” নিজের স্ত্রীকে তুই এভাবে বাধ্য করতে পারিস না! নিজের দ্বিতীয় বিয়ের জন্য সব আয়োজন তাকে দিয়েই কেন করাতে হবে তোর! একটুও দয়া হচ্ছে না তোর তিথির উপর? মেয়েটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।”
আনিস কিছুটা উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলল।
বেশ ক্ষিপ্ত কন্ঠে আমান বলল “জাস্ট স্টপ ইট। আর হচ্ছে না আমার, তার প্রতি কোনো দয়া-মায়া। সে এটাই ডিজার্ভ করে।
আর হ্যাঁ, আজ তার পক্ষে আমার কাছে এসে ওকালতি করেছিস, ঠিক আছে, কিন্তু এর পর যদি আর কখনো এমন ভুল করিস; তোর উপর থেকেও আমার দয়া উঠে যাবে। আন্ডারস্টুড?!
তুই আমার বন্ধু, আমার বন্ধু হয়েই থাক, অন্য কারো এত শুভাকাঙ্ক্ষী হওয়ার প্রয়োজন নেই।”
আনিস একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ” আমান, একবার ভেবে দেখ। মেয়েটা কতটা ভালবাসে তোকে, তোর খুশির জন্য, তোর কথামত ঠিকই সবকিছু নিজ হাতে করছে। তার আড়াল করা চোখের অশ্রুও মাঝে মধ্যে অবাধ্য হয়ে ওঠে।
যা আশেপাশের সবার হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করে। তোর দেয়া ক্ষতগুলোই সেসব অশ্রুর উৎস। অথচ তোর ঘৃণার আগুনকে তা নেভাতে পারে না। আফসোস!”
আমান বলল “সে নিজ হাতে সব আয়োজন এজন্যই করছে যাতে আমি তাকে ছেড়ে না দেই। নেহাতই নির্লজ্জ আর স্বার্থপর একটি মেয়ে সে।”
এরপর আরো রেগে গিয়ে বলল “দেখ আনিস, আমার সামনে তার ব্যাপারে আর একটা কথা বলবি না তুই। আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিস না। আর এটাকে আমার পরামর্শ হিসেবে নিতে পারিস কিংবা ওয়ার্নিং।”
এমন সময় আমানের ফোন বেজে উঠল। আমান পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে দেখল “লাইফ পার্টনার” লেখা।
সে তার রাগ সংযত করে ফোন রিসিভ করে নরম স্বরে কথা বলতে বলতে সেখান থেকে চলে গেল।
স্ক্রিনে লেখা নামটা আনিসও দেখেছিল, সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল ” যে তোর দ্বিতীয় স্ত্রী হতে যাচ্ছে, সেই মেয়েটিও তোর মতই, নির্দয়। তোদের দুজনকে চিনতেই ভুল করেছি আমি।” আরেকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে-ও তার কাজে চলে যায়।
.
.
.
তিথি নিজ হাতে আজ অনেক আইটেম রান্না করেছে। কাজের মানুষ ছিল বেশ কয়েকজন, তারা তাকে সাহায্যও করেছে অনেক। তবে রাঁধতে তার-ই হত। আজ বাসায় মেহমান আসছে দাওয়াত খেতে, কাজের মানুষ নয়, রাঁধতে যে তার-ই হবে। কারণ তার স্বামী চায় না, মেহমানরা কাজের মানুষের হাতের রান্না খাবে।
রাঁধতে রাঁধতেই হঠাৎ তার চোখ পানিতে ভরে উঠলো। অন্যমনষ্ক হয়ে সে ভাবতে লাগলো, এত কষ্ট করে রান্না করছে ঠিকই, কিন্তু তার হাতে রান্না করা কোনো কিছু থেকে তার স্বামী এক চামচ নিয়েও খাবে না। যদি এমন হত যে তার স্বামী অনন্ত এক চামচ তুলে খেয়েছে, তার সমস্ত কষ্ট আনন্দে রূপান্তরিত হত। কিন্তু তার ভাগ্যে হয়ত এই সুখ লেখা নেই।
চোখের অশ্রু মুছে সে আবারও রান্নায় মন দিল। এখনও অনেক কাজ বাকি, মেহমানরা যেকোনো সময় এসে পৌঁছাবে। এখন যেন মন খুলে কান্না করাও তার জন্য একটি বিলাসীতা।
.
.
.
আনিস ফোন হাতে দাঁড়িয়ে টিপছিল, এমন সময় সেখানে আমানের মা রেহানা এসে উপস্থিত হলেন। ব্যস্ত হয়ে তিনি আনিসকে বলতে লাগলেন “আরে আনিস, বিয়ে বাড়ি, এত কাজ পড়ে আছে। আর তুমি আমানের এত কাছের বন্ধু, এই বাড়ির ছেলের মতই। অথচ কোনো কাজ না করে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোন টিপছ। কাজে সাহায্য করো, বাবা।
এছাড়াও মনে আছে নাকি এটাও ভুলে গিয়েছ যে আজ আইজার পরিবারকে রাতের খাবার এখানে করার জন্য দাওয়াত দেয়া হয়েছিল? তারা কিন্তু যেকোনো সময় এসে পৌঁছাবে।”
আনিস নিরস কন্ঠে বলল “সেটাই তো। দুই দিন পর বিয়ে। বিয়ে বাড়ি, দশ রকমের ঝামেলা।
এর মধ্যে আবার তাদের আলাদাভাবে দাওয়াত করার কি প্রয়োজন ছিল?!”
রেহানা বললেন “সৌজন্য বলতে কিছু আছে নাকি নেই! এভাবেও তারা তো পরিবারই।
এছাড়া আমানের ইচ্ছাতেই তাদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে, বুঝতে পেরেছ!”
আনিস বিড়বিড় করে বলল “আমান আর তার ইচ্ছা!”
রেহানা বললেন “তুমি কিছু বললে, বাবা?”
আনিস বলল “কিছুই না, আন্টি। আপনি বলুন, কি কাজ করতে হবে আমায়? আমি এখনই করে দিচ্ছি।” তখন রেহানা তাকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আনিসও কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
.
.
.
কিছুক্ষণের মধ্যেই আইজা আর তার পরিবার আমানের বাসায় এসে পৌঁছায়। রেহানা নিজে তাদের দরজা থেকে বরণ করলেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও ভেতরে তখন তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
আমানও সেই মুহূর্তে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে নিচে। আইজা আমানের চোখাচোখি হতেই নিজের অজান্তেই আইজা চোখ ঘুরিয়ে নেয় অন্যদিকে।
আমানের বিয়ের পর থেকেই আইজার মনে যে একই অনুভূতি কাজ করে না, বিষয়টি খুব ভালো করেই বুঝতে পারে আমান, যা তার মনে একইসাথে অনেকগুলো মিশ্র অনুভূতি সৃষ্টি করে। যেগুলোর মধ্যে কষ্ট, রাগ, ঘৃণা অন্যতম।
সে গিয়ে আইজার কাছে দাঁড়াল। আইজা এবার তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি টেনে বলল “কেমন আছো?”
আমান কোন জবাব না দিয়ে গম্ভীরভাবে কেবল তাকিয়ে রইল তার দিকে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে আইজা তার মা লায়লার দিকে তাকালো।
লায়লা বললেন “আমার মেয়ে মনে হয়, অনেক ভাগ্যবতী। খুবই ভালোবাসে তার হবু স্বামী তাকে।”
এবার চোখ নামিয়ে আমান লায়লার দিকে তাকিয়ে বলল “বসুন আপনারা। আমি আসছি।”
এই বলে এক পলক আইজার দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে চলে গেল সে।
রেহানা সবাইকে বসিয়ে একজন ভৃত্যকে তাড়া দিয়ে বললেন “নাদিয়া, মেহমানদের জন্য জলদি ঠান্ডা শরবত নিয়ে আয়।”
তখন লায়লা বললেন “ভাবী, এত ব্যস্ত হতে হবে না। আমরা তো একই বংশেরই, এছাড়া প্রথমবার তো আর আসছি না এই বাসায়।”
মুখ ভর্তি হাসি ছড়িয়ে রেহানা বললেন “এই আসা আর সেই আসা কি একই হলো?! এখন তো আমরা বেয়াই হতে চলেছি।”
প্রতিউত্তরে লায়লাও মিষ্টি করে হাসলো। শরবত আর হালকা কিছু নাস্তার কিছুক্ষণ পর রাতের খাবারের জন্য সবাই একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসল। কিন্তু তখনও আমানের কোনো খবর নেই। সে এখনো ফিরে নি।
লায়লা চারদিকে চোখ বুলিয়ে বললেন “আমান! তাকে তো দেখতে পাচ্ছি না কোথাও। সবাই খেতে বসেছি, আমান কি খাওয়া দাওয়া করবে না আমাদের সাথে?”
রেহানা বললেন “খাবে না মানে! অবশ্যই খাবে। নিশ্চয়ই আনিসের সাথে বসে কোথাও আড্ডা দিচ্ছে। আমি এখনই কাউকে পাঠাচ্ছি, তাদের ডেকে আনার জন্য।”
তিথি সেখানেই দাঁড়িয়ে তাদের খাবার পরিবেশন করছিল। তখন আইজার বাবা ফারুক তিথির উদ্দেশ্যে বললেন ” তিথি, তুমি নাহয় ডেকে নিয়ে এসো তাকে।”
তিথি কিছু বলার আগেই রেহানা বললেন “আসলে এই মুহূর্তে তিথি আমানের কাছে গেলে সে অযথা রাগ করবে। আইজা মা, এক কাজ করো, তুমি ডেকে নিয়ে এসো আমানকে।”
আইজা কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ল, সে বলল “আমি?! তিথিই নাহয় যাক। এছাড়া আমি কীভাবে…”
রেহানা কৃত্রিম শাসনের স্বরে বললেন “কেন, প্রথমবার আসছ নাকি এই বাড়িতে!! ছোটবেলা থেকে এই বাড়িতে আসার পর পরই তো আমানের সাথে দেখা করতে চলে যেতে। আজ কেন এত লজ্জা করছে তাহলে, তাকে ডেকে নিয়ে আসতে?”
আইজা বলল ” লজ্জা করছে না, এমনিই বলেছিলাম। এছাড়া ছোট বেলা থেকেই সে আমার ভালো বন্ধু, তাকে কেন লজ্জা করব।”
এই বলে আইজা চেয়ার থেকে উঠে চলে গেল।
তিথি করুণ চোখে আইজার গমন পথের দিকে অল্পক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে আবারও নিজ কাজ করতে লাগলো।
.
.
.
আমান আর আনিস ছাদে বসেছিল দোলনার ওপরে। একসাথে বসে থাকলেও টুকটাক-ই কথা হচ্ছিল তাদের মধ্যে। আমান তার ফোন নিয়েই ব্যস্ত।
এমন সময় তারা দুজনই সেখানে আইজাকে আসতে দেখে। আইজাকে আসতে দেখে অল্পক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর আনিস প্রায় সাথে সাথে আমানের দিকে তাকায়। আমানও আইজার দিকে তাকিয়ে আছে।
আইজা তাদের কাছে গিয়ে বলল “খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। আন্টি তোমাদের দুজনকে খেতে ডাকছেন।”
আনিস বলল “হুম, আমাদের এখন নিচে যাওয়া উচিত, সবাই অপেক্ষা করছে নিশ্চয়ই।”
আমান তখন আনিসের উদ্দেশ্যে বলল ” তুই নিচে যা। আমি আর আইজা কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।”
আনিস একবার আইজাকে দেখে নিচে চলে গেল।
চলবে…
#জিদ_অনুভূতির_অন্য_এক_স্তর
#পর্ব_১
#লেখিকা : #Kaynat_Ash