#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_১৭
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
১৭.
দানীন অনেকক্ষণ যাবৎ হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছে। নিজের ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে মুখের সামনে ধরে শূন্যে ঘুষি ছুঁড়ল। স্তম্ভিত হয়ে নিজের বুকে হাত রাখলো। নিজের কর্মকান্ড ও কলিজায় ধারণ করা সাহস দেখে সে নিজেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কাকে না কাকে এই মোরগ ডাকা প্রত্যূষে দৃঢ়মুষ্টির আঘাতে নাক টেপা পুতুলের আকৃতি দিয়ে এসেছে আল্লাহ জানে। আচ্ছা, নাক কী ফেটেছে? ছেলে ধরা গ্রুপের বড় লিডার না তো? উফ ছোকরা-বাকরা হলেও তো হতো। অবশ্য ছোকরা-বাকরা হবে বলে দানীনের মনে হচ্ছে না। দুটো তদ্বিপরীতভাবে যুক্তি চিন্তা করে দানীন দুই ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে।
এক. ছোকরা সম্প্রদায়ের পক্ষে—
ছোকরা-বাকরা ছাড়া বড় লিডার নিজে লাফিয়ে লাফিয়ে কোনো মেয়েকে বস্তায় ভরে বগলদাবা করে তুলে নিতে আসবে না। এতো চর্বি নিশ্চয়ই হয়নি। যা হ্রাসের প্রয়াসে ভোরবেলা মুখ উন্মুক্ত করে মেয়ের পিছনে ছুটবে।
দুই. ছোকরা সম্প্রদায়ের বিপক্ষে(পক্ষে মিশেল)—
এমন মোহনীশক্তির অধিকারী যার এক পলক সময়কালীন হাসিতে চাঁদও হাসবে, সেরকম কেউ ছোকরা-বাকরা হতে পারে না। তাদের হতে হয় কেচুর মতো চিকুন, বিছার মতো খাড়া খাড়া গোফ, কনক্রিটের রাস্তার মতো এবড়োখেবড়ো দাঁত, কানে দুল, হাতে রাবার ব্যান্ড। সর্বপরি বোচা নাক যেই নাকে ঘুষি মারার আগেই মুখের সঙ্গে ল্যাপ্টে থাকে।
দানীন বিছানার কোণা থাকে উঠে চেয়ার টেনে জানালার পাশে এসে বসলো।
চুলোর ঘন ধোঁয়ার মতো কুয়াশার মেঘাচ্ছন্নতা অনেকটা কেটে গেছে। শিশিরের পরম স্পর্শে মসৃণ রাস্তা হালকা ভেজা। যদিও আতপে উত্তপ্ত সূর্যালোক এখনও তার দর্শন দিয়ে কৃতার্থ করেনি, তবুও ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ পরিলক্ষিত। অনেকে মর্নিং ওয়াক শেষে ঘরে ফেরার পথে বোধহয়। দানীনের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো বাউন্ডারির সঙ্গে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা তেতুল গাছে। আস্ত একটা মানুষকে সে কিনা তেতুল গাছের জ্বীন ভেবেছে। তেনা-তুনা বিশেষজ্ঞ জ্বীন! দানীন নিজে নিজে হো হো করে হেসে ওঠলো।
আকস্মিক দুর্বিপাকে পতিত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে নিজের অস্বিত্ব চূর্ণবিচূর্ণ করে যে সত্তাটি আর কখনো হাসবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে, সে আজ হাসছে। হাসলেই বুঝি জনমের মতো দুঃখ পেয়ে অন্ধকার গুহার কারাগারে বন্দী হবে সেই ভয়ে তটস্থ হয়ে নিজের নমনীয় হৃদয়ে কাটাযুক্ত প্রাচীর নির্মাণ করেছে, নিজের দুই কপোল খামচে ধরে হাসি প্রতিরোধ করেছে– আজ সে তার অজান্তেই হাসছে। ঐ তো, ঐ যে সূর্য দেখা যাচ্ছে। অংশুমালীর নমনীয় অরূণ কুয়াশার মাঝে উঁকি দিয়ে বাহ্যিকভাবে সজ্জিত, অভ্যন্তরীণভাবে ছন্নছাড়া মেয়েটির হাসির সাক্ষী হতে নিজের আগমন ঘটাচ্ছে। শিশির ভেজা ঘাস তার অরূণ দ্বারা প্রজ্জ্বলিত করে সবুজে আবৃত লোকালয়কে এই হাসি তাদের দৃশ্যপটে বন্দী করতে তাড়িত করছে। কৃষ্ণকায় তরুণীর পাতলা ওষ্ঠাধর থেকে হাসি হারিয়ে গেলেও যেনো প্রকৃতি থেকে না হারায়। প্রকৃতি যেনো আজকের মতো নিজের উপর দায়িত্ব গ্রহণ করে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে যার হাসি তার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারে। তার জন্যই এই হাসি নিরীক্ষণের এতো তোড়-জোড়।
দানীনের ফোন কেঁপে ওঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দানীন সেইভ করা নামটিতে চোখ বুলালো, ‘AD Sir.’ দানীন ফুস করে নিশ্বাস ছাড়লো। আদ্রিয়ান হলো তার সহ-শিক্ষক। লোকটি যে তাকে অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে আলাদা ও বিশেষ নজরে দেখে তা সে বেশ বুঝতে পারে। তাকে করা নানা কৈফিয়ত ন্যায় প্রশ্নই তা স্পষ্ট জানান দেয়। কিন্তু লোকটি এতো সরল-সোজা, স্বচ্ছ মনের যে কঠিন স্বরে কিছু বলতেও ইচ্ছে করে না। কখনো ভুলবশত ধমকে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের মতো মুখ কালো করে মাথা নিচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার আরেকজন সহকারী শিক্ষিকা শাহানাজ আপা। তার প্রতি আদ্রিয়ানের এই মনোভাবের জন্য সর্বক্ষণ জ্বালাতন করে। দানীনের ধমকে সাময়িকের জন্য চুপসে গেলেও খানিক বাদে পুরোদমে দানীনের কান মুরগি ভাজা করে ছাড়ে। দানীনের তো প্রায়ই মনে হয় যে সে এক অতি রূপবতী রমণী। যার হেতু শাহানাজ নামক মেয়েলি পুরুষের দ্বারা প্রতিনিয়ত ইভ-টিজিংয়ের শিকার হচ্ছে।
দানীন ফোন ধরতেই আদ্রিয়ান মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে কেমন আছো জিগ্যেস করলো। প্রশ্ন শুনেই দানীনের মাথা গরম হয়ে গেলো। গতকালই তো দেখা হলো। তবে আজ জিগ্যেস করে কি প্রমাণ করতে চাইছে? সে রোগাক্রান্ত ব্যক্তি? যে সর্বক্ষণ অসুখের বস্তা নিয়ে বসে থাকে এবং বস্তা থেকে টুক টুক করে অসুখ গিলে খেয়ে অসুস্থতা বাঁধায়? এরপর খাতাপত্র নিয়ে বলাতে দানীনের মাথা আরও গরম হয়ে ওঠে। রাগান্বিত কণ্ঠে আদ্রিয়ানকে কিছুক্ষণ ঝাঁড়লো। আদ্রিয়ান বোধহয় ভয়েই তাড়াহুড়ো করে ফোন কেটে দিয়েছে। ফোন রেখে দানীন নিজের মাথায় দুই-তিনটা মৃদু চাপড় মারলো। ঠান্ডা থাকতে হবে, ঠান্ডা। দরকার হলে পেঙ্গুইনের মতো ফ্রিজে ঢুকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। হুটহাট রেগে যাওয়া শয়তানের লক্ষণ।
দানীন চিন্তাভাবনা ঝেড়ে ব্যাগ গোছাতে শুরু করলো। মায়ের জরুরি তলব পড়েছে। কারণ সম্পর্কে অবগত করেনি, কিন্তু দানীন তা সমন্ধে অবহিত। দানীন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এক সময় ভাবতো মেয়েরা অসহায়, এদের কোনো দাম নেই। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলো এই পৃথিবীতে যারা দুর্বল, অসহায় তাদেরই অপরাধীর কাঠগড়ায় অজানা অপরাধ মাথায় পেতে দাঁড়াতে হয়। এই যে তারা দুর্বল; এটাই হয়তো তাদের অপরাধ। আর নারী-পুরুষ? একটা পুরুষ যখন তার প্রেয়সীর হাত ত্যাগ করে অন্য নারীর হাতে হাত স্থাপন করে; তখন অন্য নারীমূর্তির হাতের উপস্থিতি আছে বলেই ধরার সাহস পায়। মা মরা মেয়েটাকে নানা পুরুষ যখন খামচে-খাবলে খেতে আসে তখন মায়ের পরবর্তী স্থানে রাখা খালা-চাচী-ফুফু-দাদী তারাই মেয়েটির সর্বাঙ্গে শিকল পেঁচিয়ে পিছন থেকে ল্যাং মেরে খুবলে খাওয়া পুরুষদের পায়ের ধারে পতিত করে। কালো মেয়ে, মোটা মেয়ে কিংবা খাটো মেয়ে বিয়ে করা যাবে না, এক্কেবারে নাজায়েয– এই ধারণা একজন পুরুষের ভিতরে গেড়ে দেয় কে! নিজ মা এবং সমাজে বসবাসকারী হাজারো বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ মা। তার অন্তর্গত কারও বোন, রূপবতী বান্ধবী, সৌন্দর্য-সৌষ্ঠবে পরিপূর্ণ আত্নীয়। আর এই শিক্ষা পুরুষ তার অন্তরে ধারণ করে বাস্তবায়িত করে।
নারী-পুরুষ একে-অপরের পরিপূরক। খুব সত্য! তারা একে অপরের পরিপূরক। তবে বিশ্বে যা কিছু ধ্বংসের পথে, নৈরাজকতার করায়ত্ত্বে অর্ধেক তার করেছে নারী, অর্ধেক তার পুরুষ!
দানীন পাতলা একটা শাল গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লো। রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হুট করে আদ্রিয়ান রিকশা করে সামনে এসে থামলো। টি-শার্টের উপর ডেনিম জ্যাকেট। সকালের স্নিগ্ধ, আন্তরিক সূর্যরশ্মি তীর্যকভাবে পড়ায় চুলগুলো লালচে দেখাচ্ছে। মৃদুমন্দ বাতাসে তা মৃদু কাঁপছেও। আদ্রিয়ান রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে দানীনের সামনে হাসি হাসি মুখে দাঁড়ালো।
দানীন ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে জিগ্যেস করলো,
“কি ব্যাপার আদ্রিয়ান স্যার? আপনি এই সময়ে এখানে?”
আদ্রিয়ান লাজুক মুখায়বে লাজুক কণ্ঠে জবাব দিলো,
“না মানে, আপনি দেশের বাড়ি যাচ্ছেন তো, তাই দেখা করতে এলাম।”
লজ্জাবতী লতিকার মুখমণ্ডল ঠাহর করে দানীন কঠিন স্বরে বলে ওঠলো,
“দেশের বাড়ি যাচ্ছি। সাত সমুদ্র, তেরো নদী পাড়ি দিয়ে বনবাস যাচ্ছি না যে আয়োজন করে বিদায় দিতে হবে।”
আদ্রিয়ান মাথা নিচু করে এক হাত দ্বারা আরেক হাতের কব্জি চেপে নিঃশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো।
এরপর দানীন তার কণ্ঠস্বর মৃদু নরম করে বললো,
“এতো কষ্ট করে আসার কোনো দরকার ছিলো না স্যার। আপনি বকশিবাজার থাকেন না? আধা ঘণ্টার পথ অতিক্রম তার উপর এই শীতের সকালে আসার সত্যিই প্রয়োজন ছিলো না। আমি তো কয়েকদিন থেকেই ফেরত আসছি।”
আদ্রিয়ান মিনমিনে গলায় বললো,
“রিকশা দিয়ে আসলে দশ মিনিটের মতো সময় লাগে ম্যাম।”
দানীন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিছু কিছু ব্যক্তি আছে যাই বলা হোক তার প্রত্যুত্তরে কিছু না কিছু বলবেই। এদের মন এতো সহজসরল যে হা, হু’র বাহিরে কিছু বললেই তাদের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। আকামের মাঝু, কদু কুটনের যম।
দানীন আদ্রিয়ানের উপস্থিতি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে খানিক এগিয়ে সিএনজির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। পাঁচ-সাত মিনিট পর একটা সিএনজি সামনে এসে থামলো। দরজা খুলে বেরিয়ে এলো আদ্রিয়ান। দানীন চমকে পাশে তাকালো। এতোক্ষণ যে আদ্রিয়ান তার পাশে অনুপস্থিত ছিলো তা সে খেয়ালই করেনি।
আদ্রিয়ান দানীনের মাঝারি আকারের ট্রলিটা সিএনজিতে তুলতে তুলতে বললো,
“আমিও বরিশাল যাচ্ছি ম্যাম।”
দানীন একটা চিৎকার দিলো,
“কিহ!”
আদ্রিয়ান হেসে বললো,
“ভয় পাবেন না ম্যাম। আমার ভাই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কলা ও মানবিক অনুষদের শিক্ষক। তার ওখানে যাবো আরকি।”
দানীন অবাক কণ্ঠে বললো,
“বাহ! আপনার ভাইও শিক্ষক। তো ঢাকা থেকে বরিশাল? চাইলে তো এখানেই জয়েন করতে পারতো। এখন পরিবার ছেড়ে একা একা থাকতে হচ্ছে। কোথায় থাকে?”
“বিশবিদ্যালয়ের শিক্ষক আবাসিক হলেই থাকে। আমার বরিশাল শহর ঘুরার খুব ইচ্ছে। তাই ভাবলাম এই সুযোগে ভাইয়াকে সঙ্গে করে একটু ঘুরে আসি।”
“ওহ, আচ্ছা। ভালো তো।”
দানীন সিএনজিতে গিয়ে বসলো।
“আচ্ছা ম্যাম। বরিশালে দর্শনীয় স্থানসমূহ কি কি?”
দানীন কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে বলে ওঠলো,
“বরিশালের অন্যান্য জেলার কথা তো বলতে পারবো না। আমি তো বরিশাল জেলার অন্তর্গত এলাকায় থাকি। সেখানে কলসকাঠী, উলানীয়া জমিদার বাড়ি, কসবা মসজিদ, কীর্তনখোলা নদী, দুর্গাসাগর দীঘি। এই দুর্গাসাগর নিয়ে কিন্তু গুজব আছে যে এখানে নানা প্রেতাত্মা ঘুরাফেরা করে। এর পাড়ে নাকি অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে বিচ্ছিরি পন্থায় হত্যা করে দগ্ধ করা হয়েছে। অবশ্য আমি এর সত্যতা জানি না। তবে হ্যাঁ, সাতলা বিল কিন্তু অবশ্যই যাবেন। পুরো বিল জুড়ে পদ্মফুলের সমারোহ। মন চাইবে বিলের উপর বাসস্থান নির্মাণ করে থাকি। সবুজের রাজ্যে গোলাপি বর্ণে রঙ্গিন পদ্মের অনপেখিত প্রবেশ। আর এই সবুজ কণিকার তরূণসম্প্রদায় তাকে সাদরে গ্রহণ করে চলছে যেনো। তারূণ্যপূর্ণে আবৃত গোলাপি আভার সুবিস্তীর্ণ রাজ্য।”
আদ্রিয়ান হাঁ করে তাকিয়ে আছে। দানীন এই প্রথম বোধহয় তার সঙ্গে এতো কথা বললো, তা-ও আবার নিজ থেকে!
আদ্রিয়ানের হতভম্ব দৃষ্টি দেখে দানীনের হুশ এলো। মনে মনে নিজেকে খানিক বকলো, এতো পকর পকর করার কি প্রয়োজন ছিলো। আসলে বরিশাল সম্পর্কিত কিছু জিগ্যেস করলেই সে কথার ঝুড়ি, ডিব্বা, ড্রাম সব নিয়ে বসে। নিজের জন্মস্থান বোধহয় এরকমই। আদরণীয়, সবচেয়ে প্রিয়।
সিএনজি ছাড়ার আগ মুহূর্তে আদ্রিয়ানকে ধন্যবাদ দেবে না দেবে না বলেও কপালে আঙ্গুল বুলিয়ে হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে বলে ওঠলো,
“ধন্যবাদ স্যার। ভালো থাকবেন।”
আদ্রিয়ান প্রত্যুত্তরে শুধু মিষ্টি করে হাসলো।
(চলবে)