#শুভ্রময়_পুরঁজন
পর্ব_২০
লেখনী: মাহরুশ মুতাদায়্যিনাত মুক্তা
২০.
দানীন পরীক্ষার পেপার্স মার্কিং করছিলো। ফারিহ পাশে বসে বসে রীতিমতো তার মাথা খেয়ে ফেলছে।
নিজের ফোনে চোখ বুলিয়ে ফারিহ বলে ওঠে,
“বলো না কিউটু। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে সবচেয়ে আপন ভাবো। তোমার সব কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করো। তবে আজ এই কি দৃশ্য দেখছি আমি?”
ফারিহ’র কাঁদো কাঁদো চেহারার দিকে তাকিয়ে দানীন নিঃশ্বাস ফেললো।
গতকাল তেনাতুনা বিশেষজ্ঞ বাবা থেকে দৌঁড়ে চলে আসার পর বাঁধে আরেক বিপত্তি। যে মেয়েগুলোকে দানীন নুইয়ে চুঁইয়ে জ্বীন বাবাজির সামনে পড়ে যেতে দেখেছিলো তারা ছুটে দানীনের কাছে আসে। এসেই গলায় পড়ে বিলাপ।
“এই কি হলো বোন, তোমার এতো সুন্দর জীবনটা ওই গুন্ডাটা শেষ করে দিলো!”
আরেকজন হেঁচকি তুলতে তুলতে বলছে,
“আমি ওই গুন্ডাটার উপর ক্রাশ খেয়ে ছিলাম। ছিঃ! আর শয়তানটার বদনজর তোমার উপর পড়েছে। তোমার সুন্দর চেহারা দেখে তোমাকে বাগিয়ে আনতে চায়।”
ফারিহ আর ইউসরা হতবিহ্বল হয়ে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। তারা হতবুদ্ধি আরও বেশি হচ্ছে কারণ দানীন দুঃখদায়ক চাহনি দ্বারা মেয়েগুলোর মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
শেষেরজন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“তুমি ওই ছেলেটার সঙ্গে কী সত্যি..”
কথা শেষ না করে বড় বড় ঢোঁক গিলতে লাগলো।
“প্লিজ ওই ছেলেটার সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিও না। যতোই সুদর্শন হোক, ধলা চেহারা দেখে ফাঁদে পড়ো না।”
ইউসরা ভ্রু কুঁচকে ফিসফিস করে বলে ওঠলো,
“ছেলে! কোন ছেলে, কার ছেলে?”
ফারিহ দানীনের দিকে তাকিয়ে দেখেই উত্তর দিলো,
“আমার বউ থাকলে বলতাম আমার ছেলে। এখনও বলতে পারি, তবে তা অবৈধ হয়ে যায়।”
ইউসরা ফারিহ’র বাহুতে জোরে আঘাত করলো,
“তোমার সবসময় বাজে কথা।”
এদিকে দানীন মেয়েদের স্বান্তনা দিতে দিতে বলছে,
“এই ছেলে সবার দিকে নজর দেয় না। আমরা যেসব মেয়েরা সাজগোজ করে, কোমর দুলিয়ে হাঁটি শুধু তাদেরই তুলে নিয়ে যায়।”
তারা আঁতকে ওঠলো। একজন ভয়ার্ত গলায় জিগ্যেস করলো,
“কিন্তু তোমার তো নাক আর চোখ ছাড়া রীতিমতো কিছুই দেখা যাচ্ছে না।”
দানীন মাথা নিচু করে চোখ মুছতে মুছতে বললো,
“আমিও কিছুদিন আগে তোমার মতোই ছিলাম।”
মাথা তুলে দুই হাত প্রসারিত করে বললো,
“আমার চুল ছিল এত্তো বড়। চুল ছেড়ে মাথা পেন্ডুলামের মতো নাড়তে নাড়তে যেতাম, খিলখিল করে বত্রিশ দাঁত বের করে হাসতাম। হাসির জন্য গায়ের ওড়না পড়ে যেতো। আর একদিন..”
“আর একদিন?”
“একদিন সেই ওড়না গুন্ডার ঘড়িতে গিয়ে আটকালো। তখন থেকেই আমার ওড়নার মতো আমাকেও সে আটকাতে চায়।”
ফারিহ আর ইউসরা আঁতকে ওঠলো। ইউসরা চাপা গলায় বললো,
“এসব কি শুনছি আমি? এতোক্ষণ সুন্দর জীবন সুদর্শন গুন্ডা দ্বারা নষ্ট হলো। এখন আবার ওড়না-ঘড়ির মিলন ঘটলো।”
ফারিহ প্রত্যুত্তরে গলা নামিয়ে বললো,
“এবার বিয়েশাদি সম্পন্ন না হলেই বাঁচি।”
মেয়ে তিনজন তাদের ওড়না প্রসারিত করে নিজেদের ভালো মতো ঢেকে নিলো।
দানীন সহানুভূতি প্রকাশ করে বললো,
“তোমরা নিজেদের খেয়াল রেখো। আমার যা হওয়ার হয়েছে। আমি চাই না আমার আর কোনো বোনের একই অবস্থা হোক। তোমরা কী আর কখনো এভাবে বুক ফুলিয়ে, কোমর নাচিয়ে হাসবে?”
“না, না, না।”
“দাঁতে লেগে থাকা গোবরের মতো কালো লিপস্টিক দেখিয়ে হাসবে?”
“না, না, না।”
একজন বললো,
“আমরা এখন তো বড় জামাকাপড় পরা ছাড়া বেরই হবো না। সবসময় মাথায় হিজাব থাকবে।”
তখন থেকে শুরু হয়েছে ইউসরা ও ফারিহ’র সুদর্শন গুন্ডা বের করার অভিযাত্রা।
দানীন পাশ ফিরে ফারিহকে ধমক দিতে গিয়ে দেখলো সে ইউসরাকে টেক্সট করছে। ইউসরা লিখলো, ‘আপুকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করো। দরকার হলে হারপিক খেয়ে আত্মহত্যার হুমকি দাও।’
দানীন ফারিহ’র মাথায় জোরে চাপড় মারলো। ফারিহ লাফিয়ে ওঠলো।
“যা ওঠ, এখনই হারপিক খাবি। এরপর খাবি মুরগির গু। পরে চ্যাপ্টা করে ফ্লোরে শুইয়ে তোর পেটে আমি হাইডোক্লোরিক এসিড ঢালবো।”
ফারিহ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
“মানুষের গোপন কথা পড়া ভালো না কিউটু।”
দানীন চোখ পাকিয়ে বললো,
আচ্ছা,
“তাই না? তাহলে আমার গোপন খবর জানতে চাইছিস কেন? দাঁড়া তোকে!”
ফারিহ দৌঁড়ে পালালো।
তখন তার মা এক কাপ কফি নিয়ে তার ঘরে প্রবেশ করলেন। কফির কাপ শব্দ সহিত রেখে, কাশি দিয়ে দানীনের পাশে গিয়ে বসলো।
“কিছু বলবে মা?”
“না। তুই কী কাম হরছ?”
“খাতা দেখছি মা।”
“পারিশা তোরে দেখবার চাইছিলো। কিন্তু শশুরবাড়ির মাইনষেরা তো আইতেই দিলো না।”
“পারিশার কয় মাস চলছে?”
“আট মাস। জামাই তো ওরে এককালে চোহে হারায়। এতো যত্ন করে। তাই তো আইতে দেয় না। ডেইট হওনের পনরো দিন আগেই নিয়া আমু।”
দানীন মৃদু হেসে বললো,
“পারিশার ছেলেটা যা দুষ্ট হয়েছে। এলেই দিয়ার সঙ্গে মারামারি লেগে থাকে। অথচ ভাইয়ার ছেলেমেয়েদের বৈশিষ্ট্য হওয়ার কথা ছিলো পারিশার ছেলের মতো; পারিশার ছেলেমেয়ে দিয়ার মতো। ভাইবোনের আন্ডাবাচ্চারা বৈশিষ্ট্য ক্রিস-ক্রস করে কিভাবে পেলো বলো তো?”
দিলরুবা খাতুন কোমল কণ্ঠে বললেন,
“তোরারও তো এমন একখান সংসার দরহার মা। আর কয়দিন একলা থাকবা? মা-বাপ ব্যবাক্কে তো আর হারাজীবন থাকুম না।”
দানীন পেপার্সের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই জবাব দিলো,
“আমি তো মা-বাবার ঘাড়ে বসে অন্য ধ্বংস করছি না মা। তাহলে কিসের ভয় দেখাচ্ছো?”
“এম্মায় কস কেন মা। সব কাল কী মাইনষের ভালা যায়? বিপদ আছে, দুঃখ আছে; এরপরেই তো সুখ আছে। দুনিয়ার সব মানুষও তো মানুষ না। নাইলে শয়তান, জানোয়ারের দল হইবো কারা? শয়তান, জানোয়ারগো কর্মের বাধা দেওনের লাইগা তাগো তৈরি করা কষ্ট, বিপদ-আপদ পাড়ি দিয়া আমরার সুখী থাকন লাগবো। মোরা সুখী থাকলে তারা জ্বলবো। আমরা সুখী থাকলে শান্ত মনে, শান্ত মগজে আল্লাহর ইবাদত হরবার পারুম। তইলে ইহকালেও সুখ, পরকালেও সুখ। শয়তান, জানোয়ার যারা যেই সুখ লইয়া আছে তা তো আসল সুখ নারে মা। তারা গোলকধাঁধায় ঘূর্ণায়মান। তারা বিপথগামী, চোখ থাকতেও আন্ধা, মগজ থাকতেও প্রতিবন্ধী। তাগো সুখ যেমন প্রকৃত সুখ না, তেমন তাগো দেওয়া দুঃখও প্রকৃত দুঃখ না। তারা আগুনের পুহিরে, জাহান্নামের নদীত হাতোর পাইরা হাসতে পারলে মোরা কেরে তাগো পায়ের জ্বলনী নিজেগো গায়ে লাগাবো ক? তুই মানুষ। তুই মানুষ হইয়া মানুষের লগে চলবি, মানুষ দুঃখ দিলে কেবল তাইলেই দুঃখ পাবি!”
দানীন খাতাগুলো সরিয়ে মায়ের কোলে মাথা রাখলো। অশ্রুমোচন কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“আমার কেন প্রথমে মানুষের সঙ্গে দেখা হলো না মা? কেন শয়তান, জানোয়ারের সঙ্গেই সাক্ষাৎ হলো?”
দিলরুবা খাতুন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“যতোদিন যাইতাছে দুনিয়াত ততো মানুষের বিলুপ্তি ঘটতাছে। সৃষ্টিকর্তার সুন্দর দুইন্নাতে যখন খারাপ কামে, খারাপ মাইনষে ভরবো তখন সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টি জগৎ গুটাইয়া নিবেন। মোরা তো ভালা। মোরা ভালা আছি হেই লাইগাই তো সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিজগৎ এহনও আছে। সৃষ্টিকর্তার যত্ন কইরা বাইন্ধান্না জগতে বেজন্মা, জানোয়ার ঢুইকা পড়তে পারলে আমহার লগে তাগো সাক্ষাৎও অতি সামাইন্য ব্যাপার। আমহারার বুদ্ধি-বিবেক নাই? এই বুদ্ধি দিয়া শয়তান চিন্না তার থেইকা দূরে অবস্থান কইরা ভালোর সন্ধানে ধাবিত হইমু। তবেই তো আমহারার ভালা মানুষের জীবন সার্থক। তুই কেন এহনও ঐ পোলার লেইগা নিজেরে কষ্ট দিতাছোছ? কষ্ট পাবি মানুষ কষ্ট দিলে। তাইলে তো তুই মানুষ থেইকা জন্তু-জানোয়াররে বেশি তাগাদ দিতাছোছ। এতে তো সৃষ্টিকর্তার থেইকা দূরে সইরা গিয়া ঐ জানোয়ারগো পথের সঙ্গী হইতাছোছ। খারাপ মানুষগো জিতাই দিতাছোছ, আর ভালা মানুষরে হারাইবার দেস।”
দানীনের হৃদয়টা জুড়িয়ে যাচ্ছে। মা যখন তাকে এই বয়সেও নানা উপদেশ দেয় তখন তার খুব ভালো লাগে। সেই সঙ্গে অজানা ভয়ও মাথায় গেঁথে বসে। ধীরে ধীরে যখন প্রসঙ্গ বিয়ের দিকে যাবে তখনই মায়ের কথা শুনতে তার আর ভালো লাগবে না। একসময় খারাপ মানুষের সান্নিধ্যে ছিলো। দ্বিতীয়বারও যে ভালো মানুষের বদলে খারাপ মানুষের সংস্পর্শে আসবে না তার কি নিশ্চয়তা! সে বিয়ে করবে না মানে করবে না!
দিলরুবা খাতুন মেয়ের গালে হাত বুলিয়ে বললো,
“একখান ভালা পোলা দেইখা বিয়া হইরা ফেল মা। এম্মায় আর কতো নিজেরে দুঃখু দিবি?”
দানীন উঠে বসে উচ্চস্বরে বললো,
“না মা আমি বিয়ে করবো না। এই বিয়ে সম্পর্কিত কোনো কথা আমাকে আর বলবে না।”
তখনই ঘরে দানীনের ভাই নাকিদ প্রবেশ করলো।
“বিয়ে করবি না মানে? ভাইবোনের ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে। আর তুই এখনও অবিবাহিত। তোর ছোট বোনের ছয় বছরের ছেলে আছে। আর তুই এখনও বাবা-মার কোলে বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি মেরে আছিস।”
দানীন নিশ্চুপ রইলো।
নাকিদ এরপর মায়ের দিকে ফিরে বললো,
“আমার একটা পরিচিত ছেলে আছে। দানীনের কথা বলেছি। কোনো দাবি নেই। এক কাপড়েই মেয়েকে তুলে নিতে চায়।”
দিলরুবা খাতুনের চোখ ঝলমল করে ওঠলো।
আনন্দে খাবি খাওয়ার মতো করে জিগ্যেস করলো,
“পোলা কিয়ারে?”
“পনেরো বছর ধরে বিদেশ থাকে। আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো। ছয় মাসেই ডিভোর্স হয়। আগের বউয়ের স্বভাব-চরিত্র নাকি ভালো ছিলো না। ছেলেদের আর্থিক অবস্থা কিন্তু অনেক ভালো মা। পুরো এলাকায়..”
বাক্যের ইতি টানার পূর্বেই দিলরুবা খাতুন গর্জন করে ওঠলো,
“তুই এতো জানোয়ার কেম্মায় হইলি নাকিদ! আগে বিয়া হইছে ঐ পোলার কাছে বোইনের বিয়া দিতে চাস!”
নাকিদ যেনো খুব বিরক্ত হলো।
“আশ্চর্য! তোমার মেয়ের বয়স কতো? সাতাশ শেষ হয়ে আটাশ হতে চললো। কোনো ছেলে যে ওকে বিয়ে করতে চাইছে তাই তো অনেক। তোমার মেয়ে চাকরি করে সাবলম্বী হতে গেছে। মেয়েদের সাবলম্বী দিয়ে কী জীবন চলে? শারীরিকভাবেও নানা কিছুর কারণে ছেলেরা কালো মেয়ে বিয়ে করলেও বয়স্ক মেয়ে পায়ে পড়ে থাকলেও বিয়ে করে না। তোমার মেয়ের কপাল ভালো যে অন্তত কেউ বিয়ে করতে চাইছে।”
“দানীন ইচ্ছা কইরা দূর শহরে একা একা পইড়া চাকরি করে? এই তোর মতো জানোয়ারের জন্য। পরে কইতি তোর অন্ন ধ্বংস করতাছে। এখন যেমন টাকার লোভে বিয়াইত্তা পোলার কাছে বোইনের সাঙ্গা দিতে চাইতাছোছ, তখন টাকার লেইগা বোইনেরে বেইচা দিতি!”
“একদম উল্টোপাল্টা কথা বলবে না মা! তোমার মেয়ে বয়স্ক। আবার কালো। কে বিয়ে করবে একে? এসেছিলো না একজন বিয়ে করতে? কয়দিন নাচিয়ে সেই তো চলেই গেলো।”
সঙ্গে সঙ্গে নাকিদের গালে থাপ্পড় পড়লো। থাপ্পড়টা মেরেছে দানীনের বাবা। তার মা-ও তিন-চারটা থাপ্পড় মারলো।
“তোর মতো বেজন্মা পেটে ধরে আমি আমার গর্ভরেই কলঙ্ক করলাম। তুই তো বুঝ! সব বুঝোছ। বোইনের শইল কালা না? এডা তো ওর দোষ, ওয় নিজে কালা অইছে। এহন সাদা করনের তরিকা ক জানোয়ার! সাদা কর!”
বলেই নাকিদকে এলোপাতাড়ি মারতে লাগলো।
“হুন নাকিদ। আমার মতো মায়ের গর্ভে তোর মতো কিছু জন্তু-জানোয়ার জন্ম নেয় দেইখাই আমার মাইয়ার মতো মাইয়াগো বিয়া না কইরা মা-বাবারে ছাইড়া একলা একলা দূর দেশে থাকন লাগে। তোরা ইজ্জত লইয়া পেট চালাইতেও দিবি না।”
দানীনের হাত টেনে সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,
“তোরে এট্টু আগে শয়তান, জানোয়ারের কথা কইতাছিলাম না। এই দেখ সাক্ষাৎ জানোয়ার! এই দেখ সাক্ষাৎ শয়তান!”
“কালা কালা করতে করতে দুচ্ছাই দুচ্ছাই করবি। পরে কচি বাচ্চা থেইকা বুড়ি হইলে তাগোরে নর্দমায় ছুইড়া ফেলবি। তোগো মতো কুত্তার জন্য বাপ-মা ছোড ছোড মাইয়াগো চারজনের বাপের বেডাগো গলায় মাইয়া বাইন্ধা দেয়। নাইলে তো তোরা ডেগা ছেরি ছাড়া সাঙ্গা করবি না। তখন আবার হারাজীবন আবিয়াত্তা থাকন লাগবো! এইরাম মনোভাবের জন্য আইজ তোর বোইনেরেও ছাড়লি না! মইরা যাস না কেরে তুই!”
দানীনের বাবা নাইমোল্লাহ সাহেব শান্ত স্বরে বললেন,
“নাকিদরে তোরও মাইয়া আছে। তোর মাইয়ার চামড়া ধলা দেইখাই যে বেডারা নিয়া যাইবো এমন গ্যারান্টি দিতে পারবি না। বোইন তো তোর চোখের বিষ। সম্পত্তির ব্যাপার আছে না? তাই তো বোইনেরে বিয়াইত্তা বেডার কাছে বেচতেও দুইবার ভাবোস না। কিন্তু নিজের মাইয়ার বেলা? কখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে আমরা কেউ-ই জানি না নাকিদ। অভিশাপ নারে অভিশাপ না। কিন্তু আল্লাহ তোগো মতো কুলাঙ্গারের অহংকার মাডিতে মিশানোর লেইগা হইলেও নানা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়া নেয়। যাতে তোরা মানুষ হোস।”
নাকিদ এবার রাগান্বিত কণ্ঠে বলে ওঠলো,
“তোমরাই তো আমাকে এসব শিখিয়েছো!”
দুই জোড়া হতভম্ব চোখ তার মুখমণ্ডলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।
“তোমরাই তো দানীনকে ওর গায়ের রঙের জন্য সারা দিন-রাত কথা শুনাতে। আমাকে যেই অভিশাপ দিচ্ছো সেই অভিশাপ দানীনকে দিতে। আমি, পারিশা যেনো ওর ধারে না ঘেঁষি তা আড়ালে নির্দেশ দিতে। কি দিতে না? কৃষ্ণকায় রঙের অধিকারী হলে সে পাপী, বয়স্ক মেয়েদের বিয়ে করা নাজায়েয এসব তুমিই শিখিয়েছো মা। এখন বিয়াইত্তা লোকের কথা আমি বললাম বলে আমার শিক্ষা, জাত সব নিয়ে প্রশ্ন ওঠছে। কিন্তু দানীন প্রতিবার বাড়িতে এলে ওকে বিয়ে নিয়ে নানা কথা শুনায় কে! বাহিরের মানুষ তো জানে না। আপাত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে তোমাদের সুখের সংসার। দানীনকে ঘিরে তোমার আর বাবার মধ্যে বিচ্ছিরি ঝগড়া কে ঘটায়? পড়ালেখা না? দানীনের চাকরি নিয়ে আজকে গর্ব করছো। কালো মেয়ে, ঘরের কাজকর্ম না করে পড়াশোনা করতো বলে কতো কটুক্তি করেছো যা কোনো মায়ের ঠোঁট থেকে কখনো নির্গত হতে পারে না। এসব তো আড়ালে ঘটেছে, তাই তুমি মা হিসেবে সেরা। একটু আগে বললে না তোমার মতো মায়ের গর্ভে আমার মতো কুলাঙ্গার জন্মানোর কথা? তোমার মতো মা আছে বলেই ঘরের মেয়েকে ঘরের পুরুষ সম্মান করতে পারে না। দানীন আমার বোন, পারিশাও আমার বোন। বোনের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি যদি হয়েও থাকে তা তোমাদের মতো শ্রেষ্ঠ মা-বাবার জন্যই হয়েছে। বেঁচার কথা বলছো না? দানীনের আজ চাকরি না থাকলে দেখা যেতো। নিজের পেট চালানোর ক্ষমতা না থাকলে দেখা যেতো কে আপন কে পর! মনোভাব, চিন্তাচেতনা তোমরাই নষ্ট করো। গোড়াতেই গলদ করে পরবর্তীতে নীতি বাণী শুনিয়ে মানুষ করতে চাও! হুহ!”
নাকিদ রুম থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হওয়ার পূর্বে থামলো। দরজার নিকট থেকে বলে ওঠলো,
“তোমরা যে দানীনকে বিবাহিত পুরুষের কাছে বিয়ে দিতে অসম্মতি প্রদান করেছো তাতে আমি সত্যিই বিস্মিত এবং খুশি। কিন্তু দেখবো এই খুশির রেশ কতোদিন থাকে। কয়দিন পর তোমরাই না ওকে মেরে-ধরে যার তার গলায় গছিয়ে দাও।”
দিলরুবা খাতুন ধপাস করে ফ্লোরে বসে পড়লেন। তার স্বামী নাইমোল্লাহ এগিয়ে এসে তাকে সামলানোর চেষ্টা করলেন। দানীন এলো না। মায়ের থেকে খানিক দূরত্বে সে-ও ফ্লোরে বসে পড়লো।
দিলরুবা খাতুন একবার মেয়ের বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন।
“দেখছেন? নাকিদ বুইঝা ফালায়ছে!”
নাইমোল্লাহ সাহেব অসহায় দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
দিলরুবা খাতুন কান্নায় কম্পিত কণ্ঠে বলতে থাকলেন,
“সবসময় এই ডরে থাকতাম। ছেলেকে সুশিক্ষা দিতে পারি নাই এইডার জন্য যদি আমার কাছ থেইকা কৈফিয়ত চায় তখন কি কমু! আড়ালে খবর তো কেউ-ই জানে না। বাহিরে নানা মানুষের লগে চলাফেরা কইরা ঘরে আইসা আমার লগে বাজাইতেন। মাইনষে আপনার মাইয়ারা কালা কয় তখন আমি কেরে জন্ম দিলাম তা নিয়া আমার বাপ-মা তুইল্লা গালি দিতেন। আপনার মানসিক অত্যাচারের সব রেশ ঝাড়তাম আমার মাইয়াডার উপর। আপনি আমারে শিখায় দিতেন পারিশা, নাকিদরে দানীনের কাছে যাইতে না দিতে। তিন সন্তানের মা হইয়াও আপনি দাসী ভাইবা হুকুম দিতেন আর আমি তা আপনার মন রাজি-খুশি করনের লাইগা পালন করতাম। এই দানীন! আমার সোনার টুকরা মানিক। এ যখন জন্ম নিলো তখন আমি এতো খুশি হইছিলাম! সবসময় থেইকা আমার একটা বেটি সন্তানের শখ আছিলো। দানীন পেটে আওয়ার আগেই আমি আমার বেটি সন্তান নিয়া কতো সুন্দর স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু এখন দেহেন! সবার কাছে আপনি ভালা, আদর্শ পিতা। দানীনরে জিগান। হেয়ও কইবো। খালি মা হইয়া বিপদ আমার। একজনের স্ত্রী হইয়া দুনিয়ার জালা আমার!”
নাইমোল্লাহ সাহেবের দৃষ্টি ফেটে বর্ষণ নামতে চাইছে। ভিতরটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে এই দেহযষ্টি মাটিতে লুটিয়ে পড়তে চাইছে।
টগবগে যুবক থাকাকালীন বিয়ে হয়েছিলো তার। নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা রেখে বাহিরের বন্ধুমহলের কথায় বেশি গুরুত্ব আরোপ করতেন। কৃষ্ণবর্ণ সমাজের চোখে হেয়– তা সূক্ষ্ম ধারণা ছিলো তার মস্তিষ্কে। দানীন জন্মানোর পর সেই কথাটা প্রতিবেশের মানুষজন, বন্ধুরা মাথায় যেনো সুই দিয়ে সেলাই করে দিয়েছিলো। ছোট্ট দানীন হয়ে উঠেছিলো তার চক্ষুশূল। অথচ এই মেয়েই তাকে আলোর পথে পরিচালিত করে, সুন্দর জীবনের দিকে অগ্রসর হতে উদ্যত করে। তার এই ছোট্ট মেয়েটি! সন্তানের ভালো থাকা যে জীবনের সবকিছুর ঊর্ধ্বে তা এই কৃষ্ণবর্ণ মেয়েটি জন্ম না দিলে উপলব্ধিই হতো না। নাকিদ, পারিশাকেও তো ভালোবাসতো। কিন্তু তারা সমাজের চোখে সুন্দর ছিলো বলেই তিনিও সেই সঙ্গে প্রবাহিত হয়েছিলেন। সন্তানের কষ্টে জর্জরিত হয়ে তার দুঃখে নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে শুদ্ধতম অন্তরে সন্তানকে ভালোবাসা তো এই মেয়েটির কাছেই শিখেছেন।
পূর্বের মূর্খতার কারণে আজ সে সন্তানসহ স্ত্রীর কাছেও অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে।
(চলবে)