জিদ_অনুভূতির_অন্য_এক_স্তর #পর্ব_৩০+৩১

0
406

#জিদ_অনুভূতির_অন্য_এক_স্তর
#পর্ব_৩০+৩১
#লেখিকা : #Kaynat_Ash

অবশেষে দেশের মাটিতে পা রাখে আইজা। যখন থেকে তার প্লেন ল্যান্ড করেছে, ফোনের মাধ্যমে তাকে মিনিটের মিনিটের আপডেট দিতে হয়েছে লায়লাকে, যে এখন কোন জায়গায় আছে, এই মুহূর্তে কোথায় পৌঁছিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। একটু পর পরই লায়লার কল আসছিল তার ফোনে। আইজা তো একবার বিরক্ত হয়ে ভাবল ফোন-ই অফ করে দেয়। কিন্তু তার মা বাবা আবার দুশ্চিন্তা করবেন ভেবে আর করে নি।

দেশের মাটিতে পা রেখে তার আলাদা এক অনুভূতি কাজ করছিল, হাজার হোক, নিজের দেশ, নিজের মাটি। অথচ কিছু মানুষ আর স্মৃতির জন্য এই দেশ চিরতরে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তাকে। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আইজা প্রাইভেট কারের জানালা দিয়ে নিজের জন্মভূমি দেখতে লাগল, কতদিন পর চোখগুলো এতটা শান্তি পাচ্ছে।

তবে সে তখনও জানে না, অদূর ভবিষ্যতে এখানেই তার ভাগ্যের অসমাপ্ত রেখা আবারও টানার চেষ্টা করা হবে।

বাসায় পৌঁছে কলিং বেল দেয়ার পর তার বাবা মা একসাথে এসে দরজা খুলে দিলেন, আইজা উচ্ছ্বসিত হয়ে তাদের জড়িয়ে ধরল, তারাও এতদিন পর মেয়েকে পেয়ে খুবই খুশি।

তখন আইজা মেকি রাগ দেখিয়ে তার বাবার উদ্দেশ্যে বলল “তোমার উচিত ছিল, আমাকে নিতে এ্যায়ারপোর্ট যাওয়া। যেহেতু যাও নি এখন আমি যা বলবো, তাই শুনতে হবে। আমি অনেকগুলো আরব ডিশ শিখে এসেছি, আমি আর তুমি মিলে সবগুলো ট্রাই করব, আর মাকে দিয়ে টেস্ট করাবো।”

ফারুক হেসে বললেন “আমার মেয়ে অস্ত্রেলিয়া গিয়ে আরব ডিশ শিখে আসল কীভাবে, কে শিখিয়েছে তোমাকে সেখানে আরব ডিশ ?!”

আইজা বলল “অফিস কলিগ, এন্ড ফ্রেন্ড। পোস্টে আমার সিনিয়র। ছুটি ম্যানেজ করতে সে অনেক সাহায্য করেছে আমাকে, নাহলে ছুটি ম্যানেজ করাটা একটু কঠিন ছিল আমার পক্ষে। এছাড়া খুবই ভালো মানুষটা, অনেক হেল্পফুল।”

ফারুক লায়লার দিকে এক পলক দেখে আইজার দিকে তাকিয়ে মজা করে বললেন “ছেলে নাকি মেয়ে ভালো মানুষটা?”

আইজা বলল “উমর নাম, বাকিটা তুমি অনুমান করে নাও ছেলে নাকি মেয়ে।”

এরপর দুজনই হাসতে লাগল। এই পর্যায়ে লায়লা বললেন “আসতে না আসতে দুই বাবা আর মেয়ের শুরু হয়েছে।

এছাড়া বলছে কিনা নিজেরা এক্সপিরিমেন্ট করে খাবার বানাবে আর আমাকে বানাবে গিনিপিগ।

যাই হোক, এখন দরজার উপর দাঁড়িয়েই তোমাদের এসব চলতে থাকবে, নাকি, আইজা, ভিতরেও প্রবেশ করবে তুমি।
এছাড়া জানো, ভিতরে তোমার জন্য অনেক বড় সারপ্রাইজ আছে।”

আইজা বলল “সারপ্রাইজ?! এই একটি শব্দ আমি মনে প্রাণে অপছন্দ করি। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু উপস্থাপনকেই ঢং করে সারপ্রাইজ বলা হয় তো। কিন্তু আমি আমার লাইফে সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক চাই, অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু নয়।”

ফারুক বললেন “এখন দরজার উপর দাঁড়িয়েই কথা বলতে থাকবে নাকি প্রবেশও করবে?!”

আইজা বলল “মা সারপ্রাইজের কথা বলে ভেতরে প্রবেশ করার আগ্রহটাই শেষ করে দিয়েছে, ইচ্ছা করছে দরজা থেকেই ফিরে যাই।”

লায়লা বললেন “আইজা! এত রসিকতা ভালো না, মা। ভেতরে এসো।”

আইজা বলল “ভিতরে তো আসবই, এতদূর থেকে এসে সত্যিকার অর্থে দরজা থেকে তো নিশ্চয়ই ফিরে যাব না, এটা তো কমন সেন্স।
যাই হোক, আমার ব্যাগগুলো গাড়িতে আছে। ওগুলো…।”

লায়লা বললেন “ওগুলো নিয়ে পালিয়ে যাবে না কেউ, কাজের লোককে পাঠাচ্ছি, এখনই নিয়ে আসবে। এবার আসবে তুমি নাকি আমি দরজা বন্ধ করে দিব।”

আইজা বলল “আসছি তো, মেয়েকে এতদূর থেকে জোর করে আনিয়ে মুখের উপর দরজা লাগানোর কথা বলছ, আজব তো!” কথা বলতে বলতেই প্রবেশ করল আইজা।

তারা তিনজন ড্রয়িংরুমে আসার পর আইজার মুখ অটো বন্ধ হয়ে যায়। সত্যিই এমন কোন সারপ্রাইজ সে আশা করেনি।

ড্রয়িংরুমে আমান তিথি আর তাদের পরিবারের সবাই বসে ছিল।
তাদের দেখে কয়েক মুহূর্ত যেন শকে ছিল আইজা। এরপর নিজ থেকেই স্বাভাবিক হয়ে লায়লার দিকে তাকিয়ে বলল “যেদিন আমার ল্যান্ড করার কথা, সেদিনই কোন এক বিষয়ে তোমার এসব দাওয়াত রাখতে হলো? আজব! সবাইকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে আজ খাওয়াচ্ছ, আমাকে আগে জানিয়ে রাখলেই পারতে।

যাই হোক, তুমি তাহলে মেহমানদের এখন সময় দাও, আমি গিয়ে ফ্রেশ হই। এমনিতেও খুব টায়ার্ড আমি। বিশ্রামেরও প্রয়োজন।”

এই বলে আইজা চলে যেতে নিলে সবার সামনেই আমান আইজার হাত ধরে তাকে থামায়।

আমানের এমন ব্যবহারে আইজা হতবিহ্বল হয়ে যায়। সে এক টানে নিজের হাত ছাড়িয়ে বেশ রুক্ষভাবে বলল “পৃথিবীর সবকিছু বদলে গেলেও তুমি কখনো বদলাবে না, নিজের যা খুশি, যখন খুশি তাই করবে। নিজের স্ত্রী এখানে বসা, পুরো পরিবার বসে আছে, অথচ তোমার কোন কিছুতেই কিছু যায় আসে না। আদব লেহাজ তো এর আগেও কখনো তোমার মধ্যে এমনিতেও ছিল না।

এমনিতে কোন সাহসে তুমি আমার হাত ধরেছ?! এছাড়া মনে নেই, আমি তো প্রতারণা করেছিলাম তোমার সাথে। আমার চেহারা যেন কখনো তোমাকে না দেখাই, নাহলে আমাকে হত্যা করবে, এটাই বলেছিলে না তুমি?!

আমার বাসায় যদি এই মুহূর্তে তুমি বসে না থাকতে, আমার মৃত্যু ঘটলে আমার লাশের মুখও দেখতে না তুমি!”

বাসার সবাই লজ্জিত অবস্থায় বসে রইল, কেউ যে কিছু বলে আইজাকে শান্ত করবে, সেই সাহসটাও কারো নেই। আইজার রাগ তো ন্যায়সঙ্গতই, কতকিছু সহ্য করতে হয়েছে তার। অথচ দোষ তো কখনো তার ছিলই না।

আইজার কথার এই পর্যায়ে তাকে থামিয়ে আমান বলল “আইজা প্লিজ, এভাবে বলো না। আমাকে আর লজ্জিত করো না। আমি তোমার সাথে যা করেছি, তা সত্যিই ক্ষমার অযোগ্য।”

আইজা বলল “এক সেকেন্ড, কি করেছ তুমি?! না, আসলে আমার মনে পড়ছে না তো, তাই জিজ্ঞেস করলাম। আমি ভুল কিছু বললে আমাকে শুধরে দিও।

তুমি তো কিছুই করো নি, করেছিলাম তো আমি। তোমার সাথে এ্যাংগেইজমেন্ট হওয়ার পরও একজনের সাথে সম্পর্ক ছিল আমার।
আর তুমি কি-ই বা করেছ?! আমার সমস্ত সত্য সবার সামনে নিয়ে আসো। পুরো বাড়ি ভর্তি মেহমানদের সামনে আমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলেছ, এ্যাট দ্যা সেইম টাইম, এই পুরো কাহিনীর রচয়িতাকে খুব ভালোভাবে প্রটেক্ট করেছ, সবার সামনে আমাদের বিয়ে ভেঙে পরদিন অন্য কাউকে বিয়ে করেছ।

আমাকে একা করে দিয়েছিলে, সম্পূর্ণ একা।

তোমরা সবাই মিলে কাউকে মুখ দেখানোর যোগ্য রাখো নি আমায়।
কেবলমাত্র এসবই তো করেছিলে।”

এই পর্যায়ে আইজার গলা ধরে আসে, সে বাচ্চাদের মত ঠোঁট উল্টে কান্না থামানোর চেষ্টা করে চোখের অশ্রু উল্টো হাতে মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল “অনেকদিন ধরে আমার মনে যে পরিমাণ ক্ষোভ জমা ছিল, না চাইতেও সবার সামনে এই সিন ক্রিয়েট হয়ে গিয়েছে। নাহলে তোমার মত সবার সামনে তামাশা করার মত মানুষ আমি নই।”

এই বলে আইজা ভেতরে যেতে নিলে আমান আবারও তাকে বাঁধা দিয়ে বলল “তুমি এভাবে যেতে পারো না। একবার আমার কথা…।”
আইজা আমানের কথার মাঝখান দিয়ে বেশ ঠান্ডা স্বরে বলতে লাগলো ” আমি আগের সেই আইজা নই আমান, যার পথ আটকে যা খুশি তুমি করতে পারবে। ভয় তো আমি তখনও পেতাম না তোমাকে, কিন্তু তখন ভালোবাসা ছিল, আর এখন তো সেটাও নেই।

কষ্ট মানুষকে অনেক বেশি স্ট্রোং করে দেয়। যে যত বেশি কষ্ট পায়, তার ধৈর্য ক্ষমতা, তার ধারণা শক্তি তত বাড়তে থাকে। আর আমি কষ্টের সব পর্যায় পার করে এসেছি, সুতরাং আমার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শক্তি আর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে লাভ নেই।

নিজের স্ত্রীকে সাথে নাও, আর বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে।

আমি এমনটা বলতে চাই নি কিন্তু তুমিই বাধ্য করেছ আমাকে।”
এই বলে আইজা নিজেও আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় নি সেখানে। নিজের রুমে চলে আসে।

রুমের দরজা বন্ধ করে সে বিছানায় এসে বসে, দুহাত চোখের সামনে তুলে ধরে দেখে তা এখনও কাঁপছে। সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না এসবের জন্য। আমানকে ফেইস করার জন্য। কেন তাদের সামনে পড়তে হলো তাকে, যাদের জীবনে আর কখনো দেখতে চায় নি সে।

তবে একটা জিনিস ভেবে ভেবে আইজা মাথা ফাটিয়ে ফেলছে যে, সব সত্য তো মাটি চাপা পড়েই গিয়েছিল, তবে তা সবার সামনে প্রকাশ পেল কীভাবে?!

সে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে বসেছে কেবল। এরমধ্যে লায়লা তার রুমে এসে উপস্থিত হলেন।

এরপর তার পাশে বসলেন, আইজা বেশ বিরক্ত হয়ে বলল “এসব হচ্ছেটা কি এখানে?! এজন্য এখানে ডেকে এনেছো আমায়? এসব তামাশা করতে! তুমি প্রতারণা করে আমাকে ডেকে এনেছো!”

লায়লা কাঁপা গলায় বললেন “আমি তোমাকে এজন্যই ডেকেছিলাম যাতে আমার নির্দোষ মেয়েটার থেকে ক্ষমা চাইতে পারি, যার কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও এতকিছু সহ্য করতে হয়েছে। আমরা সবাই তোমার কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাই, মা। জানি হয়ত যা কিছু তোমার সাথে করেছি এর জন্য এই ক্ষমা শব্দটা খুবই তুচ্ছ‌। তবে চাইলেও আমরা অতীত তো আর বদলে ফেলতে পারবো না। পারলে তোমার অপরাধী মাকে ক্ষমা করে দিও। এছাড়া সত্য বলে যদি তোমাকে ডাকতাম তুমি কখনো ফিরে আসতে না।”

লায়লা কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন। মায়ের এমন কান্না দেখে এবার কিছুটা নরম হয়ে আইজা বলল “আচ্ছা; বাদ দাও এখন সেসব কথা।”

এরপর একটু থেমে কিছু একটা ভেবে বলল “তুমি আমাকে এটা বলো, এত বছর পর সব সত্য সবাই জানল কি করে?! সত্য তো মাটি চাপা পড়ে গিয়েছিল অনেক আগেই, তা আবার কীভাবে প্রকাশ হলো?!”
কিছুটা তাচ্ছিল্যের সাথেই কথাটি বলল সে।

লায়লা বললেন “মা, সত্যকে কখনো মাটি চাপা দেয়া যায় না। এর প্রকৃতিই এমন, কেউ এটাকে মাটি চাপা দিতে গেলে তা বৃক্ষ হয়ে সেই মাটি ভেদ করে উঠে। এবং ডালা পালা ছড়িয়ে আরো প্রকান্ডভাবে প্রকাশ পায়।

রাজিব তোমার সাথে যা কিছু করেছে, আমি জানি না, তবে আমার মনে হয় এর শাস্তিই পাচ্ছে সে।

তার অপারেশন কিছুদিন পর। বাঁচবে কিনা কোন নিশ্চয়তা নেই। এই অবস্থায় মানুষের নিজেদের পাপের কথা বেশি মনে পড়ে। তার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে, ভেবেছে মৃত্যুর আগে নিজের অপরাধ স্বীকার করে যাক, সব সত্য সবাইকে জানিয়ে যাক যে কীভাবে একটা মেয়ের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে সে, কীভাবে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে।

এছাড়া তার স্বীকারোক্তির পর তিথিও সবকিছু স্বীকার করতে বাধ্য হয়।

যদি রাজিব অলরেডি এই অবস্থায় না থাকতো আর তিথি গর্ভবতী না হতো। আমান হয়ত সত্যিই তাদের দুজনকে খুন করত, সে কতটা রেগে ছিলো এসব জানার পর, আমি ব্যখ্যা করতে পারব না তোমাকে আইজা। অনুতাপে, রাগে ক্ষোভে সে পাগল হয়ে যাচ্ছিল। এমনকি নিজের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি পর্যন্ত করার চেষ্টা করেছিল, সে তো ভাগ্য জোরে বেঁচে যায়!

এসব কিছু দেখার পর আমার এটাই মনে হয়েছে যে তোমাকে এখানে ডেকে আনাটাই ভালো হবে। নিজেদের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে সবাই নিজেদের বুকের বোঝা তো হালকা করতে পারবে।

এছাড়া তুমি জানো, আমান এখন তিথির সাথে সংসার করা তো দূরের কথা, তার চেহারা পর্যন্ত দেখতে চায় না। এমনকি সে তিথিকে তার বাবার বাড়ি পর্যন্ত পাঠিয়ে দিয়েছে। মেয়ের এসব অপকর্ম জানার পর তো জয়নুল ভাই আর আনোয়ারা ভাবীরও কোন মুখ নেই কাউকে কিছু বলার, তাদের তো লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা।

এছাড়া আমান মনে করে, তিথি তাকে, তোমাকে, আমাদের সবাইকে ধোঁকা দিয়েছে।
তোমার মান সম্মান, আমাদের বংশের মান সম্মান সব ধুলায় মিশে গিয়েছিল। এসবের জন্য তিথিকে দায়ী ভেবে ঘৃণা করে সে তাকে।

জানো কি আইজা, সম্মান তো এমন একটা জিনিস, যা কামাই করতে সারাজীবন লেগে যায়, অথচ হারাতে এক সেকেন্ড সময়ও লাগে না। মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ এই সম্মান, যা অর্থ দিয়ে ক্রয় করা যায় না, জোর করে আদায় করা যায় না।

অথচ তিথির সেই বাচ্চামো জিদের কারণে শুধু তোমার না, পুরো বংশের মেয়েদের সম্মান নিয়ে মানুষ প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিল। তুমি কি জানো, এখনও মানুষ এসব নিয়ে আমাদের পিঠ পিছনে কথা বলে। কতটা লজ্জাজনক!”

আইজা বলল “সেসব নাহয় বুঝলাম, কিন্তু তিথি যদি সত্যিই গর্ভবতী হয়ে থাকে, তবে তার সাথে এমন ব্যবহার করাটা আমানের হয়ত ঠিক হচ্ছে না। তিথির কথা চিন্তা না করলেও বাচ্চাটার কথা তো তার ভাবা উচিত, কারণ সেটা তো তার নিজেরই রক্ত।”

লায়লা বললেন “কটু হলেও সত্য, সে তোমাকে ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কিছুই ভাবছে না। আমি জানি, সে তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে, কিন্তু সেই মুহূর্তে তার পজিশনে একটু নিজেকে রেখে চিন্তা করো, তার স্থানে তুমি হলে কি করতে তখন?! এতসব নিজের চোখে দেখার পর বিশ্বাস করতে পারতে তাকে? কথা তো তুমিও অনেক লুকিয়েছিলে তার থেকে। মিথ্যা বলেছ প্রতিনিয়ত, সে সেই পরিস্থিতিতে তোমাকে ভুল বুঝতে বাধ্য হয়েছে; সেটাও কেবল পরিস্থিতির শিকার হয়ে।”

আইজা বলল “যা হওয়ার ছিল, হয়ে গিয়েছে। এখন অতীত খুঁড়ে কোন লাভ নেই। হয়ত সত্যিই আমানের জোড়া আমার সাথে না, তিথির সাথেই লেখা ছিল, এজন্যই তাদের বিয়েটা এভাবে হলেও হয়ে গিয়েছে। আর আমারটা এত স্বপ্ন সাজানোর পর, এত পরিকল্পনা করার পরও হয়নি। এখন এসব বলে তো আর লাভ নেই। যা হয়েছে তা ভুলে গিয়ে, যা আছে, আমাদের সবার সেটাই মেনে নেয়া উচিত।

অবশ্য তিথি যা করেছে এর শাস্তি সে একদিন অবশ্যই পাবে, এটা আমি জানতাম।
একটি মেয়ের জীবন, সম্মান এত খারাপভাবে ধ্বংস করার পর, এর ধ্বংস স্তুপে যে স্বপ্নের বসতী বানানো হয়, তার পরিণতি একদিন না একদিন এমনই হওয়ার কথা।

এছাড়া; তখন আমি ভুল ছিলাম না। বিধায় আমার সাহায্যকারী স্বয়ং আমার খোদা হয়েছে। এজন্য এত অপমানিত, এত লাঞ্ছিত হওয়ার পরও আজ সেসব থেকে বের হয়ে আমি অনেক সুখী। যদি আমিই ভুল হতাম, এতটা সুখী হয়ত জীবনে আর কখনো হতে পারতাম না। এটাই আমার নিরপরাধ হওয়ার প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট ছিল। কেউ যদি আমার সত্য সম্পর্কে কখনো কিছুই না জানত, এতেও আমার আর কোন সমস্যা ছিল না। কারণ আমি যে নিরপরাধ তা আমার খোদা জানত, আর এই জিনিসটাই সবচেয়ে ইমপোরটেন্ট, অন্য কে কি জানে, বা ভাবে তাতে আমার আর কিছু যায় আসে না।

এছাড়া মা; এখন আমি আমার অতীতের সেই সমস্ত অধ্যায় থেকে অনেক উর্ধ্বে উঠে গিয়েছি।

কত সন্ধ্যা যে রুমের লাইট অফ করে অন্ধকারে একাকীত্বে ডুবে কাটিয়েছি, কত রাত নিজের অপমানের কথা স্মরণ করে নির্ঘুমে কাটিয়েছি, সেই হিসাব আমার কাছেও নেই। এরপর গিয়ে আমার আল্লাহর রহমত হয়েছে আমার উপর। এসব চিন্তা থেকে, এসব অনুভূতি থেকে অবশেষে মুক্তি পেয়েছি আমি। আর এর মূল্য কীভাবে দিয়েছি সেটা এইমাত্র বললাম।

সুতরাং এসব জিনিস থেকে এত কষ্ট করে নিজেকে দূরে সরিয়ে আবার এসবে জড়াতে চাই না আমি। এসব জিনিস, সেসব মানুষ, এই সমস্ত কিছু থেকে দূরে থাকতে চাই।”

লায়লা বললেন “কিন্তু মা, ড্রয়িংরুমে বসে তারা সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। গিয়ে যদি তাদের সাথে অল্পক্ষণ কথা বলতে!

এছাড়া আমি গিয়ে কি বলবো তাদের যে তুমি দেখা করতে চাও না তাদের সাথে?!”

আইজা বলল “গিয়ে বলো, আমি অনেক ক্লান্ত ঘুমাতে চাই। তারা এখন আসতে পারেন।”

লায়লা বললেন “ঠিক আছে, এখন নাহয় তুমি ক্লান্তির অজুহাত দিয়ে তাদের পাঠিয়ে দিবে, কিন্তু কতক্ষন? একসময় না একসময় তোমার তাদেরকে, বাস্তবতাকে ফেইস করতেই হবে।”

আইজা বলল “আজ ক্লান্তির অজুহাত দিয়েছি, আগামীকাল অন্য কোন অজুহাত।
এছাড়া তাদের ফেইস করার আমার প্রয়োজন নেই। কারণ তারা আমার বাস্তবতা নয়, তারা কেবল আমার অতীতের একটি দুঃস্বপ্ন।”
লায়লা আর কথা না বাড়িয়ে উঠে চলে গেলেন।

আইজা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো। এরপর ভাবতে লাগলো “তিথি আমার সাথে যা কিছু করেছে, এর জন্য হয়তো কখনো আফসোস করে নি সে। তবে আজ তিথির সাথে এত খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে এটা শোনার পর আমার কেন এত খারাপ লাগছে, আমার তো খুশি হওয়ার কথা ছিল!

তিথি, এসব করার আগে ওভার কনফিডেন্ট হয়ে তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছিলে, কখনো যদি এই সত্য সবার সামনে চলে আসে তোমার অবস্থা তখন কি হবে! মিথ্যার ভিত্তির উপর দাঁড় করানো সংসার বাতাসের এক ধাক্কায় তাসের ঘরের মতো ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে মানুষের বিচার শুধু পরকালের জন্য তুলে রাখা হয়না। মাঝে মধ্যে, এই পৃথিবীতেও হয়ে যায়। এরপরও দোয়া করি, তুমি যাতে ক্ষমাপ্রাপ্ত হও। আমি সারাজীবন তোমাকে ঘৃণা করব ঠিক, কিন্তু তোমার জন্য খুব আফসোসও হচ্ছে।

পর্ব_৩১

আইজা দেশে ফেরার পর থেকে আমান এক মুহূর্তের জন্যও এই চেষ্টা থেকে বিরতি দেয়নি যেন আইজা তাকে ক্ষমা করে দেয়। প্রথম প্রথম তো তার সামনেও পড়ত না আইজা। কিন্তু পরবর্তীতে লায়লার সহযোগিতায় অনেক চেষ্টা করার পর একটু আধটু কথা হতো তাদের মধ্যে। তবে আমানের সাথে কথা বলার সময়ও সে সবসময় কাটা কাটা কথাই বলত।

এমনই এক বিকেলে আমান আইজার সাথে দেখা করতে তার বাসায় যায়, লায়লা তাকে বসিয়ে আইজাকে ডাকতে যান।

আমান গার্ডেনে গিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পর আইজা এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল “বারবার এসে আমার সাথে দেখা না করলে হয়না?! আমার করার মতো আরো কাজ আছে।”

আমান মলিন দৃষ্টি আইজার উপর স্থির রেখে বলল “আর আমি নিজের সব কাজ কর্ম ছেড়ে কেবল এই চেষ্টা করে যাচ্ছি যেন এই শেষবারের জন্য তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।

তোমার সাথে যে অন্যায় আমি করেছি, তা আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। তোমার কথা, একটা বারের জন্য শুনিনি। সবার সামনে তোমাকে…।
আইজা! সেসব কথা মনে হলে আমার সত্যিই বেঁচে থাকার ইচ্ছা মারা যায়, যাকে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবেসেছিলাম, তাকেই অপমান করে নিজের জীবন থেকে বের করে দিয়েছি। আমি অনুশোচনার আগুনে কি পরিমান দগ্ধ হচ্ছি, তুমি হয়তো অনুমানও করতে পারবে না।”

আইজা অল্পক্ষণ চুপ থেকে বলল “কি চাই তোমার? এটাই তো যে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেই। যাও দিলাম তোমায় ক্ষমা করে।
এবার অন্তত নিজের লাইফ নিয়ে সিরিয়াস হও, নিজের জীবনের ব্যাপারে ভাবো, আর নিজের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকো। আর আমাকেও শান্তি মত বাঁচতে দাও।

এসব পুরাতন কথা খুঁড়ে বের করলে নিজে যেমন কষ্ট পাবে, একইভাবে অন্যদেরও কষ্টের মধ্যে পড়তে হবে।”

ঠোঁটে মলিন হাসি টেনে আমান বলল “যদি সত্যিই মন থেকে ক্ষমা করে দিতে, তবে এভাবে কখনো কথা বলতে পারতে না আমার সাথে।”

আইজা বলল “তো কীভাবে কথা বললে বুঝবে তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। ক্ষমা চেয়েছ, আমিও ক্ষমা করে দিয়েছি; এরপরও কথা টেনে লম্বা করছ কেন!

এছাড়া ক্ষমা করলেও সবকিছু আবার আগের মত হয়ে যাবে, এমন ভাবারও তো কারণ নেই।

কাউকে ক্ষমা করা বা না করা মানুষের হাতে থাকে, কিন্তু সেই ব্যক্তির অপরাধ চিরতরে ভুলে যাওয়া সবার এখতিয়ারে থাকে না।”

এরপর একটু থেমে বলল “আমান, এখন তোমার যাওয়া উচিত। এছাড়া এখানে আর আসারও তোমার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না, কেননা তুমি যা চেয়েছিলে, তা তো পেয়েই গিয়েছ নিশ্চয়ই।”

আমান বলল “প্রতি মুহূর্তে এই জীবন থেকে যা চেয়েছিলাম, তা তো কখনো পাই নি।”

আইজা বলল “এখনই তো বললাম ক্ষমা করেছি।”

আমান বলল “সবসময়ের মতো এখনও বুঝে না বুঝার ভান করছ নাকি সত্যিই বুঝতে পারো নি আমি কাকে পাওয়ার কথা বলছি।”

কিছুটা কনফিউজড হয়ে অল্পক্ষণ ভাবার পর হঠাৎ আইজার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ছড়িয়ে পড়ল, সে বলল “সিরিয়াসলি আমান?! তুমি এখনো আমার আশা করো, এতকিছুর পরও?!

এছাড়া আবেগী হয়ে তুমি হয়তো এটাও ভুলে যাচ্ছো যে তুমি একজন বিবাহিত পুরুষ, স্ত্রী আছে তোমার। তা-ও যে কিনা গর্ভবতী।
আর তুমি এসে আমাকে এসব শোনাচ্ছ?!
সত্যিই অবিশ্বাস্য!”

আমান বলল “সেই বিয়ে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হয়নি, সেটা তুমিও ভালো জানো। তা তিথির-ই ঘৃণ্য পরিকল্পনার ফল। এছাড়া এই মুহূর্তে তিথির নামও সহ্য করতে পারিনা আমি। বিয়ের মত পবিত্র সম্পর্ককে সে কলুষিত করেছে, ভালোবাসার নামে সবার সাথে প্রতারণা করেছে। তার মতো বিশ্বাসঘাতক মেয়ের সাথে সারাজীবন থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। তাকে শীঘ্রই ডিভোর্স দিয়ে দিব আমি।

এছাড়া তার প্রতি প্রত্যেকটা দায়িত্ব পালন করলেও এক মুহূর্তের জন্যও তাকে নিজের মনে স্থান দিতে পারিনি আমি। আমি সবসময়ই কেবল তোমাকেই ভালোবেসেছি।”

এবার কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে আইজা বলল “কতটা ভালোবাসো আমায়, তা আমার বুঝা হয়ে গিয়েছে, আমান।

এছাড়া তুমি তিথির সাথে থাকবে কি থাকবে না, এটা তোমার আর তিথির ব্যাপার, নিজেদের জীবন নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার তোমাদের দুজনের আছে।

তবে আমার একটা কথা ভালোভাবে বুঝে নাও আমান। আমি তোমার জীবনে কখনোই ফিরে আসব না। সবসময় এই কথা মনে রেখো।”

আমান বলল “আইজা, একটা বার আমার কথা শুনো প্লিজ। আমাকে একটা সুযোগ দাও, আমি সবকিছু আবার আগের মত করে দিব।”

আইজা বলল “কোন কিছুই আর আগের মত হবে না। এছাড়া আমাদের মাঝে বলা শোনার মত আর কোন কিছুই অবশিষ্ট নেই, যা ছিল তা অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে।
এছাড়া তোমার কোন কথা শোনার ব্যাপারে আমার আর কোন আগ্রহও নেই।”
এরপর একটু থেমে বলল “তুমি এখন যেতে পারো।”
এই বলে আইজা নিজেও আর দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে হেঁটে বাসার ভেতরে চলে গেল। পেছন থেকে আমান কয়েকবার তার নাম ধরে ডাকলেও সে থামে নি।

.
.
.

আমান তার ইচ্ছার কথা তার বাবা মাকেও জানায়। তারা তো আঁতকে উঠে, এ কি বলছে তাদের ছেলে! এটা কি আসলেই সম্ভব?! এছাড়া এতকিছু হওয়ার পর আইজা নিজেও তো কখনো এই বিয়েতে রাজি হবে না।

কিন্তু আমান নিজের জিদে অনড়। দিনকে দিন তার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে, ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করে না। রাতকে রাত নির্ঘুমে কাটিয়ে দেয়, এখন ঘুমানোর জন্য হাইডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয় তার।

আগে সিগারেট স্পর্শ পর্যন্ত না করা আমান এখন চেইন স্মোকার। মানসিক এবং শারীরিকভাবেও সে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। একেক সময় ব্লাড প্রেসার খুব হাই হয়ে যায়।

দিনের বেশিরভাগ সময় বাসা থেকে বাইরে থাকে। আনিস সবসময় তার সাথে থাকে বলে তার বাবা মা একটু নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, এরপরও ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তার অভাব নেই তাদের। যা অবশ্য তার এমন অবস্থায় করারও কথা।

গ্রেজুয়েশেন কমপ্লিট করার পর চাকরি খোঁজার সময় আমান আনিসকে যখন তাদের কোম্পানিতে চাকরি করার অফার করেছিল, তখন আনিসের মনে হয়েছিল, না চাইতেই হাতে চাঁদ পেয়ে গিয়েছে সে। এত বড় কোম্পানিতে চাকরির সুযোগ পাচ্ছে তা-ও এমন রেজাল্ট আর চাকরির অভিজ্ঞতা ছাড়াই।
এরপর চাকরির কারণে সে এই শহরেই শিফট হয়ে যায়। তখন থেকে সে সবসময় আমানের ছায়া হয়ে থাকতেই পছন্দ করে।

মাঝে মধ্যে আনিসেরও বেশ আফসোস হয়, আমান সেদিন রাতে রাগের মাথায় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা বাস্তবায়ন করার জন্য আনিস নিজেও তাকে বেশ ইনফ্লুয়েন্স করেছিল, তিথির আর তার বাবার সম্মানের কথা বলে বলে আমানকে খুবই মানসিক চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এছাড়া আমান যেহেতু কথা দিয়েছিল, রাগের মাথায়-ই হোক না কেন; সেহেতু তাকে তার কথা রাখার ব্যাপারেও আনিস অনেক বুঝায়। আনিস যদি তখন এসব সত্য সম্পর্কে জানত, যদি জানত পরবর্তীতে তার বন্ধুর এতটা কষ্ট হবে সে হয়ত এমন করার ব্যাপারে কখনো ভাবতোও না। তবে এই মুহূর্তে তার তিথির জন্যও খুব খারাপ লাগে। এই সময়টায় সে নিজেও অনেক অসহায়। কেন যে মানুষ এমন ভুল করে যা তার নিজের জীবনই ধ্বংস করে দেয়!

যাই হোক, রায়হান রেহানা ছেলের এরকম অবস্থা দেখে সহ্য করতে পারছিলেন না। খুব বেশি অসহায় বোধ করেন তারা, ছেলের জন্য কিছুই করতে পারছেন না।

যদিও আইজার জবাব তাদের জানা আছে, এরপরও রায়হান আর রেহানা আইজার বাসায় যান আইজার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।

প্রথমে যদিও লায়লা, ফারুক বেশ অবাক হন, কিন্তু পরবর্তীতে লায়লা এই বিয়েতে তার নিজের ইচ্ছার কথাও জানান। এতে ফারুক কিছুটা চটে যান লায়লার উপর।

তখন লায়লা ফারুকের উদ্দেশ্যে বললেন “আইজার সাথে আমানেরই ভাগ্য লেখা ছিল, মাঝখান দিয়ে তিথি ভাগ্যের রেখা চুরি করার চেষ্টা করে, সে আমান আর আইজাকে আলাদা করে দেয়। কিন্তু এখন সেই ভাগ্যই যদি অতীতে করা ভুল শুধরে দিতে চায়, তবে আমরা আপত্তি করার কে?

এছাড়া আইজাকে আমানের চেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারবে না অন্য কেউ‌। আর আমানের ভালোবাসা কতটা গভীর তা আমি নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছি, আলাদা প্রমাণেরও প্রয়োজন নেই। এছাড়া মা হিসেবে আমি আমার আইজার জন্য এমন জীবন সঙ্গীই চাই যে তাকে এতটাই ভালোবাসবে।”

ফারুক বললেন “তুমি তোমার মেয়েকে একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে বিয়ে দিতে চাও?!

এছাড়া তিথির কি হবে? বংশের মেয়ে সে, আমাদেরই মেয়ে, তার সংসার উজাড় করতে নিজের মেয়েকে পাঠাবো?! এমনটা কখনো হবে না।”

লায়লা বললেন “আইজা আমানকে যদি বিয়ে না-ও করে, এরপরও কি সে তিথিকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে নিবে বলে তোমার মনে হয়?! সে ঘৃণা করে তাকে।

এছাড়া আইজা একজন মানুষকে কখনো এই কারণে রিজেক্ট করবে না যে তার আগে বিয়ে হয়েছিল; একবার তার আর আমার মধ্যে একটা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল আর সে নিজ থেকেই আমাকে তা বলেছে।”

এবার একটু দমে গিয়ে, কিন্তু এরপরও বেশ দৃঢ়ভাবে ফারুক বললেন “কিন্তু সেই মানুষটি আমান হলেও করবে তা নিশ্চয়ই বলে নি।
এছাড়া তিথিকেও আমি নিজের মেয়ের মতোই মনে করি, তার সাথে খারাপ কিছু ঘটুক তা আমি কখনো চাইবো না। তার সংসার ভাঙুক তা কখনো চাই না আমি। আমার মেয়ে তার সতীন হয়ে তার সংসারে যাবে তা আমি সহ্য করতে পারব না।”

লায়লা তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন “বাহ ফারুক! যে সংসারটা তার বলে দাবি করছ, তা আমার মেয়ের হওয়ার কথা ছিল, আমার মেয়ের।

সব স্বপ্ন তার ছিল, কিন্তু সেসব স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে অন্য কারো জীবনে। আমার মেয়ের স্বপ্নের সংসার ছিনিয়ে নিয়ে নিজে সে তার সতীন হয়ে এসেছে, আমার মেয়ের জীবন ধ্বংস করেছে, আর এখন তার জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে?! নিজের মেয়ের জন্য কষ্ট হয়না!”

ফারুক ব্যাখ্যার স্বরে বললেন “আমার আইজাকে আমি কতটা ভালোবাসি তা তুমিও জানো। এজন্যই বলছি, সেই বাড়িতে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গিয়ে সে সুখী হতে পারবে না।

এছাড়া তিথি এখন আমানের স্ত্রী, যেভাবে হোক না কেন, তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এখন সবার উচিত সবকিছু ভুলে তাদের সম্পর্ক মেনে নেয়া।”

লায়লা বললেন “যেভাবে হোক, বিয়ে তো হয়েই গিয়েছে, এখন সবার উচিত এই বিয়ে মেনে নেয়া। – এই একটি বাক্যের জন্যই এই ধরনের ঘটনাগুলো ঘটে থাকে, যে যাকে ইচ্ছা এভাবে প্রতারিত করে বিয়ে করবে, এরপর তা করার পরও, সবাই তো এটাই বলবে যা হওয়ার ছিল, হয়ে গিয়েছে, এখন উচিত মেনে নেয়া। কেন! কেন মানতে হবে কারো প্রতারণা, কেন মেনে নিতে হবে সেসব বিয়ে যেগুলোর ভিত্তিই প্রতারণা।

এছাড়া কেনই বা অহরহ ঘটে চলেছে এসব ঘটনা? কারণ এই একটিই, সবাই মেনে নেয়, সবাই প্রতারণাও মেনে নেয়, প্রতারককেও মেনে নেয়। এজন্য তারাও সাহস পায়, আরো অন্যান্য প্রতারক উৎসাহী হয় এসব করার ব্যাপারে। আর তাদের এসব করার মূল ভিত্তিও এই একটি বাক্যই, একবার বিয়ে হয়ে গেলে সবাই সব মেনে নিতে বাধ্য।”

রায়হান আর রেহানার বাধ্য হয়ে বসে লায়লা, ফারুকের এতক্ষন ধরে চলা এই ঝগড়া দেখতে হচ্ছে।

অবশেষে রেহানা মুখ খুললেন, তিনি বললেন “ফারুক ভাই, আপনার সমস্যা তো এটাই যে তিথির সংসার ভাঙবে, আপনি আমাকে এখন একটা প্রশ্নের উত্তর দেন যে আইজা যদি আমানকে বিয়ে না করে তাহলে কি তিথির সংসার ভাঙবে না?! উত্তর দেয়ার পর বাকি অসম্পূর্ণ কথাটিও আমি বলছি।”

ফারুক বললেন “সেটা হয়তো আমান আর তিথির নিজস্ব ব্যাপার হবে, অন্তত আমি তো আর পাঠাচ্ছি না নিজের মেয়েকে এই কাজ ত্বরান্বিত করতে।”

রেহানা বললেন “আর যদি আইজার আগমনে তিথির সংসার না ভেঙে বরং বেঁচে যায়!”

ফারুক অবাক হয়ে বললেন “মানে?!”

রেহানা বললেন “মানে হচ্ছে, আপনি যদি নিজের মেয়েকে আমার বাড়ির পুত্রবধু করতে রাজি হন তবে কথা দিচ্ছি, যেভাবেই হোক, আমানকে মানানোর দায়িত্ব আমার, সে যাতে তিথিকে ডিভোর্স না দেয়। এছাড়া আমি নিশ্চিত, আইজাকে পাওয়ার জন্য সে সেই মেয়েটিকে আবারও স্ত্রীর মর্যাদা দিতে রাজি হবে যাকে এই মুহূর্তে সামনে পেলে খুন করতেও দ্বিধা বোধ করত না হলে!

এছাড়া তিথি! সে কেমন মেয়ে, আমার জানা নেই। এতকিছুর পরও যে কিনা আমানকে ছাড়তে রাজি নয়, এছাড়া তার মনোভাবও এমন যে প্রয়োজনে সতীনের সংসার করবে তবু আমার ছেলেকে ছাড়বে না! এটা তার কি ধরনের অনুভূতি, কে জানে। ভালোবাসা নাকি কেবলই জিদ।

তবে তার সংসারও বেঁচে যেতে পারে আপনার এই একটি সিন্ধান্তে। যদি আপনি সত্যিই তাকেও আপনার মেয়ে ভেবে থাকেন!

এখন আপনি বলুন ফারুক ভাই, আপনার সিন্ধান্ত কি?!”

এবার ফারুক চুপ করে যদিও দোদুল্যমান অবস্থায় বসে আছে, তবে এবার লায়লা দ্বিমত পোষণ করে বললেন “রেহানা ভাবী, এই আপনি কি বললেন?! আমি তো আমানের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলাম এই ভেবে যে সে তো তিথিকে ছেড়েই দিচ্ছে। কিন্তু এখন আপনি আবার এই কথা বলছেন! আপনার কি মনে হয়, আমি আমার মেয়েকে সতীনের সংসার করতে পাঠাবো?! আমার আইজা তিথির মতো নয়, যার কারো সতীন হওয়ার ব্যাপারেও কোন আপত্তি নেই। যদি এমনই হয়, আমি আমার আইজাকে পাঠাবো না আপনাদের বাড়িতে বউ করে।”

রেহানা এবার বেশ বিরক্ত হয়ে এবং রেগে বললেন “দুজন দুই রকমের কথা বলছেন কেন? এতকিছু এখানে বসে সহ্য করার একমাত্র কারণ আমার ছেলে আমান! আপনাদের মেয়েকে এতটা ভালবাসে যে তার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।

এছাড়া এখনও যদি চাই, আমার ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রীর লাইন লেগে যাবে। আপনারাও ভালো জানেন, যেকোনো বাবা মা এখনো নিজেদের মেয়েকে আমাদের বাড়ির বউ করার জন্য খুশি মনে নিজেদের মেয়ে দান করবেন। এটা আপনারাও ভালো জানেন এবং অস্বীকারও করতে পারবেন না।”

লায়লা ফারুক চুপ করে রইলেন, তারাও জানেন বিষয়টি সত্য।

এরপর নিজেকে একটু শান্ত করে রেহানা বললেন “দেখেন লায়লা ভাবী, আপনি নিজেই একটু আগে বলেছেন যে আপনি নিজ চোখে দেখেছেন যে আমান আপনার মেয়েকে কতটা ভালবাসে, এই ক্ষেত্রে প্রমাণেরও কোন প্রয়োজন নেই। আপনার কি মনে হয়, সে কখনো বেইনসাফি করবে আপনার মেয়ের সাথে?! সে সারাজীবন আইজাকে তার স্বপ্ন বানিয়ে নিজের চোখে সাজিয়ে রাখবে। প্লিজ, না করবেন না এই সম্পর্কের ব্যাপারে।

এছাড়া ফারুক ভাই, আমি আপনাকেও এই নিশ্চয়তা দিচ্ছি তিথির সাথেও কখনো অন্যায় অবিচার হতে দিব না। আমান এই শর্ত মানলেই এই বিয়ে হবে। এছাড়া আমি জানি, সে আইজার জন্য যেকোনো শর্ত মানতে পারে।

আপনাদের কাছে এই প্রস্তাব নিয়ে আসার উদ্দেশ্য এটাই যাতে আপনারা আপনাদের মেয়েকে বুঝান, সে যেন এই বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। এতেই সবার জন্য মঙ্গল। এখনই জবাব দিতে না চাইলে আপনারা এই বিষয়ে ভাবার জন্য সময় নিতে পারেন। তবে খেয়াল রাখবেন, খুব বেশি দেরি যাতে না হয়ে যায়।”

এই বলে রেহানা রায়হানের দিকে তাকালেন, তখন রায়হান উঠে দাঁড়িয়ে ফারুককে উদ্দেশ্য করে বললেন “কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এটা মাথায় রাখবেন, আমার ছেলে আপনার মেয়েকে অনেক বেশি ভালোবাসে। আর আমি তাকে। আমি আমার আমানকে এতটা ভালোবাসি যে তার সুখের জন্য যেকোনো কিছু করতে দ্বিধাবোধ করবো না।

এখন আপনারা এটা খেয়াল রাখবেন যেন আপনাদের কোন সিদ্ধান্তের কারণে আমাদের সম্পর্কে না আবার কোন ফাটল ধরে।”

ফারুক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন “জ্বী। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, সবার জন্য যেটা ভালো হবে, আমরা সেটাই সিন্ধান্ত নিব।”

তখন রায়হান দ্রুত পা চালিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন, সাথে রেহানাও।

লায়লা আবার সোফায় বসে কপালে আঙ্গুল রেখে বললেন “ওই তিথির একটি বোকামির কারণে কতগুলো জীবন আর কতগুলো সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যাচ্ছে।”এরপর ফারুকের দিকে এক নজর তাকিয়ে আবারও বললেন “কিন্তু কিছু কিছু মানুষ এখনও তার কথাই ভাবছে!”

ফারুক সরাসরি লায়লাকে বললেন “তিথি যা করেছে, তা অবশ্যই ভুল ছিল। বরং বড় গুনাহ করেছে সে। আমি এটাও জানি, তার কারণে এতগুলো জীবন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, এমনকি তার নিজেরটাও। এত বছরের গভীর এই সম্পর্কগুলোতেও তিক্ততা চলে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু সে যা করেছিল, সেসবের জন্য এখন অনুতপ্ত সে। আমরা যেমন অতীত বদলাতে পারব না, সেও তো পারবে না নাকি?!”

লায়লা বললেন “এটা ভালো, আগে আগুন লাগিয়ে সবার জীবন, সব সম্পর্ক পুড়িয়ে ছাই করে পরবর্তীতে সেই ছাইয়ের উপর বসে আফসোস করা।”

ফারুক বললেন “লায়লা; ছোটবেলা থেকে তাকে নিজেরই মেয়ে ভেবেছি, এখন তার এই দুরবস্থা দেখে আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগে।”

লায়লা বললেন “এই অবস্থার জন্যও দায়ী কে?

ফারুক বললেন “ব্যস লায়লা। এখন তর্ক না করে এই বিষয়ে একটি সিন্ধান্তে আসা উচিত আমাদের।

নাহলে জয়নুল ভাইয়ের সাথে আমার আর রায়হান ভাইয়ের সম্পর্ক তো আগেই খারাপ হয়েছেই, তিনি লজ্জায় এখন আমাদের তার চেহারা পর্যন্ত দেখান না। এখন আমার আর রায়হান ভাইয়ের সম্পর্ক না আবার খারাপ হয়!

এরপরও, এতকিছুর পরে আমানের সাথে আইজার বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আমার মন মানছে না।”

লায়লা বললেন “এখন মনকে মানিয়ে নাও, ফারুক।
এত ধনী আর পাওয়ারফুল পরিবারে মেয়ে আমার রাণী হয়ে থাকবে। এছাড়া আমান তাকে এত ভালোবাসে যে তার মনের একচ্ছত্র রাণীও সে-ই হবে এবং রাজত্বও তারই হবে।

এছাড়া রেহানা ভাবী তোমাকেও তো নিশ্চিত করে গিয়েছেন তিথির সাথে কখনো অন্যায় করবে না আমান। সুতরাং এই বিষয়ে তুমিও নিশ্চিন্ত হয়ে যাও।

এসব বাদও যদি দেই, তবে তোমার ভাই শেষে কি বলে গিয়েছেন নিশ্চয়ই মনে আছে, এই সম্পর্ক না হলে, যে সম্পর্ক বিদ্যমান তাও নষ্ট হবে।”

ফারুক বেশ চিন্তিত হয়ে বললেন “সবকিছুই ঠিক আছে। কিন্তু আমার আইজার মনের অবস্থার কথা আমরা কেউ ভাবছি না, সে কখনো মত দিবে এই বিয়েতে? এতকিছু হওয়ার পর সে পারবে সব মানিয়ে নিয়ে এই সম্পর্কগুলো মেনে নিতে?!”

লায়লা বললেন “আমরা দুজন মিলে বুঝালে ঠিকই মেনে নিবে। বিশেষ করে, তুমি।”

ফারুক বললেন “তুমি এটাই বলতে চাইছ, আমরা আমাদের মেয়েকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে রাজি করাবো?!”

লায়লা বললেন “এখানে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল এর কিছুই নেই। সে বুঝদার মেয়ে, তাকে আমরা দুজন মিলে বুঝালে সে ঠিকই মেনে নেবে।”

ফারুক আর কিছুই বললেন না। গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন।

ফারুক আর লায়লা আইজার সাথে কথা বলার জন্য সময় করে তার রুমে গেলেন। এরপর অনেক কথা বলার পর আমানের সাথে বিয়ের কথাটা তুললেন।

আইজা খুব বেশি রিয়েক্ট করল না, সে ঠোঁটে মুচকি হাসি টেনে বলল “তোমরা চাও আমি এমন একজন মেয়েকে সতীন হিসেবে মেনে নেই যে কিনা বিয়ের আগেই আমার জীবন জাহান্নাম বানিয়ে দিয়েছিল। সে বিয়ের পর আমার সাথে কি করবে?!”

লায়লা বললেন “আমান থাকতে সে তোমার সাথে খারাপ কিছু কখনোই ঘটতে দিবে না।”

আইজা বলল “আমানের ভালোবাসার উপর আমার আগের মত আর বিশ্বাস নেই। সে আমাকে ছাড়া পৃথিবীর অন্য যে কাউকে বিশ্বাস করতে পারে। এছাড়া তিথি গর্ভবতী, একবার তার বেবি হয়ে যাওয়ার পর সে তো অবশ্যই অনেক কেয়ার করবে তার বাচ্চা আর বাচ্চার মাকে, সেটা অবশ্য করাও উচিত তার। তখন তিথি যদি আবারও আমার সম্পর্কে কোন অপবাদ দেয়, সে তখনও আমার কথা না শুনে তার কথাই শুনবে।

এছাড়া তোমরা চাও, আমি আমানের দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে তার বাসায় যাই, তখন মানুষ কি ভাববে আমার সম্পর্কে, সেটাও নিশ্চয়ই জানো তোমরা! অতীতে কি হয়েছে, কেউ তা জানতে চাইবে না, সবাই কেবল এটাই ভাববে, আমি তিথির সংসারে আগুন ধরিয়ে তার সবকিছু ছাই করে এর উপর নিজের সংসার গড়ছি। কিন্তু ঠিক এই কাজটি তিথি করেছিল, সেটা কেউ জানবে না, জানতে চাইবেও না।

সবাই আমাকে দোষী ভাববে, ভাবুক। মানুষ আমাকে বিনা দোষে দোষী ভাববে, বিষয়টির সাথে আমি আগে থেকেই অভ্যস্ত। আমার কিছু যায় আসে না এতে।

তবে এই বিয়ে আমি করবো না। এতকিছুর পরে আমানকে স্বামী আর তিথির মত মেয়েকে সতীন হিসেবে মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। এটা আমার আত্নসম্মানের প্রশ্ন।”

লায়লা বললেন “মা, তোমাকে এতক্ষন ধরে তো বুঝালাম, এই বিয়েটা হওয়া সবার জন্য জরুরি। তিথি যা করেছে তা অতীত হয়ে গিয়েছে, এজন্য বেচারি অনেক অনুতপ্তও। এখন তুমি যদি এই বিয়েতে হ্যাঁ বলে দাও, তার সংসারটাও বেঁচে যাবে।”

আইজা ঠোঁটে উপহাসের হাসি টেনে বলল “সতীনের আগমনে আজ পর্যন্ত মানুষের সংসার ভাঙতে দেখেছি, আর আমি সতীন হয়ে তিথির সংসারে গেলে তার সংসার বেঁচে যাবে?!

আমার, আমানের আর তিথির সম্পর্কটা আসলে অন্যান্য সম্পর্কগুলোর মত মোটেও স্বাভাবিক কোন সম্পর্ক না, এই ছোট জিনিসটা থেকেই নিশ্চয়ই অনুমান করে নিতে পারছ।

এছাড়া এই ত্রিকোণ ভালোবাসা কেবল একটি বিধ্বংসী ভালোবাসা, যা এর সাথে জড়িত সবার মন ভেঙে দিয়েছে। সবার সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে, সবাইকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

আমার ভালোবাসা এতটা অভিশপ্ত হবে যদি আগে জানতাম তবে আমি কখনোই ভালোবাসতাম না কাউকে।”

লায়লা বললেন “আইজা মা, তুমি নিজেও যে আমানকে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসো, মা হিসেবে তা আমি ভালো করেই বুঝতে পারি, তোমার মনের সব কথা তুমি না বললেও আমি পড়ে ফেলতে পারি। তবে কেন সু্যোগ থাকা সত্ত্বেও নিজের ভালোবাসাকে অর্জন করার সুযোগ তুমি নিচ্ছো না। তুমি আর আমান একে অপরকে ছাড়া সম্পূর্ণ হয়েও অসম্পূর্ণ, একে অপরের সাথেই তোমরা পরিপূর্ণতা পাবে। এছাড়া সে তোমাকে ছাড়া সত্যিই বাঁচতে পারবে না, তুমি যদিও বাঁচতে পারো, আর সুখীও হতে পারো।
তবে সে অপরাধবোধ আর তোমার ভালোবাসা হারানোর মত অপ্রাপ্তির আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, মা। এভাবেই তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে সে।

আচ্ছা, দৃষ্টি না লুকিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো, তোমার মন থেকে কি আমানের প্রতি সব ভালোবাসা, সব অনুভূতি শেষ হয়ে গিয়েছে?!”

আইজা এই প্রশ্নের জবাবে কিছুই বলল না প্রথমে, কিন্তু এরপরে সরাসরি মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল “তার প্রতি আমার ভালবাসা মিথ্যা ছিল না, যে এতকিছু হওয়ার পর সেটাও একেবারে শেষ হয়ে যাবে। সত্যিই নিজের জীবনের চাইতে বেশি ভালোবেসেছিলাম তাকে, তাকে ছাড়া বাঁচতে পারব, কখনো ভাবতেও পারিনি। কিন্তু জীবন মানুষকে বাঁচতে শিখিয়ে দেয়। আমার মন থেকে তার প্রতি সব অনুভূতি আজও শেষ হয়ে যায়নি, যতদিন বাঁচবো ততদিন হয়ত শেষ হবে না। সত্যি বলতে, এই অনুভূতির উপর আমার নিজের কোনো এখতিয়ার নেই, এজন্যই তা আজও বিদ্যমান।

কিন্তু আমার আবেগ অনুভূতি আমার কোন সিদ্ধান্তের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।আর আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এটাই যে আমি আমানকে বিয়ে করবো না।”

লায়লা আক্ষেপ করে বললেন “আবেগ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত না হয়ে তুমি যদি বিবেক দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে মেনে নিতাম, কিন্তু তুমি কেবল নিজের জিদ দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছো, ঠিক যেমন তিথি আর আমান নিয়েছিল।”

আইজা কিছু বলতে গিয়েও পারল না বা তার কাছে কোন সদুত্তর ছিল না।

মা মেয়ের আলোচনা সমালোচনা এতক্ষন বসে চুপ করে শোনার পর অবশেষে ফারুক মুখ খুললেন, তিনি লায়লাকে উদ্দেশ্য করে বললেন “তুমি হয়তো শুনতে পেয়েছ, যে আইজা নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এখন সেটাই চূড়ান্ত। আমার মেয়ের ইচ্ছার বাইরে কোন সিদ্ধান্তই নেব না আমি।”

লায়লা বললেন “কিন্তু তুমি যদি এমনটা করো, রায়হান ভাইয়ের সাথে আমাদের এত বছরের সম্পর্ক একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে।”

ফারুক বললেন “আমার মেয়ের জীবন নষ্ট হওয়ার চেয়ে সম্পর্কই নাহয়…। এছাড়া আমার পক্ষ থেকে তো আমি আর এই সম্পর্ক নষ্ট করছি না। সুতরাং এতে এত ভাবার কিছুই নেই। এছাড়া আমার মেয়ের খুশি আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমি এখনই রায়হান ভাইকে ফোন করে জানিয়ে দেই যে এই বিয়েটা সম্ভব না।”

লায়লা আপত্তি করে কিছু বলতে গেলে তাকে থামিয়ে ফারুক বললেন “আর একটাও কথা না, লায়লা। আমার মেয়ের যে বিয়েতে মত নেই সেই বিয়ে করার জন্য তাকে কোন ভাবেই প্রেসার ক্রিয়েট করবে না।”

এই বলে তিনি পকেট থেকে ফোন বের করে রায়হানকে কল করলেন। এরপর বললেন “আমি আইজার সাথে কথা বলেছি, এই বিয়েতে তার মত নেই। আর আমিও নিজের মেয়ের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিনয়ের সাথে জানাচ্ছি যে এই বিয়েটা হবে না। সম্ভব হলে আমাকে মাফ করে দিবেন।”

ওপাশ থেকে রায়হান কি বললেন আইজা আর লায়লা শুনতে পাননি, কিন্তু ভালো কিছু যে বলেন নি, তা ফারুকের করুন হয়ে যাওয়া মুখাবয়ব দেখেই তারা ধারণা করতে পারছিল। কল কাট হওয়ার পর তিনি মলিন মুখে আইজার রুম থেকে বের হয়ে গেলেন, হয়ত চোখের অশ্রু গোপন করতেই।

ফারুক চলে যাওয়ার পর লায়লা বেশ রেগে আইজার উদ্দেশ্যে বললেন “এবার খুশি হয়েছো তো তুমি?! তোমার খুশির জন্যই তো এত বছর এত যত্ন করে লালন করা সম্পর্কগুলোও তিনি খুব সুন্দরভাবেই নষ্ট করছেন। এখন তুমি কেবল খুশি থাকলেই হবে।

আইজা; তিথি আর আমান নিজেদের জিদের কারণে অতীতে যে বড় বড় ভুল করেছিল, তুমিও ঠিক একই জিদের কারণে এই ভুলটি করছ। বলে রাখলাম আমি। পরে তোমাকেও না আবার তাদের মতই আফসোস করতে হয়।”

এই বলে লায়লাও উঠে চলে গেলেন।

লায়লার কথা শুনে হঠাৎ আইজারও যেন কেমন গিল্টি ফিল হওয়া শুরু হয়েছে।

কেন সম্পর্কগুলো এত কোমল সুতা দিয়ে বাঁধা থাকে, অল্পকিছু ঘটলেই যে সুতা ছিঁড়ে এর মধ্যে একত্রে থাকা মানুষগুলো মুক্তোর টুকরোর মতো একটার পর একটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে, একজন আরেকজন থেকে আলাদা হয়ে যায়!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here