#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_১৮
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
১৮.
উঠোনে হাত-পা চতুর্দিকে প্রসারিত করে মাটির চাকলা ছোটো ছোটো আঙ্গুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে। জিহ্বাটা একটু বের করে চাকলাটির সংস্পর্শে আনতেই নাক-মুখ কুঁচকে উঠে বাচ্চাটি। ধূসর রঙের বিভিন্ন আকৃতির মাটির চাকলা সে সংগ্রহ করেছে। এগুলো দেখলে তার ছোট্ট মস্তিষ্ক জানান দেয় কচকচ করে চিবিয়ে গলাধঃকরণ করতে হবে। ঘাড় যতটুকু সম্ভব বাঁকিয়ে সদর দরজায় মায়ের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করে ছোট ছোট দাঁত বের করে কামড় দেবে, ঠিক তখনই কারও আকস্মিক বাধায় সে চমকে ওঠলো। যার ফলে মাটির গুটিগুলো হাত থেকে বিচ্যুত হয়ে তার বসার স্থান থেকে দুই-তিন হাত দূরে গড়িয়ে পড়লো। প্রথমে আতঙ্কিত চোখে তাকালেও মুহূর্তে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠলো।
আদো আদো গলায় ডাকলো,
“ফুপুউ।”
দানীন গালে চুমু খেয়ে বললো,
“আরে আমার দিয়ামণিটা। কেমন আছে আমার দিয়া সোনা? ফুফুর জন্য বসে অপেক্ষা করছিলো বুঝি?”
দিয়া কি বুঝলো কে জানে, কিন্তু দানীনের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে মাথা উপর-নিচ বার কয়েক ঝাঁকিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলো। তখনই দানীনের ভাবি বেরিয়ে আসে।
বিগলিত হেসে বললো,
“আরে দানীন। চলে এসেছো? কেমন আছো? আগের থেকে খানিক ফর্সা হয়েছো দেখছি।”
দানীন অধরে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললো,
“জি ভাবি, ভালো আছি। তুমি ভালো আছো? দিয়াকে এভাবে মাটিতে বসিয়ে রেখেছো কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।”
ভাবী কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
“তোমার ভাইঝিকে ঘরে রাখা যায়? যখন তখন মাটি-পানি নিয়ে বইসা পড়ে।”
“যাইহোক, একটু কষ্ট করে ট্রলিটা ঘরে নিয়ে আসো তো ভাবি। আমি দিয়াকে নিয়ে ঘরে যাচ্ছি।”
“হ্যাঁ, যাও। শুনো, ফারিহ আর ইউসরা আসছে। এখন বোধহয় ছাদে।”
দানীন দিয়াকে কোলে নিয়ে ছাদে গেলো। দিয়া হলো দানীনের ভাই নাকিদের মেয়ে। কিছুদিন বাদে তার পাঁচ বছর পূর্ণ হবে। এই পাঁচ বছরে দানীন কতোবার বাড়ি এসেছে তা ঠিক গুণে বলা যাবে। এই অল্প সংখ্যক সাক্ষাতেই ছোট্ট দিয়া তার ফুফুর জন্য প্রগাঢ় ভালোবাসা অনুভব করে। বাচ্চারা বোধহয় এরকমই। তারা হয় নিষ্কলুষ, নিরঁজন অন্তরের অধিকারী।
ছাদে যেতেই দানীন উচ্ছাসপূর্ণ কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ!”
ইউসরা, ফারিহ দৌড়ে এসে দানীনকে ঝাপটে ধরলো। আর দিয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে সবার মুখের ভঙ্গি বুঝার চেষ্টা করলো।
ফারিহ বিস্ফোরিত গলায় বলে ওঠলো,
“আমার কিউটুটাকে কতোদিন পর দেখছি!”
দানীন হাসলো। এরপর ভ্রু সঙ্কুচিত করে ইউসরার উদ্দেশ্যে বললো,
“ইউসরা আসবি তা তো আগে বলিসনি। তাহলে তো একসঙ্গেই আসতে পারতাম। ঢাকা থেকে কার সঙ্গে এসেছিস? একা একা?”
ইউসরা আয়েশী ভঙ্গিতে দু’হাত উপরে তুলে বললো,
“ইয়েস, একা একা। এখন বড় হয়েছি না। ঢাবির স্টুডেন্ট বলে কথা।”
দানীনও তার মুখায়ব ইউসরার অনুরূপ করে বললো,
“তুমি যেই কলেজে পড়ো, আমি সেই কলেজের প্রফেসর মনা।”
দুজনেই হেসে ওঠলো।
মাঝখানে ফারিহ কৃত্রিম বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,
“ইশশ! একজন ঢাবির স্টুডেন্ট, আরেকজন ঢাবির টিচার বলে আশেপাশের মানুষকে যেনো মেথর মনে হয়। এমন ভাব যেনো গুয়ের টাঙ্কি থেকে দলা দলা গু উত্তোলন করে সামনে এসে হাজির হয়েছি। এই বরিশালের স্যাঁতসেঁতে থুক্কু, ঝরঝরে সুগন্ধ প্রদানকারী মাটিতেই কিন্তু তোমার জন্ম কিউটু।”
দানীন অবাক গলায় জিগ্যেস করলো,
“তোকে কখন মেথর বললাম? মেথর সংশ্লিষ্ট কোনো কথাই তো উচ্চারণ করিনি।”
“অবশ্যই বলেছো।”
এরপর ইউসরাকে পিঞ্চ মেরে বললো,
“নাহলে দিনে চব্বিশ দুই গুণে আটচল্লিশবার ঢাবিতে পড়ি, ঢাবিতে পড়ি বলতো না, হুহ!”
ইউসরা ভেঙচি কেটে বললো,
“যার মনে যা লাফিয়ে উঠে তা। আমাদের তোমায় মেথর বলতে হবে না। কারণ তুমি যে তা, সেটা এভাবেই তোমার মনে খাবৎ করে নাড়া দিয়েছে।”
“এহ! চান্স পেয়েছো তো ভাঁওতাবাজি করে।”
ইউসরা চোখ রাঙিয়ে বললো,
“বেয়াদপস! যা জানে জাঁতা জানে, যে পিষে সেই জানে। তোমার বলতে হবে না। আর কোথাও ঢাবি, আর কোথাও বরিশাল। হুর!”
দানীন দিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে অলস ভঙ্গিতে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ালো।
“দুই ছাগলকে ধাক্কা মেরে এক্ষণই ছাদ থেকে ফেলে দেবো। ভার্সিটি পলিথিন দ্বারা মুড়িয়ে, নিম পাতা ছেঁচে তার রসের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়াবো। জলহস্তী-সজারুর মতো সারাদিন ঠুকাঠুকি লেগে থাকতেই হবে!”
ফারিহ কাদো কাদো স্বরে বললো,
“আমাকে কেউ ভালোবাসে না, কেউ না।”
এরপর দিয়াকে টেনে তার নিকটে এনে বললো,
“তুমি আমাকে ভালোবাসবে, ঠিক আছে দিয়ামণি?”
ইউসরা উল্টো দিয়াকে টেনে তার কাছে এনে বললো,
“দিয়া তুমি না আমাকে ভালোবাসো? হ্যাঁ বলো, হ্যাঁ বলো।”
বাচ্চাটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দুজন থেকে হাত ছুটিয়ে দানীনের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। পিছনে থেকে সচকিত দৃষ্টিতে মাথা খানিক বের করে উঁকি দিলো। দানীনের উদ্দেশ্যে আশ্চর্যান্বিত গলায় বললো,
“ফুপুউ!”
আচমকা পুরোনো কাদাটে স্মৃতির এক টুকরো পরিত্যক্ত অবস্থাতেই দানীনের মস্তিষ্কে টুং করে আওয়াজ তুললো। এরকম ঘটনা যেনো এর আগেও ঘটেছে। বাচ্চাটির নাম মনে করার চেষ্টা করলো। মুগ্ধ বোধহয়..
“কিউটু চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি।”
দানীন আনমনে জবাব দিলো,
“হু।”
“কি হু? কোথায় যাবে?”
ইউসরা বললো,
“চলো আমতলা পার্কে যাই।”
দানীন ধ্যান থেকে বেরিয়ে বললো,
“এখনই? কাল যাস না হয়।”
“না, আজকে চলো। আজকের আবহাওয়াটা কতো সুন্দর। একটু সবুজের সংস্পর্শে গিয়ে আরও গভীরভাবে পরিবেশটা উপভোগ করে আসি।”
ফারিহ বললো,
“আজ থাক। কালই যাবো ইউসরা। কিউটু অনেকখানি পথ জার্নি করে এসেছে। আজ বরং রেস্ট নিক।”
“আরে রেস্টের জন্য না। এখনও তো মা-বাবার সঙ্গে দেখাই হলো না।”
“মামা-মামী তো পারিশা আপুর বাড়ি গেছে। আপুকে বোধহয় বাসায় নিয়ে আসবে। তারা ভেবেছে তোমার বোধহয় আসতে আরও দেরি হবে। কতোদিন পর আসলে বলো তো। প্রায় দেড় বছর পর।”
দানীন নিঃশব্দে হাসলো। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো কালকেই ঘুরতে বের হবে।
(চলবে)