#জিদ_অনুভূতির_অন্য_এক_স্তর
পর্ব_২৮+২৯
#লেখিকা : #Kaynat_Ash
রাগে ক্ষোভে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে হীতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে আমান এগিয়ে আসে। এরপর উচ্চ স্বরে চিৎকার করে সে বলল “এতদিন ধরে এসব চলছিল তাহলে!
তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আইজা, বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু আমার সব প্রশ্নের জবাবে কেবল মিথ্যা গল্প শুনিয়েছ আমায়। এরপরও বিশ্বাস ছিল তোমার উপর, যে তুমি খারাপ কিছু কখনো করতে পারো না। আমাকে ধোঁকা দেয়া তো দূরের কথা। অথচ আমার পিঠ পিছনে এসব করছিলে এতদিন!
তোমার সাহস কি করে হয়েছে, আমাকে ধোঁকা দেয়ার, তা-ও রাজিবের মত একটা ছেলের জন্য ?!”
আমানের চিৎকারে বাসার সব মানুষ, মেহমান সবাই উপরে চলে আসে।
আইজা পাগলের মত কাঁদতে কাঁদতে বলল “আমান, তুমি ভুল বুঝছ, ভুল কিছুই করিনি আমি। প্লিজ একটা বার আমার কথা শুনো। আমি সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারব।”
বাসার সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। তখন রেহানা বললেন ” কি হচ্ছে এখানে?! আর আমান! এভাবে কথা বলছ কেন তুমি আইজার সাথে, কি করেছে সে ?!”
আমান কিছু বলার আগেই তিথি বলল “আইজা রাজিবের জন্য আমানকে ধোঁকা দিচ্ছিল, আর আজ আমান তাদের হাতে নাতে ধরে ফেলে।”
তিথির কথায় আইজা আকাশ থেকে পড়ল, সে যেন পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।
রেহানা অবিশ্বাসের সাথে বললেন “আইজা তো এই ধরণের মেয়ে ছিল না কখনো। তাকে খুব ভালো মেয়ে হিসেবেই চিনি। আমার মনে হয় তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে, আমান!”
আমান ক্রুদ্ধ কন্ঠে গর্জে বলল ” ভুল আমারই হয়েছিল, তবে এই মেয়েকে চিনতে।
সে এভাবে বদলে যাবে, এটা ধারণা পর্যন্ত করতে না পারাটাও আমার একটা ভুল ছিল।
অথবা এমনও হতে পারে যে সে সবসময়ই এমন চরিত্রহীনা ছিল, কিন্তু তাকে চিনতে প্রথম থেকে আমিই ভুল করি।”
আইজা ডুকরে কেঁদে উঠে বলল “আমান বিশ্বাস করো, তোমার সাথে কোন প্রতারনা করিনি আমি।
এই সবকিছু এই তিথি করিয়েছে। আমি জানি না, আমাকে এভাবে ফাঁসিয়ে তার কি লাভ হচ্ছে, কিন্তু এইসব কিছু আমি তার জন্যই করি।”
আমান অবিশ্বাসের সাথে বলল “তিথির জন্য?! আর তা কীভাবে?!”
আইজা তার বাঁধ ভাঙা কান্না কোন রকম নিয়ন্ত্রণ করে বলল “তিথি আর রাজিবের রিলেশেন ছিল, আর এই রিলেশেনের প্রুফ হিসেবে রাজিবের কাছে তার আর রাজিবের কিছু ছবিও ছিল। যেগুলোর বেসিসে তিথিকে নাকি সে ব্ল্যাকমেইলও করছিল যে তার পরিবারকে তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানিয়ে দিবে।
আর এজন্য তিশা আমার কাছে সাহায্য চায় যাতে আমি রাজিবের সাথে কথা বলে, তাকে বুঝিয়ে সেই ছবিগুলো তার কাছ থেকে তাদের নিয়ে দেই। কেননা তাদের দুই বোনের কোন কথাই নাকি সে শুনছিল না।
এছাড়া তিশা আমাকে কথা দিতে বলে, আমি যেন এই বিষয়ে কাউকে কিছুই না জানাই।
বিশ্বাস করো আমান, সত্য এটাই। তুমি যেটা ভাবছ এমন কিছুই নেই।”
কান্নার জন্য আর কোনো কথা বের হলো না আইজার মুখ দিয়ে।
তিথি আর তিশা বুঝতে পারেনি এমন একটি পরিস্থিতিতেও এভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে সে সবাইকে এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সব বলে দিবে। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল মনে মনে। ভেতরে ভেতরে তাদের নিজেদের অবস্থাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
এখন আইজার চরিত্রের সাথে সাথে তিথির চরিত্রের ব্যাপারেও সবার মধ্যে গুঞ্জণ উঠল।
কিন্তু আমান আইজার বক্তব্যকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে বলল “আমার তো মনে হয়, নিজের দোষ ঢাকার জন্য এখন বসে বসে কাহিনী বানাচ্ছ তুমি। তিথি আর রাজিবের মধ্যে এমন কিছু থাকলে আমরা কেউ না কেউ ঠিকই এই বিষয়ে জেনে যেতাম। তুমি নিজের চুরি লুকানোর জন্য এখন নির্দোষ একটি মেয়েকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ।”
আইজা বলল “তিশা সবকিছু জানে, তাকে জিজ্ঞেস করো।
তবে আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না, রাজিব আর তিথি এভাবে আমার সম্পর্কে মিথ্যা বলছে কেন!
তিশা! প্লিজ; এবার তুমি অন্তত সত্যটা বলো। বলো যে রাজিবের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, বরং সম্পর্ক তো ছিল রাজিব আর তিথির মধ্যে। আর তোমাদের দু’বোনের কথা মতই আমি এসব করেছি।
তিশা কাঁপা গলায় বলল “এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। নিজেকে বাঁচাতে সে আমার বোনের উপর অপবাদ দিচ্ছে, কারণ তিথি আগে থেকেই ধারণা করতে পেরেছিল যে তাদের দুজনের মধ্যে কিছু একটা চলছে।
তিথি এই ব্যাপারে আগেই জেনে গেছে হয়ত এই জিদ থেকেই সে তিথির ব্যাপারে এসব বলছে।”
তিথির মা আনোয়ারা বললেন “নিজের বিয়ে ভেঙে যাওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য আমার মেয়ের উপর এসব মিথ্যা অপবাদ দিও না আইজা। তোমার বিয়ে হয়ত ঠিকই আমানের সাথে হয়ে যাবে, কিন্তু আমার মেয়েকে আর কেউ বিয়ে করবে না।”
তখন মেহমানদের মধ্যে থেকে একজন বললেন “আইজা সত্যও তো বলে থাকতে পারে। হয়তো তিথি মেয়েটার-ই কোন সমস্যা আছে?! এই মেয়ের যে স্বভাব চরিত্র! সত্যিই তাকে বিয়ে দিতে পারবেন না, ভাবী।”
এই কথা শুনে সবাই মোটামুটি হতবাক। এবার মেহমানদের মধ্যে তিথির চরিত্র নিয়ে গুঞ্জন উঠে। সবাই ভালো মন্দ শুনাতে লাগল তাকে।
তিথি আর তিশা হতভম্ব হয়ে যায়, এভাবে পুরো বাড়িসুদ্ধু মানুষ একত্র হয়ে যাবে, এমন একটা তামাশা হবে সবার সামনে, তারা নিজেরাও এই বিষয়ে ভাবতে পারে নি আগে। তাদের তো কেবল এটাই পরিকল্পনা ছিল যে রাজিব আর আইজার সম্পর্কের ব্যাপারে ভুল বুঝে আমান আইজাকে ছেড়ে দিবে, তাদের বিয়েটাও হবে না। অথচ এটা কি হয়ে গেল, বাড়িসুদ্ধ মানুষের সামনে এত বড় তামাশা!
এখানে এতক্ষন ধরে যা কিছু হচ্ছে এর কোনটাই তো তাদের পরিকল্পনায় ছিল না কখনো।
আসলে কেউই পারফেক্ট পরিকল্পনাকারী নয়, পরিকল্পনা তো করে ভাগ্য যা আমাদের ভুল পদক্ষেপকে আরো ভয়াবহ রূপ দিয়ে দেয়। আর আমরা তো কেবল স্রোতের তোড়ে প্রবাহিত হতে থাকি।
কেউ কেউ বলতে লাগলো আইজা এবং তিথি দুজনের চরিত্রেই সমস্যা আছে। দুজনের-ই এক ছেলের সাথে সম্পর্ক রয়েছে, দ্বিতীয় জন তো এ্যাংগেইজড হওয়ার পরও।
আইজা এসব কথা নিতে পারছিল না আর।
তবে সে কি জানত, তার জন্য আরো বড় একটা চমক অপেক্ষা করছে এখনো।
তখন আনোয়ারা কাঁদতে কাঁদতে বললেন “আইজা সর্বনাশ হোক তোমার, একটা মাকে বদদোয়া দিতে বাধ্য করেছ তুমি। এখন তোমার কি মনে হয়, আমার মেয়েটাকে ভালো কোন জায়গায় বিয়ে দিতে পারব?! নিজেকে বাঁচাতে আমার মেয়েটার উপর কেন এভাবে মিথ্যা অপবাদ দিলে!”
মেহমানদের মধ্যে থেকে আরেকজন আত্নীয় তখন বলে উঠলো “মেয়েকে ভালো শিক্ষা দিলে আজ এই দিন দেখতে হয়না।”
এতক্ষণে আমানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল, সে বলল “দোষ আইজা করেছে, আর এই দোষীর কথা শুনে তিথির উপর সবাই অপবাদ দিচ্ছে! মানুষের কমন সেন্স যে জিরো লেভেলে নেমে গিয়েছে, তা বুঝতে কোন জ্ঞানী লোকের অন্তত সমস্যা হবে না।”
এতক্ষণে আমান কথা বলাতে যদিও সবাই কিছুটা হলেও ভয় পেয়েছে। তবে তাদের কথা থেমে নেই।
একজন বলল “জয়নুল সাহেবের জন্য আমার খারাপ লাগছে। আইজা তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, তারা তো মেয়ের জন্য কিছু না কিছু একটা করেই ফেলবে। কিন্তু জয়নুল সাহেব অসুস্থ মানুষ, হার্টের রোগী, মেয়ের এসব দেখলে তো সময়ের আগেই…।”
এসব কথা শুনে জয়নুলের যেন সত্যিই বুকে ব্যথা শুরু হয়েছে। তিনি বুক ধরে মেঝেতে বসে পড়লেন। তার অবস্থা দেখে সবাই কিছুটা চিন্তিত ও ভীত হয়ে উঠল।
কিন্তু এই মুহূর্তেও একজন বলে উঠল “হায় হায়, জয়নুল ভাইয়ের কিছু হয়ে গেলে তার এমন স্বভাবের এই মেয়ের বিয়ে হবে কীভাবে? কে করবে আর তাকে বিয়ে?!”
মানুষ যে কি পরিমাণ খারাপ হতে পারে, তা হয়ত এসব বিপদের মুহূর্তে বুঝা যায়। তবে এতটা নিষ্ঠুরতাও কেউ আশা করেনি এই মুহূর্তে।
এমন সব প্রশ্ন শুনে যেন জয়নুল আরো ছটফট করতে লাগলেন।
এবার অত্যধিক রেগে গিয়ে আমান বলল “চরিত্রহীনা তিথি নয়, আইজা। আর তিথির বিয়ের চিন্তা কারো করতে হবে না, আমি করবো তাকে বিয়ে। আমার তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত-ই তার নির্দোষ হওয়ার প্রমাণ।
এছাড়া আইজার মত মেয়েকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত, তার আসল চেহারা প্রকাশ পাওয়ার পর পরই বাতিল করেছি আমি। এমন প্রতারককে স্ত্রী তো দূরের কথা, নিজের বাড়ির ভৃত্যও রাখব না আমি।
এইবার তিথির চরিত্র সম্পর্কে কেউ আর কোন প্রশ্ন তুলবে না। কারো মুখে আর একটা কথা আমি সহ্য করবো না।”
আমানের এই ঘোষণায় সবাই বাকরুদ্ধ, আইজা তো যেন অতি শোকে পাথর হয়ে গিয়েছে। সে কোন মতে এগিয়ে এসে আমানের সাথে কথা বলার জন্য তার হাত ধরতে গেলে সে এক ঝটকায় তাকে সরিয়ে দেয়। এরপর অতিরিক্ত রেগে বলল “আজ তোমার কারণে এখানে অতিরিক্ত তামাশা হয়েছে , আইজা। যথেষ্ট পরিমাণে।
এখন তোমার গলা টিপে নিজ হাতে তোমাকে হত্যা করার আগে, চলে যাও এখান থেকে। আর যদি নিজের ভালো চাও; তো আর কখনো নিজের এই ঘৃণ্য মুখ দেখাবে না আমাকে।”
এই পর্যায়ে রেহানা লায়লাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন “ভাবী, দয়া করে, আপনাদের মেয়েকে নিয়ে যান এখান থেকে। তার মত একটি মেয়ের দ্বারা সত্যিই এমনটি আশা করি নি। বংশের মান সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিল।”
এতক্ষণ লায়লা ফারুক লজ্জায় এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই কথা শুনে বিব্রত লায়লা এগিয়ে এসে আইজার হাত ধরে টেনে তাকে নিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু আইজা জায়গা থেকে নড়ল না।
সে শেষবার আমানকে বলল “তুমি কি সত্যিই তিথির সাথে বিয়ে করবে নাকি তা কেবল রাগের মাথায় বলা কথা ?”
পর্ব_২৯
আমান তার রক্তলাল চক্ষু দেখিয়ে বলল “আগামীকালই হবে আমাদের বিয়ে। তোমার মত একটা মেয়ের মিথ্যা অপবাদের কারণে তিথির জীবন আর জয়নুল আংকেলের সম্মান নষ্ট হতে দিব না আমি।”
আইজা অশ্রু শুকিয়ে যাওয়া চোখে এক পলক তিথির দিকে তাকিয়ে চলে গেল তার মায়ের সাথে।
আনিস এতক্ষন সেখানে দাঁড়িয়েই চুপচাপ দেখছিল সব। সে নিজেও আইজার দ্বারা এমনটি আশা করেনি।
এখন তার এই ভেবে আফসোস হচ্ছে যে এমন একটি মেয়েকে কীভাবে ভালোবাসতে পারল সে! নির্লজ্জ আর চরিত্রহীন একটা মেয়ে।
এখন সে নিজেও বুঝাবে আমানকে, সাহস দিবে যে যদিও তিথিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত সে গরম মাথায় নিয়েছে, তবে তার উচিত হবে এই সিদ্ধান্তের উপরই স্থির থাকা, কারণ সে একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে অন্তত তার আর তিথির জীবন ধ্বংস হওয়া থেকে বেঁচে যাবে। আনিস সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে যেন আমান তার নেয়া সিদ্ধান্ত অবশ্যই বাস্তবায়ন করে।
.
.
.
রুমে বসে তিশা কাঁদছে আর বলছে “এসব তো হওয়ার কথা ছিল না, তিথি। আমান আর আইজার বিয়ে ভাঙবে, কথা কেবল এটাই ছিল। কিন্তু সবার সামনে এই বংশের প্রতিটি মেয়ের সম্মানে চুল কালি মাখা হয়েছে, যারা এতদিন আমাদের সম্পর্কে কথা বলার সাহস পায় নি, সুযোগ পেয়ে তারাও কত কি শুনিয়েছে।
যৌতুকের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে হয়ত পরীর বিয়েটা ভাঙবে না। কিন্তু আমাদের সম্মান তো ঠিকই একেবারে শেষ।
কিন্তু জানিস কি! এত কিছুর পরও আমার মনে হয়, তুই এই ভেবেই খুশি যে আমানের সাথে তোর বিয়ে হতে চলেছে।”
তিথি বিরক্ত হয়ে বলল “আইজা যতটুকু কেঁদেছে, সমপরিমাণ আমিও কেঁদেছি। মানুষ আমাকেও তো কম কথা শুনায় নি, কম অপবাদ দেয়নি। তবে?!”
তিশা বলল “হ্যাঁ, কিন্তু এসব কিছু তোর সৃষ্টি।তোর ভুলের কারণে এসব হয়েছে। যদিও আমরা এটা পরিকল্পনা করিনি। এমন কিছু হবে, আশাও করি নি। কিন্তু এসব আমাদেরই সৃষ্টি। অথচ আইজা! সে ভিকটিম এসব কিছুর। তার উপর দিয়ে এখন কি বয়ে যাচ্ছে, এটা কেবল সে-ই জানে।
এছাড়া তোর সাথে বিয়ে করে তো আমান সকল অপবাদ থেকে তোকে মুক্ত করে দিচ্ছে। হয়ত এই কারণেও নয়, একটা কারণেই তুই শুধু খুশি যে তোর তার সাথে বিয়ে হচ্ছে, ব্যস। এটাই তো ছিল তোর লাইফটাইম ড্রিম।
যা কিছু হয়েছে এজন্য একটুও আফসোস হচ্ছে না তোর, না?!”
এবার তিথি বেশ বিরক্ত হয়ে বলল “না, হচ্ছে না। একটি পর্যায় পর্যন্ত হচ্ছিল, কিন্তু যখন আমান বলেছে আমাকে বিয়ে করবে, তখন থেকে আর হচ্ছে না।
আমি এসব কিছু তার আর আইজার সম্পর্ক ভাঙানোর জন্য করেছিলাম, কিন্তু দেখ, ভাগ্য তার সাথে আমার জোড়াও মিলিয়ে দিয়েছে। এই থেকে এটাই প্রমাণ হয়, কি রকম পাগলের মত ভালবাসি আমি তাকে, যে ভাগ্যও আমার সহায়তা করেছে।”
তিশা আক্ষেপ করে বলল “তোর কি মনে হয়, এভাবে সম্পর্ক জোড়া লাগে?! এভাবে হয় বিয়ে! স্রষ্টা না করুক, কিন্তু কোন এক সময় যদি সত্য সবার সামনে চলে আসে, কি করবি তুই?!”
তিথি বলল “প্রথমত এমনটা কখনোই হবে না। আর দ্বিতীয়ত, একবার বিয়ে হয়ে গেলেই হলো। বিয়ে হয়ে গেলে ঠিকই সম্পর্ক টেনে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য থাকে সবাই।”
তিশা অবিশ্বাস্যের সাথে বলল “কোন যুগে বাস করছিস তুই, যে বলছিস একবার বিয়ে হয়ে গেলে আর কোন ঝামেলা নেই।
এছাড়া বিয়ে কোন কিছুর শেষ না, এটা একটা শুরু, নতুন কোন জীবনের। বিয়ে কোন কম্প্রোমাইজ না যা কেবল সহ্য করে টিকিয়ে রাখা যায় কোন মতে। বিয়ে এমন একটি সম্পর্ক যা দুজন ব্যক্তি মিলে সুন্দর করে এগিয়ে নিয়ে যায় স্বপ্নের এক ভবিষ্যতের দিকে। যে স্বপ্ন স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে একে অপরের চোখে এঁকে দেয়।
তোর আর আমানের যে পরিস্থিতিতে বিয়ে হচ্ছে তা আদৌও সম্ভব হবে তোদের সম্পর্কে?!
এছাড়া এই যুগে বিয়ের মত সম্পর্কে কম্প্রোমাইজ খুব কম মানুষই করে, বেশিরভাগই তালাকের পথে পা বাড়ায়।
এমনিতে অনেক অনেক শুভেচ্ছা তোকে অবশেষে তোর বিয়ে হতে যাচ্ছে, তোর ভালবাসার মানুষের সাথে।”
এই বলে তিশা তিথির রুম থেকে বের হয়ে যায়।
এসব কথা শুনে, পেয়েও অপ্রাপ্তির সূক্ষ্ণ এক অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল তিথির মনে, যা এই মুহূর্তে স্ফুলিঙ্গ হলেও অদূর ভবিষ্যতে তা আগুন হয়ে তাকে পুরোপুরি দগ্ধ করতে থাকে সর্বক্ষণ।
.
.
.
আইজা নিজের রুম অন্ধকার করে বিছানায় বসে আছে পা তুলে। এখন একদম-ই কাঁদছে না সে। এই একটি সন্ধ্যা যেন তাকে হাজার বছরের ম্যাচিউর একটা ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। মানুষের এত জঘন্য রূপ থাকতে পারে, আগে কেন ধারণা করতে পারে নি সে!
যে তিথির জীবন আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমানের সাথে পর্যন্ত মিথ্যার পর মিথ্যা বলেছে, সে-ই কিনা তাকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছিল, এতটা সময় ধরে!
আর আমান! তার ছোটবেলার ভালোবাসা; মুহূর্তেই অপরিচিত হয়ে গেল তার কাছে। একটি বারের জন্য তার কথা বিশ্বাস করা তো দূরের কথা; এমনকি সবার সামনে তাকে চরিত্রহীন বলতে পর্যন্ত তার মুখে বাঁধে নি। সবার সামনে তার তামাশা বানিয়ে ছেড়ে দেওয়ার আগেও দ্বিতীয়বার ভাবার অবকাশ হয়নি তার।
অথচ তিথির পক্ষে ঠিকই সবার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, তাকে ঠিকই বিশ্বাস করতে পেরেছে। তার চরিত্রের পক্ষে সবার সাথে ঠিকই লড়াই করেছে এবং তাকে নির্দোষ প্রমাণ করেছে।
এইটুকু বিশ্বাস নিয়ে সে ভালোবেসেছিল আইজাকে! যে কাঁচের ঘরের মত এক আঘাতে তা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। এত তাড়াতাড়ি সিন্ধান্তে না পৌঁছে আগে সত্য মিথ্যার যাচাই তো করতে পারত সে?!
বিশ্বাস ঠিক কতটা ছিল তাদের সম্পর্কে? ততটা ছিল কি! যা ভালোবাসাকে সুন্দরতম একটি অনুভূতিতে রূপ দেয়, এই অনুভূতিতে নয় যে ভালোবাসা আসলে কেবলই একটি ভুল ছিল।
সত্যিই বিশ্বাস ছাড়া ভালোবাসা অর্থহীন।
আইজার মস্তিষ্ক যেন ফাঁকা হয়ে গিয়েছে, সে কিছুই ভাবতে পারছে না, কিছুই ভাবতে চাইছেও না। যা কিছু ঘটেছে, তা যদি অতি দ্রুত ভুলে যেতে পারত সে! যে মানুষগুলো তার জীবনে ছিল, তাদের সবাইকে যদি ভুলে যেতে পারত! তা-ও এমনভাবে, যে এমন কেউ কখনো ছিলই না তার জীবনে। বা এমন কিছু কখনো ঘটেই নি তার সাথে।
বাইরে থেকে তার মায়ের উচ্চ স্বর ভেসে আসছে, ড্রয়িংরুমে বসে তিনি ফারুকের সাথে কথা বলছেন। কথা না আসলে আইজার ক্রিটিসাইজ করছেন।
লায়লা বলে চলেছেন “কি মেয়ে জন্ম দিলাম আমি! আজ তার জন্য সবার সামনে কতটা অপমানিত হতে হয়েছে আমাদের। আমার তো সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল যেন মাটি সরে যাক, আর আমি এর মধ্যে ঝাঁপ দেই। কাউকে মুখ দেখানোর যোগ্য রাখে নি সে আমাদের।
আরে যদি ওই থার্ড ক্লাস রোড সাইড রোমিওকেই তোমার মেয়ের পছন্দ ছিল, তাহলে আমানের সাথে বিয়ে করতে চেয়েছিল কেন, কেন আমাদের পাঠিয়েছিল আমানের বাবা মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে?! আমাদেরকে কারো কাছে মুখ দেখানোর যোগ্য রাখে নি তোমার মেয়ে। এরচে ভালো হত, জন্ম হওয়ার পর পরই যদি মারা যেত সে।”
এবার ফারুক আপত্তি করে বললেন “কি বলছ এসব?! কথা বলার আগে ভেবে কথা বলো!
এছাড়া আস্তে বলো। সে শুনলে কি ভাববে?!”
উচ্চ স্বরেই লায়লা বললেন “শুনুক সে, তাকে শুনানোর জন্যই জোরে বলছি। এমনিতে তো যে ধরনের নির্লজ্জ সে! একজনের সাথে এ্যাংগেইজড হওয়ার পরও আরেকজনের সাথে প্রেম করে বেড়ায়। আমার কথা শুনে যদি একটু লজ্জা হয়!”
ফারুক বললেন “ব্যস অনেক হয়েছে, লায়লা। থামো এবার।”
এই বলে ফারুক উঠে নিজের রুমে চলে গেলেন।
লায়লার কথা শুনে আইজার শুকিয়ে যাওয়া চোখ আবারও অশ্রুতে পূর্ণ হতে লাগলো। কিন্তু সে আর কাঁদতে চায় না। এই অল্প সময়ের ব্যবধানে সে শতাব্দীর মত লম্বা সময়ের অশ্রু ঝড়িয়েছে। কিন্তু অবাধ্য অশ্রু যেন বাঁধ মানছে না।
আমানকে হারানোর চেয়ে বেশি কষ্ট, তিথির প্রতারণার চেয়ে বেশি কষ্ট তার এই ভেবে হচ্ছে যে আজ সবার সামনে তার চরিত্রে কালিমা লেপন করা হয়েছে। সবার সামনে তাকে চরিত্রহীনা বলা হয়েছে। সবাই মিলে তার চরিত্র নিয়ে কত কি বলেছে; কত প্রশ্ন তুলেছে! এসব কীভাবে সহ্য করবে সে?!
মনের শান্তি যেন সে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে। একটু শান্তির জন্য জায়নামাজ নিয়ে বসে পড়ল। মোনাজাত ধরে কত কান্নাকাটি করে যাতে এই অপমান থেকে, এই অশান্তি থেকে সে মুক্তি পায়। যেন মনের শান্তি খুঁজে পায়।
আর এসব থেকে বের হয়ে আসতে পারে, সবকিছু ভুলে যেতে পারে।
.
.
.
দুদিন পরের কথা। আইজা নিজের অন্ধকার রুমে বসে আছে। তার রুমের দরজা নক করে তখন ফারুক প্রবেশ করলেন। খাবারের ট্রলি সাইডে রেখে তিনি আইজার পাশে বসলেন। এরপর বললেন “ঘর অন্ধকার করে, খাবার দাবার ঠিকভাবে না করে এভাবে বসে থাকলে কি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে?! তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। কিছু খেয়ে নাও।”
এরপর একটু থেমে বললেন “এছাড়া অন্যরা তো ঠিকই নিজেদের জীবনে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, তুমি ছাড়া।
নিশ্চয়ই জানো, আমান আর তিথির বিয়ে পড়ানো হয়ে গিয়েছে, তারা স্বামী স্ত্রী এখন।”
আইজা মুখ খুলে বলল “সুখী হোক নব দম্পতি।” তবে তাকে কেমন যেন একদম নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছিল ফারুকের কাছে। মেয়ের এমন অবস্থা যেন তার সহ্য হচ্ছিল না।
ফারুক বেশ কাতর কন্ঠে বললেন “তুমি কেন এমন করলে, মা?! আমি জানি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু…” এই বলে ফারুক আর কিছু বলতে পারলেন না।
আইজার যেন এবার ভাবান্তর ঘটল, সে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল “আমার কষ্টের সবচেয়ে বড় কারণ কি জানো? কেউ বিশ্বাস করে নি আমায়। কেউ বিশ্বাস করে নি আমার কোন কথায়। সবাই আমার চরিত্র নিয়ে কত কি বলেছে!
এখন আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করি, বাবা। তুমিও কি মনে করো যে আমি কোন অপরাধ করেছি?! তুমি বিশ্বাস করো আমায় নাকি অন্য সবার মত তোমারও মনে হয় যে আমি দোষী। ”
কাঁপা কন্ঠে ফারুক বললেন “বিশ্বাস করি। আমার আইজার উপর আমার পুরো আস্থা আছে।
কিন্তু আমি এটা মানতে পারছি না যা তুমি সেদিন বলেছ; তিথি কেন এমন করতে যাবে, মা?!”
আইজা অন্যমনস্ক দৃষ্টি শূন্যে স্থির রেখে বলল “প্রথমে আমিও বুঝিনি। তবে পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছি।
সে যা চেয়েছিল, তা পেয়েছে। কিন্তু নিজের জিদ পূরণের জন্য আমার জীবনটা এভাবে ধ্বংস না করলেও পারত! অন্যভাবে আদায় করে নিত যা তার চাই। এতটা কষ্ট হত না আমার। ভুলে যেতাম আমি সবকিছু।
প্রয়োজনে মেরে ফেলত আমায়। অন্তত এই অপবাদ নিয়ে তো বাঁচতে হত না আমার। আমার আত্না মেরে ফেলেছে তারা সবাই মিলে, আমি জীবিত থেকেও মারা গিয়েছি, বাবা।”
ফারুক আইজার অবস্থা দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন “আমাকে ক্ষমা করে দাও, মা। তোমাকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য কিছুই করতে পারি নি আমি।
তবে জানো কি! মানুষ মানুষের প্রতি যতই অবিচার করুক, অপবাদ দিক, কিন্তু উপরে একজন ঠিকই আছেন, তুমি যদি সত্যিই নির্দোষ হয়ে থাকো, তবে তিনি অবশ্যই এর সাক্ষী। আর তোমার রব যখন এই বিষয়ের সাক্ষী তখন মানুষ তোমাকে নিয়ে কি ভাবছে না ভাবছে, তা চিন্তা করে নিজের মন ছোট করতে হবে না, মা। তুমি একজন সৎ চরিত্রবান মেয়ে তার সাক্ষী তোমার রব, এখন আমি তোমাকে প্রশ্ন করি, তোমার কাছে কার গুরুত্ব বেশি, মানুষের নাকি তোমার স্রষ্টার?! যদি তোমার জবাব হয় স্রষ্টার, তাহলে মানুষ কি ভাবছে না ভাবছে, সেই বিষয়ে আর কখনো ভেবে নিজেকে কষ্ট দিবে না। যদি ভাবতেই হয়, এই বিষয়ে ভাবো, সবসময় তোমার স্রষ্টার দৃষ্টিতে কীভাবে ক্লিন থাকতে পারবে!
অনেকে দেখা যায়, মানুষের দৃষ্টিতে অনেক ভালো, কিন্তু তাদের অপকর্মের সাক্ষী তাদের স্রষ্টা। তারা বেশি ভালো নাকি তারা যারা প্রকৃতপক্ষে কোন দোষ না করলেও মানুষ ঠিকই ভুল বুঝে, কিন্তু তাদের স্রষ্টা তাদের ব্যাপারে সব খবর রাখেন, এবং তাদের গোপন বা প্রকাশ্যে করা সকল গুনাহ এর সাক্ষী থাকেন!”
আইজা মন্ত্রমুগ্ধের মত তার বাবার কথা শুনছিল, কিন্তু তার বাবার কথা শেষ হলে সে মন খারাপ করে বলল “যদিও এই বিষয়ে আমি নির্দোষ, তবে আমি নিজেও অনেক পাপী বান্দা। ছোট এই জীবনে হয়তো অনেক পাপ করেছি, ভবিষ্যতেও হয়ত অনেক করবো, সুতরাং স্রষ্টা আমার কথা কেন শুনবেন?!”
ফারুক নিজের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন “আমাদের পাপের পরিমাণ স্রষ্টার রহমতের কাছে অতি নগন্য, মা। স্রষ্টার রহমতের কোন সীমা পরিসীমা নেই।
কেউ যদি সত্যিকার মনে স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চেয়ে তার কাছে কিছু চায়, তিনি কখনো তা ফেলে দেন না। তবে সেই সমস্ত পাপের দিকে যাতে সে কখনো ফিরে না যায় যা সে করলে সে মনে করে, স্রষ্টা কখনো তার কথা শুনবে না; এই বিষয়েও তার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।
এছাড়া মা, তুমিও নিজের মনের হারিয়ে যাওয়া শান্তি খুঁজে পাবে, যা কিছু হয়েছে, সব ভুলে নতুন করে নিজের জীবন গুছাতে পারবে। আর বাবা হিসেবে তোমার জন্য আমি সবসময় এটাই দোয়া করে যাচ্ছি, তোমাকে যেন এসব থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। জীবনে যেন অনেক সুখী হও, অতীতের ছায়া যাতে কখনো তোমার ভবিষ্যতের উপর না পড়ে।”
.
.
.
কয়েকদিন এভাবেই অতিবাহিত হয়ে গেল। ফারুক এই কয়েকদিনে আইজার সেবা যত্নে কোন ক্রুটি রাখেনি। আইজা যদিও ভয়াবহ ডিপ্রেশেনের রোগীতে পরিণত হয়েছে তবে তার বাবার কথাগুলো তার কাউন্সিলিং এর মতোই মনে হয়। এই কারণে ফারুকের অনেক বার বলা সত্ত্বেও সে কোন সাইকোলজিস্টের কাছে যায় নি কাউন্সিলিং এর জন্য।
একদিন বিকেলে ফারুক আর আইজা একসাথে বসেছিল। তখন লায়লা এসে তাদের সাথে বসে বলতে লাগলেন “আমি সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি, আইজা কিছুদিনের মধ্যেই তার খালার কাছে অস্ত্রেলিয়া যাবে। সেখানের কোন ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করুক, এরপর জব নিয়ে সেখানেই সেটেল হয়ে যাক।
আমি চাই না সে এখানে থাকুক। যদিও এর অনেকগুলো কারণ আছে, তবে একটি কারণ এই মুহূর্তে-ই তোমাদের জানিয়ে দেই, তাকে সবসময় নিজের চোখের সামনে দেখতে চাই না আমি। সহ্য হয়না আমার!”
ফারুক বললেন “যথেষ্ট বলে ফেলেছ লায়লা।আইজা মেয়ে তোমার, তার মানসিক অবস্থা কতটা বিপর্যস্ত তা জেনেও তার সামনে বসে এসব বলছ?!
এছাড়া এটা আইজারও বাড়ি। কোথাও যাবে না সে, এখানেই থাকবে।”
আইজা তার বাবার উদ্দেশ্যে বলল “ইটস্ ওকে, বাবা। মা ভালো করেছে আমার যাওয়ার সব ব্যবস্থা করছে, এমনিতেও আমি নিজেও এখানে থাকতে চাই না। এই পরিবেশ থেকে বের হতে পারলে, একটা আজাব থেকে মুক্তি পেয়ে যাব।আমি নিজেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে চাই এখান থেকে।”
এই বলে উঠে সে নিজের রুমে চলে যায়।
ফারুক লায়লার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে মাথা নেড়ে তিনিও উঠে গেলেন। লায়লা চোখে অশ্রু নিয়ে সেখানে বসে রইলেন, মেয়ের প্রতি তার মনে অনেক অনেক অভিমান জমে আছে, যা তাকে নিজের সন্তান থেকে এভাবে দূরে রেখেছে।
কয়েকদিন পর সব প্রসেসিং শেষে অস্ত্রেলিয়া চলে যায় আইজা। সেখানে গিয়ে সেখানকার পরিবেশ আর মানুষজনের সাথে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লেগে যায় তার।
তবে সেখানে নিজের জীবন নতুনভাবে সাজানোর একটি সুযোগও যেন সে পায়। দম বন্ধ হওয়া সেই পরিবেশ, তার সেই অবস্থা থেকে বের হয়ে, নতুন এই জায়গায় এসে, এখন যেন দম ভরে নিঃশ্বাস অন্তত নিতে পারছে সে।
মানসিক সেসব ট্রমা থেকেও সে আস্তে আস্তে রিকোভারি করছিল।
সেখানের একটি ভার্সিটিতে মাস্টার্স কোর্সে ভর্তি হয় সে, তার রেজাল্ট বেশ ভালো ছিল বিধায় স্কলারও পেয়ে যায় খুব সহজে। এছাড়াও সে সাবজেক্ট রিলেটেড আরো কিছু কোর্সে ভর্তি হয়। এবং আস্তে আস্তে নিজের প্রাত্যহিক জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ফারুকের সাথে নিয়মিত ফোনে কথা হত তার, যদিও লায়লা খুব একটা কথা বলত না।
আইজা নিজের জীবন এত সুন্দর করে গুছিয়ে নিচ্ছে, ভার্সিটি, ফ্রেন্ডস, পড়াশোনা এসব নিয়ে বেশ ভালোই কাটছে তার সময়। বেশ ভালোই আছে সে, তা দেখে লায়লা ফারুক মনে মনে ভীষণ স্বস্তি পায়।
এদিকে স্বনির্ভরতায় বিশ্বাসী আইজা পার্ট টাইম জব করাও শুরু করে। এবং নিজের টাকায় এটা সেটা কিনে মাঝে মধ্যেই বাবা মায়ের জন্য দেশে পাঠিয়ে দেয়, পরিচিত কেউ দেশে আসার সময়।
অপরদিকে তিথি আর আমানের জীবনও খুব খারাপ কাটছিল না। আমান সবসময় আন্তরিকভাবে চেষ্টা করত, তাদের মধ্যে যেন সবকিছু ঠিকঠাক থাকে। আমান তিথিকে স্ত্রীর মর্যাদা, সম্মান সবকিছুই দিত। কিন্তু মন থেকে কেন যেন তাকে মেনে নিতে পারছিল না। চেষ্টা সে ঠিকই সর্বোচ্চ করছিল, এরপরও পারছিল না। হয়তো স্বপ্নে অন্য কাউকে নিজের স্ত্রীর আসনে দেখে অভ্যস্ত, অন্য কারো সাথে নিজের সাজানো জীবন কল্পনা করে রেখেছিল সারাজীবন ধরে। সেজন্য তিথিকে সেই একই স্থানে মেনে নিতে এত কষ্ট হচ্ছে তার।
আমান কিছু না বললেও তিথি বিষয়গুলো বুঝে। আমানকে তার খুব বেশি সুখী মনে হয়না যদিও সে কোন চেষ্টাই বাদ রাখে নি তাকে সুখী করতে।
কিন্তু আমানের তার প্রতি এতটা আদর, যত্ন, সোহাগ, সহানুভূতি; মোট কথা, এতটা দায়িত্ববোধ দেখে তার নিজেকে খুবই সুখী মনে হয়। আমান সত্যিই খুব যত্ন নেয় তার। তার সব দায়িত্ব খুব ভালোভাবে পালন করে।
তিথি তো এটা ভেবেই খুশিতে আত্মহারা থাকে যে তার ভালোবাসা এখন কেবলই তার। সারাজীবন তারই থাকবে।
.
.
.
এভাবেই কেটে গেল কয়েকটা বছর। একদিন আইজার ফোনে তার মায়ের কল আসে। সে কিছুটা অবাক হয়ে কল রিসিভ করে হ্যালো বলার পর তার মা বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে তার সাথে কথা বলতে লাগলেন।
লায়লার কথা বলার ধরনে, বেশ কিছু বছর আগের কথা মনে পড়ে যায় আইজার। যখন তিনি এভাবেই ভালোবেসে কথা বলতেন তার সাথে।
কিন্তু এখন আর খুব একটা আবেগী হতে পারে না আইজা। কেন যেন চাইলেও তেমন একটা আবেগ কাজ করে না আর কোথাও।
কথা বলার এক পর্যায়ে লায়লা বললেন “জানো, আইজা! রাজিবের ব্রেন টিউমার হয়েছে। তাকে অপারেশন করা হবে কয়েকদিনের মধ্যে। অবস্থা বেশি ভালো না। বাঁচবেও কিনা কে জানে?!”
এই খবর শুনে আইজার বিশেষ কোন ভাবান্তর হলো না। সে বলল “আচ্ছা?! খারাপ খবর। আল্লাহ সেফা দান করুন।”
লায়লা বললেন “কি বললে, ঠিক বুঝলাম না।”
আইজা বলল “বললাম যে আল্লাহ সুস্থতা দান করুন।
আসলে আমাদের এখানে একটি আরব ছেলে আছে, তার থেকে সুযোগ পেলে একটু আধটু আরবি শিখে ফেলি, এই আর কি। আর মাঝে মধ্যে তা এ্যাপ্লাইও করি।”
লায়লা কনফিউজড হয়ে গেলেন, এমন খবরে আইজার এই ধরনের মন্তব্যে। তবু তিনি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললেন “আইজা, তোমার কাছে যদি একটা অনুরোধ করি, রাখবে?”
আইজা বলল “আরে, অনুরোধ কেন, হুকুম করো, তুমি।”
লায়লা বললেন “একসময়, সবসময় সিরিয়াস থাকা আমার এই মেয়েটি হঠাৎ এত চঞ্চল, রসিক হয়ে গেল কীভাবে! যে সিরিয়াস কোন বিষয়েও এভাবে রসিকতা করছে।”
এবারও সিরিয়াস না হয়েই আইজা বলল “আসলে উমর ঠিক এরকম, আমার মনে হয়, তার সাথে থাকতে থাকতে আমিও এমন হয়ে যাচ্ছি। আরে উমর, সেই আরব। খুবই ভালো ছেলে। তার মত ভালো ছেলে আমি আমার লাইফে কম দেখেছি, খুবই ভদ্র।”
এবার লায়লা বললেন “উমর আর তুমি কেবল বন্ধুই তো?!”
আইজা হেসে বলল “এখন পর্যন্ত তো কেবলই বন্ধু। তবে আমার মনে হয়, উমর আমাকে লাইক করে। আর সত্যি বলতে, তার নম্রতা ভদ্রতা দেখে আমিও ইমপ্রেস। সে যদি আমাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করে আমিও হ্যাঁ বলে দিবো।”
লায়লা বললেন “তুমি একজন আরবের সাথে বিয়ে করবে?! আর বিয়ের পর কি আরবে সেটেল হয়ে যাবে?”
আইজা হেসে বলল “সে অস্ত্রেলিয়া সিটিজেন, মা। এছাড়া ভুল বলেছিলাম, সে হচ্ছে আরব বংশোদ্ভূত। এবার ক্লিয়ার। এছাড়া তার বাচ্চা দুইটাও বেশ কিউট। একদম বাবার মত হয়েছে।”
লায়লা আঁতকে উঠে বললেন “তার আবার বাচ্চাও আছে, তা-ও দুইটা?! আইজা, তুমি পাগল হয়ে যাও নি তো! আর তার স্ত্রী?!”
আইজা বলল “মা, রিলেক্স। তার স্ত্রী তাদের দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার সময়ই মারা যান, আল্লাহ জান্নাত নসিব করুন।
এছাড়া সে বিবাহিত বলে তার সব সৎ গুণগুলো ভেনিশ হয়ে যায় নি। যে মানুষটার স্বভাব চরিত্র এতটা ভালো, কেবলমাত্র এই একটি কারণে যে তার স্ত্রী ছিল বা মারা গিয়েছে; তাকে জাজ করা কি ঠিক হবে?! এছাড়া কারো স্ত্রী মারা গেলে এটা তার জন্য তো দোষের কিছু না।
আর মা, প্রেমে পড়িনি আমি তার। আমরা দুজন বেশ বুঝের, একে অপরের সব সৎ গুণ বদগুণ সব পর্যবেক্ষণ করে একে অপরকে পছন্দ করেছি কেবল। তা-ও কেউ কাউকে কিছু বলিও নি এখনো। আমরা যথেষ্ট ম্যাচিউর, এমন তো নয়, একে অপরের প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি আর বিয়ে না হলে মারা যাবো!
যাই হোক। অনেকক্ষণ তো কথা বললাম। এবার রাখি তাহলে। পরে কথা বলবো। এমনিতেও অফিসের অনেক কাজ পড়ে আছে যা আমি বাসায় নিয়ে এসেছি, যা আমার আগামীকালের মধ্যে শেষ করতে হবে। তো রাখি তাহলে?”
এতক্ষণ লায়লা চুপ করে মেয়ের কথা শুনছিলেন, তার মনে হলো, এই আইজা আর সেই আইজা আসলেও এক না। এই আইজা অনেক বুঝের, গোছানো একটি মেয়ে, যে কিনা যেকোনো এলোমেলো পরিবেশও একেবারে গুছিয়ে দিতে পারবে নিমিষেই। আসলে প্রবাস জীবন মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়, হাজার রকমের মানুষের সাথে মিলে মিশে মানুষ বেশ বিচক্ষণও হয়ে উঠে।
ফোন রেখে দেয়ার কথা শুনে লায়লা ব্যস্ত হয়ে বললেন “না না, যে কথা বলার জন্য, তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম তা তো বলাই হয়নি।”
আইজা বলল “আচ্ছা বলো তাহলে।”
লায়লা বললেন “যে অনুরোধ করতে চেয়েছিলাম আর তুমিও বলেছ হুকুম করো, হুকুম; তা তো না শুনেই রেখে দিচ্ছিলে!”
আইজা বলল “ওকে সরি, এবার বলো।”
লায়লা বললেন “মা, অনেকদিন তোমাকে দেখি না। একবার দেশে আসতে পারবে প্লিজ?!”
আইজা বলল “এই সময়ে দেশে আসাটা আসলে কঠিন। মাস্টার্স ডিগ্রি পাশাপাশি বেশ কিছু কোর্স কমপ্লিট করে নতুন নতুন জবে ঢুকেছি মাত্র। ছুটি না পাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। আর দেশে আসতে হলে চাকরি ছাড়তে হবে, যা মারা গেলেও আমি ছাড়বো না। এত এত কোর্স ডিগ্রি অর্জন করে এজন্য নাকি এত ভালো জবে ঢুকেছি?!
এই জবে আমার ফিউচার আর ক্যারিয়ার কাঁচের আয়নার মত স্বচ্ছ। মোট কথা, এখনই দেশে আসতে পারব না। আগে সেটেল হই, এরপর নাহয় একেবারে তোমার জামাই সাথে নিয়েই আসব।”
লায়লা বললেন “সিরিয়াস কথার শেষেও রসিকতা না করলে হয়না? এসব রসিকতা বন্ধ করো আইজা।
এছাড়া হয়তো ততদিনে এসে দেখবে, তোমার মা আর বেঁচে নেই। লাশটিও হয়ত দেখার ভাগ্য হবে না তোমার।”
আইজা এবার কিছুটা সিরিয়াস হয়ে বলল “মা… তুমি।”
লায়লা বললেন “তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, মা। শরীরটাও খুব একটা ভালো না। এছাড়া তোমার সাথে করা দুর্ব্যবহারগুলো মনে হয়ে আরো অসুস্থ বোধ করি। আইজা প্লিজ, একবার এসে দেখে যাও মাকে।”
আইজা টেবিলে কনুই রেখে কপালের কাছের মাথার চুলগুলো মুঠিবদ্ধ করে ধরে বলল “আমার জায়গায় তুমি হলে নিজের ক্যারিয়ারের ব্যাপারে করতে কোন কম্প্রোমাইজ?! কারণ এই পর্যন্ত এই জিনিসটা আমি করতে দেখিনি তোমায়।”
আইজা বুঝতে পারল তার মা ওপাশ থেকে কাঁদছে। আইজা মুচকি হেসে বলল “আমার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই কাঁদতেও শুরু করে দিয়েছ!
আমি আসছি। প্রয়োজন হলে চাকরি ছেড়েই আসব।”
এরপর একটু থেমে আবার কিছুটা চঞ্চল হয়ে বলল “তোমার সব কথা শেষ হয়ে থাকলে এখন তবে রাখতে পারি, এখনো আমার অনেক কাজ পড়ে আছে কিন্তু ?!”
লায়লা কান্নারুদ্ধ কন্ঠে বললেন “ধন্যবাদ মা, ভালো থাকো তুমি।”
এরপর দুই পাশ থেকে দুজন লাইন কেটে দেয়। কল কাট করে ফোন কান থেকে নামিয়ে কিছুক্ষণ সেভাবেই বসে রইল আইজা। দেশে ফিরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার নেই, কেবল মায়ের জন্য যেতে হচ্ছে। সে ভাবতে লাগলো, এটাই তার শেষ যাওয়া, এরপর ব্যবস্থা করে বাবা মাকেও এখানেই নিয়ে আসবে সে। চিরতরে।
চলবে…