নীল চিরকুট #লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা ২৬.

0
1402

#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

২৬.

পশ্চিমাকাশে ঝুলে আছে স্নিগ্ধ, নিরুত্তাপ সূর্য। চারদিকে কমলা রঙা আলো ছড়িয়ে জানিয়ে দিচ্ছে ক্লান্ত দিনের বিদায় সম্ভাষণ। কেবিনের ছোট্ট কাঁচের জানালায় গড়াগড়ি খাচ্ছে নরম, মিষ্টি আলো। জানালার কার্নিশে বসে থাকা কুচকুচে কালো কাকটা কিছুক্ষণ পরপরই সবিস্ময়ে ঠুকরে দিচ্ছে স্বচ্ছ কাঁচে ভেসে উঠা তার নিজস্ব প্রতিবিম্ব। অন্তু সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে। মস্তিষ্কটা কেমন ঘোলাটে, অনুভূতিশূন্য। প্লাস্টারে ঢাকা বামহাতটা কিছুক্ষণ পর পরই তীক্ষ্ণ ব্যথায় অস্থির করে তুলছে। অন্তু চোখ বোজল। অসহনীয় ব্যথায় কপাল কুঞ্চিত। অন্তু চোখ বোজেই বুঝতে পারল কেবিনের দরজাটা খুলে গিয়েছে। মৃদু মেয়েলী সুবাস ভেসে আসছে কাছে, খুব কাছে। অন্তুর চোখ মেলতে ইচ্ছে করছে না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। চুপচাপ শুয়ে থেকে তার উপস্থিতি অনুভব করতে ইচ্ছে করছে। নীরা কাঠের টোলটা টেনে অন্তুর মাথার কাছে বসল। এই এতোক্ষণে কেবিনে ঢোকার সাহস ও সুযোগ হলো তার। নীরার প্রতি অন্তুর দুর্বলতাটা হয়ত কোনোভাবে জেনে গিয়েছেন অন্তুর মা জাহানারা বেগম। শান্তশিষ্ট, গোলাগাল মহিলাটি পুরোটা সময় হিংস্র দৃষ্টিতে খেয়াল করে গিয়েছেন নীরাকে। তার দৃষ্টি বলছিল, অন্তুর এই অবস্থার জন্য শুধু এবং শুধুই নীরা দায়ী। নীরা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ জেগে আছিস?’

অন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ মেলে তাকাল। নীরার সুন্দর,টুলটুলে মুখটিতে গভীর বিষাদ দেখতে পেলে হয়তো খুব বেশিই খুশি হতো অন্তু। তার সুপ্ত মনও বুঝি এমনটাই চেয়েছিল। কিন্তু নীরার মাঝে আহামরি দুঃখী দুঃখীভাব দেখা গেল না। স্নিগ্ধ চোখজোড়ায় ক্লান্তি ব্যতিত কিচ্ছুটি নেই। অন্তুর জন্য বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই। কষ্ট আর হতাশায় বুকের ভেতরটায় চিনচিনে ব্যথা করে উঠল অন্তুর। অন্তুকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নীরা। কঠিন কন্ঠে বলল,

‘ এক্সিডেন্টটা কিভাবে হলো? কোথায় ছিলি এই দুইদিন? সবকিছুকে ফ্যান্টাসি ভাবলে হয় না অন্তু। জীবনটা ফ্যান্টাসি নয়। এই যে তুই এমন উদ্ভট কার্যকলাপগুলো করছিস, তাতে আমার ভেতরের বিরক্তটা হুহু করে বাড়ছে। এর বাইরে অন্যকোনো অনুভূতি হচ্ছে না। দুনিয়াকে কী দেখাতে চাইছিস? আমি অপরাধী আর তুই মহান? ভালোবেসে দেবদাস হয়ে যাচ্ছিস? লিসেন অন্তু, জোর করে বা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে কিছু হয় না। কেন বুঝিস না যে, আমিও তোকে ভালোবাসি। যতটা নাদিম, রঞ্জন, নমু, ছোঁয়াকে ভালোবাসি ঠিক ততটা ভালোবাসা তোর জন্যও বরাদ্দ। তোকে এভাবে দেখলে কষ্ট হয়। খারাপ লাগে। কিন্তু এই খারাপ লাগা থেকে সেমপ্যাথি আসে। ভালোবাসাটা আসে না। তাই এসব দেবদাসের ভং ধরা বন্ধ কর। বন্ধু আছিস, বন্ধু থাক। প্লিজ!’

নীরার কঠিন কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলো অন্তু। কয়েক সেকেন্ড অপলক তাকিয়ে থেকে শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ তুই নিজেকে এতো ইম্পোর্টেন্ট কেন ভাবছিস নীরু? এক্সিডেন্ট বিষয়টাই আকস্মিক। রাত জেগে বাইক চালাচ্ছিলাম তাই হয়তো একটু এদিক-ওদিক হয়ে গিয়েছে। এছাড়া কিছুই না। অন্যের জীবনে নিজেকে অতোটা ইম্পোর্টেন্ট ভাবিস না। পায়েসে বাদাম যেমন উটকো। থাকলে বিলাসিতা না থাকলে গুরুত্বহীন। তুইও আমার জীবনে সেরকম, গুরুত্বহীন। আমাকে নিয়ে না ভেবে নিজের হবু স্বামী আর সংসার নিয়ে চিন্তা কর দোস্ত। ফ্রেন্ড সার্কেলে তোরই প্রথম বিয়ে। আমরা কিন্তু খুব আশাবাদী।’

অন্তুর জ্বালা ধরা কথা আর অপমানে ভেতরটা বিষিয়ে উঠল নীরার। অন্তুর দিকে স্থির তাকিয়ে থেকে ম্লান হাসল।

‘ বেশ তো। শুনে ভালো লাগল। এই কথাগুলো বাকি দুনিয়াকেও জানিয়ে দিস। দুনিয়ার কাছে তো আবার নীরা মহাপাপী।’

অন্তুও ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বলল,

‘ অবশ্যই। তুই কি এখন একটু যাবি দোস্ত? আমি ঘুমাব।’

নীরা চুপচাপ বসে রইল। ভেতরটা পুড়ছে, জ্বলছে। চোখ ভাসিয়ে দিতে চাইছে উত্তপ্ত বর্ষণ। ততক্ষণে চোখ বোজে নিয়েছে অন্তু। নীরা উদাস দৃষ্টিতে অন্তুর বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ধীর পায়ে উঠে এলো জায়গাটা থেকে। কেবিন থেকে বেরিয়েই মায়ের ফোন পেল নীরা। ফোনটা কানে নিয়ে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতেই উদ্বেগী কন্ঠে বলে উঠলেন মা,

‘ কেমন আছিস নীরা?’

নারী স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

‘ ভালো আছি মা। তুমি ভালো আছ?’

‘ তা আছি। কাল যে একটু বাড়ি আসতে হচ্ছে তোকে। খুব জরুরি।’

‘ কেন? কি হয়েছে, মা? পরশো থেকে আমার ফাইনাল পরীক্ষা। এখন কিভাবে যাব?’

‘ একটু ম্যানেজ করে চলে আয় মা। ছেলের বড় খালা আর দুলাভাই তোকে দেখতে চাইছে। ছেলেপক্ষকে তো আর মানা করতে পারি না।’

নীরা বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ আমি কী কোনো শো-পিস মা? জনে জনে দেখতে হবে কেন? কুরবানির পশুকেও বোধহয় এত যাচাই বাছাই করে না। আমার অস্বস্তি লাগে।’

ওপাশ থেকে ব্যস্ত উত্তর,

‘ ওমন বলতে নেই নীরা। বিয়ের সময় ওসব একটু আধটু হয়। আমাদের সময়ও হয়েছে। ছেলে টাকা-পয়সা কিছু নেবে না। শুধু সুন্দরী মেয়ে চায়। এমন শর্তহীনভাবে বিয়ে করছে, মেয়ে তো একটু যাচাই-বাছাই করবেই। আমাদের কী এখন টাকা-পয়সা দিয়ে বিয়ে দেওয়ার মতো সামর্থ্য আছে?’

নীরার বলতে ইচ্ছে করল, ‘ সুন্দর মেয়ে চাওয়া কী শর্তের মধ্যে পড়ে না মা? লোকটি তোমার মেয়ের মন নয় দেহে দেখে বিয়ে করছে। এই দেওয়াটা টাকা-পয়সা দেওয়ার থেকে অনেক বেশি কিছু কি হয়ে যাচ্ছে না?’ নীরা তেমন কিছুই বলল না। সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আচ্ছা মা। আমি সকালের বাসেই আসছি। চিন্তা কোরো না।’

‘ হ্যাঁ। তাই কর। আর আসার আগে পার্লারে কি-সব করে না মেয়েরা? ফ্যাশিয়াল না কি? ওসব করে আসিস। নিজের যত্ন তো নিস না একদম। দিন দিন পোঁড়া কাঠ হচ্ছিস। ছেলের বড়খালা নাকি বাঘা মহিলা। বিয়ে টিয়ে ভেঙে গেলে সর্বনাশ। এদিকে ইরা স্মার্টফোনের জন্য লাফালাফি করছে। দুই বোনের ভার্সিটির খরচই সামলে উঠতে পারছে না ইরাম। তারমধ্যে আবার ফোন? বিন্দুমাত্র আক্কেল নেই মেয়েটার।’

নীরা দুর্বল কন্ঠে বলল,

‘ এখন একটা স্মার্টফোন ওর আসলেই দরকার মা। ভার্সিটিতে পড়ছে। সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে না? তাছাড়া এসাইনমেন্ট, নোট এসবের জন্যও লাগে ফোন।’

নীরার মা ক্ষ্যাপা কন্ঠে বললেন,

‘ কই? তোকে তো কিনে দিইনি। তুই তাল মিলিয়ে চলতে পারিসনি? উল্টে পড়ে গিয়েছিস? পেঁয়াজের দাম হয়ে গিয়েছে ত্রিশ টাকা কেজি। একটা সংসার চালাতে কত খরচ হয় কোনো ধারণা আছে? ছেলেটা খেঁটে খেঁটে মরে যাচ্ছে। মেসে থেকে চাকরী করছে। এই খাচ্ছে, এই খাচ্ছে না। এসব কী ও বুঝে না? সারাদিন স্যাশন ফি। হেন ফি। তেন ফি। কই? তুই তো নিস না।’

‘ আমার সাথে ওর তুলনা করছ কেন মা? আমার আর ওর জেনারেশনে যথেষ্ট গ্যাপ আছে। তুমি ওকে অযথা বকো না তো মা। ওকে ওর মতো বাঁচতে দাও। আমি টিউশনি খুঁজছি। দুই-এক মাসের টিউশনির টাকা জমিয়ে ওকে একটা ফোন কিনে দেব। আমার কাছে টিউশনির কিছু টাকা জমানো আছে ওর স্যাশন ফি আমিই পাঠিয়ে দেব মা। ভাইয়াকে পাঠাতে হবে না।’

নীরার কথায় মা শান্ত হলেন না। সংসারের একের পর এক জোট-ঝামেলার কথা আওড়াতে লাগলেন। নীরা চুপচাপ শুনছে। সেইসাথে বুক ফেঁটে কান্না পাচ্ছে। মনে মনে শুধু একটাই প্রার্থনা করছে, পৃথিবীর আর কোনো মেয়েকেই যেন তার মতো বাটগাছহীন, দুর্ভাগা হতে না হয়। ইরাকে যেন তার মতো এতোটা সহ্য করতে না হয়। তার ছোট বোনটা একটু বাঁচুক। প্রাণখোলে বাঁচুক। বুক ফাঁটা কষ্টগুলোকে দাবিয়ে দিয়ে মস্তিষ্কে চাড়া দিয়ে উঠল একটিই চিন্তা, আরেকটা টিউশনি পেতে হবে। খুব শীগগির পেতে হবে!

রেস্টুরেন্টের চওড়া টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে আরফান-নম্রতা। শেষ বিকেলের কমলা আলো তাদের গায়ে পড়ছে না। অত্যাধুনিক রেস্টুরেন্টটা কৃত্রিম আলোতে ঝলমল করছে। নম্রতা ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশের ডেকোরেশন দেখছে। মূলত, আরফান নামক মানুষটিকে পুরোদমে এবোয়েড করার চেষ্টা করছে। আরফান নিশ্চুপ চোখে নম্রতার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নম্রতা তাকে লক্ষ্য করছে কি করছে না সেদিকে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। নম্রতা ব্যাপারটা প্রথম থেকেই খেয়াল করেছে এবং চুপ থেকেছে। কিন্তু এবার একটু নড়ে চড়ে উঠল। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করল।

‘ আপনি আমার পায়ের দিকে কি দেখছেন?’

নম্রতার কথায় আরফানের ঘোর কাটল। আনমনা হয়ে বলল,

‘ হু? কিছু বললেন?’

‘ আপনি আমার পায়ের দিকে অতো কী দেখছেন? জুতোগুলো পছন্দ হয়েছে? খুলে দেব?’

আরফান উত্তর না দিয়ে অল্প কাঁশল। দু-একদিনের অযত্নে গজানো দাঁড়িগুলোতে হাত বুলিয়ে নিয়ে ঘাড়ে হাত বুলাল। নম্রতাকে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে একজন ওয়েটারকে ডাকল আরফান। ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,

‘ কি খাবেন?’

নম্রতা শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ কিছু খাব না। আপনি কি বলবেন, বলুন। শুনে চলে যাব।’

‘ আপনাকে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম তবুও করলেন না কেন অপেক্ষা?’

নম্রতা এবার চোখে চোখ রাখল। আরফানের গম্ভীর, শান্ত চোখে কোথাও একটা শিশুসুলভ চঞ্চলতা। এক আকাশ কৌতূহল আর মায়া। নম্রতা সেই শিশুসুলভ চোখে চেয়ে বলল,

‘ অপেক্ষা খুবই ক্লান্তিকর ডক্টর। তাই এখন আর অপেক্ষা করার সাহস হয় না।’

আরফান কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসে থেকে নজর ফেরাল। অন্যদিকে চোখ রেখে বলল,

‘ আপনার পায়ে একটা পায়েল দেখেছিলাম সেদিন।’

‘ তো?’

‘ পায়েলটা আমার পরিচিত। আসলে, আপনার পা জোড়াও আমার পরিচিত। ওগুলো সত্যিই আপনার পা?’

কথাটা বলে হাসল আরফান৷ নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

‘ না তো। পাশের বাসা থেকে ধার করে এনেছি পা।’

নম্রতার কথায় মাথা নিচু করে হাসল আরফান। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

‘ জুতো জোড়া একটু খুলবেন প্লিজ?’

নম্রতা অবাক হয়ে বলল,

‘ কেন?’

‘ এক পলক দেখে যে ভাবনাটা এসেছিল সেই ভাবনাটা সঠিক কি-না যাচাই করব।’

নম্রতা সন্দিহান কন্ঠে বলল,

‘ কি ভাবনা এসেছিল?’

আরফান সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,

‘ পা জোড়া আপনি চুরি করেছেন।’

‘ কিহ!’

নম্রতার আওয়াজটা খানিক জোড়ে হওয়ায় আশেপাশের দু-একজন ঘাড় ফিরিয়ে ওদের দিকে তাকাল। আরফানের ঠোঁটে মৃদু হাসি। নম্রতা থতমত খেয়ে চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ বাদে টেবিলের ওপর ঝুঁকে এসে নিচু স্বরে বলল,

‘ কি?’

আরফানের হাস্যোজ্জল জবাব,

‘ আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না? আই হ্যাভ আ প্রুফ।’

নম্রতা এবার সোজা হয়ে বসে সরু চোখে তাকাল। ‘হি হ্যাজ আ প্রুফ?’ কিসের প্রুফ? নম্রতার কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, লোকটি বদ্ধ পাগল। শ্যামবর্ণের অসহ্য সুন্দর পাগল। আরফান পকেট থেকে নিজের ফোন বের করে নম্রতার চোখের সামনে ধরল। নম্রতা অবাক হয়ে খেয়াল করল, আরফানের ফোন ওয়ালে নম্রতার পায়ের ছবি। প্রেমের প্রথম দিকে চিঠির সাথে পাঠানো কিশোরী নম্রতার ফর্সা পায়ের ছবি। নম্রতার চোখে-মুখে বিস্ময় ফুঁটে উঠতেই হাসল আরফান। ফোনটা পকেটে রেখে বলল,

‘ এবার বলুন, পা গুলো আমার নিজস্ব সম্পদ না আপনার?’

নম্রতা জবাব দিল না। তার হৃৎস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে ছুঁটছে। অদ্ভুত অনুভূতিতে উথাল-পাতাল হচ্ছে বুক। চোখ ভাসিয়ে কান্না পাচ্ছে। তারমানে আরফান তাকে ভুলে যায়নি। সেও আরফানের কাছে ততটুকুই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যতটুকু নম্রতার কাছে ছিল আরফান। নম্রতা চট করে উঠে দাঁড়াল। ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়েই রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে হাঁটা দিল। আর এক মুহূর্ত এখানে থাকলে নিশ্চয় কেঁদে-কেটে অস্থির হয়ে যাবে নম্রতা। এই পাব্লিক প্লেসে এমন ন্যাকামোর কোনো মানে হয়? নম্রতার হঠাৎ প্রস্থানে হতভম্ব হয়ে গেল আরফান। নম্রতার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ-ই ডেকে উঠল সে,

‘ শ্যামলতা! আপনিই শ্যামলতা, তাই না? ‘

নম্রতা থমকে গেল। দরজার কাছাকাছি গিয়েও ফিরে তাকাল। আরফান তার শিশুসুলভ চোখদুটোতে অসংখ্য প্রশ্ন নিয়ে চেয়ে আছে। নম্রতা টলমলে চোখদুটো ফিরিয়ে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো। চোখদুটো থেকে নেমে গেল এক বর্ষা শীতল বর্ষণ। আরফান বলা ‘শ্যামলতা’ ডাকটা ঘুরেফিরে বাজতে লাগল কানে। আকাশ, বাতাস, এই কোলহলময় শহর সবকিছুকে ছাপিয়ে ডেকে উঠল একটি পুরুষালি কন্ঠ, ‘ শ্যামলতা! আপনিই শ্যামলতা, তাই না?’ নম্রতার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আসছে। চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে জানাতে ইচ্ছে করছে, শুনছ? আমি পেরেছি। চার চারটা বছর অপেক্ষার জ্বালা সইতে আমি পেরেছি। সে এখন আমায় ডাকে। কি আশ্চর্য! আজ আমি তাকে শুনতে পাই!’

রাত দুটো কি তিনটা বাজে। এতোরাতেও হলের দু-একটা রুম থেকে গুনগুনিয়ে পড়ার আওয়াজ আসছে। সিনিয়রদের তাসের আড্ডার হৈ-হুল্লোড়ও কানে আসছে মৃদু। নাদিম-রঞ্জন মাত্রই হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। ঘামে গোসল হয়ে থাকা শরীর থেকে বিদঘুটে গন্ধ আসছে। ঘামে ভেজা শার্টটা খুলে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে চেয়ারে গা এলিয়ে বসল নাদিম। শরীরটা প্রচন্ড ক্লান্ত। রঞ্জন নিজের শার্ট খুলে ব্যালকণিতে লাগানো দড়ির ওপর ছড়িয়ে দিল। ধীরে স্থিরে এসে বসল বিছানায়। রঞ্জনের সব কিছু যেন মাপা মাপা। সবকিছুই পরিষ্কার, পরিপাটি আর গোছালো। পূজার প্রতি ভালোবাসাটাও তার গোছানো। কোনো অতিরঞ্জতা নেই। কোনো ঝামেলা নেই। দু’জনেই শান্ত আর বোঝদার। নাদিম টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে গিটারটা টেনে নিল কোলে। গিটারের মাথায় আলতো চুমু খেয়ে উলোটপালোট টুন বাজাতে লাগল। সেই উলোটপালোট সুরই বেশ সুন্দর শোনাল রঞ্জনের কানে। নাদিম গিটারটা বেশ আবেগ নিয়ে বাজায়। গিটারের প্রতিটি তারে তার স্পর্শ দেখে মনে হয় গিটার নয়, পরম আদরে প্রেমিকার নরম চিবুক ছুঁয়ে দিচ্ছে সে। নাদিম বার দুয়েক সুর তোলার চেষ্টা করে বলল,

‘ দোস্ত? তুই যদি মাইয়া হইতি তাহলে তোর সংসার হইতি হেব্বি পার্ফেক্ট। এক্কেরে ঝকমকা।’

রঞ্জন কপাল কুঁচকে তাকাল। বিছানা হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজে নিয়ে বলল,

‘ তুই মুখ খুললেই ফালতু কথা। এজ আ ম্যান, আমি ঠিক আছি। কথায় কথায় মাইয়া মাইয়া করলে তোর খবর আছে।’

নাদিম হাসল। টেবিলে পড়ে থাকা নতুন উপন্যাসের বইটির দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। বইটি মৌশি দিয়েছে। মৌশি নাকি জন্মদিনে তার প্রিয় মানুষ এবং মোটামুটি প্রিয় মানুষদের গিফ্ট দিতে পছন্দ করে। দুর্ভাগ্যবশত নাদিম তার মোটামুটি প্রিয় মানুষগুলোর দলে আটকা পড়ে গিয়েছে এবং এই বই গিফ্ট হিসেবে নিতে বাধ্য হতে হয়েছে। নাদিম বইটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। বইটা খুলে দুই-এক পাতা উল্টাতেই ভেতর থেকে টুপ করে পড়ে গেল একটা চিরকুট। নীল কাগজে লেখা নীল চিরকুট। নাদিম চিরকুটটা তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। তাতে লেখা,

‘ স্যার, আমি আমার জন্মদিনে বেশ কিছু মজার মজার খেলা খেলি। তারমধ্যে একটি হলো ধাঁধা খেলা। আমি যদি খেলাটা আপনার সাথে খেলতে চাই তাহলে কি আপনি খুব রাগ করবেন?

আপনার সাথে খেলাটা খেলতে চাওয়ার বিশেষ একটা কারণ আছে। এই বিশেষ কারণটা আমি এখনই বলব না। আপনাকে আমি চারটা প্রশ্ন করব। সেই প্রশ্নগুলোর ঠিকঠিক উত্তর দিতে পারলেই সেই বিশেষ কারণটা বলব নয়তো নয়। প্রশ্নগুলো হল,

১. যখন ওকে দেখে হাসি, সে ও হাসে আমাকে দেখে। আমি চোখ মারলে, সে-ও মারে। আবার আমি তাকে চুমু খেলে সে-ও আমায় সমান আগ্রহে চুমু খায়। কে সে বলতে পারেন?

২. এই জিনিসটা আসলে আমার। কিন্তু আমার কাছে ছাড়া তা শুধু তোমার কাছেই থাকতে পারে! কোন জিনিসের কথা বলছি জানেন?

৩. কার্বনের সঙ্গে হাইড্রোজেনের কখনও ঝগড়া হয় না কেন জানেন?

৪. এই জিনিসটির উপর বড়লোকেরা অধিকার স্থাপন করতে চান। জ্ঞানীরা বুঝতে চান। আর গরিব মানুষদের কাছে এটাই সবচেয়ে বড় সম্পদ। কোন জিনিসটির কথা বলছি জানেন?

স্যার, আপনি কি প্রশ্নের উত্তরগুলো ধরে ফেলেছেন? প্রশ্নগুলো লেখার সময় আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি যেন আপনি উত্তরগুলো পেয়ে যান। আমি সেই বিশেষ কারণটা আপনাকে বলতে চাই। আপনি উত্তরগুলো খুঁজে না পেলে সেই বিশেষ কারণটা আমার বলা হবে না।

ইতি
মৌশি ‘

নাদিম গোটা চিঠিটা বেশ কয়েকবার মনোযোগ সহকারে পড়ল। প্রশ্নগুলো খুবই সহজ। প্রশ্নের উত্তরগুলো আরও সহজ। মৌশির সেই রহস্যময় বিশেষ কারণটাও স্পষ্ট। নাদিম দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, এই প্রশ্নের উত্তরগুলো সে মৌশিকে বলবে না। মৌশির বিরক্তিকর বিশেষ কারণটাও সে শুনবে না। কিছুতেই না। নাদিম চিরকুটটা ধুমলে মোচড়ে জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলল। রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল কিশোরী মেয়ের এক দলা অনুভূতি আর স্বপ্ন!

#চলবে….

[ রি-চেইক করা হয়নি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here