নীল চিরকুট লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা ৫৩.

0
1273

নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৫৩.

পূর্বাকাশে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। আকাশটা লালাভ রঙে ঢাকা। জানালার পাশ ঘেঁষে বসে থাকা নম্রতার মনটা ভীষণ খারাপ। শেষ রাতের দিকে অনেকটা সময় নিয়ে ফোনালাপ হয়েছে আরফান- নম্রতার। মন খারাপের শুরুটা সেখান থেকেই। কথায় কথায় আরফানের পরিবার নিয়ে কথা তুলেছিল নম্রতা। সেই কথার প্রেক্ষিতেই নিজের ভাইকে নিয়ে গল্প করছিল আরফান। পরিবারের মধ্যে সব থেকে স্মার্ট দেখতে ছেলে ছিল নেহাল। হৃষ্টপুষ্ট বিশাল শরীর। সর্বদা হাসিখুশি আর দূর্দান্ত বুদ্ধিমান। পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষকে বটগাছের মতো আগলে রাখায় ছিল তার স্বভাব। আরফান-নিদ্রার কাছে সকল সমস্যার একমাত্র সমাধান ছিল ভাই। চমৎকার গান করত নেহাল। তার ব্যবহৃত গিটারটি এখনও খুব প্রিয় স্নিগ্ধার। স্নিগ্ধা নামক মেয়েটিকে প্রচন্ড ভালোবাসত নেহাল। ভার্সিটি থেকে বেস্ট জুটির খেতাপ পেয়ে আসা জুটিটির এনগেজমেন্ট পর্যন্ত হয়েছিল। কিন্তু বিয়েটা হয়ে উঠল না। স্বপ্নের সংসার সাজানোও হলো না। তার আগেই আকস্মিক ঝড়ে উলোটপালোট হলো সব। এতটুকু শুনেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠেছিল নম্রতা। আরফান চুপচাপ কিছুক্ষণ কান্না শুনে ফোন কেটেছে। গত দুই ঘন্টা যাবৎ অযথায় কেঁদে কেটে পৃথিবী ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল নম্রতার। নেহালের জন্য প্রচন্ড খারাপ লাগছিল। নম্রতার মতো নেহালেরও নিশ্চয় অনেক অনেক স্বপ্ন ছিল? অনেক সুখ পাওয়া বাকি ছিল? এমন হাসিখুশি, দূর্দান্ত একজন মানুষকেই কেন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হল? যে মানুষটি এতোগুলি মানুষের হাসি আর ভরসার কারণ ছিল সেই মানুষটিকেই কেন হারিয়ে যেতে হলো? তাছাড়া স্নিগ্ধা নামক মেয়েটিই বা কিভাবে সামলাল? নম্রতা পারত? কথাগুলো ভাবতেই দুনিয়া ভেঙে কান্না আসে নম্রতার। নেহালের জায়গায় আরফানের কথা চিন্তা করলেই ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে তার। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে সিঁদুর রাঙা আকাশ দেখে নম্রতা। ধীরে ধীরে ফুটে উঠা প্রত্যুষ দেখতে দেখতেই জন্ম-মৃত্যু নিয়ে ভাবে নম্রতা৷ হঠাৎ মৃত্যুর কথা মনে পড়তেই কেঁপে উঠে রোম। বেশ কিছুক্ষণ আকাশ-পাতাল চিন্তা করে কাঁপা হাতে আরফানকে ফোন লাগায়। প্রথমবারের চেষ্টায় ফোন উঠায় আরফান। হাসি হাসি কন্ঠে বলে,

‘ সুপ্রভাত মিস.নিম পাতা। কান্না থেমেছে?’

নম্রতা উত্তর দিল না। বেশ কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থেকে বলল,

‘ স্নিগ্ধা আপু এখন কোথায়?’

নম্রতার প্রশ্নে কিছুটা মিইয়ে গেল আরফান। বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

‘ এই টপিক আপাতত থাকুক নম্রতা। বাই এনি চান্স, আপনি কি এখনও কান্নাকাটি করছেন?’

নম্রতা উত্তর দিল না। হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আপনার ডিউটি এখনও শেষ হয়নি?’

‘ শেষ হয়েছে। আমি এখন রাস্তায়। বাড়ি ফিরছি।’

এটুকু বলে থামল আরফান। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে হঠাৎই বলল,

‘ এই মুহূর্তে আপনার যে অনুভূতিটা হচ্ছে ঠিক এমন অনুভূতি বেশ কিছুদিন আগে আমারও হয়েছিল নম্রতা। পার্থক্য হলো, আমি আপনার মতো কেঁদে-কেটে বুক ভাসাতে পারিনি।’

কথাটা বলে হালকা হাসল আরফান। কৌতুক করে বলল,

‘ হারিয়ে ফেলার ভয়েই যে মেয়ে কেঁদে-কেটে নাজেহাল। সেই দুর্বল হৃদয়ের মেয়ে হারিয়ে ফেলেও কি করে এতো স্বাভাবিক থাকল? এতটা বছর?’

‘ স্বাভাবিক থাকলে নিশ্চয় আমাকে পাগল বলে মনে হতো না আপনার। প্রথম প্রথম তো পাগলই বলতেন।’

খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে হয়েছে এমন একটা ভাব নিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলল আরফান,

‘ ও হ্যাঁ। লঞ্চে খুব উইয়ার্ড বিহেভ করেছিলেন সেদিন। অদ্ভুত সব পাগলামো। সেসব পাগলামো এই অধমের জন্য ছিলো?’

শেষ কথাটায় আরফানের কন্ঠে যেন বিস্ময় খেল। নম্রতা অভিমানী কন্ঠে বলল,

‘ শুরু থেকে শেষ, সম্পূর্ণ গল্পটিতে কালপ্রিট আপনি একা। প্রথমে না বলে হাওয়া হলেন। তারপর হুট করে উদয় হয়ে আমার ডায়েরি, আমার চিঠিগুলো জলে ফেলে দিলেন। সেদিন যে আপনি খুন হয়ে যাননি সেই-ই আপনার ভাগ্য।’

নম্রতার কথায় হতভম্ব হয়ে গেল আরফান। বিব্রত কন্ঠে বলল,

‘ ডায়েরিতে আপনার চিঠি ছিল সে তো আমি জানতাম না নম্রতা। আর ইচ্ছে করেও ফেলিনি। আপনি তো আমার ল্যাপটপটাই ফেলে দিলেন। তবুও ইচ্ছেপূর্বক। দোষ আমার একার নয়। আপনিও দোষী। আমার গল্পে কালপ্রিট কিন্তু আগাগোড়া আপনিই। এতো ঝামেলার মাঝে চিঠি লিখলাম। চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম অথচ আপনি খুঁজেই পেলেন না। আমাকে চার চারটা বছর তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে রাখলেন। তারপর হুট করে উদয় হয়ে জীবনটা তামা তামা করে ছেড়ে দিলেন।’

নম্রতা অবাক হয়ে বলল,

‘ আমি আপনার জীবন তামা তামা করে ফেলেছি?’

আরফান নিঃসংকোচে বলল,

‘ তা করেছেন। প্রচন্ড বিরক্ত ছিলাম আমি আপনার ওপর। এমনিতেই প্রেয়শী হারিয়ে দেবদাস তারওপর আপনার কার্যকলাপগুলো অসহ্য লাগছিল। আপনিই সেই প্রেয়শী, এমনটা জানলে অবশ্য বিরক্ত হতাম না বরং ইঞ্জয় করতাম। কিন্তু তখন আমি আপনাকে কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি।’

নম্রতা হেসে বলল,

‘ আমার জন্যও সাডেন শক ছিলেন আপনি। আমি তো নিষাদ ভাইয়াকে সন্দেহ করেছিলাম। তখন আমার ভাবনা ছিল, আপনি আর সে? ইয়াককক!’

আরফান হতভম্ব কন্ঠে বলল,

‘ ইয়াক! এমনটা কেন?’

নম্রতা খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,

‘ সরি টু ছে, তখন আপনাকে ইয়াক-ই লাগত আমার। একদম বিশ্রী। নাদিম তো আপনার বিশেষ একটা নামও দিয়েছিল। ওর নাম অনুযায়ী বন্ধুমহলে সবাই আপনাকে ‘ধাক্কা আরফান’ বলে সম্বোধন করত। এখন অবশ্য বলে না… ‘

নম্রতাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই হতবিহ্বল কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল আরফান,

‘ হোয়াট!’

নম্রতা আবারও খিলখিল করে হেসে উঠল।

_

সকাল আটটা। চোখে চশমা চড়িয়ে খাবার টেবিলে এলো ছোঁয়া। চোখদুটো হালকা ফুলে থাকলেও, মনটা বেশ ফুরফুরে তার। কাল সারারাত জেগে থেকে সূর্য উঠার পর ঘুমোতে গিয়েছে ছোঁয়া। ছাঁদে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখেছে। তিনদিন যাবৎ শেষ করতে না পারা বইটির ইতিও টেনেছে। ছোঁয়াকে চেয়ার টেনে বসতে দেখেই প্লেটে খাবার তুলে দিলেন সিঁথি হক। প্লেট ভর্তি পোলাও, মাংস দেখে ভ্রু কুঁচকাল ছোঁয়া। সিঁথি হক গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

‘ বিয়ের কিছুদিন তোমার খাওয়া-দাওয়ায় নিয়ে কোনো রেস্ট্রিকশন থাকবে না মামুনি। তুমি ব্রেডের জায়গায় পোলাও, মাংস খেতে পারো।’

ছোঁয়া বিরক্ত চোখে তাকাল। ছোট থেকে ব্রেকফাস্টে ব্রেড, ফ্রুটস খেয়েই অভ্যস্ত ছোঁয়া। সকালে ভারী খাবার মানেই আস্ত ঝামেলা। ছোঁয়া বুঝতে পারে না, হুট করে খাবারের ম্যনু চেঞ্জ করার মানে কি? এটা কোন ধরনের স্বাধীনতা? মাম্মা কী স্বাধীনতার সজ্ঞা জানে না? ছোঁয়ার ভাবনার মাঝেই আবারও কথা বলেন সিঁথি হক,

‘ সাইম আর তোমার বড় খালামনি প্রায় সব ধরনের কাগজপত্র রেডি করে ফেলেছেন। বিয়ের এক মাসের মাঝেই অস্ট্রেলিয়াতে শিফট হতে পারবে তুমি। আর স্কলারশিপের ব্যাপারটাও ম্যানেজ করে নিয়েছে তোমার বাবা। বাদ বাকি সাইম তো আছেই। ওখানে গিয়ে পড়াশোনায় একদম ঢিলেমি করবে না মামুনি। তোমার লো-ক্লাস ফ্রেন্ডরা বাইরের দেশে গিয়ে পড়াশোনা করছে আর তুমি হাত গুটিয়ে বসে আছ? প্রুফ ইউরসেল্ফ মামুনি। ইউ হ্যাভ টু বি বেস্ট। ‘

ছোঁয়া উত্তর দিল না। মাম্মার কথা তার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাল বলেও মনে হলো না। মনে মনে বিয়ে নামক বিষয়টা নিয়ে ভাবছে ছোঁয়া। আর যায় হোক, বিয়ের মাধ্যমে এই একঘেয়ে জীবন থেকে তো ছাড়া পাবে ছোঁয়া। কারো কথা অনুযায়ী নয় নিজের বিবেচনা দিয়ে একটুখানি হাত-পা ছড়িয়ে শুবে। তার গায়ে থাকবে নিজের পছন্দের জামা। নিজের পছন্দের খাবারে ভরে থাকবে খাবার টেবিল। বন্ধুদের সাথে ইচ্ছেমতো সময় কাটাবে। কথাগুলো ভাবতেই বুকের ভেতর অদ্ভুত এক আনন্দ হয় ছোঁয়ার। পরমুহূর্তেই বিভ্রান্তিকর এক প্রশ্ন বলের মতো ঢপ খেলতে থাকে তার মস্তিষ্কে, আদৌ কি নিজের কোনো পছন্দ গড়ে উঠেছে ছোঁয়ার? শক্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে তার? বিয়ের পর বন্ধুগুলোকে আগের মতো করে আদৌ পাওয়া হবে তার? ছোঁয়ার হাত থেমে যায়। অনেক ভেবেও উত্তরের ঘরে ভেসে উঠে শুধুই শূন্য নামক অঙ্ক।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here