#নীল চিরকুট #লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা ২৩.

0
1389

#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

২৩.

হতভম্ব আরফান হঠাৎ-ই কোনো কথা খুঁজে পেলো না। আপন শক্তিতে আলাদা হয়ে গেল তার ওষ্ঠদ্বয়।। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। নম্রতার হঠাৎ আগমন,কিছু ঝাঁঝালো কথা আর সেই চির পরিচিত পায়েলের অর্থোদ্বার করে উঠার আগেই জায়গা ত্যাগ করল নম্রতা। টালমাটাল চালে এগিয়ে যাওয়া রমণীর পায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল আরফান। চোখের পলক পড়ছে না। নম্রতা করিডোরের বাঁকে হারিয়ে যেতেই ঘোর কাটলো আরফানের। ডান হাতের উল্টো পাশ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো সে। শার্টের উপরের বোতাম দুটো খুলে বার দুয়েক ঢোক গিলল। কণ্ঠনালী শুকিয়ে আসছে। অস্থির লাগছে। প্রচন্ড অস্থিরতায় দরফর করছে শরীর।

কালো বিশাল আকাশটিতে তারার মেলা বসেছে আজ। সারাদিনব্যাপী বর্ষনের পর ঝকঝক করছে আকাশ। চারদিকের মৃদুমন্দ বাতাসে শীত শীত লাগছে নীরার। ওড়নাটা গায়ের উপর আরো একটু টেনে দিয়ে চারপাশে তাকাল নীরা। থমথমে , নীরব রাস্তায় কোথাও নম্রতার টিকিটুকুর সন্ধান নেই। নম্রতার দেরী হচ্ছে দেখে নিজেকে আর ঘরে ধরে রাখতে পারেনি নীরা। এই অসময়ে বেরিয়ে এসেছে রাস্তায়। নম্রতাকে ফোনে না পেয়ে রঞ্জন আর নাদিমকেও ইনফর্ম করেছে। দশ-পনেরো মিনিটের মাথায় ল্যাম্পপোস্টের ফিঁকে আলোর নিচে রঞ্জনকে চোখে পড়ল নীরার। টুংটাং শব্দ তুলে ছুটে চলা রিকশার উপর বসে আছে রঞ্জন। পাশে ভুবনমোহিনী পূঁজা। সাদা আর নীলের মিশেলে শাড়ি পড়েছে পূজা। বড় বড় চোখদুটো গাঢ়ে কাজলে রাঙা। নীরার ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল রিকশা। রিকশাটা ছেঁড়ে দিয়ে নীরার দিকে তাকাল রঞ্জন। ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ বের হতে মানা করেছিলাম না? শুধু শুধু বেরিয়েছিস কেন? সাড়ে আটটা বাজে প্রায়। হলে ঢুকতে দেবে এখন?’

কথাটুকু বলে নীরার উত্তরের জন্য মিনিট খানেক অপেক্ষা করল রঞ্জন। এরইমধ্যে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে দ্রুত পায়ে হেঁটে আসতে দেখা গেল লম্বাটে এক তরুণ। পরনে থ্রী কোয়াটার প্যান্ট, কাঁধে গিটার। ফ্যাকাশে বাদামি চুলগুলো বাতাসে মুক্ত। নীরাদের দেখতে পেয়ে আরও দ্রুত পায়ে পথটুকু অতিক্রম করল ছেলেটি। ওদের কাছাকাছি দাঁড়িয়েই ধমকে উঠে বলল,

‘ তোগো কী আর কোনো কাম-কাজ নাই? শালার রাইতেও শান্তি দিবি না। ওই হারামি মরছেডা কই? রাত-বিরেতে মাইয়া মানুষের এতো টগরবগর থাকব ক্যান? থাপড়াইয়া ঠিক করা উচিত বেয়াদব।’

নীরা, রঞ্জন নীরব দৃষ্টিতে নাদিমের দিকে তাকিয়ে রইল। নাদিম বিশাল বিরক্তি নিয়ে পাশে থাকা ল্যাম্পপোস্টে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। অসচেতনতায় পূজার দিকে দৃষ্টি পড়তেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। এক গাল হেসে বলল,

‘ আসসালামু আলাইকুম থুক্কু আদাব। আদাব বৌদি। এই গর্দভ এই রাতের বেলাও আপনাকে বগল দাবা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে নাকি? বন্ধুকে তো একদম মজনু বানিয়ে দিয়েছেন বৌদি। রাতে ঘুমালেও বৌদি বৌদি থুক্কু পূজা পূজা করে।’

নাদিমের কথায় হেসে ফেলল পূজা। রঞ্জন ঘাড়ের কাছে একটা কিল বসিয়ে বলল,

‘ ডাহা মিথ্যা কথা! তোর আজাইরা প্যাঁচাল বন্ধ করে নম্রতাকে খোঁজ। নম্রতাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

নাদিম নিরুদ্বেগ কন্ঠে বলল,

‘ মইরা গেছে হয়তো। পাশেই মেডিক্যাল। আয় মর্গে চেইক মাইরা আসি গা।’

নীরা রাগী দৃষ্টিতে তাকাল। শাসিয়ে বলল,

‘ একদম ফাজলামো করবি না। ব্যাপারটা সিরিয়াস। ফোনে কিসব উলোটপালোট কথা বলছিল। মাথা ঘুরছে, শরীর খারাপ করছে হেনতেন।’

নীরার কথায় কানের পাশে চুলকাতে চুলকাতে মুখভঙ্গি গম্ভীর করল নাদিম। ঠিক তখনই পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠল। নাদিম মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তি নিয়ে ফোন বের করল। স্ক্রিনে ছোঁয়ার নামটা দেখেই চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল সে। ভ্রু-কপাল কুঁচকে বলল,

‘ এই বালডা ফোন দেয় ক্যান আবার?এক্সট্রা মাথাব্যথা একটা।’

কথাগুলো বলতে বলতেই ফোন রিসিভ করল নাদিম। প্রথম বাক্যেই ধমকে উঠে বলল,

‘ ওই হারামি! তোর ফোনে আর কারো নাম্বার নাই? আমারে ফোন দেস ক্যান? শুদ্ধ ভাষা শিখাইতে ফোন দেস? তোর বা..’

ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠল ছোঁয়া,

‘ খবরদার শব্দটা উচ্চারণ করবি না নাদিম। ছিঃ! তোর এসব থার্ডক্লাস কথাবার্তায় বমি পায় আমার। একটা স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা সত্ত্বেও নর্দমার মতো বিহেভিয়ার তোর। মাম্মা তো স্বাদে বলে না যে, নাদিম নামের ছেলে থেকে দূরে থাক। দেয়ার ইজ আ স্ট্রং রিজন।’

নাদিম জ্বলে উঠে বলল,

‘ ওই ইংরেজের ঘরের ইংরেজ। তোরে কইছি আমার লগে মিশতে? শালের জীবনডারে ফ্যানা ফ্যানা বানাই হাল দিলি।’

ছোঁয়া বুঝতে না পেরে বলল,

‘ হোয়াট ইজ ‘ফ্যানা ফ্যানা’? আর ‘হাল’ দেয় কিভাবে?’

নাদিম চূড়ান্ত বিস্মিত। রঞ্জনের দিকে তাকিয়ে অভিযোগের স্বরে বলল,

‘ এই শালী তো বাংলা বুঝে না রে মামা। এই তুই বাংলাদেশতে বাইর হ। এই মুহূর্তে বাইর হ। ব্রিটিশের বংশদূত। বাংলা বুঝস না আবার ভাষা শিখাস!’

ছোঁয়া যেন বেকুব বনে গেল। অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ ওগুলো বাংলা ছিল? তাহলে আমি কখনও শুনিনি কেন?’

‘ তুই ইংরেজের জাত এইজন্য। ফারদার তুই যদি আমারে ফোন দিয়া মাথা খাস। কসম ছোঁয়াইয়া, তোরে আমি মার্ডার কইরালামু।’

এদের দুজনের ঝগড়ায় চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে ফোনটা ছিনিয়ে নিল রঞ্জন। ছোঁয়াকে ফোন দেওয়ার কারণ জিগ্যেস করতেই জানা গেল, সে নম্রতার বর্তমান পরিস্থিতি জানার জন্য কল করেছে। কিন্তু নাদিম তাকে বাজেভাবে ডিস্ট্রেক্ট করে দিয়েছে। নাদিমের মতো বেয়াদব ছেলে এই দুনিয়াতে হয় না। ওর মতো একটা বন্ধু পেয়ে ছোঁয়ার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। বাংলা ভাষার এমন বাজে পরিণতির জন্য নাদিমকে পুলিশ দেওয়া উচিত। রঞ্জন বেশ মনোযোগ দিয়ে ছোঁয়ার কথা শুনলো। টুকটাক প্রয়োজনীয় কথা বলে ফোন ছাঁড়ল। নাদিমের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই পাঁচমিশালি চরিত্রের বন্ধু পেয়ে বেচারার জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। আড়চোখে পূজার দিকে তাকাতেই দেখল পূজা হাসছে। ঠোঁট টিপে বিচিত্র ভঙ্গিমার সেই হাসিতেই মাথা পাগল হয়ে যায় তার। ইশ! মেয়েটা এতো স্নিগ্ধ কেন? নাদিমদের কথাবার্তার মাঝপথেই একটা রিক্সা এসে থামল তাদের পাশে। রিক্সা থেকে নেমে বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল সেই তরুণী,

‘ তোরা সব এখানে কী করছিস?’

নম্রতাকে সুস্থ-সবল দেখে গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল ওরা। নীরবতা ভেঙে নাদিমই কথা বলল প্রথম,

‘ তুই একলাই আইসা পড়ছস? আমরা আরও মর্গে থাইকা আনতে যাইতাছিলাম তোরে। লাশ আনতে যে গাড়িবাড়ি লাগব সেই ভাড়ার জন্য চান্দা তুলতাছিলাম। তোর তো মামা ধৈর্য্য এক্কেবারে কম!’

নম্রতা হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাল। কিছু বুঝতে না পেরে বলল,

‘ মানে?’

‘ ওর কথা বাদ দে তো। কোথায় ছিলি এতোক্ষণ? ফোন দিচ্ছি ফোনটা পর্যন্ত তুলছিস না। ঠিক আছিস?’

নীরার কথার মাঝেই মাথায় শক্ত চাটি মারল নাদিম। নীরা শক্ত চোখে তাকাতেই চোখ পাকিয়ে তাকাল নাদিম। রঞ্জন দুষ্টুমি করে বলল,

‘ তোমার চিন্তায় তো ঠিকঠাক প্রেমটাও করতে পারলাম না কলিজা। বারবার আমার প্রেমে এমন বজ্রপাত ঘটালে কিন্তু তোমাকে ইন্সট্যান্ট ডিভোর্স দিয়ে দেব কলিজা।’

নম্রতা হেসে ফেলল। রঞ্জনের বাহুতে চড় বসিয়ে বলল,

‘ হারামি!’

নাদিম বাঁকা হেসে বলল,

‘ কলিজা! ভাই তোর কয়ডা লাগে? এইডা কলিজা হইলে ওই পাশেরটা কি? ফুসফুস? ‘

‘ উহু। এইটা জান।’

রঞ্জনের কথার ধরনে আবারও হেসে ফেলল সবাই। নীরা কৃত্রিম মন খারাপ নিয়ে বলল,

‘ আহা! আজকে কারো জান, কলিজা হতে পারলাম না বলে!’

নাদিম তৎক্ষনাৎ মাথায় চাটি মেরে বলল,

‘ তোর কয়ডা লাগে রে বেয়াদব মহিলা? ওই ব্যাংকারের হাত, পাও, কিডনি, ফ্যাঁপড়া, ফুসফুস হয়েও তোর শান্তি নাই? আবার জান, কলিজা হইতে মন চায়?’

নাদিমের কথায় মুখ ভেঙাল নীরা। পূজা খিলখিল করে হেসে উঠল। প্রত্যেকের জীবনের চাপা কষ্টগুলো মুহূর্তেই যেন শূন্যে উড়াল দিল।

ঘড়িতে মধ্যরাতের ঘন্টা বাজছে। নীরা-নম্রতা কারো চোখেই ঘুম নেই। নীরা দুটো চায়ের কাপ এনে বিছানায় পা তুলে বসল। নম্রতার দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে বেশ ফুরফুরে কন্ঠে বলল,

‘ এখন বল তো কই ছিলি? কারো প্রেমে মজেছিলি নাকি, হুম?’

নীরা ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হাসল। নম্রতা অনুভূতিশূন্য চোখে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে খুবই সাধারণভাবে বলল,

‘ খুঁজে পেয়েছি।’

নীরা বুঝতে না পেরে বলল,

‘ কী খুঁজে পেয়েছিস?’

নম্রতার ভাবলেশহীন উত্তর,

‘ যাকে খুঁজে পেলে মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার কথা ছিল, তাকে খুঁজে পেয়েছি।’

নম্রতার কথাটা বুঝতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিল নীরা। বুঝে উঠার সাথে সাথেই চোখ বড় বড় করে বলল,

‘ তুই কি কোনোভাবে তোর পত্রপ্রেমিকের কথা বলছিস নমু?’

নম্রতা শুকনো হাসল। উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠল নীরা। চায়ের কাপটা রেখে দুই হাতে মুখ চেপে ধরে বলল,

‘ কিভাবে সম্ভব? হাও ম্যান হাও? আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। দেখেছিস তাকে? দেখা হয়েছে? কিভাবে কি হলো? কি কথা বললি? সব বল আমায়। ও মাই গড! আমি আর চিন্তা করতে পারছি না।’

নীরাকে এতো উত্তেজিত হতে দেখে হাসল নম্রতা। মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ তুইও চিনিস। দেখেছিসও।’

নীরার চোখ এবার কুটোর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। বিছানায় আবারও ধপ করে বসে পড়ল সে। কৌতূহল নিয়ে বলল,

‘ আমি চিনি? বলছিস কী? পরিচিত কেউ?’

নম্রতা ফোনটা উল্টে নীরার মুখের সামনে ধরল। নীরা চোখ ছোট ছোট করে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। আরফান আলম নামের একটি আইডি থেকে কন্টিনিউয়াসলি ম্যাসেজ আসছে ফোনে। নীরা মুখটা আরেকটু এগিয়ে নিল। দেখতে দেখতেই আরও তিন চারটে ম্যাসেজে এসে জমা হল ইনবক্সে। নীরা জোরে জোরে পড়ার চেষ্টা করল,

‘ মিস. নম্রতা, আই ওয়ান্ট টু টক টু ইউ। প্লিজ! একটু বোঝার চেষ্টা করুন। এটা আমার জীবন-মরণ প্রশ্ন। ম্যাসেজের রিপ্লাই তো দিন এটলিস্ট। প্লিজ, নম্রতা। আই বেগ ইউ, প্লিজ।’

ম্যাসেজটা পড়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল নীরার। কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে থেকে বলল,

‘ দোস্ত! তুই প্লিজ এটা বলিস না যে ডক্টর আরফানই..’

নম্রতার নির্বিকার চাহনি দেখে যেন দুনিয়া ঘুরে গেল নীরার। ভাবনাতীত বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ কেমনে সম্ভব? আমার একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না। কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে না তো?’

নম্রতা জবাব দেওয়ার আগেই আবারও প্রশ্ন করল নীরা,

‘ এক্সাইটমেন্টে হাত-পা কাঁপছে আমার। কিভাবে সম্ভব! আচ্ছা? ডক্টর জানে ব্যাপারটা?’

নম্রতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আমি কিছু বলিনি। তবে সন্দেহ অবশ্যই করেছে। আর সন্দেহ জেগেছে বলেই একের পর এক ম্যাসেজে পাগল করে দিচ্ছে।’

‘ ও মাই গড! দোস্ত? তোর কেমন ফিলিংস হচ্ছে রে? লজ্জা লাগছে? আমার তো ভাবতেই কেমন কেমন লাগছে। জাস্ট চিন্তা কর? এই ডাক্তারের জন্য তোকে বাসর ঘরে একহাত গোমটা দিয়ে বসে থাকতে হবে। যে ডাক্তারকে তুই দুই চোখে দেখতে পারিস না তাকে প্রেমিক হিসেবে মানতে হবে। এই ব্যাটারে তুই প্রেমময় গদ্য লিখেছিস, ভাবা যায়? এই তোরা বাসর ঘরের আলাপচারিতাও সেড়ে নিয়েছিলি নাকি চিঠিতে? আস্তাগফিরুল্লাহ! অস্বস্তি লাগছে না?’

নম্রতা কপাল কুঁচকে তাকাল,

‘ তোর চিন্তা এতো দ্রুত দৌঁড়ায় ক্যান? ডিরেক্ট বাসর ঘরে ঢুকে গেলি? এতো সোজা? এই ডাক্তারকে এতো সহজে ছাড়ব নাকি আমি? আমাকে চারটা বছর যে জ্বালানো জ্বালিয়েছে তার ডাবল জ্বালাব আমি।’

নীরা উৎসাহ নিয়ে বলল,

‘ কী করবি? চেম্বারে গিয়ে সুযোগ নিবি? ফ্রীতে চিকিৎসা নেওয়া যাবে, আহা!’

নম্রতা কটমট করে তাকাল। চোখ পাকিয়ে বলল,

‘ তোর মাথা।’

নীরা মুখ গোমড়া করে বলল,

‘ তাহলে? কি করবি তুই?’

‘ কিছুই করব না। এই কিছুই না করাটাই তার জন্য হবে অনেক কিছু। আচ্ছা? একটা বিয়ে করে ফেললে কেমন হয় নীরা? সেই বিয়ের ভিডিও তাকে গিফ্ট হিসেবে পাঠাব। দেখাব, তার প্রতারণায় আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি ভালো আছি। এবং হেসে খেলে সংসার করছি।’

কথাগুলো বলতে বলতেই নীরব হয়ে গেলো নম্রতা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ-ই ফু্ঁপিয়ে উঠল। দু’হাতে মুখ চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,

‘ আই হেইট হিম নীরু। আই জাস্ট হেইট হিম।’

নীরা অসহায় চোখে চেয়ে রইল এই অসম্ভব দুঃখী মেয়েটির দিকে। চেয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ উপলব্ধি করল, এই কান্নায় দুঃখ নেই। এই কান্না ভরা প্রাপ্তির সুবাস। নম্রতার কাঁধে একটা হাত রেখে খানিকটা এগিয়ে এসে বসল নীরা। নরম কন্ঠে বলল,

‘ ধুর পাগলী! কাঁদছিস কেন বল তো? তোর মতো ধৈর্য্যশীল মেয়ে এমন ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে নাকি?’

নম্রতা জলমাখা চোখ তুলে তাকাল। বোকা বোকা কন্ঠে বলল,

‘ আমার নিজেরও ভীষণ অস্বস্তি লাগছে রে। আমি ডক্টর আরফানকে… ‘

নম্রতার কথার মাঝেই ফোন বাজল নীরার। ফোনটা তুলতেই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠল নাদিম,

‘ অন্তুকে একটা ফোন লাগা তো নীরু।’

কোনো ভূমিকাহীন এই কথায় অবাক হলো নীরা। বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ কেন? এতোরাতে ওকে ফোন দিব কেন হঠাৎ ?’

নাদিম বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ আমার ফোনে টাকা নাই তো তাই তুই ফোন দিয়ে জিগ্যেস করবি টয়লেট হচ্ছে নাকি ঠিকঠাক?’

‘ মানে?’

নাদিমের বিরক্তি এবার আকাশ ছুঁলো। ধমকা ধমকির এক পর্যায়ে বলল,

‘ তুই হইলি দুনিয়ার বেকুব। ফোন লাগা ওরে। ওর মায়ে কাইন্দা কাইটা ফিট মারতাছে। বাসায় যায় নাই সারাদিন। রাত একটা বাজে এখনও কোনো খোঁজ খবর নাই। কারো ফোন ধরতাছে না। এখন নিশ্চয় বুঝাই দেওয়া লাগব না যে কেন ফোন দিতে কইতাছি?’

নীরা প্রথম দফায় আঁতকে উঠলেও খুব দ্রুত সামলে নিল। শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ আমি ফোন দিতে পারব না।’

নাদিমের মেজাজ চটে যাচ্ছে। রাগ গমগমে কন্ঠে বলল,

‘ কেন পারবি না?’

‘ যেখানে তোদের কারো ফোন তুলছে না সেখানে আমার ফোন কেন তুলবে ও। তাছাড়া আমি চাইছি না… ‘

নাদিমের কন্ঠে বিস্ফোরণ ঘটল এবার। চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘ কি চাইছিস না তুই? শুনি কি চাইছিস না? তুই চাস পোলাডা মইরা যাক? তিনদিন পর পরীক্ষা আর আমরা এখানে পড়াশোনা বাদ দিয়া তোগোর রঙলীলা দেখতে বইসা আছি। শালার…. ‘

নাদিম কথাটা শেষ না করেই ফোন কাটল। নীরা ফোনটা কানে নিয়েই স্থির বসে রইল। বুকের ভেতর উথলে উঠা কান্নাটা বুকের কাছেই থেমে গেল। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে নম্রতার দিকে তাকাল। কান্না আর কষ্টটুকু চেপে প্রশ্ন করল,

‘ অন্তু আমাকে ভালোবাসে। এটা আমার দোষ? আমি বলেছিলাম ভালোবাসতে?’

নীরার কঠিন কথাগুলো শুনে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল নম্রতা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চমকে উঠে ভাবল, নীরা কী সত্যিই অন্তুকে ভালোবাসে না? একটুও না? নাকি সবই নাটক বা বাহানা?

রাতের শেষ প্রহর। আকাশের কোণে ফ্যাঁকাশে আলোর স্ফূরণ। সদ্য ফর্সা হয়ে আসা আকাশটাতে দুই একটা পাখির পদচারণ। চারপাশে শিরশিরে ঠান্ডা বাতাস। এই নিস্তব্ধ রাতের শেষ প্রহরে ভূতগ্রস্তের মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে পাতলা টি-শার্ট পরিহিতা সুঠাম দেহী যুবক। মাথার চুলগুলো বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে। চোখের কোণে নির্ঘুম রাতের ছাপ। ডান হাতের মুঠোয় ফোন। হাতে থাকা ফোনটার দিকে শেষ বারের মতো তাকিয়েই রাগে-বিরক্তিতে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল আরফান। সবসময় পরিপাটি থাকা ঘরটি আজ অগোছালো। এখানে সেখানে পড়ে আছে বই, ফুলের ঝাঁড়। বুকের অস্থিরতাটা যেন ছড়িয়ে আছে ঘরজুড়ে। আরও কিছুক্ষণ বারান্দার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের ভেতরের দিকে সরে এলো আরফান। শেভিং রেজারের ওপর নগ্ন পাটা পড়তেই চোখ-মুখ কুঁচকে গেল তার। অবিন্যস্ত ঘরটির দিকে চোখ রেখেই রেজারটা খুলে ছুঁড়ে ফেলল দূরে। কেঁটে যাওয়া পা নিয়েই ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিল বিছানায়৷ পায়ে নয় বুকে জ্বালাপোড়া করছে খুব। ডান হাতটা কপালের ওপর রেখে চোখ বোজল। সাথে সাথেই ডান চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা জল৷ বহু বছর পর। হ্যাঁ, বহু বছর পর আবারও গড়াল এই জল!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here