#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_৪
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
৪.
বাবাকে খোশামুদি করা, মনভোলানো কথাবার্তার এক দীর্ঘ কাহিনী অতিক্রমের শেষে কাজ হলো। বাসাবদল দানীনের জেসমিন ফুফুর ঠিকানা অবধি সীমাবদ্ধ হলো। ভার্সিটির নিকটবর্তী আত্নীয় বলতে জেসমিন ফুফুর বাসাই আছে। অর্থাৎ ফারিহদের বাসা। তারা রূপাতলীর ব্লক ডি’তে ছয় তলা বিল্ডিংয়ের চার তলায় থাকেন। দানীনের বাবা নিজের বোনের কাছে আপাতত মেয়েকে রাখতে সম্মতি প্রদান করেছেন।
কয়েক মাস হয়েছে দানীন তার জেসমিন ফুফু অর্থাৎ, ফারিহদের বাসায় থাকছে।
কিছু মানুষ আছে যাদের নিজ কুঠরির দ্বার থেকে এক পা স্থানান্তরিত হলেই বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে পড়ে। ত্রাসিত, বিরক্ত– উভয় ছঁদেই পরিবেষ্টিত হয়। ‘উপযোজন’ শব্দটি যেনো তাদের কাছে শ্বাসরুদ্ধকর ঠেকে। তবে দানীন এই সমন্বয়সাধনে খুব দক্ষ। নতুন পরিবেশ তাকে বিচলিত করে না। পরিবেশের প্রত্যেক উপাদানের সঙ্গে সে তার চকিত অন্তদৃষ্টির সম্পৃক্ততা ঘটিয়ে এক সতন্ত্র রাজ্যের গঠন দান করে। সবকিছু যেনো নতুন সৌন্দর্যে সূচিত হয়।
মনোরমা তরুণীদের ডাকাডাকির ভোরে অনুজ্বল-নীরস জ্যোতি ছড়িয়ে দেওয়া আকাশ সকলের কাছে স্নিগ্ধকর। কিন্তু দানীনের কাছে আকাশের সেই ধূসরাভ চাহনি প্রেমপরায়ণ ও আবেগপ্রবণ। স্নেহপূর্ণ চাঁদের আলো ক্ষণিক কর্মবিরতির পথে যাত্রা করে বলে ধূসরবর্ণ আকাশ যেনো দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত হয়। সূর্যালোকের রাজাধিকার প্রতিহত করতে অপারদর্শীতা প্রদর্শিত হয় বলে ত্রপায় মূর্ছিত হয় সে। লজ্জায় সে যেনো ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদল করে। তাই তো, ভোর আকাশে আমরা রঙের নানা খেলা দেখতে পাই।
এই যে, বিল্ডিংয়ের সামনের পথ ধরে মানুষ নিরন্তর অতিবাহিত হচ্ছে। কেউ কেউ অবক্র পথ চলার অবকাশে বারান্দা কিংবা জানালায় বিদঘুটে দৃষ্টি দিচ্ছে। বাসার মালিকের জাগরিত দৃষ্টিতে তা ধরা পড়লে নিজের বাসভবন থেকে চেঁচিয়ে মুখঝামটা দিচ্ছে। সেই নির্লজ্জ মানুষগুলোর লজ্জহীন অভিব্যক্তি দেখে দানীন ভারী আশ্চর্য হয়।
কেউবা চারপাশে দৃষ্টি বুলানোর সুযোগও পাচ্ছে না, এগিয়ে যাচ্ছে ব্যস্ত পদক্ষেপে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে। সারাদিন প্রচেষ্টার পর অপরাহ্নে সূর্যালোকের তীব্র আতপকে আকাশমণ্ডল পরাভূত করতে সক্ষম হয়; গগনপটের সেই আনন্দ ও মুচকি হাসি দানীন দুই আঁখিতে তৃপ্তি নিয়ে দেখে।
রাতে কখনো সিঁড়ি ভেঙে ছাঁদে সিমেন্টের খর্খরে আস্তরণে পা ফেললে মিটিমিটি তারার মেলার সঙ্গে সাক্ষাৎ মেলে। মৃদু বা অনুজ্জ্বলভাবে তারারা যেনো বিচারালয়ে আসন নিয়ে রাতের আঁধারে হারিয়ে যাওয়া ঘটনাবলীর বিচার করতে ব্যস্ত থাকে।
এতো এতো রহস্যাবৃত প্রতিবেশ দেখার পর কী অসামঞ্জস্য-সামঞ্জস্য নিয়ে আর চিন্তিত থাকা যায়? আর ফুফু ও ফারিহ’র সঙ্গে সারাদিন খুনসুটি তো আছেই। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকজন ব্যক্তি, ইউসরা।
এই বিল্ডিংয়েই দ্বিতীয় তলায় ইউসরা নামের একটি মেয়ে সপরিবার নিয়ে থাকে। দানীন তার গৃহশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে। অবশ্য ইউসরাই প্রতিদিন চার তলায় এসে দানীনের কর্মভার কমিয়ে দেয়। সে এবার সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে। তার ফুফাতো ভাই ফারিহ এই বয়সে যেমন চঞ্চল ছিলো ইউসরা তেমনই শান্ত, অব্যাকুল ও অনুত্তেজিত। চঞ্চল তো নয়-ই। বরং খুব গম্ভীর। তার সুস্থির কনীনিকা ভেদ করে বিজ্ঞ ব্যক্তির মনোভাব ঘণীভূত হয়ে ওঠে। বিনয়ীপূর্ণ দৃষ্টিতে স্থির থেকে প্রতিবেশের সব নিরীক্ষণ করে। এই বয়সের অন্য বাচ্চাদের তুলনায় তার চিন্তাচেতনা সূক্ষ্ম ও গভীর। এইজন্য দানীন ইউসরাকে খুবই পছন্দ করে।
ইউসরা পড়তে আসলেই ফারিহও বই নিয়ে দানীনের পাশ ঘেঁষে বসে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ফারিহ জীববিজ্ঞান বই বগলদাবা করে টেবিলের ওপর পাশে চেয়ার এনে বসলো।
ফারিহ ইউসরার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলো,
“তো ইউসরা পড়াশোনা ঠিকঠাক চলছে তো?”
ইউসরা তাকে শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। এই ছেলের অহেতুক কথাবার্তা তার মোটেও পছন্দ নয়। খানিক বাদেই এই কথোপকথন তুমুল যুদ্ধে পরিণত হবে।
দানীন ফারিহ’র মাথায় চাটি মেরে বললো,
“তুই আগে তোর পড়াশোনার করুণ অবস্থার উপর বিবৃতি দান কর। রেজাল্টের সঙ্গে তো পড়াশোনা তুলনায় হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। এরকম করলে কী চলবে, হুম?”
দানীনের কথায় ইউসরা দাঁত কেলিয়ে ফারিহকে বললো,
“ফারিহ ভাইয়া, আপনার ফার্স্ট বেঞ্চার হওয়ার জাদুময় রূপকথা সম্পর্কে যদি অবহিত করতেন। না মানে, আপনার সেই জাদুকরী উপাখ্যানের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে পড়ালেখা বিহীন প্রথম হওয়ার অভিযান চালাতাম আর কি।”
ফারিহ কপট কুপিত কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“সায়েন্সের সাবজেক্ট গুলো তো রসগোল্লার মতো। শুধু ঢক ঢক করে গিলতেই মন চায়, তাই না?”
ইউসরা নাক কুঁচকালো। বললো,
“সায়েন্স নিতে কাতুকুতু দিয়েছে কে?”
এরপর দুজন পুরোদমে ঝগড়া শুরু করলো। দানীন এই ঝড়ের পরিবেশ শান্ত করতে উভয়কেই কষে ধমকে ওঠলো।
“দুজন শুধু বেয়াদব না বেয়াদবির সীমানা অতিক্রম করেছিস। ইউসরা তুই বাসায় যা। আর ফারিহ, ইউসরা পড়ার সময় তোকে আমার আশেপাশে টুকুর টুকুর করতে দেখলে দুই গালে চারটা করে থাপ্পড় লাগাবো।”
ইউসরা ফারিহকে ক্রোধিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চেয়ার ছেড়ে ওঠলো।
ইউসরা যাওয়ার পর দানীন ফারিহ’র কান চেপে ধরে বললো,
“এই ছেলে, ইউসরা তোর থেকে ছোট না? ওর সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার না করে সবসময় বিড়ালের মতো খাবল মারতে উদ্যত থাকিস কেন?”
ফারিহ দাঁত কেলিয়ে প্রত্যুত্তরে বললো,
“ওকে জ্বালাতন করতে ভালো লাগে।”
দানীন তার কান ছেড়ে চোখ রাঙিয়ে বললো,
“তোকে যে এতো এতো জ্ঞানের বাণী শুনাই, অহেতুক! তোর থেকে ইউসরাই অনেক ভালো। এইটুকু বয়সে কতো কতো বই পড়ে। ওর একদিনে পরিণীতা শেষ। আর তুই একমাস ধরে প্রথম পৃষ্ঠায় সাঁতার কাটছিস।”
ফারিহ দানীনকে অপাপবিদ্ধ চাহনি উপহার দিয়ে বললো,
“জ্ঞানের থেকে আমার দাঁতের মায়া বেশি কিউটু।”
বলেই দৌড় লাগালো।
দানীন ফারিহ’র দৌঁড়ানোর অঙ্গভঙ্গি ঠাহর করে হেসে ওঠলো। এই ছেলেটি বুঝি আর বড় হবে না।
দানীন একা রুমে তার কৃষ্ণবর্ণ কেশ খোপা থেকে বিচ্ছিন্ন করে পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে দিলো। চেয়ার থেকে উঠে বারান্দায় গেলো।
বারান্দায় রাখা টুলে বসে গ্রিলে বৃদ্ধাঙ্গুল ব্যতিত চারটি আঙুল ঠেকিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। রবির রবিকরের প্রখরতা কমে এসেছে। বাহির থেকে প্রবেশ করা মৃদুমন্দ বায়ু প্রবাহ পুরো শরীরকে বিশ্রাম দিয়ে যাচ্ছে। এমন শান্ত, নিঝুম সময়ে আকস্মিকভাবে, দানীনের চোখ দুটো নিশ্চল হয়ে গেলো। নিবিদ্ধ হলো ঘর্মাক্ত চেহারার কষাটে চাহনির উপর।
রাস্তার অপর পাশে ফারিহদের এই বিল্ডিংয়ের বরাবর যে বিল্ডিংটি অবস্থিত, তার গেইটের সামনে কমলা রঙের টি-শার্ট ও ধূসর রঙের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরিহিত এক শ্যামবর্ণ দাঁড়িয়ে আছে। তার ঘর্মাক্ত চেহারা তার কঠোর শ্রমের ইঙ্গিত।
একজন মধ্যবয়স্ক লোকের সঙ্গে হাত নাড়িয়ে কথা বলছে। কথা বলার অবসরে দুই আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম মুছার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভ্রু কুঁচকে হঠাৎ ছেলেটি উপরে তাকালো। তখনই দানীনের সঙ্গে তার সমক্ষ দৃষ্টি বিনিময় হলো। এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো দানীনের শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে গেছে। সে তাড়াতাড়ি অন্য দিকে তাকালো। খানিক বাদে নিচে তাকিয়ে দেখলো ছেলেটি নেই। দানীন দমে গেলো। হুট কর মন খারাপ হয়ে গেলো। মন খারাপ করে গ্রিলে বাম গাল ঠেকিয়ে ঠোঁট উল্টো করে সামনে তাকিয়ে রইলো। তখনই কিছুক্ষণ আগে দর্শন পাওয়া শ্যামবর্ণের মুখমণ্ডল দৃষ্টিগোচর হলো।
ছেলেটি অপর পাশের বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলার বারান্দায় কয়েকটা বাক্স ঠেলে এঁটে রাখছে। সঙ্গে বাচ্চা বয়সী একটি ছেলে তার সেই ঠেলাঠেলি কাজে সাহায্য করছে। ওই বাচ্চা ছেলেটি চলে গেলেও এই শ্যামবর্ণ রয়ে গেলো। দানীনের উপর দ্ব্যর্থহীন দৃষ্টি স্থাপন করে তার উদ্দেশ্যে মিষ্টি হাসি উপহার দিলো। দানীন প্রথমে চমকে ওঠলো। যখন দেখলো ছেলেটি তখনও একই মুখায়বে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সে এই আকস্মিক সঙ্কেত পর্যবেক্ষণ করে লজ্জায় রাঙা হয়ে দ্রুত বারান্দা ত্যাগ করলো।
(চলবে)