নীল চিরকুট লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা ৩৯.

0
1403

নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৩৯.

বাইকের ছোট্ট আয়নার উপর ঝুঁকে পড়ে চুল ঠিক করছিল নাদিম। ভ্রু দুটো কুঞ্চকে আছে অজানা কোনো বিরক্তিতে। আয়না থেকে চোখ সরিয়ে মুখটা তেঁতো করে রঞ্জনের দিকে তাকাল নাদিম।

‘ এই গরমের মধ্যে এইসব সং-ঢং পিন্দার কোনো মানে আছে? টি-শার্ট পিইন্দা বিয়াতে গেলে সমস্যাটা কী মামা? বেহুদা এইসব বা*- ছা* পরাইলি। বিরক্ত লাগতাছে।’

রঞ্জন ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বাইকের চাবিটা উপরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে লুফে নিতে নিতে বলল,

‘ পাঞ্জাবিতে তোকে বন মানুষ থেকে মানুষ লাগছে। ধীরে ধীরে মানুষ হওয়ার চেষ্টা কর। বিয়েতে কত শত মেয়ে থাকবে। ডোন্ট ফরগেট, ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্যা বেস্ট ইম্প্রেশন দোস্ত।’

নাদিম পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘ ছাতার ইম্প্রেশন।’

রঞ্জন হাসল। হাসিটা তাকে মানালও খুব। নাদিম হাতের ঘড়ির দিকে এক পলক তাকিয়েই তাড়া দিল,

‘ বৌদি কখন আসবে? দশটা তো বাজতে চলল। এই গরমে খাড়াই থাকতে ভাল্লাগতাছে না আর।’

রঞ্জন চিন্তিত মুখে ফোনে সময় দেখল। পূজাকে আজ সাথে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সে। কাল সন্ধ্যায় ফ্লাইট। বিদেশের মাটিতে আত্মাহুতি দেওয়ার আগে আজকেই তার শেষ দিন। এই দিনে মেয়েটাকে সময় দিতে না পারলে রঞ্জনের নিজেরই বড় অস্থির লাগবে। ফাঁকা ফাঁকা লাগবে।রঞ্জন রাস্তার দিকে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল,

‘ বলল তো বেরিয়েছে। আমি পিক করতে চাইলাম। নিষেধ করে বলল প্রায় চলে এসেছে।’

‘ নমু-ছোঁয়াও কি অন্তুদের বাসাতেই যাবে নাকি? আমরা সব বরযাত্রী?’

রঞ্জন হেসে বলল,

‘ নমু-ছোঁয়া কনেপক্ষ। ওরা ডিরেক্ট রূপগঞ্জ যাবে। আজ ওরা আমাদের বেয়াইন। বেয়াইন বলে না ওটাকে?’

নাদিম জবাব না দিয়ে হাসল। রঞ্জন কৌতুক করে বলল,

‘ আজ বান্ধবী টান্ধবী বাদ। অনলি বেয়াই-বেয়াইন সম্পর্ক। প্রচুর ফ্লার্টিং চলবে।’

নাদিম দাঁত বের করে হাসল। ফিচেল কন্ঠে বলল,

‘ নমুকে তো চিনো না মামা। একবার যদি বুঝে তুমি তার প্রতিপক্ষ তাহলে বিশ্বাস কর, তোর কলিজা তোর কলিজা বের করে ছেড়ে দিবে। আর জান বের করার জন্য সাথে তোর জানপাখি তো আছেই।’

রঞ্জন প্রত্যুত্তর করার আগেই হঠাৎ বলে উঠল নাদিম,

‘ আরেহ! ফোনটা তো রুমেই ফেলে আসছি দোস্ত। সকালে চার্জে দিয়ে আর খুলতে মনে নাই। তুই থাক। আমি আনতাছি।’

রঞ্জনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হলের দিকে ছুটে গেল নাদিম। পাঁচ দশ মিনিটের মাঝে ফিরে এসে দেখল পূজা এসে পৌঁছেছে। রঞ্জনের সাথে মিলিয়ে খয়েরী জামদানী শাড়ি তার গাঁয়ে। দুজনকে পাশাপাশি হাস্যোজ্জল মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনের গুমোট ভাবটা খানিক কেটে গেল নাদিমের। বুকের ভেতর চাপা আনন্দ নিয়ে ওদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। রঞ্জন রওনা দেওয়ার জন্য তাড়া দিতেই নাদিম হালকা অস্বস্তি নিয়ে বলল,

‘ সরি দোস্ত! আমি যেতে পারছি না। বড় মামা ফোন দিয়েছিল একটু আগে। আমাকে একটু মামার বাড়ি দর্শন দিয়ে আসতে হবে। আর্জেন্ট।’

রঞ্জন অবাক চোখে তাকাল। নাদিমের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে হাতেগুণা কয়েকটা কথা ছাড়া কিচ্ছু জানে না তারা। নাদিমের যে কোনো মামা আছে তা এই জীবনে আজই প্রথম শুনছে বলে তার ধারণা। রঞ্জন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

‘ মামার বাড়িই তো। কাল যাস। বিয়েতে না গেলেও এটলিস্ট অন্তুর সাথে সাক্ষাৎটা করে যা।’

নাদিম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রসন্ন হাসি হেসে বলল,

‘ আরে ধূর! বিয়া তো আমাগো নীরুরেই করতাছে। অত সাক্ষাৎ টাক্ষাৎ করা লাগব না। প্রায় দশটা বাজে, সাড়ে এগারোটায় ট্রেন ধরব। স্টেশনে পরিচিত লোক আছে, টিকেট হয়ে যাবে।’

রঞ্জন হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ এমন কী দরকার যে আজকের দিনটা ম্যানেজ করতে পারবি না তুই? বাই এনি চান্স, তুই অন্তুর উপর রেগে আছিস বলে….’

রঞ্জনকে কথা শেষ করতে না দিয়েই পাত্তাহীন কন্ঠে বলল নাদিম,

‘ আরে ধূর! রাগের কী? ওই ছোট্ট একটা ইস্যু নিয়ে বসে থাকার কোনো মানে আছে? মামা আজ প্রায় সাড়ে চার বছর পর তলব করেছে আমায়। ব্যাটার কাহিনীটা তো এবার দেখতেই হয়!’

এটুকু বলে থামল নাদিম। রঞ্জনের দিকে চেয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ যেতেই হবে দোস্ত।’

কথাগুলো বলতে বলতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো নাদিমের। রঞ্জন অবাক চোখে চেয়ে থেকেই বিদায় দিল নাদিমকে। নাদিম রাস্তার বাঁকে হারিয়ে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল রঞ্জন। নাদিম আর অন্তুর মাঝে ঘটে যাওয়া ঝামেলাটা নতুন কিছু নয়। এর থেকেও বড় বড় ঝামেলা হয়েছে তাদের। ইচ্ছেমতো মারপিট করে ঘন্টা ঘুরতেই এক সঙ্গে সিগারেট ধরিয়েছে। হেসেছে। ফাজলামো করেছে। দূরত্ব অভিমান বাড়ায়। অভিমান থেকে জন্মায় ক্ষোভ। ক্ষোভ থেকে অহং। তারপর ধীরে ধীরে তৈরি হয় ধারালো এক ফলা। সেই ফলাতেই ক্ষতবিক্ষত হয় সুন্দর কিছু সম্পর্ক। ঝামেলাটা হওয়ার পর অন্তু আর নাদিম যদি একটাবার সামনা-সামনি দাঁড়াত তবেই সমাপ্ত হতো এই স্নায়ু যুদ্ধ। উবে যেত এই মান-অভিমানের খেলা। রঞ্জনও তাই চাইছিল কিন্তু…. রঞ্জন আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছুই ভালো লাগছে না তার। মনের মাঝে তীক্ষ্ণ একটা কাটা নিয়েই দেশ ছাড়তে হচ্ছে তাকে। মনে সূক্ষ্ম এক ভয়, সব আগের মতোই থাকবে তো?

_

অন্তুর মেজাজ খারাপ। তার এই মেজাজ খারাপ ভাবটা সময়ের সাথে সাথে তরতর করে বাড়ছে। আশেপাশের মানুষগুলোকে অযথায় ধমকাতে ইচ্ছে করছে। দুই একটা চড় থাপড়াও দিতে ইচ্ছে করছে। বিছানার উপর রাখা সাদা শেরওয়ানির দিকে তাকিয়ে থেকে ভ্রু কুঁচকাল অন্তু। সাধারণ ঘরোয়া বিয়েতে এমন ভারী শেরওয়ানি পরার কোনো মানে হয়? অন্তু কোমরে হাত রেখে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। পায়ের কাছে থাকা জুতোটা লাথি দিয়ে সরিয়ে চেঁচিয়ে অয়নকে ডাকল। অয়ন সেজেগুজে বাবু হয়ে এদিক-সেদিক ঘুরছিল। সমবয়সী কাজিনদের মধ্যে আজ তার কদরই বেশি। মেজাজটাও ফুরফুরে। ভাইয়ের এমন রাগান্বিত চিৎকারে মুখটা চুপসে গেল তার। ঘরের মাঝে উঁকি দিয়ে দ্বিধা নিয়ে বলল,

‘ ভাইয়া ডেকেছ?’

অন্তু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ আমার ফোন কোথায়?’

অয়ন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। ভাইয়ের রক্তচক্ষুতে আরও একটু গুটিয়ে গিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ আমি জানি না ভাইয়া।’

অন্তু ধমকে উঠে বলল,

‘ একদম মিথ্যা বলবি না। তোকে পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। এই পাঁচ মিনিটে ফোন খুঁজে নিয়ে আসবি নয়তো থাপ্পড় দিয়ে গাল ফাটিয়ে দেব।’

অয়ন মুখ কাঁচুমাচু করে চেয়ে রইল। সকালে ভাইয়ার ফোন নিয়ে গেইম খেলেছিল সে। গেইম খেলতে খেলতে কখন যে চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি। মাত্রই চার্জে বসিয়েছে। খুব একটা চার্জ হয়েছে বলেও মনে হয় না। অন্তু আবারও ধমকে উঠতেই চুপসানো মুখ নিয়ে ফোন আনতে গেল অয়ন। তিন পার্সেন্ট চার্জসহ ফোনটা এগিয়ে দিতেই কটমট করে তাকাল অন্তু। অয়ন মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকেই এক দৌঁড়ে অন্তুর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। অন্তু নিজেকে খানিক শান্ত করার চেষ্টা করল। টি-টেবিলটা লাথি দিয়ে সরিয়ে ফোন চার্জে বসাল। ফোনটা চার্জে লাগিয়েই নাদিমকে একের পর এক কল লাগাতে লাগল। প্রতিবারই লাইন ব্যস্ত। অন্তুর খিটমিটে মেজাজটা আরও একধাপ খারাপ হলো এবার। কাল সারাদিন নিজের রুমে পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে অন্তু। বিকেল দিকে রঞ্জনের ফোন পেয়ে ঘুম ভেঙেছে। রঞ্জনকে বিয়ের ব্যাপারটা শর্টকাট জানিয়ে দিয়ে আবারও ঘুমিয়েছে। রাতে বন্ধুদের জানানোর কথা মনে হতেই নাদিমকে ফোন দিয়েছিল সে। কিন্তু নাদিমের ফোন বন্ধ। ঝড়-বৃষ্টি চলাকালীন পুরোটা সময় চেষ্টা করেও নাদিমকে পাওয়া যায়নি। অন্তু ক্লান্ত হয়ে রঞ্জনের নাম্বার ডায়াল করল। প্রথমবারেই ফোন উঠাল রঞ্জন। অন্তু মেজাজ দেখিয়ে বলল,

‘ নাদিম তোর পাশে থাকলে ধুমিয়ে একটা ঘুষি মার ওর গালে। রাত থেকে কল দিচ্ছি কোনো খোঁজ খবর নাই। সমস্যাটা কী ওর?’

রঞ্জন শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ রাতে ফোন বন্ধ ছিল ওর। এখন ট্রাই কর। আমার সাথে কথা হলো মাত্র।’

অন্তু কপাল কুঁচকে বলল,

‘ কথা হলো? কথা হলো মানে কী? নাদিম তোর সাথে নেই? তোরা আসছিস না?’

‘ আমি আসছি। নাদিম আসছে না।’

‘ কেন?’

‘ তুই ওকে বলছিলি? কেন যাবে ও?’

‘ বলার জন্য তো ফোনে পেতে হবে রে বাপ। বাচ্চাদের মতো জেদ কী ওকে মানায়?’

রঞ্জন উত্তর দিল না। অন্তু কল কেটে আবারও নাদিমের নাম্বারে ডায়াল করল। যাবে না মানে কী? নাদিম যাবে না তো ওর বাপ যাবে। ফাজলামো নাকি?

_

রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে আছে নাদিম। ইচ্ছুক চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। ফ্যাকাশে সাদা চামড়ায় কালো রঙের পাঞ্জাবিটা বেশ মানিয়ে গিয়েছে। কয়েক মাসের অযত্নে বেড়ে উঠা চুলগুলো কপাল আর ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে। বামহাতে মাথাভর্তি চুলগুলো গোছাতে গোছাতে ঘড়ির দিকে তাকাল নাদিম। প্রচন্ড গরম পড়েছে। ঘন চুলের অত্যাচারে গরম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এবার ঢাকা ফিরেই চুল কেটে ন্যাড়া হয়ে যাবে নাদিম। চুল নিয়ে এক্সট্রা মাথা ঘামানোর সময় তার নেই। নাদিমের ভাবনার মাঝেই ঝকঝক শব্দ তুলে স্টেশন পাড় করল একটি ট্রেন। ছুটন্ত ট্রেনের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎই আনমনা হয়ে গেল নাদিম। মানুষের জীবনটা কী ট্রেনের মতোই ছুটন্ত নয়? ট্রেনের যেমন নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা হয় না। অযথা কোনো বিশ্রাম হয় না। ঠিক তেমনই মানুষের জীবনটাও হয় বিশ্রামহীন। জীবনের সূচনালগ্ন থেকে শুরু হয় এই ছুটে চলার খেলা। ছুটতে ছুটতে মানুষ ক্লান্ত হয় কিন্তু ক্ষান্ত হয় না। হয়ত, ক্ষান্ত হওয়ার সুযোগটাই তাদের হয়ে উঠে না। মানবজন্মটাই কী ভাসমান নয়? ঠিকানাহীন, গন্তব্যহীন নয়? সেই ভাসমান জীবনে স্টেশনের মতো ক্ষনিকের স্বস্তি হয়েই কী আসে না প্রিয় কিছু মুখ? মানুষ থমকায়। ক্ষনিক বিশ্রাম চায়। তারপর আবারও ছুটে চলে ভাসমান গন্তব্যে। সেই গন্তব্যে ছুটতে ছুটতেই হঠাৎ হারিয়ে যায় মৃত্যু নামক অতল গহ্বরে। তার বাবার জীবনটাও কী এমনই এক ভাসমান ট্রেন ছিল না? মায়ের সাথে সাক্ষাৎ হওয়াটা কী নেহাৎই ক্ষণিকের বিশ্রাম ছিল না? কোনো ট্রেনই সারাজীবন স্টেশনে আটকে থাকে না। বাবাও থাকেনি। মা চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি। মা হয়তো ট্রেনের থিওরিটা জানত না। জানলে কখনো আটকানোর চেষ্টা করত না। নাদিমও এভাবেই ভেসে যাবে। হারিয়ে যাবে। পার্থক্য এতটুকুই বাবার মতো তাকে কেউ আটকানোর চেষ্টা করবে না। নাদিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। ট্রেন চলে এসেছে। নাদিম শেষ বারের মতো ঘড়িটা দেখে নিয়ে ট্রেনে গিয়ে উঠল। চ বগিতে নিজের সিটটা খুঁজে নিয়ে বসতেই ফোন বাজল। ফোনের স্ক্রিনে অন্তুর নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকাল। কয়েক সেকেন্ড ফোন হাতে বসে থেকে ফোনটা তুলতেই ওপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠল অন্তু,

‘ শালা তুই আছিসটা কই? সারারাত ফোন বন্ধ করে বসে থেকে এখন ঢং মারাইতাছস? আধ ঘন্টার মধ্যে বাসায় আসবি। অপেক্ষা করছি।’

‘ ট্রেন ছেড়ে দিছে দোস্ত। ময়মনসিংহ যাওয়াটা খুব জরুরি নয়তো এতোক্ষণ তোর বাসায় থাকতাম।’

‘ ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে মানে কী? ফাজলামো করছিস আমার সাথে? তুই আসবি কি-না বল? তোকে ছাড়া যাব না। বিয়ে ক্যান্সেল।’

নাদিম হেসে বলল,

‘ পাগল নাকি? তুই বিয়া করতে না গেলে বিয়ার খাওয়ন পামু কই? শোন, বিয়েতে যাইতে পারতাছি না বলে কিন্তু আমারে রাইখা খাইতে বইসা যাবি না। আগে আমার জন্য প্যাক করবি তারপর খাইতে বসবি। নয়তো খবর খারাপ কইরালামু।’

অন্তু গরম কন্ঠে বলল,

‘ সবসময় ফাজলামো ভালো লাগে না নাদিম। আমি এখন সিরিয়াস। তুই না আসলে বরযাত্রী যাবে না। বিয়েও হবে না। ব্যস।’

‘ আরে ফ্যাসাদ। মাইয়া গো মতো এতো সেন্টি খাইস না তো মামা। আমি তো আর হারায় যাইতাছি না। কালকের মাঝেই চলে আসব। রঞ্জন, নমুরা তো আছেই।’

অন্তু জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। নাদিম হেসে ফেলে বলল,

‘ ঘরের বউয়ের মতো রিয়েকশন দিচ্ছিস ক্যান মামা? আচ্ছা, আমি রাত বারোটার আগে তোর বাসায় থাকলেই তো হলো? এখন দয়া কইরা বিয়ে করতে যা। আর জরুরি ভিত্তিতে দুই-তিনটা শালী নিয়ে আয়। নীরুরে রাইখা আসলেও চলব কিন্তু শালী রাইখা আসা চলব না। নীরু তো নিজে গো মানুষ। ওরে এতো আদর-যত্ন করে ঘরে তোলার কিছু নাই। ওর যা স্পিরিড, ওই হারামি একা একাই আসতে পারব।’

অন্তু মৃদু হাসল। নাদিম ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজের মাঝে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছে সে। ভেতরের অহংবোধটা মাঝে মাঝেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। আজ অন্তুর বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে আসার পেছনে কি এই অহংবোধটা একটুও দায়ী নয়? শুধুমাত্র বড় মামার ফোন পেয়েই কি এভাবে ছুটে যাচ্ছে সে? এর পেছনে কী অন্য কোনো কারণ ছিল না? নাদিম জানে, ছিলো। তার চারপাশটা যে ধীরে ধীরে বিষণ্ন বিষে বিষাক্ত হয়ে উঠছে তা খুব টের পাচ্ছে নাদিম। এই দমবন্ধ শহরটা তাকে বাঁধতে চাইছে। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। কিন্তু রক্ত যে কথা বলে!

_

শোবার ঘরের বিশাল আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ছোঁয়া। বিছানা আর ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য জামা, শাড়ি আর অলংকার। সবসময় জিন্স-টপস পরা ছোঁয়া শাড়ি পরতে জানে না। বুদ্ধি হওয়ার পর কখনও শাড়ি পরেছে বলে মনে পড়ে না। তবুও শাড়ি পরতে হবে। নম্রতা তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, নীরার বিয়েতে দুজনেই নীল রঙের জামদানী পরবে। একই সাজে দুজন গুট গুট করে ঘুরে বেড়াবে। ভাবতেই ভালো লাগে। ছোঁয়ারও ভাবতে ভালো লাগছে। নম্রতার সাথে গিয়ে নীল রঙা জামদানীও সে কিনেছে। কিন্তু ছোঁয়ার মা সিঁথি হকের ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। সিঁথি নিজে ডিজাইন করে মেয়ের জন্য শাড়ি আর ব্লাউজ বানিয়েছেন। তার ধারণা ছোঁয়াকে সেই পিচ রঙা শাড়িতে অপ্সরার মতো সুন্দর দেখাবে। এইসব ব্যাকডেটেড শাড়ির তার প্রয়োজন নেই। ছোঁয়ার একটু মন খারাপ হয়েছে। একটু নয় ভয়ানক মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু সেই মন খারাপে কিছু আসে যায় না। ছোঁয়া জানে, তাকে শেষমেশ মায়ের ডিজাইন করা শাড়িটাই পরতে হবে। সবসময় তাই-ই হয়। ছোঁয়ার পৃথিবীতে বন্ধুমহল ছাড়া বাদ বাকি সবই তার বাবা-মার পছন্দ-অপছন্দের উপর ভিত্তি করেই চলে। এইযে ছোঁয়া রোজ সকালে ব্রেড, ফ্রুটস আর কফি খায় এটাও তার মায়েরই নিয়ম। ছোঁয়া কখন কোন লিপস্টিপ লাগাবে, কোন নেইলপালিশ লাগাবে , তার কোন কোন বই পড়া উচিত সবই তার মায়েরই ঠিক করা। ছোঁয়ার গোছাল রুম। গোছাল চাল-চলন। গোছাল কথাবার্তা সবই তার মায়ের পছন্দ। মা যদি অগোছালো থাকতে পছন্দ করত তবে ছোঁয়াকে অগোছালোই থাকতে হতো। ছোঁয়ার জীবনটা ঘড়ির কাটায় কাটায় নিয়ন্ত্রিত। ছোঁয়া এই নিয়ন্ত্রণ মেনে নিয়েছে। ছোট থেকে এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। জীবনের কোনো পর্যায়েই সে অবাধ্য নয়। শুধু বন্ধুমহল নিয়েই তার যত নীরব বিদ্রোহ। তার বদ্ধ জীবনে এই বন্ধুমহলটাই শুধু তার নিজের। একান্তই নিজস্ব। এখানে কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করে না। হাই ক্লাস ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে হয় না। বন্ধুরা যখন গলা ছেড়ে গান গায়। হুটহাট উদ্ভট সব কাজ করে। ক্যান্টিনের রমরমা আড্ডা ছেড়ে হঠাৎ বৃষ্টিতে নেমে যায়। রেস্টুরেন্টে পেট পুড়ে খেয়ে বিল না দিয়েই দৌঁড়ে পালায়। আবার কখনও ফুটপাতে ওই নোংরা বাচ্চাদের পাশে বসে বিস্তর খায়, খাওয়ায়, গল্প করে। সিনেমা হলে গিয়ে প্রাণ খোলে ছিটি বাজায়। তখন ছোঁয়া অবাক হয়ে দেখে। সেই সময়টুকু সে বিস্মিত সুন্দর এক পৃথিবী দেখে। প্রাণ খোলে হাসে। তার ধরা বাঁধা জীবনটাতে ওই মানুষগুলোই যেন বড্ড তৃপ্তির। ছোঁয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের কাছে শাড়ি পরায় মনোযোগ দেয়। মুখটা হাসি হাসি করে রাখে। দামী অলংকার গায়ে বড়োলোকি অহং মাখে। আপাতদৃষ্টিতে ছোঁয়ার কোনো দুঃখ নেই। বিলাসিতার চাদরে ঘেরা জীবনটা তার খুব সুন্দর আর গোছাল। তবুও ছোঁয়ার বড় কষ্ট হয়। সহজ-সরল মনটা ধুঁকে উঠে বলে, আমার জীবনটা কেন নমু আর নীরু মতো স্বাভাবিক নয়? মধ্যবিত্ত ঘরনার টানাপোড়েন কেন আমার নেই? সেই টানাপোড়েনই বুঝি আনন্দ! বেঁচে থাকার অদ্ভুত এক স্বাদ! সংকটহীন বেঁচে থাকাটা আদৌ কী বেঁচে থাকা?

#চলবে…

[ সারাদিন রোজার পর ক্লান্ত হয়ে পড়ি। চাইলেও লেখা হয়ে উঠে না। তাই এই সময়ের হের-ফের। দুঃখিত।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here