#জিদ_অনুভূতির_অন্য_এক_স্তর
#পর্ব_৩৩
#লেখিকা : #Kaynat_Ash
ফারুক বাসায় ফিরে আইজার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেন, তিনি আইজার উদ্দেশ্যে বললেন “হাসপাতালে তিথি আর তার পরিবারের সামনে তোমার কি এই বিষয়ে কথা বলা ঠিক হয়েছে, মা?”
আইজা এবারও নির্লিপ্তভাবে বলল “বিয়ে ঠিক হলে তো তারা এমনিতেই জানত। সুতরাং তাদের সামনে বললেই বা কি সমস্যা?!”
ফারুক একটু চুপ থেকে বললেন “তুমি কি কোন চাপে পড়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছ?”
আইজা বলল “না, কোন চাপে পড়ে এই সিদ্ধান্ত নেইনি। এমন হলে আগেই এই সিদ্ধান্ত নিতাম। আমি কেবল এজন্যই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি কারণ আমান আমাকে ভালোবাসে।
আর আমিও তাকে।
আমাদের পরিবারের সবাইও এই সম্পর্কে রাজি।
আমি জানি, সে ভুল করেছিল, যার জন্য আমি তাকে ক্ষমাও করে দিয়েছি। তবে কেন নিব না আমি এই সিদ্ধান্ত? তিথির কথা ভেবে? যে এতকিছু করার আগে একবারও আমার কথা ভাবে নি! এছাড়া আমার সিদ্ধান্তে তার বরং লাভই হচ্ছে। তার সংসার ভাঙবে না। তার ব্যাপারে আমানকে দেয়া তোমার শর্তে আমারও আপত্তি নেই।”
ফারুক বললেন “মা, তার সতীন হয়ে যাচ্ছ, ঠিক আছে।
সে তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছে, কিন্তু তুমি তার সাথে কখনো কোন অন্যায় নিজেও করবে না, অন্য কাউকেও করতে দিবে না, আমাকে কথা দাও। আমি চাই না, আমার মেয়ের দ্বারা অথবা আমার মেয়ের কারণে অনেক বড় কোন গুনাহ হোক!
তুমি তখন মজলুম ছিলে আর তোমার প্রতিটা অশ্রু অভিশাপ হয়ে আজ তিথির জীবন কি বানিয়ে দিয়েছে!
এই মুহূর্তে সে-ও মজলুম, অসহায় এক নারী। তার অশ্রুর কারণ হবে না, মা। আমি চাই না, তোমার উপর কারো অভিশাপ লাগুক, এই জিনিসটা আমি খুব ভয় পাই। সত্যি বলতে তোমার খুশির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমার জন্য অন্য কিছুই না।
তুমি চাইলে এখনো না করে দিতে পারো। কিংবা এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সময়ও নিতে পারো ভাবার জন্য। এছাড়া দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, তোমার বাবা আছে তোমার পাশে, আমি সব সামলে নেবো, মা।”
আইজা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলল “আমি যা সিদ্ধান্ত নেয়ার, নিয়ে নিয়েছি বাবা। এখন তা বদলানোর নয়।
এছাড়া আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, বাবা। যাই হোক না কেন, আমার কারণে তিথির সাথে কোন অন্যায় হবে না। আর তোমাকে দেয়া কথা, আমার কাছে নিজের জীবনের চাইতে বেশি মূল্যবান।”
ফারুকের বলার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, তিনি আইজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
.
.
.
অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে কখন সকাল হয়ে গিয়েছে, আইজা টেরই পায়নি। বর্তমানে ফিরে আসলেও তার মনে হয়, কোথাও না কোথাও আজও অতীতেই আটকে আছে সে। ঠিক কি কারণে তার এমনটা মনে হয়, সে নিজেও জানে না।
আজ তার বিয়ে। এই দিনটি ঘিরে কত শত রঙিন স্বপ্ন সাজিয়েছিল সে আর আমান একসাথে; সেই কত বছর ধরে। কতটা প্রতীক্ষিত ছিল এই দিনটি। অথচ এই দিনটি কি আদৌ সেইরকম এই মুহূর্তে যেরকম সে কল্পনা করেছিল; বা যেরকম আমান ভেবেছিল?!
কত পরিকল্পনা, কত স্বপ্ন! তাদের স্বপ্নের গুছানো ছোট এক সংসার। হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হেঁটে সারাজীবন অতিবাহিত করে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা!
সেই দমরুদ্ধকর অপেক্ষা অবশেষে শেষ হয়ে তারা তাদের স্বপ্নের পথে!
এরপরও আইজার সবকিছু এত অসম্পূর্ণ, এত ফাঁকা মনে হচ্ছে কেন! এই কেমন জট লেগে আছে তার মন মস্তিষ্কে! এরপরও আইজার মনে কোন খুশি নেই কেন! এই বিয়েতে সে নিজে মত দিয়েছে এরপরও তার মনে আজ এত কনফিউশন কেন!
সে কি ভাবছে, ঠিক কার কথা ভাবছে। সে জানে না। তবে এই মুহূর্তে খুব বেশি কান্না পাচ্ছে তার। কিছু স্বপ্ন কেন পূর্ণতা পেলেও কেবল কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়!
তার জীবনের এত সুন্দর একটি দিনে কোন কারণ ছাড়াই অনেকক্ষণ যাবৎ বসে কাঁদল সে। এরপর চোখের অশ্রু ভালোভাবে মুছে ওয়াশরুমে গিয়ে তৈরি হয়ে এলো বিয়ের জন্য।
একটু পরেই তার বিয়ে। তার নতুন জীবনের শুরু, তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে। সেই ব্যক্তির সাথে যে তার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল। কিছুক্ষণ পরে তার নতুন জীবনের পথ চলা শুরু হবে, কেমন হবে তার নতুন জীবন?! সে জানে, আমান তাকে অনেক ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে। আগে যতটা ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখার কথা ছিল, এরচে বেশি ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে। পূর্বে করা ভুল সংশোধনের চেষ্টায় সে সবকিছু করবে আইজার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে এসবই ভেবে চলেছিল সে। নিজেকে দেখতে আজ নিজের কাছেই নতুন লাগছে তার।
অস্ত্রেলিয়া থেকে আসার সময় রিটার্ন টিকেটও করে এনেছিল সে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তা আজকের ডেটেরই। সে ভেবেছিল, সে এই তারিখে বাবা মায়ের বাসা থেকে বের হয়ে হয়ে অস্ত্রেলিয়া ফিরে যাবে, কিন্তু বাবা মায়ের বাসা থেকে তার বের হতে হচ্ছে ঠিকই, তবে স্বামীর বাসায় যাওয়ার জন্য। ভাগ্যও খুব অদ্ভুত জিনিস, কখন কার জীবনে কি তুফান নিয়ে আসে, বলা কঠিন।
টিকিট ফিরিয়ে দিলেও পারত সে, কিন্তু তা ছিঁড়ে ফেলার জন্য আইজা তা বের করে নিজের সামনে রাখলো।
.
.
.
সবাই শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে, আমান বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল “আইজা কোথায় এখন, বলছেন না কেন আপনারা ?! বিয়ে হওয়ার কথা ছিল দুপুরে আর এখন প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে, অথচ তার কোন খবর নেই, ফোনও সুইচড অফ। তার দুশ্চিন্তায় আমার নিজের অবস্থা শোচনীয়। তার ফোনে সারাদিন কল করেও পাই নি, বরাবর সুইচড অফ।”
এরপর একটু অধৈর্য হয়ে কিছুটা চিৎকার করে বলল “এভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে না থেকে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”
ফারুক আর লায়লার উদ্দেশ্যে খুব রেগে কথাগুলো বলল আমান।
সেখানে কেবল জয়নুল, ফারুক আর রায়হানের পরিবার উপস্থিত ছিলেন, বাকি সব মেহমান আগেই চলে গিয়েছে।
তখন আনোয়ারা বলে উঠলেন “আইজার যদি বিয়ে করার ইচ্ছা না-ই থাকে তবে কেন মত দিয়েছিল এই বিয়েতে?!
আমার তো মনে হয়, সে পালিয়ে গিয়েছে, যেন এই বিয়ে না করতে হয়। খুবই জেদি মেয়ে!”
লায়লা বললেন “না আনোয়ারা ভাবী, সে নিজেই মত দিয়েছিল এই বিয়েতে, আমানের সাথে বিয়ে করার ব্যাপারে কোন আপত্তি ছিল না তার। কিন্তু বিয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে সে কোথায় চলে গিয়েছে, আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। তবে সমস্যা নেই, কাজী সাহেব তো আছেন-ই, সে ফেরার সাথে সাথেই বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হবে।
এছাড়া আমার মনে হয়, জরুরি কিছুই ছিল নিশ্চয়ই। এজন্যই এভাবে কাউকে কিছু না বলেই সে গিয়েছে। এছাড়া আমার মেয়ে এমন নয় যে অন্যায় কিছু করবে।”
আনোয়ারা বললেন “হ্যাঁ, তা তো সময় আসলেই দেখা যাবে।”
এরইমধ্যে আনিস দৌড়ে আমানের কাছে এসে বলল “আইজার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে, চল আমার সাথে।”
আমানই আনিস সহ তার আরো কিছু লোককে লাগিয়েছিল আইজাকে খুঁজে বের করার জন্য।
তখন আমানও আর কালক্ষেপণ না করে আনিসের সাথে বের হয়ে যায়।
গাড়িতে আমান আনিসকে উদ্দেশ্য করে বলল “তার খোঁজ পেয়েছিস কোথায় ?”
আনিস বলল “সে-ই আমার ফোনে কল করেছিল। বলেছে তোকে যাতে সাথে করে নিয়ে যাই।”
আমান কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল “সে আমাকে কল না করে তোকে কেন কল করেছে?!”
আনিস বলল “এই একটি কারণে। কারণ সে জানত, তুই খুব বেশি উত্তেজিত এবং রেগে থাকবি। তার কোন কথাই ঠিকমত শুনবি না।
এজন্য আমাকে বলেছে যে করেই হোক, তোকে যেন তার কাছে নিয়ে যাই। তোর সাথে নাকি তার খুব জরুরি কিছু কথা ছিল।”
আমান আর কিছুই বলল না, তার কোন প্রশ্নের জবাব আনিসের কাছে নেই, সুতরাং তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেও লাভ নেই।
তার সব প্রশ্নের জবাব তো আইজার কাছে। যা তার কাছে পৌঁছেই সে পাবে।
.
.
.
এয়ারপোর্টে ওয়েটিংরুমে আমান আর আইজা পাশাপাশি বসে আছে। আমান আইজার দিকে তাকিয়ে বলল “এসব কি হচ্ছে, আইজা?!”
আইজা বলল “কিছুক্ষণ পর আমার ফ্লাইট, আমান।”
আমান বলল “এসবের মানে কি?! আজ আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। আর তুমি অস্ত্রেলিয়া ফিরে যাচ্ছ?!”
আইজা বলল “আমি অনেক ভেবেছি এই বিষয়ে, আমান। আমার কথা শুনো, বেশিক্ষণ সময় নিবো না, অল্পক্ষণ সময় দাও আমাকে, নিজের সব চিন্তা ভাবনা, মানসিকতা আর আমার মনের সব কথা তোমার সামনে তুলে ধরার জন্য। এরপর তুমি যে সিদ্ধান্ত নিবে, মেনে নিবো আমি।”
আমান কি বলবে সে ভেবে পেল না, সে চুপচাপ বসে রইল।
আইজা বলল “তুমি কি মাঝে মধ্যে এটা উপলব্ধি করতে পারো যে তুমি আর আগের আমান নেই। নাহলে এতক্ষণে পুরো এয়ারপোর্ট মাথায় তুলে ফেলতে।
আসলে কি জানো, মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে এমন বড় কোন ঘটনা ঘটে যায়, যার প্রভাবে একহলে ভালো একটা মানুষও বিপথে চলে যেতে পারে। অথবা জেদি, অহংকারী একটা মানুষও মাটির মানুষে পরিণত হতে পারে।
সবই নিয়ত আর নিয়তির ব্যাপার!
তুমি আগের চেয়ে অনেক বেশি বদলে গিয়েছ আমান, ভালো পরিবর্তনই। এতটা বদলে যাবে কখনো ভাবতে পারিনি। এই নতুন তুমির প্রেমে যেন আমি আবারও পড়েছি। তুমি তো এমন একজন যার প্রেমে বারবার পড়া যায়! সত্যি বলতে, তোমার এই পরিবর্তন আমাকে তোমার প্রতি আরো দুর্বল করে তুলছে, অনেক বেশি। কিন্তু তোমার এই পরিবর্তনও অন্য কারো ভাগ্যেই হয়তো লেখা ছিল।
আমান, প্রথমে আমি তোমাকে রিজেক্ট করি, নিজের জিদের কারণে। এরপর নিজের জিদ থেকে বের হয়ে তোমার সাথে বিয়েতে মত দেই, নিজের আবেগের কারণে, বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় খুব বেশি আবেগী ছিলাম আমি। সেই মুহূর্তে অনেক কিছুই ভাবতে পারি নি কিংবা ভাবার অবস্থায় ছিলাম না।
আর এখন ঠান্ডা মাথায় সবকিছু চিন্তা ভাবনা করে আমার মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে। আমার বিবেকের কাছে আমার সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ। আমি এখন সব আবেগ অনুভূতি থেকে উর্ধ্বে উঠে ঠান্ডা মাথায় একটা সিন্ধান্ত নিয়েছি।
আমি যদিও উত্তর জানি, তবে তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। তুমি আমাকে ঠিক কতটা ভালবাসো?”
আমান স্থির দৃষ্টিতে অল্পক্ষণ আইজার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল ” আমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে চাইছো?!”
আইজা ঠোঁটে এক টুকরো বিষন্ন হাসি ছড়িয়ে বলল “পরীক্ষা তো আমরা সবাই প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছি। কেউ ভালোবাসার, কেউ ধৈর্য্যের, কেউ বিশ্বাসের। কিন্তু কয়জন উত্তীর্ণ হতে পারে এসব পরীক্ষায়?!
তোমার কি মনে হয়, তুমি পারবে এই দফা উত্তীর্ণ হতে?”
আমান ভ্রু কুঁচকে আইজার দিকে তাকিয়ে বলল ” যা বলবে স্পষ্ট করে বলো।”
আইজা বলল “সমাজ এখনো এই দ্বিতীয় বিয়েকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় না। তারা তোমার আমার কাহিনী জানবে না, তারা এটাই ভাববে, আমি তোমার আর তিথির সংসারে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি হিসেবেই প্রবেশ করেছি। আমি মানুষের কথার পরোয়া করি না, কিন্তু আত্নসম্মান বলতেও একটি বিষয় আছে। তুমি কি এই জিনিসটি চাইবে যে, আমার ভালোবাসার কারণে আমার আত্নসম্মান প্রশ্নবিদ্ধ হোক।
এছাড়া যেসব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না, সেগুলো কি সত্যিকার ভালোবাসা হয় না?!
সব ভালোবাসা তো পূর্ণতা পায় না। থাকুক না আমাদের ভালোবাসাটাও অপূর্ণ, অন্য কারো ভালোবাসা আমাদের ভালোবাসার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দিয়ে নাহয় পূর্ণতা পাক।
আমি তিথির কথা বলছি, আমান। আমি মাঝে মধ্যে চিন্তা করি, সে তোমাকে কতটা ভালোবাসতে পারলে, তোমার ভালোবাসায় এতকিছু করেছে, পরিণামেরও ভয় পায়নি।
তার ভালোবাসা কি পরিমাণ হতে পারলে, ভাগ্যও তার উপর সদয় হয়ে, তোমাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে তাকে সমর্পণ করে দিয়েছে!”
আমান বলল “এর মানে, ভালোবাসায় প্রতারণা জায়েজ?! সে যা করেছে, সব জায়েজ?”
আইজা বলল “কখনোই না, সে যা করেছে সবকিছু ভুল ছিল।
আর প্রতারণা তো এমন এক বিষ যা এক মহাসমুদ্র সমান ভালোবাসায় পড়লে তাও বিষাক্ত হয়ে যায়। এবং সেই বিষ ভালোবাসার মানুষটিকেই তিলে তিলে মারতে থাকে।
তিথির অপরাধ শাস্তিযোগ্য। তবে তোমার মনে হয় না, সে তার শাস্তিও পেয়েছে।
তুমিই চিন্তা করো, যাকে ভালোবেসেছিল এতকিছু করার পর তাকে ঠিকই অর্জন করে ফেললো। সে-ও তাকে আদর সোহাগ যত্নে তার পুরো পৃথিবীটা সুখ দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিল।
এরপর হঠাৎ একদিন তার সমস্ত প্রতারণা সবার সামনে চলে আসে। সবাই তাকে ঘৃণা করা শুরু করে, এমনকি তার নিজের পরিবারের মানুষজনও। কেউ তার চেহারা পর্যন্ত দেখতে পছন্দ করে না।
সুখের সুউচ্চ আকাশে উড়তে উড়তে হঠাৎই যেন দুঃখ তাকে জমিনেরও নিচে ছুঁড়ে মারে। ব্যথাও নিশ্চয়ই সে ততটাই পেয়েছিল, কষ্টও হয়েছিল খুব বেশি! এটা কি শাস্তি হিসেবে কম কিছু?!
এছাড়া এতকিছুর পরেও সে তোমাকে ছাড়তে চায় না, এখনো তার একই মনোভাব, প্রয়োজনে সতীনের সংসার করবে তবু তোমাকে ছেড়ে যাবে না। কাউকে কি পরিমাণ ভালোবাসতে পারলে কেউ এমন কিছু করতে পারে!
সত্যি বলছি, আমার মনে হয়, আমার চেয়ে বেশি সে তোমাকে ভালোবাসে, সেজন্যই তাকে তোমার ভাগ্যে রেখে দিয়েছেন রব।”
আমান বলল “তার সম্পর্কে এসব শোনার কোন আগ্রহ নেই আমার, আইজা। তা তুমিও ভালো করেই জানো।
এছাড়া আমাকে কে কতটা ভালোবাসে, এরচে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমি কাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তের জন্যও অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারিনি আমি। তিথির প্রতিও প্রথম দিকে যা ছিল, সব দায়িত্ববোধ থেকে করেছি, যেন তার প্রতি কোন অন্যায় না হয়ে যায়। কারণ স্ত্রী হিসেবে তাকে গ্রহণ করলেও আমার মনে তখনো কেবল তুমি ছিলে, যদিও তোমাকে তখন কেবলই ঘৃণা করতাম। তবুও। আর এসব বিষয়ে তিথিও খুব ভালো করে জানত।”
আইজা বলল “এখন একই দায়িত্ববোধ থেকে বাকি জীবনটাও পার করে দাও, আমান। তিথির ভুলকে এমনভাবে ভুলে যাও, যে সে তা কখনো করেই নি। এতেই তুমি, সে আর বাকি সবাই সুখী হতে পারবে।”
আমান বলল “আমি এখন কেবল ঘৃণা করি তাকে, তার সাথে কাটিয়ে দিবো বাকি জীবন?! তুমি জানো, তাকে আবারো স্ত্রীর মর্যাদা দিতে আমি কেন রাজি হয়েছি।”
এরপর একটু দম নিয়ে শান্ত গলায় বলল “আচ্ছা। আমার কথা শুনো। আইজা। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, তার সাথে আর কখনো কোন অন্যায় করবো না। তাকে কখনো কষ্ট পেতে দিবো না, তার প্রতি নিজের সমস্ত দায়িত্ব পালন করবো। দুনিয়ার সব সুখ এনে তার পদতলে রেখে দিবো।
এরপরও আইজা, আমার ভালোবাসা থেকে আমাকে দূর করে দিয়ো না। তোমাকে বারবার এতটা কাছ থেকে পেয়ে আবারও হারিয়ে ফেলি। এবার অন্তত হারিয়ে যেও না। তোমাকে নিজের চোখে স্বপ্ন হিসেবে হলেও সাজিয়ে রাখতে চাই। তুমি আমার কাছে আছো, এই সান্তনা নিয়ে বাকি জীবন শান্তিতে কাটিয়ে দিতে চাই। তোমাকে হারিয়ে ফেললে নিজের শান্তি হারিয়ে ফেলবো আমি, আইজা।”
আইজার চোখে অশ্রু জমে উঠল, সে যে এই মুহূর্তে নিজেকে কীভাবে শক্ত রাখতে পেরেছে তা সে নিজেও জানে না। সে বলল “আমি জানি, আমার সুখের জন্য, এমনকি তিথিকে সুখী রাখতেও তুমি সবকিছু করতে পারো। কিন্তু আমি এতটা স্বার্থপর নই যে কেবল নিজের সুখের কথা চিন্তা করবো! সত্যি তো এটাই যে তুমি আমাকে সুখী করতে বা তাকে সুখী করতে যা কিছু করো, আমরা কখনো খুশি হবো না। তখন আমরা কেবল এটাই ভাববো, তুমি হয়তো অপরজনের দিকে বেশি খেয়াল করছো, তার যত্ন বেশি নিচ্ছো। জানি, এই মুহূর্তে এসব শুনতে তোমার কাছে হয়তো খুব লেইম মনে হচ্ছে। কিন্তু সংসার তো সুখের হয় ছোট ছোট বিভিন্ন জিনিসের সংযোগেই। কিন্তু তোমার আমার আর তিথির সংসারে তুমি নিজেও কখনো সুখী হতে পারবে না।
এটা নারীর স্বভাবজাত, জন্মগত বৈশিষ্ট্য বলতে পারো, এরা সবকিছু হাসিমুখে শেয়ার করতে পারলেও নিজের স্বামীকে পারে না কখনো। এজন্য তুমি তাদেরও ঠিক দোষ দিতে পারো না। তাদের মনের অবস্থা বুঝতে হলে তাদের স্থানে নিজেকে রেখে আগে চিন্তা করতে হবে। তারা নিজেদের স্বামীকে নিজেদের ভালো থাকার অবলম্বন ধরে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চায়। তবে কীভাবে করবে সহ্য, সেই ভালো থাকার অবলম্বনের পাশে অন্য কাউকে!
তবে অনেকেই আছে, তারা হয়ত মানিয়ে নেয় সবকিছু নিজস্ব কিছু কারণে; মহৎ কোন কারণে, বা নিজস্ব কিছু স্বার্থে। তবে সবাই তা পারে না।”
অঝোরে ঝরে পড়া চোখের অশ্রু মুছে নিজেকে কিছুটা শক্ত করে স্বাভাবিক স্বরেই আইজা আবারও বলল “দয়া করে, এখন নিজের মন থেকে এই ঘৃণার রেখাটি মুছে ভালোবাসার নতুন এক রেখা এঁকে ফেলো। সে কেবল তোমার স্ত্রী-ই নয়, কয়েকদিন পর তোমার বাচ্চার মা-ও হবে। সুতরাং, সেই সম্মানেই নাহয় তাকে মাফ করে দাও। গ্রহণ করে নাও তাকে। নিজের কথা না, তিথির কথা না, অন্তত বাচ্চাটার কথা চিন্তা করো।
এছাড়া তিথি যদি এই সত্য জানার পর তোমাকে ছেড়ে দিতে রাজি হত যে তুমি কখনো তাকে ভালোবাসতে পারবে না, তখন নাহয় একটা কথা ছিল। কিন্তু সে যেকোনো মূল্যে তোমার সাথে থাকতে চায়, তার এসব বিষয়ে কিছুই যায় আসে না যে তুমি কখনোই তাকে ভালোবাসতে পারবে না।”
আমান খুব হতাশ, মলিন চেহারা নিয়ে বসে রইল। তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে, তার ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
আইজা আমানের হাতের উপর নিজের হাত আলতো করে রেখে বলল “আমান, জোর করে তোমার মনে তাকে স্থান দিতে বলছি না। আমি জানি, মনের উপর কারো কোন জোর নেই। ভালোবাসা জোর করে হয়না।
কিন্তু দায়িত্ববোধ থেকে হোক বা আমার করা অনুরোধ থেকে, তুমি তিথির এতটা যত্ন নিবে, এতটা সুখী করবে তাকে যাতে কেউ এই অপবাদ দিতে না পারে আমার ভালোবাসায়, আমার কারণে তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে অন্যায় করছো।”
আমান মলিন দৃষ্টি নিয়ে আইজার দিকে তাকিয়ে বলল “যে মেয়ে আমাদের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে, তার জন্য এতো দয়া দেখাচ্ছো?!”
আইজা বলল “তার উপর দয়া দেখাচ্ছি না, হয়তো নিজের উপর দেখাচ্ছি। অবশেষে আমি অতীতকে ছেড়ে দিয়েছি, যা এতদিনেও করতে পারি নি। আর তোমাকেও সেটাই করার পরামর্শ দিচ্ছি। নিজের অতীতকে নিজের উপর বোঝা হতে দিয়ো না। অতীত মনে রাখলে তা আমাদের ভবিষ্যত ধ্বংস করে দেয়, আমান। অতীত তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করার আগে তুমি অতীতকে নিয়ন্ত্রণ করো। নিজের মন মস্তিষ্ক থেকে তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে।
যা হয়েছে তা যদি প্রকৃতপক্ষেই আমরা ভুলে যাই, আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে।
এছাড়া সেদিন আমি তিথিকে দেখেছিলাম, এখন তার চোখের দিকে তাকালে অন্ধ কোন ব্যক্তিও বলে দিতে পারবে যে তার কৃতকর্মের জন্য কতটা অনুতপ্ত সে।
প্রকৃতপক্ষেই কেউ অনুতপ্ত হলে তো স্রষ্টাও ক্ষমা করে দেয়, আমরা তো তবু মানুষই।
এছাড়া যেদিন তুমি তোমার বাচ্চাকে প্রথমবারের মতো কোলে নিবে, যখন তার হাত ধরে তাকে হাঁটতে শিখাবে, প্রথমদিন স্কুলে নিয়ে যাবে, তখন তোমার কাছে খুব বেশি খারাপ লাগবে না এমন একটি মেয়েকে নিয়েও বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে, যাকে তুমি এক মুহূর্তের জন্যও ভালোবাসো নি। কিন্তু তার সাথে কোন অন্যায় করে থাকলে বাকি জীবনের জন্য ঠিকই নিজের বিবেকের কাছে তোমার অপরাধী হয়ে থাকতে হবে।”
আমান এখন আর কিছুই বলছে না, তার দু’চোখ ক্রমাগত ভিজে উঠছে।
ইতিমধ্যেই আইজার ফ্লাইটের ঘোষণা হলো। তা শুনতে পেয়ে আইজা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল “আমান, আমার এখন যেতে হবে।”
আমানের অশ্রু যেন এখন আর কোন বাঁধ মানছে না। সে হাতের উলটো পিঠে অশ্রু মুছে বলল “নিজের হৃদয়ের সাথে কি পরিমাণ যুদ্ধ করে তোমাকে যেতে দিচ্ছি, তোমার সব কথা মেনে নিচ্ছি, তুমি কল্পনায়ও অনুমান করতে পারবে না!
আমার আজকের এই অনুভূতি কখনো ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। হয়তো মৃত্যু এরচে সহজ ছিল।
আমি কখনো ভাবিনি এই কথা বলবো, কিন্তু আজ না বলেও পারছি না। কেন আমি ভালোবাসতে গেলাম এমন একজনকে, যে আমার ভাগ্যেই নেই। ভালোবাসা যে এতটা নির্দয়, এতটা নিষ্ঠুর, তা আমাকে দিয়েই প্রমাণ হতে হলো!”
আইজারও বুক ভেঙে কান্না আসছে, আমানকে এভাবে পাগলের মত কাঁদতে এর আগে আর কখনো দেখেনি সে। সে আর বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারল না। বসা থেকে উঠে হাঁটতে লাগলো, সে জানে, এবার যদি সে থামে আর কখনো ছাড়তে পারবে না তাকে। দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে যাক না কেন!
আমান অশ্রু ঝাপসা চোখে আইজার চলে যাওয়া দেখল। এরপর সে-ও উঠে চলে গেল সেখান থেকে।
চলবে…
{ আর একটি পর্ব পরে গল্প শেষ হয়ে যাবে, কারণ অল্প কিছু কাহিনী বাকি আছে এখনো। তবে পরবর্তী পর্ব-ই শেষ পর্ব হবে। }