শুভ্রময়_পুরঁজন পর্ব_২৯

0
260

#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_২৯
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা

২৯.
নীল রঙের সোনালী পাড়ের শাড়িটি গায়ে জড়িয়ে দানীন জানালার ধারে বসে আছে। শাড়িটা তার মায়ের। দরজা বন্ধ করে হাতে আয়না নিয়ে নিজেকে একটু পরপর দেখছে। নিজেকে কেমন লাগছে তা জানতে? না। নিজের কেমন অনুভূত হচ্ছে তা দেখতে।
চেহারা থেকে আয়নার দূরত্ব কমিয়ে মুখমণ্ডলে খোঁজার চেষ্টা করলো আতঙ্ক, ভীতি, উদ্বিগ্নতা। কই না তো। সে তো ঝলমল করছে। বসন্তের শুরুতে ডালপালায় পিটপিট করে তাকানো পাতার মতো সতেজতা, তার উপর ময়ূখমালীর উপচে পড়া আদরণীয় পরশের মতো প্রাঞ্জলতা। তার তো শীতের হিমায়কে ঝড়ে পড়ার কথা, গ্রীষ্মের চিড়খাওয়া কাঠের মতো নিংড়ে যাওয়ার পালা, বৈশাখীর দমকা বাতাসে উড়ে হারানোর বেলা। হ্যাঁ, সে উড়েছে। উড়ে হারিছেও। শেষে আছড়ে পড়েছে শুভ্রর বুকে। ভাগ্যিস আগলে ধরেছিল। কিন্তু কেন ধরেছিল? মোহ কী তবে? সাময়িক মোহ?

দরজার করাঘাতে সে উঠে দাঁড়ালো। আয়নাটি ড্রয়ারে সযত্নে রাখলো। দরজা খুললে তার খালা, ফুফু, মা, ইউসরা আর ভাবি একসঙ্গে প্রবেশ করে।
“মা তেনারা আসছেন। সামনে গিয়া সুন্দর মতো সালাম দিবা। বাত..”
দানীনের খালা তার মাকে ধমকে উঠে বললো,
“এই তুই ক্ষ্যামা দে ছেড়ি। দানীন ছুইটকা না।”
ইউসরা হেসে বললো,
“আপু তুমি বসো। নরমালি যাবে, নরমালি কথাবার্তা বলবে। আদ্রিয়ান স্যার তো আমাদের চেনাই তাই না?”
দানীন কোনো কথা বললো না। চুপচাপ খাটের উপর গিয়ে বসলো। ইউসরা বাদে বাকিরা চলে গেলো।
দানীন যেই রুমে তার সঙ্গেই সোফার রুম। দানীন কান খাড়া করে রাখলো। শুভ্রর মা কী তার গায়ের রঙ সম্পর্কে জানে? আগে তাকে দেখেছে বলে তো মনে হয় না।
একজন পুরুষ মানুষের গলা ভেসে এলো।
“নাই ভাই, মেয়ে এখানে এনে দেখানোর কিছু নেই। মহিলা মানুষ আছে, তারা ভিতরে গিয়ে দেখে আসুক। আর আমরা তো মেয়েকে আগেই দেখেছি। আর দানীন যে ভালো মেয়ে এতে কোনো সন্দেহ নেই।”
ইউসরা দানীনের দিকে হাসিমুখে বড় বড় চোখ করে তাকালো। কয়েক মুহূর্ত পড়েই দানীনের খালার সঙ্গে দুজন মহিলা প্রবেশ করলেন। উভয়েই মধ্য বয়সী রূপবতী। খয়েরি রঙের বোরকা পরা মহিলার চেহারা দেখে মনে হলো উনিই শুভ্রর মা।
দানীন বসা থেকে উঠে তাদের সালাম দিলো। ইউসরাও সালাম দিলো।
শুভ্রর মা বলে যাকে মনে হচ্ছে সে দানীনকে জিগ্যেস করলো,
“কেমন আছো মা?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ, মা। আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আমাকে চিনেছো? আমি হলাম শুভ্রর মা। আর ইনি হলো শুভ্রর খালামণি, অর্থাৎ তোমারও খালামণি।”
দানীন শুধু মৃদুভাবে হাসলো।
“তুমি বসো মা।”
দানীনের খালা বললো,
“আপনেরাও বসেন। দাঁড়ান একটা চেয়ার এনে দেই।”
“চেয়ার তো এখানেই আছে। ওখানে বসা যাবে। আমি বরং দানীনের সঙ্গে বসি।”
ইউসরা শুভ্রর খালামণির দিকে চেয়ার এনে দিলো। আর শুভ্রর মা দানীনের পাশাপাশি বিছানায় বসলেন।
”ইউসরা এদিকে আইয়ো তো মা।”
দানীনের খালা ইউসরাকে ডেকে নিয়ে গেলে তারা তিনজন রইলো।
শুভ্রর খালামণি জিগ্যেস করলেন,
“তুমি তো আদ্রিয়ানের সহ-শিক্ষিকা তাই না?”
দানীন মাথা নাড়লো।
“তোমার বয়স কতো?”
“আটাশ।”
“শুভ্রর তো ঊনত্রিশ।”
উনি হেসে দানীনের গাল টেনে বললেন,
“ছেলে-মেয়ে সমবয়সী ভালোই হয়েছে। একে অপরকে বেশি ভালোভাবে বুঝবে।”
দানীন চমকালো না, তবে যেনো অপ্রসন্ন হলো। উনি যদি বয়স নিয়ে তাকে বিরূপ মন্তব্য শুনাতেন তবে তার জন্য তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো।
শুভ্রর মা আদিলা বেগম তার বোনের দিকে তাকালেন। চোখে চোখে বোধহয় কথা সেরে নিলেন। ফলে তিনি উঠে গেলেন।
শুভ্রর খালামণি যেতে আদিলা বেগম দানীনের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।
ক্ষীণ গলায় জিগ্যেস করলো,
“আমার ছেলেকে পছন্দ তো? ছেলে হিসেবে শুভ্র ভালো। আমি তাকে দশে দশ দেবো। কিন্তু স্বামী হিসেবে, তা যদি তার বাবার মতো হয় তবে তুমি তাকে দশে একশো দেবে।”
বলে তিনি নিজে নিজে হাসলেন।
আবার বলতে লাগলেন,
“শুভ্রর বাবাও জানো শুভ্রর মতো একটু পাগলামি করে বসেছিল। কিন্তু আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না। ভেবেছিলাম, আমি নামক ব্যক্তিটিকে পাওয়ার জন্য তার ভেতরে কঠিন জেদ চেপেছে। সময়ের সঙ্গে পদাঙ্ক ফেলে জেদের চাপ কমবে, সেইসঙ্গে আমিও হবো তার চোখে অদৃশ্য। কপাল ভালো থাকলে হয়তো টিপিক্যাল সংসার চলবে। কিন্তু না।”
উনি মাথা তুলে তাকালেন। দানীনও চাইলো।
উনি বললেন,
“উনি আমাকে চিনে ছিলেন। আদর্শ মা হওয়ার চেষ্টায় যে সর্বদা নিয়োজিত থাকবো তা তিনি বুঝেছিলেন। কোনো জেদ ছিলো না। ছিলো সুন্দর কিছুকে আগলে রাখার আকুতি।”
আদিলা বেগম দানীনের মাথায় হাত রেখে বললেন,
“তুমি হলে শুভ্রর সেই সুন্দর কিছু। সুন্দর মানুষ।”
দানীনের চোখ ঝলঝল করে ওঠলো। সে তার মাথা থেকে হাত সরিয়ে বললো,
“উনাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না।”
আদিলা বেগম তার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন।
দানীনই বলতে লাগলো,
“আমি বয়স্ক। দেখতে কালো। আমার আগে বিয়ে ভেঙেছে। যার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো তার কাছেও আমি ছিলাম সুন্দর মানুষ। এরপর পেলো আরেক সুন্দর মানুষ।”
আদিলা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“বয়স্ক হয়েও মনে হয় আঠারো বছরের কিশোরী। বাপরে, আর আমরা কুড়িতেই বুড়ি হয়ে যেতাম। ঝাড়ুর দুইদিকে পা ঝুলানো উড়ন্ত ডাইনীর মতো লাগতো।”
দানীন বিহ্বলতার নয়নে তাকালো।
তিনি আরও বললেন,
“আর কালো হলে তো কারও শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসে বলে আমার জানা নেই। একবার কি হয়েছে শোন। আমি যখন কলেজে পড়ি এক ক্লাসমেট ছিলো আমার। এতো ফর্সার ফর্সা! কি আর বলবো! কিন্তু ওই খাটশের নাকি ঘামের গন্ধ অনেক প্রিয় ছিলো।”
দানীন তার কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলে।
“আবার কি হয়েছে শোন। খাটাশটা গোসল করতো না। পারফিউমের গন্ধে পাশে বসা যেতো না। তাই একদিন আমরা কয়েকজন বান্ধবী প্ল্যান করে একে বাথরুমে ধরে নিয়ে যাই। বাসন মাজার মাজনী আর ছাই দিয়ে এমন ডলা দেই। হা হা হা।”
দানীনও জোরে জোরে হাসতে লাগলো। তারা এরপর অনেক্ষণ তাদের স্কুল জীবন নিয়ে নানা হাস্যকর কথা আলোচনা করলো। দানীন যে তার স্যারকে ল্যাঙ মেরে ড্রেনে ফেলে দিয়েছিল তা-ও বললো।
পাশের ঘর থেকে অন্যরা বলছে,
“দেখো দেখো, হাসতে হাসতে মারা যাচ্ছে। আরে কেউ পানি দিয়ে আসো দুজনকে।”
আদিলা বেগম দানীনকে বললো,
“সুন্দর শরীরের মানুষ আর সুন্দর মনের মানুষ এক না। তুই নিজেকে তুচ্ছ করিস বলেই ভাবছিস আমি কারও চোখে সুন্দর হয়েও কেন আবার অসুন্দর হলাম। তুই কারও কথা না ভেবে নিজের কথা ভাব মা। তুই আমার মেয়ের মতো বললে হয়তো বিশ্বাস করবি না। ভাববি ছল-চাতুরী করছি।”
দানীন তার হাত ধরে বললো,
“না আন্টি এরকমটা না। আমি জাস্ট..”
“শুভ্রর বাবাকে বিয়ের সময় এই মনে রেখে কবুল বলেছিলাম যে, কপাল আল্লাহ সংসার রাখলে সংসার না হলে ডিভোর্সী জীবন। আমি কথাটা বললাম এ কারণে যে, আমরা চিন্তাভাবনা করে যেসব সিদ্ধান্ত নেই তা সবসময় সঠিক হয় না। কারণ তাতে ভুল কোনো উপলব্ধি বোধ বা জ্ঞানের কিংবা ভুল কোনো সিদ্ধান্তের মিশ্রণ থাকে। তাই প্রথমে মিশ্রণের পৃথকীকরণ প্রয়োজন।”
দানীন চুপ করে রইলো।
আরেকজন মহিলা এসে শুভ্রর মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“তোমার কথা হয়েছো গো। এবার ছেলে-মেয়েকে একটু আলাদা কথা বলতে দাও।”
দানীন শুভ্রর মায়ের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে ডানে বামে মাথা নাড়তে লাগলো।
উনি হেসে বললেন,
“কথা বলবি না? আচ্ছা, বলিস না। এভাবেও বর্তমানের ওর সঙ্গে আমি সাপে-নেউলে সম্পর্ক পালন করছি। তোর চিঠি দেখে জিগ্যেস করেছিলাম মেয়েটা কে। আমাকে উল্টো জিগ্যেস করে কোন মেয়ে আম্মু।”
চিঠির কথা শুনে দানীন লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো।
দানীনের খালা তাদের খাবার খাওয়ার জন্য নিয়ে গেলো। একটু পর আদ্রিয়ান, ইউসরা আর ফারিহ তার রুমে এলো।
আদ্রিয়ান গদগদ হয়ে বললো,
“ভাব্বি!”
দানীন অন্যদিকে তাকাতে লাগলো।
“ওইদিন আমাকে ভাবি বলার জন্য কি মারটাই না দিলেন।”
ফারিহ অবাক হয়ে বললো,
“কিহ!”
ইউসরা কোমরে হাত রেখে চোখ পাকিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার আপু। তুমি যে জনে জনে মানুষ অত্যাচার শুরু করেছো।একজনের নাক ফাটাও আরেকজনের..”
আদ্রিয়ানের দিকে ফিরে জিগ্যেস করলো,
“স্যার আপনাকে কিভাবে মেরেছে?”
দানীন আদ্রিয়ানকে চোখ রাঙিয়ে বললো,
“আমি আপনাকে মেরেছি স্যার? এটা যদি মিথ্যা হয়ে থাকে তবে আমি কিন্তু ঠিক বাস্তবায়িত করবো।”
আদ্রিয়ান জোরে বলে ওঠলো,
“হ্যাঁ, মা। আসছি।”
আদ্রিয়ান চলে গেলে ইউসরা আর ফারিহ হেসে ওঠলো।
আদ্রিয়ান চট করে আবার এসে দানীনের কোলে একটা কাগজ রেখে গেলো।
ফারিহ চেঁচিয়ে ওঠলো,
“লাভ লেটার।”

বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় আদিলা বেগম দানীনের হাত ধরে বললেন,
“হ্যাঁ, আমি চাই তুই শুভ্রকে বিয়ে কর। প্রথমে চাইতাম কারণ তুই শুভ্রর পছন্দ অনুযায়ী তুই একজন ভালো মানুষ। আর এখন তোকে দেখার পর.. তোকে মেয়ে হিসেবে পাওয়ার লোভ আমি সামলাতে পারছি না।”
দানীন আদিলা বেগমকে জরিয়ে ধরলেন। আটকে রাখা চোখের জল আরেক মায়ের কাঁধে নিঃশব্দে বিসর্জন দিলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here