আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে #১১_১২তম_পর্ব

0
417

#আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে
#১১_১২তম_পর্ব

দেবব্রতের কথাটা শেষ হবার আগেই তার গালে স’জো’রে চড় পড়লো। আর মানুষটি অন্য কেউ নয় বরং অবন্তীকা দেবী। আকস্মিক ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় দেবব্রত হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। অবন্তীকা দেবীর চোখজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে, চোয়াল শক্ত। সকলের মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেলো। বড়মা দাদাকে চড় বসিয়ে দিবে কল্পনাও করে নি অন্না। রীতিমতো মেয়েটি ভয়ে শিটিয়ে গেলো। বড়মা যে খুব কড়া ধাঁচের মানুষ তা নয়, তবে তার নিয়ম কানুনের বাহিরে কাজ করা অপছন্দ। ছেলেমেয়েদের প্রেম প্রীতি ব্যাপারটা কখনোই তার চোখে শোভনীয় লাগে না। প্রেম শব্দটি যেনো বেশ বাজে লাগে কানে। তাই যদি শুনেন বিয়ে বাবা-মায়ের অমতে হয়েছে অথবা ছেলে-মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছে তবে তিনি মুখ বাঁকিয়ে নেন। তাই ছেলের এমন আবদারে এমন প্রতিক্রিয়াটি খুব একটা অবাককর নয়। অবন্তীকা দেবী তখন বাজখাঁই কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“নিজের শিক্ষা কি জলে গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছো? বাবা-কাকার সামনে কি করে কথা বলতে হয় জানো না? এ কেমন অসভ্যতামী! না করলে বিয়ে করে বাড়ি আনবে? এসবের জন্য তোমায় কলকাতা পাঠাই নি।”
“আমার মনে হচ্ছে না আমি ভুল বলেছি”
“আবার তর্ক করছো! এমন শিক্ষা আমি তোমায় দিয়েছি!”
“শিক্ষা দাও নি বিধায় আমি যাকে ভালোবাসি তার দায়িত্ব নিতে চেয়েছি। আমি তো অপরাধ করি নি”
“আমার প্রেমের বিয়ে অপছন্দ দেবব্রত। সুতরাং কথা এখানেই শেষ”

দেবব্রত অধৈর্য্য হয়ে বললো,
“তুমি তো তাকে দেখোও নি”
“দেখতে চাই ও না। মেয়েটি ভালো না”
“না দেখে কিভাবে মন্তব্য করছো? একটিবার দেখো। ভালো পরিবার, মেয়েটি তোমার মত”
“আমি আগ্রহী নই”
“তুমি জেদ করছো মা”
“তুমি অভদ্রতা করছো”

মা ছেলের মাঝে বাক্যযুদ্ধ চলছে। দুজন দুজনের দিক থেকে অনড়। এদিকে রীতাদেবী, অন্না, প্রদীপ বাবু এবং নারায়ন বাবু হয়ে গেলেন নির্বাক দর্শক। অবন্তীকা দেবীর বিরোধিতা তারা করতে পারছে না আবার দেবকেও বোঝানোর কিছু নেই। এতো বড় ছেলেকে বোঝানো মানে বোকামী। সে একটি মেয়েকে বিয়ে করবে যা খুব ই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু অবন্তীকা দেবীর মনোভাব বদলানো কঠিন নয়, অসম্ভব। দেবব্রত মায়ের জিদের সামনে মাথানত করলো না। উলটো বললো,
“আমি তাকে বিয়ে করবো”
“ঘর থেকে বেরিয়ে যেয়ে যা খুশি করো”
“তুমি আমায় ঘর ছাড়া করবে?”
“সন্দেহ আছে?”
“মা?”

অবন্তীকা দেবী উত্তর দিলেন না। হনহন করে ভেতরে চলে গেলেন। রীতাদেবীও পিছনে গেলেন। বাবা-কাকার দিকে তাকালে তারা স্বান্তনার স্বরে বললো,
“ভুলে যা, তোর মা খুব জেদী। তার সাথে ঝামেলা করার মানে হয় না।”

কিন্তু দেবব্রত তার সিদ্ধান্তে অনড়। সে মোটেই পিছ পা হবে না। তবে সমস্যা হলো একটি, একজন উদবাস্তু ভাসমান ছেলের সাথে মোটেই কৃষ্ণার মা-বাবা বিয়ে দিবেন না। আর দেবব্রতের কাছে এখন চাকরিও নেই। কলকাতার চাকরিটি ছেড়ে এসেছে সে। দেশে চাকরি পেতেও সময় লাগবে। তাই এখন ঘরছাড়া হবার সাহসটি সে করতে পারছে না। তাই সিদ্ধান্ত নিলো সে আন্দোলন করবে। বিদ্রোহী আন্দোলন নয়, অসহযোগ আন্দোলন।

রাতের বেলা খাবার বাড়ছেন অবন্তীকা দেবী। অন্না কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড়মাকে দাদার হয়ে সুপারিশ করার প্রয়াশ করছে। কিন্তু বড়মার কড়া দৃষ্টিতে কথাগুলো গলায় এসেই আটকে যাচ্ছে। অবন্তীকা দেবী টেবিলে খাবার দেবার পর অন্নাকে বললেন,
“যাও সবাইকে ডেকে আনো”
“বড়মা?”
“কিছু বলবে?”
“দাদার ব্যাপারটা!”
“আমার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তোমাকে যা বলেছি তা করো”

অবন্তীকা দেবীর কড়া বাক্য ঔষধের মতো কাজ করলো। অন্নার তার কথাগুলো গিলে ফেললো। তারপর উল্টো দিকে হাটা দিলো সবাইকে ডাকতে। দেবব্রতকে ডাকতে দরজায় কড়া নাড়তেই ওপাশ থেকে সে বললো,
“আমি খাবো না”
“সে কি কথা? খাবি না কেনো?”
“অনশনে বসেছি তাই”
“কিসের অনশন?”
“যতদিন না আমার বিয়েতে মা রাজি হবে আমি অনশন করবো। আমিও দেখি তার জিদ কতোদিন থাকে”

দেবব্রতের কথায় মাথায় বাজ পড়লো অন্নার। বুঝতে পারলো এবার আর লংকাযুদ্ধ বাধতে দেরি নেই। ছুটে এসে চিন্তিত কন্ঠে বড়মাকে জানাতেই তিনি ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,
“ভালো হলো, আমার খাবার বেঁচে গেলো। সকালে এই ভাত দিয়ে খিঁচুড়ি বানিয়ে ফেলবো৷ রীতা আর সকালে নাস্তা বানিও না”
“দিদি ছেলে অসুস্থ হয়ে যাবে”

চিন্তিত কন্ঠে রীতাদেবী বললেন। তার কথা বিপরীতে অবন্তীকা দেবী বললেন,
“হোক, আমি কি করতে পারি? আমি তো বলি নি অনশনে বসতে। সিদ্ধান্ত তার”
“দিদি ছেলে তো বড় হয়েছে, এখন তার পছন্দ অপছন্দ হবেই। জিদ ছেড়ে দাও। মেয়েটি ভালো ও হতে পারে”
“রীতা আমি নিয়ে কথা বলবো না। তোমরা ছেলের বিয়ে দিলে দাও। আমাকে জানিও আমি আমার বাপের বাড়ি চলে যাবো। যে বিয়েতে আমার মত নেই সেখানে আমিও থাকবো না। এখন তোমরা যা পারো করো”

বলেই নিজ ঘরে চলে গেলেন অবন্তীকা দেবী। রীতাদেবী হতাশ দৃষ্টিতে চাইলেন ভাসুর এবং স্বামীর দিকে। মা-ছেলের এই জিদের কারণে উভয় ই কষ্ট পাচ্ছে কিন্তু তারা কেউ নিজেদের নত করবে না। কারণ তাদের জিদই প্রধান।

****

ঘরের অবস্থা ভালো নয়। দুদিন যাবৎ মা-ছেলের মাঝে শীতল যুদ্ধ হচ্ছে, কেউ কথা বলছে না। এদিকে দেবব্রত খাচ্ছে না। সে তার ঘরে নিজেকে গৃহবন্দী করছে। অন্নার এগুলো ভালো লাগছে না। কিন্তু ছোট বিধায় কথা বলতে পারছে না। এই ঝামেলায় মায়ের প্রকোপ বেড়েছে। সেও ধুমধাম ঝড় তুলছেন অন্নার উপর। সামনে পরীক্ষা অথচ তার বই দেখতেও বিরক্তি। অন্নাকে লিফো, ফিফোর ম্যাথ করতে দিয়েছে অর্জুন। অন্না অনিচ্ছুক ভাবে তা করেও দিয়েছে। অর্জুন চোখ ছোট ছোট করে সেই খাতা দেখলো এরপর একটা পেন্সিল দিয়ে তার মাথায় টোকা দিলো। টোকাটা জোড়ালোই ছিলো, ফলে মাথায় হাত দিয়ে “আহ” করে উঠলো অন্না। অর্জুনের দিকে তাকাতে তার শানিত বাক্যের সম্মুখীন হতে হলো,
“এই তোকে কতবার বুঝাবো লিফো মানে শেষের বস্তু আগে বিক্রি হওয়া। আর ফিফো মানে আগের বস্তু আগে বিক্রি হওয়া। তুই এখানে কি করে রেখেছিস? আর ব্যালেন্স শিটে এতো ভুল কেনো? ৮৯০৩ কে ৮৯৩০ কে লিখে? এতো অন্যমনস্ক কেনো রে তুই? দেখে দেখে ও তুলতে পারিস না”

অর্জুনের বকার মাত্রা বাড়ার আগেই অন্না অসহায় কন্ঠে বললো,
“অর্জুনদা, আমার মনটা ভালো নেই। আজ বকো না”

অন্নার মুখটা মিয়ে আছে। শ্যামমুখখানা আরোও কালো লাগছে যেনো। অর্জুন কিছুসময় তাকে দেখলো। তারপর কন্ঠ নরম করে বললো,
“কি হয়েছে?”
“দাদা অনশন করছে, বড়মা তার শাসনকার্য অব্যাহত রাখছেন। দাদা দুদিন কিছু খায় নি, অথচ বড়মা নির্বিকার। বোধহয় এবারে দাদার আন্দোলন কাজ দিবে না। আমার ভালো লাগছে না। কথা বলতেও ভয় হয়। দাদা তো ঘর থেকেই বের হয় না। চিন্তা হয় ও যদি অসুস্থ হয়ে যায়?”
“তোর দাদা অনশন করছে?”
“হ্যা, তাও জলছাড়া”
“মায়ের কাছে মাসির গল্প দিস না। যে ছেলে দুঘন্টা না খেয়ে থাকতে পারে না, সে দুদিন না খেয়ে আছে! এ আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? যেয়ে দেখ বিছানার তলে চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট রেখে দিয়েছে। দেবব্রত অনশন করছে এ যদি আমাকে দেবতা এসেও বলে আমি বিশ্বাস করবো না”
“তুমি মজা নিচ্ছো? সত্যি আমার দাদা অনশন করছে। প্রেমের জন্য দাদা সব ছাড়তে পারে। অবশ্য তোমার মতো বেরসিক মানুষ প্রেমের কি বোঝে?”

অন্না ক্ষেপে গেলো। তার রাগ হচ্ছে। একেই বাড়ির প্রতিকুল পরিস্থিতি তার ভালো লাগছে না অথচ অর্জুনদা মোটে পাত্তা দিচ্ছে না। আসলেই পুরোদস্তুর খ’চ্চর মানব সে। ঠিক তখন ই অর্জুন ডানহাতে মাথা ঠেকিয়ে বললো,
“তোর ভাষ্যমতে আমি প্রেম বুঝি না? বেরসিক?”
“অবশ্যই, প্রেম করেছো কখনো? বুঝবে কি করে বিচ্ছদের যন্ত্রণা?”
“আমি তোমার দাদার মতো আ’হা’ম্মক নই, বসে বসে অনশন করতাম না। বিয়ে করে বাড়ি এনে তুলতাম।”

অর্জুনের কন্ঠ দৃঢ়। অর্জুনের প্রগাঢ় নয়নে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো অন্না। অর্জুনের নয়নজোড়া অন্নাতে স্থির। অন্না অনুভব করলো তার বক্ষস্থলের অস্বস্তিটা বাড়লো। তাকিয়ে থাকতে পারলো না বেশিসময়। দৃষ্টি সরিয়ে ধীর স্বরে বললো,
“দাদাও ভেবেছিলো। কিন্তু বড়মা তাকে ঘর ছাড়তে বলেছেন। এখন উদবাস্তু ছেলের সাথে কৃষ্ণাদির বাবা মা কি বিয়ে দিবে? দিবে না। তাই খামোখা আমার দাদাকে নিয়ে বাজে কথা বলো না। আহারে কৃষ্ণা দি, কত কষ্টই না পাচ্ছে। দাদা আর কৃষ্ণা দির এই বিরহ আমার মোটেই ভালো লাগছে না।”

অন্না দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সত্যি ই কৃষ্ণার জন্য তার খারাপ লাগছে। তখন কপালের চুলগুলো হাত দিয়ে ঠেলে চেয়ারে গা এলিয়ে দিতে দিতে অর্জুন বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“তা বিরহদেবী আপনি কিছু করছেন না কেন?”
“আমি কি করবো! আমার কথা কেউ পাত্তা দেয়? তুমি ই তো দেও না”
“কে বলেছে আমি তোর কথা পাত্তা দেয় না! যদি না দিতাম তবে এতো সময় তোর প্যাচাল শুনতাম?”

অকপটে কথাটা বললো অর্জুন। কথাটা মস্তিষ্কে ঝংকার তুললো। চিরচেনা খ’চ্চ’র অর্জুনদার শ্যাম মুখখানা যেনো বড্ড অপরিচিত লাগছে। তার কন্ঠে অদ্ভুত মাদকতা। অন্নার মনে হচ্ছে সে চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে। আবেগের সেই অদ্ভুত চোরাবালি। অর্জুন কিছুটা এগিয়ে এসে বললো,
“একটা বুদ্ধি দিবো? সাপ ও ম’রবে, লাঠিও ভাঙ্গবে না”

এবার ধ্যান ভাঙ্গলো অন্নার। নড়েচড়ে বললো,
“কি বুদ্ধি?”

অর্জুন হাসলো, কিশলয়ের ফাঁকে ভোরের প্রথম কিরণের ন্যায় সেই হাসি। এই হাসিতে ম’র’তেও দ্বিধা হয় না। অন্না অনুভব করলো সে ভয়ংকর কিছুতে মেতে উঠছে, এতে তার ধ্বংস নিশ্চিত। তবুও কিশোরী মুগ্ধ নয়নে তার রমেশকে দেখছে।

******

হেসেলের জানালা দিয়ে সুর্যের তাপ গলে ঢুকছে। তাপটা একটু বেশি ই। চুলোর গরম এবং সেই তাপে তরতর করে ঘামছেন অবন্তীকা দেবী। শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিলেন তিনি। মনটা ভালো নেই তার। দেবব্রতের সাথে ক্ষণে ক্ষণে বাঁধছে। ছেলেটা দিন তিনেক খাওয়া নাওয়া ছেড়েছে। ঘরের মধ্যে থাকে। মাঝে মাঝে বের হয়, কিন্তু সেটাও ক্ষণিকের। ছেলেটির মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। রীতা তাকে জোর করে খাওয়াবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু লাভ হয় নি। ফলে বাসায় একটা অরাজকতা তৈরি হয়েছে। নারায়ণবাবু ইশারা ইঙ্গিতে বুঝাতে চাচ্ছেন। কিন্তু এতে খুব একটা যায় আসলো না অবন্তীকা দেবীর। তিনি সরাসরি বলে দিলেন,
“আমি তো কাউকে মানা করি নি! তবে আমার সংসারে আমার অমতে কিছু হবে না”

নারায়নবাবু চেপে গেলেন। স্ত্রীর জেদ এবং রাগ সম্পর্কে তিনি অবগত। চিন্তা যে অবন্তীকা দেবীর হচ্ছে না তা নয়। তবে ছেলের কাছে পরাজিত হবেন না। তিনিও দেখতে চান ছেলের এই অনশনের বাহানা কতদিন চলে। এর মাঝেই রান্নাঘরে প্রবেশ করলো অন্না। চুলোয় রাখা কড়াই এর দিকে উঁকি দিতে দিতে বললো,
“কি রাধছো গো বড়মা?”
“তোমার দাদার পছন্দের পটলের দোলমা। দেখি তার খাবার ইচ্ছে হয় কি না!”
“এসব করে হবে না বুঝলে, দাদাকে বিয়ে দিয়ে দাও। দেখবে অনশন টনশন ভেঙ্গে বেড়িয়ে এসেছে”

অন্নার কথা শুনতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন অবন্তীকা দেবী। অন্না তার চাহনীতে শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“আমি বলছি না দাদার প্রেমিকার সাথে বিয়ের কথা। আমি বলছি যেকোনো মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দাও”
“মেয়ে কি হাতের মোয়া? যখন তখন পাবো? ভালো মেয়ে পাওয়া এই জমানায় অনেক কঠিন। তুই বুঝবি না! আর এমন মেয়ে কোথায় পাবো বল যে আমার ছেলের মাথা থেকে প্রেমের ভুত নামাবে, একই সাথে রুপে লক্ষী, গুনে স্বরসতী হবে”
“আমার কাছে আছে”

অন্নার কথা শুনেই অবাক নয়নে তাকালেন অবন্তীকা দেবী। বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
“কে?”
“কৃষ্ণা, আরে ওই যে অর্জুনদার সাথে এসেছিলো। তোমার সাথে কথা হয়েছে তো। মেয়েটি যেমন সুন্দরী, ঠিক তেমন ই সুন্দর ব্যাবহার। দাদার সাথে মানাবেও। ভেবে দেখো বড়মা, লটারী হাতে এসেছে। সবসময় এমন মেয়ে পাওয়া যায় না৷ তুমি বললে আমি তার ঠিকানা নিতে পারি৷ ভেবে দেখো। আমি হলফ করে বলতে পারি, ওই মেয়ের সাথে বিয়ে হলে আমার দাদার প্রেমের এই ভু’ত উড়ে শ্যাওড়াগাছে চলে যাবে। কি বলো, ঠিকানা নিবো?”

অন্নার কথা মন দিয়ে শুনলেন অবন্তীকা দেবী। তারপর কিছুসময় ভেবে ধীর কন্ঠে বললেন…….

12
#আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে
#১২তম_পর্ব

“আমি হলফ করে বলতে পারি, ওই মেয়ের সাথে বিয়ে হলে আমার দাদার প্রেমের এই ভু’ত উড়ে শ্যাওড়াগাছে চলে যাবে। কি বলো, ঠিকানা নিবো?”

অন্নার কথা মন দিয়ে শুনলেন অবন্তীকা দেবী। তারপর কিছুসময় ভেবে ধীর কন্ঠে বললেন,
“কৃষ্ণাকে আমার যে অপছন্দ না নয়, মেয়েটি শিক্ষা, ব্যাবহার খুবই চমৎকার। দেখতেও একেবারে প্রতীমার মতো। কিন্তু সব কথার শেষ কথা, তোমার দাদা কি রাজি হবে। তার তো অনশন চলে, এখন আমি নিজের পছন্দ জাহির করলে যদি হিতে বিপরীত হয়?”
“সে আমার উপর ছেড়ে দাও। রাজী না না হলে তোমার কাছে মুখ্যম অ’স্ত্র আছে, “মা অস্ত্র”। যতই হোক দাদা সেই অ’স্ত্রে কুপোকাত হবেই। তুমি রাজী কি না বলো। সময় নষ্ট করা বোকামি হবে। দাদার মতিগতি বলা যায় না, দাদা যদি সত্যি সত্যি ওই মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেলে তখন কিন্তু আম ও যাবে ছালাও যাবে। তুমি বললে আমি অর্জুনদার থেকে ঠিকানা নিবো, এখন বলো নিবো?”

এবার খানিকক্ষণ ভাবলেন অবন্তীকা দেবী। অন্না চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে রয়েছে। বুকটা টিপ টিপ করছে, গলা শুকিয়ে এসেছে। অন্নার “চো’রের উপর বাটপারি” করার স্বভাব থাকলেও অবন্তীকা দেবীর সাথে কোনো কালে করে নি। তাই ভয়টা প্রবল। অর্জুনদার বুদ্ধি মতো কথা তো পাড়লো, কাজে কতটুকু দিবে কে জানে! মিনিট পাচেক বাদে অবন্তীকা দেবী ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। শ্যাম মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যেনো বিশাল চিন্তার পাহাড় নেমে গেছে। হাসি অক্ষত রেখে অন্নার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
“তুই আসলেই আমার সোনা মেয়ে। ভালো বুদ্ধি দিয়েছিস। আমি সত্যি ভেবে দেখি নি। ও যদি চাকরি পেয়ে মেয়েটিকে বিয়ে করে ফেলে, তবে এই জিদের তো কোনো মানেই নেই। তুই অর্জুনের থেকে ঠিকানা নে। আমি আজ বিকেলেই তোর জ্যেঠু আর মাকে নিয়ে কৃষ্ণাকে দেখতে যাবো”
“এই না হলে আমার বড়মা। আমি জানতাম তুমি বুদ্ধিমতী। আমি ঠিকানা নিয়ে আসছি”

বলেই অবন্তীকা দেবীকে জড়িয়ে ধরলো অন্না। অবন্তীকা দেবী তার কপালে চুমু এঁকে বললেন,
“পা’গ’লী মেয়ে”

*******

বিকেলের শেষ প্রহর, সূর্যের তেজ এখন ক্ষীণ। তেজহীন রোদ আছড়ে পড়ছে দেবব্রতের বিরস মুখশ্রীতে। মুখখানা শুকিয়ে গেছে, ঠোঁটজোড়া শুষ্ক। মোবাইলের কর্কশ শব্দে মোবাইলের দিকে তাকালো সে। কৃষ্ণার ম্যাসেজ এসেছে। উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। কি বলবে! মেয়েটিকে মিথ্যে বলতে পারে না সে। কষ্ট হয়, অপরাধী লাগে নিজেকে। মেয়েটির প্রাণবন্ত মুখখানা দেখলে ভেতরটা চিনচিনে ব্যাথায় ছেয়ে যায়। এতো বছরের প্রণয় ফুলটি কি এভাবেই ঝড়ে যাবে! মার কঠিন হৃদয় যে গলবার নয়। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো তার। ঠিক সেই সময়ে দরজায় টোকা পড়লো। নিস্প্রভ কন্ঠে শুধালো,
“কে?”
“দাদা আমি, তোর প্রেমদূত”

অন্নার কন্ঠ শুনতেই ক্লান্ত শরীর খানা মনের বিরুদ্ধে দরজা অবধি নিয়ে গেলো। দরজা খুলতেই অন্না ঘরে প্রবেশ করলো। বিছানায় না বসে খাটের নিচে তার চোখ গেলো প্রথমে। অর্জুন দা ঠিক বলেছে, দেবব্রতের খাটের তলে চিপস, বিস্কুটের স্তুপ। কয়েকটা প্যাকেট বের করে চোখ-মুখ খিঁচিয়ে বললো,
“এই তোর অনশন?”
“কি জন্য এসেছিস তাই বল”

মহা বিরক্তি ঝরছে দেবব্রতের কন্ঠে। একেই মনটা ভালো নেই, উপরন্তু অন্না এখন মাথা খা’বার পরিকল্পনায় আছে। অন্না প্যাকেটগুলো খাটের উপর রেখে আয়েশ করে বসলো। তারপর উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলল,
“বড়মা, মা, জ্যেঠু বাড়ি নেই। তোর জন্য পাত্রী দেখতে গিয়েছে”

পাত্রীর কথাটা শুনতেই দেবব্রত নড়েচড়ে উঠলো। বিস্ময়, রাগ, অভিমান, বিরহে অন্ধপ্রায় দেবব্রত চেঁচিয়ে উঠলো,
“কিসের পাত্রী? এসব কি ফাজলামো হচ্ছে? আমি কৃষ্ণা ব্যাতীত অন্য কাউকে বিয়ে করবো না। অসম্ভব সেটা”
“হ্যা, তারা কৃষ্ণাদিকেই দেখতে গিয়েছে”

বেশ শান্ত গলায় অন্না বললো। অন্নার কথাগুলো মস্তিষ্কে ঢুকছে না। কেমন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। অধৈর্য্য হয়ে দেবব্রত বললো,
“গাঁ’জা খেয়েছিস? কি বলছিস উল্টা পালটা?”
“আমি ছাইপাস খাই না, যা বলছি ভেবেই বলছি। আমাকে তো পাত্তা দিস না। সেই আমিই তোর প্রেমের রাস্তা পরিষ্কার করে দিলাম। কত কাঠখড় পু’ড়িয়েছি জানিস! অবশেষে মায়ের কৃপা হলো, আমার বড় মা কৃষ্ণাদিকে এই বাড়ির বউ করতে রাজি হলেন”

দেবব্রত এখনো বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রয়েছে। তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। সব যেনো স্বপ্নের মতো ঠেকছে। আনন্দ, বিস্ময়, অবিশ্বাস সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তার হতবিহ্বল চাহনী বুঝতে পেরে অন্না তাকে বুঝিয়ে বললো আসল কাহিনী। কাহিনী শুনতেই দেব বললো,
“মাকে ঠকিয়ে এভাবে বিয়ে করাটা কি ঠিক হবে?”
“অর্জুনদাকে ও আমি বলেছিলাম, মিথ্যা বলছি পাপ হবে না তো! অর্জুন দা কি বললো জানো? বললো, এটাকে সত্য গোপন করা বলে, মিথ্যে বলা নয়। হ্যা একটু ছল করছি বটে, কিন্তু বড় মা তো কৃষ্ণাদিকে পছন্দ করে। তার আপত্তি প্রেমের বিয়েতে। শুধু এই সামান্য ব্যাপারে দুটো হৃদয়কে পৃথক করা আরোও বড় পাপ। আর কারোর ভাল করতে যদি একটু মিথ্যে বলাও লাগে সেটা ততটা পাপ হয় না। এই মিথ্যে তে কারোর ক্ষতি হচ্ছে না, বরং একজোড়া হৃদয়ের কষ্ট নিবারণ হচ্ছে।”
“মা যদি পড়ে জানতে পারে? কষ্ট পাবে না তো”
“কে বলবে? তুই? আমি নাকি কৃষ্ণা দি? দেখ, তোর আর কৃষ্ণাদির বিচ্ছেদ হলে তুই আর কৃষ্ণাদি কষ্ট পাবি না? আর কৃষ্ণাদিকে দেওয়া কথা রাখতে গেলে বড়মা আরোও কষ্ট পাবে। এর চেয়ে যা হচ্ছে ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক। পরেরটা নাহয় পরে ভাববো। আর যদি বড়মা জেনেও যায় আমার দোষ দিস। আমি মাথা পেতে নিবো। কারণ এই সবকিছু রচয়ীতা তো আমি। না না, আমি একা নই, অর্জুনদাও সমান ভাবে দোষী। না হয় আমরা দুজন ই শাস্তি ভোগ করে নিবো”

অন্নার কথায় হেসে ফেললো দেবব্রত। গালটিপে বললো,
“তোকে কিভাবে ধন্যবাদ দেই বল তো?”
“ধন্যবাদ আমি নিবো না। আমাকে শুধু একটা প্রতীজ্ঞা কর, যখন আমি তোর কাছে কিছু চাইবো তুই সেটা পূরণ করবি। সেটা যদি খুব বাজে কিছুও হয় তুই কথা রাখবি”
“এই ব্যাপার, যা কথা দিলাম। তুই আমরণ যা চাইবি আমি তোর কথা রাখবো”

অন্না খিলখিল করে হেসে উঠলো। নিঁখাত, প্রাণবন্ত হাসি। মেয়েটি বড় হয়ে গেছে। সেই দুঝুটি পড়া, গোলগাল বকা অন্নাটি সে আর নেই। দেবব্রত বোনকে অপলক দৃষ্টিতে দেখলো। চিরকৃতজ্ঞ সে অন্নার কাছে।

******

দেবব্রতের বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সবাই আদা জল খেয়ে লেগেছে। এই শুক্রবার ই বিয়ে। এই লগ্নের পর আগামী লগ্ন সামনের বছর। তাই সবার মতেই বিয়েটা অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই শুক্রবার। প্রথমে দেবব্রত খানিকটা মেকি অভিমান দেখিয়েছে, কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ না। এই মেকি অভিমানের নাটকটি ও অন্নার বুদ্ধিতেই করা।

পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে আড্ডা বসেছে। যুবসমাজের এখন কেন্দ্রবিন্দু দেবব্রত। অর্জুনের প্রেমকাহিনী চায়ের উড়ন্ত ধোঁয়ার সাথে কোথাও যেনো মিলিয়ে গেছে। এখন গরম গরম খবর দেবব্রতের বিয়ে তাও কৃষ্ণার সাথে। প্রতীক তো কথার ছলে বলেই দিলো,
“তোকে মানতে হবে দেব, কি গুগলি টা ফেললি! আমরা টের ও পেলাম না অথচ দেশে ফেরার সপ্তাহ খানেকের মাঝে তোর বিয়ে”
“আরে তাড়াহুড়ো কি আমি করছি। সে তো একবছরের আগে কোনো লগ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিয়ে যখন করবোই দেরি করে কি লাভ”

দেবব্রতের কথায় সবাই হেসে উঠলো। কিন্তু রবিন ভাই এর মুখে হাসি নেই। চিরচেনা হাস্যজ্জ্বল রবিনভাই আজ খিজ খেয়ে আছেন। তার মুখখানা শক্ত, মুখে কোনো কথা নেই। এতো হাসিঠাট্টার মাঝেও সে চুপ। তাই অর্জুন বলে উঠলো,
“কি গো রবিন ভাই? তোমার মুখ বেজার কেনো?”

এতোসময় পর নড়ে চড়ে উঠলো রবিন ভাই। খানিকটা অপ্রস্তুত কন্ঠে বললো,
“কই না তো”
“আলবত, তুমি কথা বলছো না, আমার পেছনে লাগছো না। হাসছো না। কি হয়েছে ঝেড়ে কাশো তো বাপু!”

কিছুসময় চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রবিন ভাই। নিস্পৃহ স্বরে বললো,
“আমার প্রেমটা বুঝি আর ঠিকবে না”
“কেনো কেনো?”
“তানিকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। তাও যে সে আলু পটল নয়। বিশাল পরিবার থেকে। শহরের বেশ ধনী মানুষ তারা। তাদের কাছে আমি মাইনর ক্যারেক্টর। কি করবো বুঝছি না”
“তানি আপু কি বললো?”
“আমাকে শাসালো, বললো, আমার সিদ্ধান্ত জানাতে। বুঝছি না কি করবো!”

রবিন ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এতো সময়ের হাসি ঠাট্টাগুলো সব ছাই চাপা পড়লো। সকলের মুখে উৎকন্ঠা। রবিন ভাই কি সিদ্ধান্ত দিবে কে জানে!

*****

বিয়ে উপলক্ষে অর্জুনদের বাড়ি নববধুর ন্যায় সেজেছে। সাজসজ্জার সকল দায়িত্ব অন্নার নিজ কাধে। একমাত্র দাদার বিয়ে। কোনো ছাড় হবে না। অর্জুন শুধু কিশোরীর উচ্ছ্বাসিত মুখ দেখছে। হাতজোড়া বুকে বেঁধে অপলক নয়নে দেখছে অন্নাকে। তারপর একটু এগিয়ে যেয়ে তার চুলে টান দিয়ে বললো,
“আমার বুদ্ধি তো বেশ নিজের নামে চালালি! এখন দাদার কাছে তো তুই তার প্রেমদেবী”

চুলে টান খেতেই “আহ” করলো অন্না। তারপর মাথা ঘষতে ঘষতে বললো,
“আমি কি তোমার মতো অকৃতজ্ঞ? মোটেই অন্যের করা কাজ আমি নিজের নামে চালাই না। আমি তোমাকেও তার ভাগ দিয়েছি”
“আমি অকৃতজ্ঞ?”
“র’ক্ত দিয়েছিলাম, ধন্যবাদ দিয়েছো?”
“দেবো না, আমার ইচ্ছে”

বলেই হনহনিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো অর্জুন। অন্না অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শ্যাম যুবকটির দিকে। পুরোদস্তর খ’চ্চ’র মানব

*******

আজ দেবব্রত এবং কৃষ্ণার বিয়ে। লাল বেনারসী, কপালে চন্দন, চোখে গাঢ় কাজল, খোঁপায় বেলীর মালা, সারা গায়ে স্বর্ণের গহনা; কৃষ্ণাকে আজ স্বর্গের অপ্সরার মতো লাগছে। আয়নায় নিজেকে দেখলো কৃষ্ণা। দেবব্রত তার কথা রেখেছে। এই সিঁথিটুকু শুধুই তার। এতোকালের প্রণয় আজ পরিণয়ে পরিণত হবে ভাবতেই গালজোড়া রক্তিম হয়ে উঠলো। আজ কিছু সময় তারপর দেবব্রতের সাথে সম্পূর্ণভাবেই জড়িয়ে যাবে সে। এর মাঝেই শুনতে পেলো বরপক্ষ চলে এসেছে। ফলে ছুটে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ালো কৃষ্ণা। সাদা টোপরখানা পড়ে সত্যি ই দেবব্রত এসেছে। তার মা তাকে বরণ করছে। কিছুসময় বাদে অন্নার আগমণ ঘটলো। কৃষ্ণাকে দেখেই বললো,
“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে জানো?”
“তাই বুঝি? ধন্যবাদ”
“কেনো?”
“আমার প্রেমনাঙ্গর পাড়ে ফেরাবার জন্য। কথা দিচ্ছি, আমিও তোমার প্রেমনাঙ্গর পাড় করিয়ে দিবো”

কৃষ্ণার কথায় জমে গেলো অন্না। গালে রক্ত জমলো। শ্যাম গালজোড়া রক্তিম হলো। কৃষ্ণা বললো,
“লজ্জা পেয়ে লাভ নেই, আমি কিন্তু অর্জুনদার ব্যাপারখানা জানি”

অন্না লজ্জায় শিটিয়ে গেলো। কৃষ্ণা হাসলো। ছোট্ট মেয়েটিকে দেখে নিজের পাঁচ বছর আগের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। একদিন এমন লজ্জা সেও পেতো দেবব্রতের নাম শুনলে।

*****

দেবব্রত এবং কৃষ্ণার বিয়ে সম্পন্ন হলো। শুভদৃষ্টিতে দেবব্রতের চোখ সরছিলো না। বিদ্যুৎ এবং প্রতীকের ধাক্কায় হুশ ফিরলো তার। বিয়ের পর পর বাসরের জন্য দেবব্রত এবং যুবসমাজের কিছু অংশ সেখানেই থেকে গেলো। অন্না থাকলো না। কারণ তার মানুষটি আসে নি। ভেবেছিলো পড়ে আসবে কিন্তু সে আসে নি। বাহানা দিয়ে অন্না চলে এলো বাড়ি। অবন্তীকা দেবী আজ খুব খুশি, ছেলের মাথা থেকে প্রেমের ভুত নামিয়েছে। এদিকে অন্না বাড়ি ফিরতেই রীতা খাবার দিয়ে বললো,
“কাকীমাকে দিয়ে আয় তো”
“কাকীমা আর অর্জুনদারা যায় নি কেনো?”
“অর্জুনের শরীরটা ভালো নেই। প্রচুর জ্বর। তাই দীপংকর দাদা শুধু গিয়েছিলেন”

অর্জুনের জ্বর শুনতেই হাত পায়ে হীম ধরলো অন্নার। বক্ষস্থলে অসহনীয় যন্ত্রণাবোধ করলো। তাই সময় নষ্ট না করেই খাবার নিয়ে ছুটলো উপরতলা। কাকলী দেবী দরজা খুলতেই মলিন হাসি হেসে বললেন,
“এসবের কি দরকার ছিলো রে?”
“অর্জুনদা কেমন আছে?”
“জ্বর নামছে না রে, বিকেল থেকে জ্বর। ছেলেটা বন্ধুর বিয়ের জন্য কতো উৎসাহী ছিলো! সন্ধ্যায় জোর করছিলো। কিন্তু এই ক্লান্ত শরীরে বিয়ে খাওয়া যায় বল”

কাকলীর দ্ববীর চিন্তিত কন্ঠে মনটা আরোও মিইয়ে গেলো অন্নার। ধীর স্বরে বললো,
“আমি একটু দেখে আসি?”
“যা, দেখে আয়। আমি তোর জন্য নাড়ু আনছি”

অর্জুনের ঘর পর্দা দিয়ে ঢাকা। একটা কম ভোল্টেজের বেগুনী আলো জ্বলছে কেবল। সেই আলোয় বিছানায় শায়িত ক্লান্ত অর্জুনকে দু চোখ ভরে দেখলো অন্না। চোখের নিচে ঘামের বিন্দু, ঠোঁট জোড়া শুষ্ক। ঘুমিয়ে আছে সে। কপালে হাত দিয়েই তাপ অনুভূত হলো। অন্নার ভেতরটা পুড়ছে, এমন নিস্তেজ অর্জুনদা যে তার মোটেই পছন্দ নয়। কিশোরীর আবেগ বাড়লো। কিছু নিষিদ্ধ ইচ্ছে ডানা মেললো সেই আবেগের আবরণে। অজান্তেই কোমল ওষ্ঠ জোড়া চলে গেলো তপ্ত কপালে। উষ্ণ ছোঁয়ার পরশ দিলো নিজের রমেশকে। অশ্রু গড়িয়ে পড়লো চোখের কোন থেকে। ধীর স্বরে বললো,
“ভালো হয়ে যাও অর্জুনদা”

মুখখানা তুলতেই দেখলো অর্জুন চোখ মেলে তাকিয়েছে। ক্লান্ত চোখে তার প্রতিবিম্ব। অন্না সরতে যেয়েও পারলো না। উষ্ণ, রুক্ষ হাতটা চলে গেলো কোমল গালে। বাহিরে তখন ঝড়ো বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দ কর্ণকুহরে আসছে। অর্জুনের ক্লান্ত ঘোরলাগা চোখ দেখছে অন্নাকে। অন্নার চোখজোড়া অর্জুনে আবদ্ধ। এরপর কি যেনো হলো! অর্জুনদা মাথা খানা সামান্য তুললো। অন্নার বোঝার পূর্বেই তার শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ছুয়ে দিলো অন্নার কোমল ওষ্ঠ…….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here