#আমার_একলা_আকাশ_তোমায়_জুড়ে
#৪র্থ_পর্ব
অর্জুন এসে বসতেই সকলের কেন্দ্রবিন্দু হলো সে। চা এগিয়ে দিতে দিতে পাড়ার মোস্ট সিনিয়র রবিন ভাই বলে উঠলেন,
“কি ভায়া, শরীর ভালো?”
“জ্বী”
“তা ভাই, প্রেমে পড়ে জ্বর হয় শুনেছি, ছ্যাকা খেয়ে জ্বর হয় প্রথম শুনলাম। দেবদাস হোক তো তোমার মতো! অন্নার পেছনে দৌড়ে কি না শেষ অবধি ক্লিনিক চলে গেলে! ভাবা যায়?”
রবিন ভাই এর কথাটা কেমন খটকা লাগলো অর্জুনের। বোধগম্য হলো না মর্মার্থ। হ্যা, সে অন্নার পেছনে ছুটেছে ঠিক কিন্তু ছ্যা’কা খায় নি। অর্জুন বোকা হাসি অব্যাহত রেখে বললো,
“ছ্যা’কা খেয়েছি মানে ঠিক বুঝলাম না রবিন ভাই!”
“আরে আরে লজ্জা পেও না, লজ্জা পেও না। ভালোবাসা তো অপরাধ নয়, আর যাকে ভালোবাসো সে না করে দেওয়াটাও অপরাধ নয়। তবে ভায়া তোমাকে স্যালুট, তুমি প্রেয়সীর জন্য ক্লিনিক অবধি চলে গেলে, এই হিমু লেনের যুবসমাজ তোমাকে সারাজীবন মনে রাখবে। শরৎচন্দ্রের দেবদাসের তুমি হলে পূর্ণাঙ্গ প্রতীক।”
“কি আবলতাবল বকছেন রবিন ভাই! ছাইপাস খেয়েছেন টেয়েছেন নাকি! আমি দেবদাস হতে যাবো কোন দুঃখে?”
অর্জুন এবার বিরক্তিমাখা কন্ঠে কথাটা বললো। এতে পাড়ার রবিনভাই এর খুব একটা যায় আসলো না। সে মোটেই তার কথাকে পাত্তা দিলো না। বরং রসিকতার ছলে বললো,
“অর্জুন, আমরা তো তোমার পাড়াতত দাদা। আমাদের কাছে এতো শক্ত হতে হবে না। বুঝি, বুঝি কষ্ট তোমার হচ্ছে। হৃদয় ভাঙ্গার কষ্ট তো যে সে কষ্ট না”
“রবিন ভাই, আপনি যা ভাবছেন তেমন না।”
রবিন মাথা নাড়লো, সে মোটামুটি পণ করেছে কোনোভাবেই অর্জুনের কথায় বিশ্বাস করবে না। এদিকে অর্জুন অধৈর্য হয়ে গেলো। মাঝখানে প্রতীক বলে উঠলো,
“তবে আমাদের প্রথমে বিশ্বাস হয় নি জানিস, এতো মেয়ে ছেড়ে কি না অন্নার পেছনে ছুটলি?”
“আমি আসলেই অন্নার পেছনে ছুটে ক্লিনিক গিয়েছি”
“আহারে! একটা মেয়ের পেছনে এতো সময় দেওয়া কি যাচ্ছে তাই কথা! আবার সে যদি হয় পড়ুয়া অর্জুন”
প্রতীকের কথার প্রতিবাদ করে রবিন ভাই বললো,
“প্রেম করেছিস জীবনে? প্রেম হলো সময়ের ব্যাপার। যেমন করে একজন মালী ফুল চাষ করে, প্রেমিককেও যেভাবেই প্রেম চাষ করতে হয়”
“রবিন ভাই, আমি না হয় প্রেম করি নি। কিন্তু আপনিও যে সফল প্রেমিক মানতে পারছি না। তানি আপুকে তো সেদিন দেখলাম। কথা বলতে গেলাম, প্রথমে ভালো করেই কথা বলছিলো। যেই আপনার কথা বললাম অমনি ঝা’ড়ি খেলাম আমি আর বিদ্যুৎ”
তানির কথা শুনতেই রবিন ভাই গলা খাকারি দিলো। তার দীর্ঘদিনের প্রেমটা এখনো ঝুলন্ত। যদিও হিমুলেনে তিনি প্রেম বিশেষজ্ঞ কিন্তু নিজের প্রেমের ই গতিপথের দিক ঠিক নেই। প্রেমিকা অভিমান করে আছে। কথা টথা বন্ধ। রবিন ভাই কথা ঘোরাবার জন্য বললো,
“আমার কথা ছাড় তো, আমার আর তানির ঠোকাঠুকি আজীবন থাকবে। শোনো, আগুন নিয়ে খেলার সাহস সবার হয় না। আমি আর অর্জুন ই করেছি। আমি যেমন বেঁছে বেঁছে উচ্চতলার গন্ডগোল একজনের প্রণয়ে মাথানত করেছি, অর্জুন ও তেমন খুঁজে খুঁজে একটা উচ্চপর্যায়ের মাথার তারছেড়া নারীতে মত্ত হয়েছি। আমি ঝু’লছি আর অর্জুনের শির কা’টা গেছে। এতোটুকুই পার্থক্য”
রবিনের কথায় করুন কন্ঠে অর্জুন বললো,
“রবিন ভাই, তোমার বোঝার ভুল আছে”
“শির কা’টা যায় নি বলছো? আবার ট্রাই করবে?”
“আরে, ধ্যাত”
বলেই উঠে গেলো অর্জুন। তার মুখশ্রীতে মহা বিরক্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে এই পাড়াতত ভাইদের উপর। সব কটা বেশি বোঝে, না তারা অতিরিক্ত বোঝে। বেশি বোঝার প্রতিযোগিতা হলে তারা নোবেলজয়ী হতো। প্রথমে তারা বানালো “অন্না অর্জুনের প্রেমিকা”। এখন বানিয়েছে “অর্জুন অন্নার দেবদাস”। তবে এই গন্ডগোলের মূলবিন্দু কে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না। এজন্য ই বলেছিলো, “আম খাও, গুটি গুনো না”। সে আমের গুটি দিয়ে আমসত্ত্ব বানিয়েছে। অর্জুন হনহন করে চলে যেতে নিলে রবিন পিছন থেকে ডাকলো,
“ভায়া, চা খাবে না?”
“রাখো তোমার চা, ওতে ডু’বে যাও”
বলেই হনহন করে চলে গেলো অর্জুন। রবিন কিছুসময় হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্জুনের যাবার পানে। বিস্মিত, হতাশ কন্ঠে শুধালো,
“ও হুট করে রেগে গেলো কেনো?”
******
অন্না নতমস্তক বসে রয়েছে। তার সামনে রুদ্ররুপী অর্জুন বসে রয়েছে। তার চোখ থেকে আগুন ঝড়ছে, সেই আগুনে ঝলসে যাচ্ছে অন্না। তার সাহস হচ্ছে না মুখ খোলার। অর্জুন বুড়ো আংগুলের ঢগা দিয়ে কপাল ঘষছে। রাগ দমাতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। গাল ফুলিয়ে কিছুসময় উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়েছে, লাভ হয় নি। গটগট করে দু-তিন গ্লাস বরফ ঠান্ডা লেবুর শবরত খেয়েছে, লাভ হয় নি। পেছন থেকে ১০০ থেকে ১ গুনেও লাভ হয় নি। অন্নাকে আখের মে’শিনে দিয়ে যদি জু’স বানানো যেতো তাহলে হয়তো একটু শান্তি লাগতো। অন্না এবার একটু সাহস করে বললো,
“বই কি খুলবো?”
“তুই কি বলেছিস এবার? আমি তোর পেছনে ছুটে ক্লিনিক গিয়েছি?”
অর্জুন দাঁতে দাঁত পিষে কথাখানা বললো। অন্না মুখ সাথে সাথেই র’ক্তশূণ্য হলো। ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,
“আমি মিথ্যে বলি নি, তুমি তো আসলেই আমার পিছনে ছুটেই বেহুশ হলে, ক্লিনিক গেলে, জ্বর ও হলো”
“তাহলে সবাই আমাকে তোমার দেবদাস বলছে কেন?”
অন্না অকপটে বললো,
“তুমি ই তো বললে, কেউ যেনো না বলে আমি তোমার প্রেমিকা”
“তাই বলে দেবদাস বানিয়ে দিবি?”
“দেখো অর্জুনদা এখানে আমার একটা প্রেসটিজ আছে, তাই তোমার কাছে দুটো অপশন খোলা। হয় আমি তোমার প্রেমিকা হবো নয় তুমি আমার দেবদাস হবে। প্রথমটা তোমার ভালো লাগে নি, এখন দ্বিতীয়টা নিয়ে নকটামি করো না তো”
অন্নার বেপরোয়া উত্তরে বেকুব বনে গেলো অর্জুন। এই মেয়ে তাকে বিনা ওয়ার্নিং এ গোলের পর গোল দিচ্ছে। অর্জুনের বুকে ব্যাথা করছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। সে নিশ্চিত এই নারীর কারণে তার মৃ’ত্যু অনিবার্য। সে হা’তে মা”রবে না, ভাতে মা”রবে। অর্জুন আর এ পাড়ায় থাকবে না, সে হিমালয় চলে যাবে। হয়ে যাবে সন্ন্যাসী। এই পাড়ায় আর থাকা যাবে না। অর্জুনের মাথায় হাত চলে গেলো। তাকে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে অন্না ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,
“তোমার কি খারাপ লাগছে অর্জুন দা?”
“ইচ্ছে করছে, তোকে…”
বলেই মুষ্টিবদ্ধ হাতটা ধরাম করে টেবিলে আঘাত করলো। অন্না ভয় পেলো কিন্তু দমলো না, ধীর স্বরে বলল,
“আমি কিন্তু তোমাকে র’ক্ত দিয়েছি”
“এবার একটু শান্তি দে”
করুন কন্ঠে বললো অর্জুন। অন্না ঠোঁট উল্টালো। এই অর্জুনদা ঠিক কি চায় সে বুঝে না। তার হাত ও যে বাঁধা, নিজের প্রেসটিজ বাঁচাতে তাকে অর্জুনদাকে দেবদাস বানাতেই হলো, নয়তো মীরজাফলের দলের কাছে মুখ থাকবে না। অর্জুনদার প্রেমিকার হবার সুবাদে যে উচ্চসম্মানটা পাচ্ছিলো সেটা তো খোয়ানো যায় না। তাই তো অর্জুনদাকে দেবদাস বানানোই শ্রেয় মনে হলো অন্না। রয়ে সয়ে বললো,
“আজ তাহলে পড়া বাদ?”
অর্জুন করুন দৃষ্টিতে চাইলো অন্নার দিকে। কোন কুলক্ষণে যে পড়াতে চেয়েছিলো, আজ আফসোস হচ্ছে। ভেবেছিলো মেয়েটিকে ইশারায় নাচাবে, এখন সেই তুর্কিনাচন নাচছে_______
*****
মহালয়া চলে এসেছে, শুভ্র মেঘের আস্তরণে পুজো পুজো গন্ধ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বৃহৎ উৎসব। হিমুলেনের যুবসমাজেও বেশ স্পৃহা দেখা গেলো। প্রতিবছরের ন্যায় এই বছরের প্যান্ডেল যুবসমাজ নিজেই করবে। মুসলিমরা কেনাকাটা এবং পরিকল্পনায় সহায়তা করবে। মোস্ট সিনিয়র রবিন ভাই এর নেতৃত্বে একটা কমিটি গঠন হলো। যদিও রবিন ভাই সেখানের কিছুই নয় তবুও তাকে যুবসমাজ প্রচুর সম্মান করে। বিকেলে সবাই জড়ো হলো, পাড়ার মেয়েরাও এখানে এসেছে। সবাই নিজ নিজ কাজ ভাগ করে নিচ্ছে। প্রতীক এবং বিদ্যুৎ হলো কমিটি হেড। সকলকে দায়িত্ব তারাই ভাগ করে দিবে। পুজোর আর বেশি দিন বাকি নেই। তাই সবার উৎসাহের অন্ত নেই। অন্না উপস্থিত হলো শেষ বিকেলে। তাকে দেখতেই সকলের চোখ চলে গেলো অর্জুনের দিকে। বেশ বিব্রতকর একটা পরিস্থিতি। এই কারণেই অর্জুনের আসার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু তার একজন অতিউৎসাহী মা রয়েছে। কাকলী দেবী ঠেলেঠুলে ছেলেকে পাঠিয়েছেন। অর্জুন ব্যাপারটা উপেক্ষা করার চেষ্টা করলো কিন্তু তার পূর্বেই বিদ্যুৎ বললো,
“আমরা যেহেতু চাকরি করি তাই সাজসজ্জার কেনার কাজটা আমরা নিতে পারবো না। এই কেনাকাটাটা অর্জুন করুক। আর অন্নপূর্ণা তাকে সহায়তা করবে। একই বাড়ির উপর নিচ থাকে। ব্যাপারটা অপ্রীতিকর ও হবে না”
বিদ্যুতের প্রস্তাবে অর্জুনের চক্ষু চড়ক গাছ। অন্নাও রীতিমতো বিষমখেলো। অর্জুন তখন চোখ ঘুরিয়ে পেছনে বসে থাকা রবিন ভাই এর দিকে তাকালো। সে মিটিমিটি হাসছে এবং হাতের বুড়ো আঙ্গুল দেখাচ্ছে। অর্জুনের ব্যার্থ বানোয়াট প্রেমকাহিনী সফলের এটাই তার প্রথম প্রচেষ্টা……..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি