বন্ধ করে রেখেছো? কতক্ষণ ধরে একাধারে প্রশ্ন করে যাচ্ছি কোনো জবাবই দিচ্ছো না। আশ্চর্য!”
দানীন বিস্ময়ে স্তম্ভিত! বাব্বাহ, বোকা বোকা চেহারার ভাই এতোদিন স্টুডেন্টদের পরীক্ষার খাতা কামড়ে, নিজের নখ কামড়ে, ঠোঁট কামড়ে কৈফিয়ত চাইতো। আর এখন উনি কোমর ঢুলিয়ে বুক নাচিয়ে কৈফিয়ত চাইছে। কোমর ভেঙে, বুক ফুটো করে দিলে কি হবে, হুহ!
দানীন এগিয়ে এসে নমনীয় স্বরে জিগ্যেস করে,
“আমি কী আপনার ছোটবোন?”
“আশ্চর্য, বোন হবে কেন!”
দানীন হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় বললো,
“এই যে, তুমি তুমির মহাপ্লাবন প্রবাহিত করে দিয়েছেন। আপনার অধীরতা দেখে মনে হচ্ছে আমি আপনার মেলায় হারিয়ে যাওয়া বোন। এখন খুঁজে পেয়ে আবেগে-আকুলতায় পাহাড় বেয়ে ঝর্ণার মতো লতিয়ে পড়ছেন।”
আরসালান থতমত খেয়ে গেলো। এরপর চেঁচিয়ে ওঠলো,
“নিজের ভাই দিয়ে হয় না? লোভী মেয়ে। যাকে তাকে ভাই বানানো..”
বলেই দোকান থেকে বের হয়ে এস্ক্যালেটর দিয়ে ওপরের তলায় চলে যায়। দানীন তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো।
ইউসরা এসে দেখে আরসালান নেই। সন্দিহান দৃষ্টিতে দানীনকে পর্যবেক্ষণ করে জিগ্যেস করলো,
“সত্যি সত্যি কী জুতাপিটা করেছো নাকি?”
দানীন কনুই ভাজ করে বললো,
“একজনকে করেছি। আরেকজন তো বাকি। সে কী জনসম্মুখেই খেতে চায় নাকি বাড়িতে যাওয়ার পর?”
ইউসরা অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো।
“তুমি সত্যি এতো বড় একটা মানুষের গায়ে হাত তুলেছো? কোথায় কোথায় স্পর্শ করেছো? মুখ দেখাতে পারবে তো?”
দানীন দাঁত কেলিয়ে হাঁটা দিলো। মূল গেট অতিক্রম করে সিএনজির জন্য দাঁড়াতেই আদ্রিয়ানের কল এলো। দানীন নাক কুঁচকালো। কল করুক, করতে করতে শহীদ হয়ে যাক। ধরলেই দেখা যাবে ইনিয়ে বিনিয়ে দানীনের বোনের বেবির কথা জেনে গুন্ডা ভাইসহ এবার ডিরেক্ট বাসায় এসে ওঠবে। এই এতো শত যন্ত্রণা নিয়ে সে কিভাবে যে এখনও অবধি বেঁচে আছে।
“এডি স্যার, বাব্বাহ! মানুষ তো তার প্রেমিক প্রেমিকার নাম সেইভ করতে এরকম এক-দুই লেটার দিয়ে নাম সেইভ করে।”
“তুই কি বলতে চাইছিস? আদ্রিয়ান স্যার আমার প্রেমিক?”
ইউসরা নিষ্পাপ চেহারা করে বললো,
“আরে আমি সেটা বলছি না। আমি বলছি প্রেমিকের নাম লেটার দিয়ে সেইভ করার দরকার নেই। যারা করে তারা নিব্বি। তুমি তো বড় মানুষ। তুমি বুক ফুলিয়েই প্রেম করতে পারো।”
দানীন কোমরে হাত রেখে অবাক হয়ে বললো,
তুই তো ভারী ধান্দাবাজ ইউসরা। কয়টাকে আমার প্রেমিক বানাস?
কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো,
“যতজন হতে চায়, ততজনকেই।”
(চলবে)