জিদ_অনুভূতির_অন্য_এক_স্তর #পর্ব_২৬ +২৭

0
505

#জিদ_অনুভূতির_অন্য_এক_স্তর
#পর্ব_২৬ +২৭
#লেখিকা : #Kaynat_Ash

পরদিন বিকেলের দিকে আইজা বাগানে হাঁটতে বের হয়েছিল। হাঁটার এক পর্যায়ে সে দেখতে পায় তিশা বাগানের বেঞ্চে বসে কাঁদছে। সে বেশ অবাক এবং কিছুটা চিন্তিত হয়ে তিশার কাছে এগিয়ে গেল।

তিশার পাশে বসে সে তাকে জিজ্ঞেস করে “কি ব্যাপার, তিশা, তুমি এখানে এভাবে বসে…‌।

কি হয়েছে?! কিছু ঘটে থাকলে, তুমি আমার সাথে শেয়ার করতে পারো।”

তিশা আইজার দুই হাত চেপে ধরে বলল “আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না, এই বিষয়ে কার সাথে শেয়ার করব?! কিন্তু আমি জানি, তোমার সাথে যেকোনো কিছু শেয়ার করা যায়, আমি জানি, তুমি কতটা বিশ্বাসযোগ্য।”

এরপর একটু থেমে দম নিয়ে বলল “আমি তিথির ব্যাপারে খুব চিন্তিত। আসলে ব্যাপারটি হচ্ছে, তিথির আর রাজিবের লাভ এ্যাফেয়ার ছিল। কিন্তু রাজিবের স্বভাব চরিত্র কেমন, তা তো তোমার অজানা নয়। এছাড়া তুমি হয়তো জানো না, সে ড্রাগসও সেবন করে।

তুমিই বলো, এতকিছুর পরও এই রিলেশেন কন্টিনিউ করা কি তিথির পক্ষে সম্ভব ছিল?!
এছাড়া সে এটাও উপলব্ধি করতে পারে, এই সম্পর্কে জড়ানোটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এজন্যই সে রাজিবকে ছেড়ে দেয়।

কিন্তু রাজিব তাকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছিল, আর তিথির এভাবে তাকে ডাম্প করাটা সে মেনে নিতে পারে নি।

সে এখন তিথিকে ব্ল্যাকমেইল করছে। এই বলে যে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা গিয়ে বাবাকে জানিয়ে দিবে। এই বিষয়ে প্রুফ হিসেবে সে রিলেশেনে থাকা অবস্থায় তাদের একসাথে তুলা কিছু পিক, যা তার কাছে আছে, সেগুলো ব্যবহার করছে।

তুমিই বলো, বাবা যদি এসব জানতে পারে, কি ঘটবে?! তুমি তো জানোই, উনার হার্টে সমস্যা আছে, তিনি এসব নিতে পারবেন না।”

আইজা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল এসব শুনে। সে বলল “তিথির রিলেশেন ছিল তা-ও কিনা রাজিবের মত একটা ছেলের সাথে?! এটা কীভাবে সম্ভব, আর আমরা কেউ এই বিষয়ে কখনো জানতে পারি নি কীভাবে?!”

তিশা বলল “কেন, তোমার আর আমানের রিলেশেন ছিল, এই বিষয়েও তো আমরা কেউ কখনো জানতে পারি নি। তোমার ক্ষেত্রে এটা সম্ভব হলে তিথির ক্ষেত্রেও একই।”

এরপর একটু থেমে মিনতি ভরা কন্ঠে বলতে লাগলো “প্লিজ আইজা, এখন তুমি-ই আমাদের সাহায্য করো। নাহলে রাজিব এভাবেই ব্ল্যাকমেইল করে তিথির পুরো জীবন জাহান্নাম বানিয়ে দিচ্ছে।”

আইজা বিচলিত কন্ঠে বলল “এই বিষয়ে আমি কি করতে পারি?!”
এরপর কিছু একটা ভেবে বলল “ওয়েট, আমি এখনই আমানের ফোনে কল করছি, তাকে সব খুলে বললে সে-ই ঠিক করবে ওই রাজিবকে।”

এই বলে আইজা তার ফোনে আমানের নাম্বারে কল দিতে গেলে, তিশা বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বলল “না না আইজা, তুমি আমানকে কল করতে যেও না প্লিজ। আমান যদি এই বিষয়ে জানে, সে কি ভাববে তিথির সম্পর্কে?! তুমি তো জানোই, তারা কত ভালো বন্ধু, আর রাজিবকে তো আমান এমনিতেও দুচোখে দেখতে পারে না।

এছাড়া তিথি যদি জানতে পারে যে এই বিষয়ে অন্য কেউ জেনে গিয়েছে সে কীভাবে রিয়েক্ট করবে, তুমি ধারণা করতে পারবে না।

প্লিজ আইজা! প্লিজ আমাকে কথা দাও এই বিষয়ে আমান তো না-ই, অন্য কাউকেও কিছুই জানাবে না তুমি। প্লিজ। এটা তিথির মান সম্মানের প্রশ্ন।”

বেশ উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলল তিশা। তাকে শান্ত করার জন্য আইজা বলল “আচ্ছা ঠিক আছে, বলব না কাউকে এই বিষয়ে।

তবে আমি আর কীভাবে এই বিষয়ে তোমাদের সাহায্য করব, তুমিই বলো?! আমার মনে হয়, তোমার অন্য কারো থেকে সাহায্য চাওয়া উচিত।”

তিশা বলল “এমনটা বলো না আইজা। আমি অনেক সাহস করে তোমাকে বলেছি, তোমার কাছে সাহায্য চেয়েছি। তুমি এভাবে মানা করে দিলে আমি কি করবো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

আইজা বেশ চিন্তিত হয়ে বলল “কিন্তু আমি কীভাবে করব তোমাদের সাহায্য ?! আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না।”

তিশা বেশ আশান্বিত হয়ে বলল “আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আছে। একটি উপায় আছে, যাতে তুমি আমাদের সাহায্য করতে পারো।”

আইজা বলল “কীভাবে?”

তিশা বলল “তুমি রাজিবকে বুঝাও, তার সাথে কথা বলো। হতে পারে, সে তোমার কথা শুনে, মেনেও যেতে পারে।”

আইজা ঘোর আপত্তি করে বলল “অসম্ভব। তার মত ছেলের সাথে এই বিষয়ে কথা বলার কোন আগ্রহ নেই আমার।
এছাড়া আমান যদি এই বিষয়ে জানে তবে সে রেগে যেতে পারে। তুমি তো জানোই তাকে।

সে একটুও পছন্দ করবে না যে আমি এমন কোন মানুষের সাথে কথা বলি, যাকে কিনা সে এতটা অপছন্দ করে।”

তিশা বলল “আমানকে এই বিষয়ে জানানোর প্রয়োজনই বা কি?! সে কিছুই জানবে না।”

আইজা বলল “তুমি বলতে চাচ্ছো যে আমি আমানকে মিথ্যা বলব?!”

তিশা বলল “না, আমি কেবল এটাই বলছি যে আমানকে সত্যটা জানানোর প্রয়োজনই বা কি?! তার কাছে এসব গোপন করলে তার কোন ক্ষতি তো নিশ্চয়ই হয়ে যাবে না। কিন্তু অন্য কারো জীবন ঠিকই বেঁচে যাবে।

এছাড়া তুমিও তো একটা মেয়ে, আইজা। আরেকটি মেয়ের জীবন এভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখেও কিছুই করবে না তুমি?!

দূরসম্পর্কের হলেও বোন হয় সে তোমার। একটুও খারাপ লাগবে না তোমার, তার সাথে খারাপ কিছু ঘটে গেলে।”

আইজা বলল “তার সাথে তো তোমার সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই। তুমি তাকে বললেই পারো।”

তিশা বলল “সে আমার কিংবা তিথির কোন কথা শুনতেই রাজি না, সেজন্যই তো তোমাকে বলছি। সে আমার কোন কথা শুনতে চায় না কারণ আমি তিথির বোন।

তুমিই আমার শেষ আশা, আইজা। তুমি বেশ বুদ্ধিমতি মেয়ে, তুমি ঠিকই পারবে। দয়া করে, না করে দিও না, প্লিজ।

আইজা বেশ দোদুল্যমান অবস্থায় পড়ে গেল। সে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল।

এরপর তিশার দিকে তাকিয়ে বলল “আমি দেখি। চিন্তা করব এই বিষয়ে।”

তিশা বলল “ঠিক আছে, চিন্তা করো তুমি। তবে যা করার, আমাদের তাড়াতাড়ি-ই করতে হবে; খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই। এটা মনে রেখো।”

আইজা চিন্তিত মুখে ভাবতে লাগলো কি করা যায়!

.
.
.

পরদিন সকালে আইজা রাজিবের নাম্বার জোগাড় করে তাকে ফোনে কল দিল। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হওয়ার পর গম্ভীর গলায় আইজা বলল “রাজিব, আমি আইজা বলছি।”

রাজিব বলল “আইজা..?! কোন আইজা? ওহ ওই আইজা নাতো যে কিনা সম্পর্কে আমার আত্নীয় এবং এত ভালো বন্ধুর হবু স্ত্রী হয়।”

আইজা কিছুটা রেগে বলল “ঠিকভাবে কথা বলো।”

রাজিব বলল “সরি, এভাবে কথা বলার জন্য। তবে আত্নীয় তো আমিও তোমার। কিন্তু কখনো একটি বার কল করে খোঁজ খবর তো নাও না। তাই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে সেই আইজা-ই কিনা কল করল আমাকে, তা-ও নিজ থেকে।”

আইজা বলল “আমার কোন শখ ছিল না তোমাকে কল করার। তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা বলতে চাই, সেজন্য কল করেছি।”

রাজিব বলল “আচ্ছা?! তো বলো, কি জরুরি কথা বলতে চাও?”

আইজা একটু সময় নিয়ে বলল “তোমার সাথে দেখা করে কথা বলতে চাই।”

রাজিব বলল “তো সমস্যা কোথায়, তুমি আসো গার্ডেনে বা টেরিসে। আমি অপেক্ষা করে থাকব তোমার জন্য। বলো কখন আসতে হবে!!”

আইজা একটু বিরক্ত হয়ে বলল “আমি যে বিষয়ে কথা বলতে চাই, আমার মনে হয় না আমাদের বাসায় কোথাও কথা বলা উচিত।

এছাড়া তোমার তো এতক্ষণে এটা বুঝে নেয়ার কথা যে আমি কি বিষয়ে কথা বলছি?!”

রাজিব বলল “হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। এই বিষয়ে আমারও বেশ অনেক কিছু বলার আছে, শুধু তোমাকে না, সবাইকে।”

আইজা বুঝতে পারল যে রাজিব এটাই বুঝাতে চাইছে যে এই বিষয়ে সে সবাইকে জানাতে চায়।

আইজা বেশ ব্যস্ত হয়ে বলল “আমি তোমাকে মেসেজ করছি যে কোথায় দেখা করবো, তুমি এখনই আমার সাথে দেখা করো।”

রাজিব বলল “এত তাড়া তোমার, আমার সাথে দেখা করার?!”

আইজা বলল “এসব ফালতু কথা বন্ধ করো। আর দেখা করবে কিনা তাই বলো।”

রাজিব বলল “আসছি আমি।”

রাজিব বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তিথিকে ফোনে কল দিয়ে জানাল সে আইজার সাথে দেখা করতে আমানের বাসার পাশের একটি ক্যাফেতে যাচ্ছে।

তিথি তখন তার রুম থেকে বের হয়ে আমানকে খুঁজতে লাগলো, কিছুদূর আসতেই সে দেখতে পায় যে আমান সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। সে আমানের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে তার কাছে গেল, আমান তার ডাকে তখনও হাঁটা থামায় নি।

সে আমানের কাছে পৌঁছে তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল “কোথায় যাচ্ছিলে, আমান?!”

আমান বলল “বিশেষ কোথাও না, আনিসের সাথে একটু বের হবো।”

তিথি বলল “আমিও যাবো তোমার সাথে। আমি তুমি, আনিস আর আইজা। এছাড়া আইজা কোথায়, তাকে তো দেখতে পাচ্ছি না।”

আমান বলল “জানি না, হয়ত কোথাও বের হয়েছে, জানিয়ে যায় নি।”

তিথি বলল “আজব, তুমি তার হবু স্বামী, তোমাকে জানিয়ে যায় নি কেন! পারমিশেনের কথা নাহয় না-ই বললাম, কেবল ইনফর্ম করে তো যেতে পারতো।

এছাড়া আগে তো সে এই বাসা থেকে ওই বাসায় যাওয়ার আগেও তোমার থেকে জিজ্ঞেস করে যেত। এখন দেখি, পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন।”

আমান ভেতরে ভেতরে কিছুটা চিন্তিত হলেও মুখে বলল “এটা আমার আর আইজার পার্সোনাল ম্যাটার। এই নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। আর নিজের এসব মিনিংলেস থটস এবং কথাবার্তা নিজের কাছেই রাখো।

এছাড়া আমার আর আনিসের সাথে তোমার যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।”

তিথি বেশ আবদার করে বলল “প্লিজ আমান! বিয়ের পর তো তোমার সব সময় কেবল আইজাই পাবে, এখন নাহয় বন্ধুবান্ধবদের একটু সময় দাও।

মনে আছে তোমার?! আগে আমরা সময় পেলেই সবাই একসাথে চলে যেতাম পাশের ওই ক্যাফেতে। কতদিন যাই না, চলো না, আজ যাই।এত অনুরোধ করার পরও না করো না প্লিজ।”

অবশেষে আমান রাজি হয়। এবং তারা তিনজন একসাথে ক্যাফের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়।

.
.
.

আইজা আর রাজিব সামনাসামনি বসে আছে। আইজা বলল “ফোনে আমার কথা থেকেই নিশ্চয়ই তুমি ধারণা করতে পেরেছ যে আমি তোমার আর তিথির সম্পর্কের ব্যাপারে জানি। এবং এটাও জানি সে তোমাকে ডাম্প করাতে তুমি এখন তাকে ব্ল্যাকমেইল করছ।”

আইজার কথা কেড়ে নিয়ে রাজিব বলল “তো অন্যায় কি করছি আমি?! হ্যাঁ, মানলাম যদিও অন্যায় করছি। কিন্তু সে যা করেছে, তা কি অন্যায় নয়?!

সম্পর্কে জড়ানোর আগে তো আমার সম্পর্কে সবই জানত, তখন তো কোন সমস্যা ছিল না। হঠাৎ তার মনে হয়েছে, এই সম্পর্ক কেবলই তার একটা ভুল।

অথচ এসবের মধ্যে আমার ফিলিংস এর কি?! আমি তো ভালোবেসেছিলাম তাকে। কিন্তু সে ধোঁকা দিয়েছে, মাঝ পথে ছেড়ে দিয়েছে।

দেখো আইজা তুমিও তো ভালোবাসো আমানকে। এখন যদি তোমার কোন বদ গুণের কথা বলে সে তোমাকে ছেড়ে দেয়; যে ব্যাপারে সম্পর্কের শুরুতেই সে অলরেডি জানত, তখন তোমার কেমন লাগবে?! কষ্ট পাবে না তুমি, প্রতিশোধ নেয়ার ইচ্ছা হবে না!”

এসব কথা বলে সে অতি সুক্ষ্ণভাবে আইজার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।

আইজা বেশ কনফিউজড হয়ে বলল “আমি বুঝতে পারছি, তুমি কেমন ফিল করছ, কিন্তু তুমি যদি তিথিকে সত্যিই কখনো ভালোবেসে থাকো, তাহলে দয়া করে, তার পিছু ছেড়ে দাও। সে এখন আর তোমাকে চায় না। তুমি কি জোর করে এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারবে?!”

রাজিব বলল “টিকিয়ে রাখতে চাই না আমি এই সম্পর্ক। তবে প্রতিশোধ তো ওই মেয়ে থেকে আমি নেব-ই।”

আইজা বিভিন্ন কথা বলে রাজিবকে বুঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।

এমন সময় আমান আর তিথিরা ক্যাফেতে প্রবেশ করে একটি টেবিলে গিয়ে বসল। ক্যাফেটা বেশ বড় হওয়ায় এবং আমান আইজার টেবিলের মধ্যে অনেক গ্যাপ থাকায় কেউই কাউকে দেখতে পায় নি। তবে তিথি চারদিকে চোখ বুলিয়ে খোঁজার পর ঠিকই দেখতে পায় আইজাকে।

তখন সে বেশ উৎফুল্ল ভাব দেখিয়ে আমানকে বলতে লাগলো “আরে ওই দেখো, আইজাও এই ক্যাফেতেই আছে। তবে তার সাথের ব্যক্তিকে দেখতে তো রাজিবের মত মনে হচ্ছে। সে রাজিবের সাথে দেখা করতে এখানে এলো কেন ?!

অবশ্য আসতেই পারে, তার ইচ্ছা। তবে তোমাকে কি বলে এসেছে যে সে তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছে?!”

আমান নিজেও বেশ অবাক এবং গম্ভীর হয়ে বলল “আমাকে জানিয়ে আসে নি। তবে হয়ত কোন কাজ ছিল, সেজন্যই এসেছে।”

তিথি বলল “রাজিবের সাথে তার আবার কি কাজ থাকতে পারে!

যাই হোক, তুমি ফোন দাও তো তাকে। ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করো, সে কোথায় এবং কি কাজে গিয়েছে?!”

আনিস চুপচাপ তাদের দুজনের কথা শুনে যাচ্ছে। তবে কেন যেন, তার মনে হচ্ছে, নতুন কোন ঝামেলা বাঁধতে চলেছে।

আমান আইজাকে কল দিয়ে যখন জিজ্ঞেস করে প্রথমে সে একটু ঘাবড়ে গেলেও পরে মিথ্যা বলতে বাধ্য হয় যে সে তার একটি বান্ধবীর সাথে আছে, কেননা রাজিবের সাথে দেখা করার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে সঠিক উত্তরটি দিতে পারবেনা।

এমনকি আমানের সাথে বেশি কথা না বলে ব্যস্ত আছে বলে সে কল কাট করে দেয়।

আইজার অকারণে এত সুন্দর করে মিথ্যা বলা দেখে আমান হতবাক হয়ে যায়। প্রথমত আমানকে কিছু না জানিয়েই সে রাজিবের সাথে দেখা করতে এসেছে। এর উপর, তার বিষয়ে আমানের সাথেও মিথ্যা বলছে।

এই ঘটনার পর আমান খুব বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ক্যাফে থেকে বের হয়ে যায়।

একবার তো আমান ভেবেছিল, আইজাকে গিয়ে ফেইস করবে, কিন্তু পরবর্তীতে তার আর ইচ্ছে হয়নি।

আমান বের হয়ে যাওয়ার পর তিথিও তার পেছনে পেছনে চলে গেল। আনিস তাদের চলে যাওয়া দেখল নিরাশ হয়ে।

এরপর স্থির দৃষ্টিতে আইজার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো আইজা এভাবে মিথ্যা বলল কেন, সে কোনো ভাবে ঠকাচ্ছে নাতো আমানকে ?!

পর্ব_২৭

এদিকে আমান দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। একবার ভাবল এই বিষয়ে আইজাকে জিজ্ঞেস করবে।

কিন্তু এরপর আবারও ভাবতে লাগল, সে যদি এমনটি করে, তবে তার মনে সবসময় একটা খসখস থেকেই যাবে আইজাকে নিয়ে। যে আইজা নিজ থেকে এসে কিছুই জানায় নি তাকে। সুতরাং সে আইজাকেই সময় দিতে চায়, সুযোগও; যাতে সে নিজে এসে আমানের কাছে ব্যাখ্যা দেয় যে মিথ্যা কেন বলেছিল!

অথচ পরবর্তীতে আইজার সাথে এই বিষয়ে কথা বলা তার ইগো প্রবলেমে পরিণত হয়।

যাই হোক। এদিকে সময়ের সাথে সাথে অবস্থার কেবল অবনতি ঘটতে থাকে। আইজা প্রায় সময় রাজিবের সাথে ফোনে কথা বলত, তাকে বুঝানোর জন্যই যাতে তিথির পিছু ছেড়ে দেয়, কারণ তিথি আর তিশা সবসময় তার কাছে এসে মিথ্যা কান্না কাঁদত।

এদিকে প্রায় দেখা সাক্ষাতও হত তার রাজিবের সাথে, রাজিব তাকে ছবিগুলো দিব দিচ্ছি বলে এভাবেই ঘুরাতে থাকে।

একদিন রাজিবের সাথে আমান সামনাসামনি পড়ে গেল। বর্তমানে একই বাসায়-ই অবস্থান করছে তারা, দেখা হওয়াটাই স্বাভাবিক।

আমানকে দেখে রাজিব হেসে বলল “কেমন আছো, আমান?! বিয়ে উপলক্ষে এতদিন একই বাড়িতে অবস্থান করছি, অথচ আমাদের তো দেখা সাক্ষাতই হয়না খুব একটা।

অথচ আইজার সাথে তো আমার রেগুলার কথা হয় ফোনে। এমনকি ঘন ঘন দেখা সাক্ষাতও হয়। নিশ্চয়ই বলে থাকবে সে তোমাকে।”

এই কথা শুনে রেগে কিছু না বলেই সেখান থেকে চলে গেল আমান।

এরপর সে আইজার রুমে গিয়ে পাশে রাখা সোফায় বসে আইজার উদ্দেশ্যে বেশ ঠান্ডা গলায় বলল “কেমন আছো, আইজা!”

আইজা তার ফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সে আমানের উদ্দেশ্যে বলল “হুম,ভালো আছি। তুমি?”

আমান বলল “আমাদের মাঝে কি যোগাযোগ গ্যাপ এতটাই হয়ে গিয়েছে যে আমাদের কথা এভাবে শুরু করতে হচ্ছে?!”

সাইড টেবিলে তার ফোন রেখে আইজা বলল “এভাবে কেন বলছ! আসলে এই কয়েকটা দিন আমি একটু ব্যস্ত আছি, তাই হয়ত একসাথে বেশি সময় স্পেন্ড করতে পারিনি।”

এবার আমান একটু রুক্ষভাবে বলল “কাকে নিয়ে এত ব্যস্ত আছো?!”

আইজা আমানের কথার অর্থ ঠিকভাবে বুঝতে পারেনি, সে বলল “বিয়ের কাজ নিয়ে, মা আমাকে অনেক ব্যস্ত রাখে। সেটাই বলছিলাম।কেন কি হয়েছে?”

আমান বলল “আইজা, তোমার কি কারো সাথে নতুন করে কোন বন্ধুত্ব হয়েছে, বা এমন কিছু আছে যা তুমি আমাকে বলতে চাও? বা আমার জানার প্রয়োজন আছে বলে তোমার মনে হয় ?!”

আমান কি বলতে চাইছে বা ঠিক কি শুনতে চাইছে আইজা বুঝতে পারল না। সে বলল “আমান এমন কিছুই নেই। এছাড়া তুমি কি বলছ, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”

আমান প্রচন্ড রেগে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। নিজেকে কন্ট্রোল করে আবারো ঠান্ডা স্বরেই বলল “আমার জন্য এক মগ কফি বানিয়ে আনতে পারবে, আমার মাথাটা ব্যথা করছে। আর আমার এই মুহূর্তে তোমার হাতে বানানো কফিই চাই।”

আমানের আচরণ যে ঠিক স্বাভাবিক না, আইজাও তা কিছুটা অনুমান করতে পারল। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ নিয়ে সে কফি বানাতে চলে গেল।

তখন আমান উঠে এসে আইজার ফোন হাতে তুলে নেয়। আইজার পাসওয়ার্ড সে জানত, চেষ্টা করার সাথে সাথে ফোন আনলক হয়ে গেল। আমান এই ভেবে স্বস্তি পেল এখনও পাসওয়ার্ড অন্তত তো বদলায় নি।

এরপর সে আইজার কল লগে গিয়ে দেখতে পায় যে, দিনে বেশ কয়েকবার আইজার ফোন থেকে রাজিবকে আর রাজিবের ফোন থেকে আইজার ফোনে কল আসে, যেগুলোর কল ডিউরেশেনও খানিকটা লম্বা-ই। আবার কিছু মেসেজেস-এ কিছু ক্যাফে এবং রেস্টুরেন্টের নাম আদান প্রদান হয়েছে দেখা করার জন্য।

প্রথম প্রথম আমানের যদিও আইজার উপর বিশ্বাস ছিল, কিন্তু এখন যেন তার বিশ্বাস পুরো নড়ে গিয়েছে।

আইজা আসলে কি করছে এসব, রাজিবের সাথে তার দেখা সাক্ষাত কথাবার্তা যদি সাধারণ বন্ধুত্ব হত, সে এসব গোপন করত না কখনো। তবে কি এর মানে…।

আর কিছু ভাবতে পারল না আমান। তার বুক বরাবর যেন কেউ ছুরি বিদ্ধ করে দিয়েছে। সে আইজার ফোন রেখে রুম থেকে বের হওয়ার সময় আইজা কফি মগ হাতে রুমে প্রবেশ করল।কিন্তু আমান কফি না নিয়েই তার সামনে দিয়ে বের হয়ে গেল। আইজা তাকে ডাকতে গিয়েও পারল না।

তবে আমানের এমন ব্যবহারের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে হঠাৎ আইজার মনে হলো, তার আর রাজিবের দেখা সাক্ষাতের ব্যাপারে কিছু জানতে পারে নি তো সে আবার!
এটা ভাবতেই আইজার আত্না শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। সে যেকোনো মূল্যে আমানের বিশ্বাস হারাতে চায় না, আমান যদি কোন কারণে তাকে ভুল বুঝে, সে কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। কারণ এতে দোষ ছিল কেবল তার নিজেরই।

সেই মুহূর্তে-ই আইজা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় যে, অনেক চেষ্টা করেছে সে তিথির সাহায্য করার। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। এখন সে হাল ছেড়ে দিয়ে এসব বিষয় থেকে দূরে থাকবে।

তিথির সমস্যা এসব, এই বিষয়ে সে-ই বুঝবে। এমনিতেও সে নিজেই দায়ী তার এমন পরিস্থিতির জন্য।
আর দেরি না করে আইজা তার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল।

.
.
.

এদিকে এই কয়েকটা দিন আমানের সাথে যা কিছু হচ্ছিল এতে সে অনেক বেশি ডিপ্রেশেনে পড়ে যায়। সেই সময়টায় তিথি একজন ভালো বন্ধু হিসেবে তাকে এত বেশি সাপোর্ট দেয়, সবসময় তার এতটা সঙ্গ দেয়, যার কারণে, আমানের মনে তিথির জন্য একটি সফট কর্ণার তৈরি হয়। তবে কেবলই বন্ধু হিসেবে, তার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে।

একদিন আইজা তিথির রুমে গিয়ে তাকে সরাসরি জানিয়ে দেয় যে সে অনেক চেষ্টা করেছে, এমনকি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে, এরপরও তাদের প্ল্যান কাজ করে নি, রাজিব তাকে কোন ছবিই দেয়নি। সুতরাং সে এখন নিজের পার্সোনাল লাইফ আর ক্ষতিগ্রস্ত না করে এসব থেকে দূরে থাকতে চায়।

তিথি তাকে অনেক বুঝানোর পরও যখন সফল হয়নি, তখন সে তার বোনের সাথে মিলে ঠিক করে যে, এই গেইমের এখন এমন একটা সুন্দর ক্লাইমেক্স দিতে হবে যার ফলে আমানের সাথে আইজার সম্পর্কটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।

তাদের পরিকল্পনার শেষ ধাপ অনুযায়ী, রাজিব অবশেষে তাকে তথাকথিত সেসব ছবি দিতে প্রস্তুত হয়। এবং সন্ধ্যার পর তাকে বাসার ছাদে যেতে বলে।

প্রথমে আইজা যদিও রাজি হয়নি, কিন্তু দুই বোনের পিড়াপিড়ীতে অবশেষে রাজি হয়।

আইজা ছাদে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তিথি আমানের কাছে গিয়ে বলে যে সে আইজা আর রাজিবকে একসাথে ছাদে যেতে দেখেছে।

এই কথা শুনে আমান নিজের মেজাজের উপর যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। তবু নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে সে ছাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। তিথিও তার পেছনে পেছনে গেল।

ছাদে আইজা সরাসরি রাজিবকে বলল “তোমরা শুরু-টা কি করেছ, একে অপরকে ভালোই যদি বাসতে তাহলে এখন কেন কুকুর শেয়ালের মত একে অপরের পেছনে লেগে আছো?!

মাঝখান দিয়ে এসবে জড়িয়ে আমিও আমার পার্সোনাল লাইফ ধ্বংস করছি।

জানি না, কি হয়েছে, কিন্তু আমান আমার সাথে এখন ঠিকভাবে কথা পর্যন্ত বলে না। সে কি জেনেছে, কতটুকু জেনেছে, এসব ব্যাপারেও আমার কোন ধারণাই নেই। তবে আমি নিজের জীবনে আর সমস্যা তৈরি করতে রাজি না। আমি আমানের সাথে সরাসরি কথা বলব এই বিষয়ে। প্রয়োজনে সব সত্য জানিয়ে দেব তাকে।

আর তুমি! তোমার যদি ছবিগুলো সত্যিই দিতে হয়, এখনই দিবে। অনেক ঘুরিয়েছ আমায়, আর না।”

এই বলে আইজা তর্জনী উঁচিয়ে রাজিবের দিকে ধরল।
তবে রাজিবের এই মুহূর্তে কিছুই বলার নেই, তার ডায়ালগ তো আমান আসার পরই শুরু হবে।

তখন তার ফোনে একটি মিসড কল আসতেই সে আইজার হাত ধরে বলতে লাগলো “তুমি এত ভয় পাচ্ছো কেন, আইজা। আমানকে ভয় পাওয়ার কি আছে, এখন যদি তুমি তাকে নিজের জীবনে না চাও, সরাসরি বলে দাও তাকে।
এখন আমরা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলেছি। আর এই বিষয়টি আমানকেও মানতে হবে।”

রাজিবের কথা শেষ হওয়ার আগেই আইজা ঝটকা মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল “পাগল হয়ে গিয়েছ? কি বলছো এসব ?!”

সেই মুহূর্তে আমানের কন্ঠস্বর শুনে অত্যধিক চমকে পেছনে তাকাল আইজা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here