নীল চিরকুট #লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা ১৩.

0
1389

#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

১৩.

নম্রতা পাঁচ-দশ মিনিট সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল,

‘ আসলে, সকালে খুব ডিস্টার্ব ছিলাম। কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছিলাম খুব। তাই অন্যমনস্কভাবে হঠাৎই দুটো উইয়ার্ড শব্দ বেরিয়ে গিয়েছিল মুখ থেকে। ট্রাস্ট মি! আমি ইচ্ছে করে বলিনি। আর না আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছি। কসম!’

বেশ কিছুক্ষণ পর আরফান উত্তর দিল,

‘ তাই নাকি? তো, কি বলেছিলেন? আই মিন, হঠাৎ বেরিয়ে আসা উইয়ার্ড শব্দদুটো কী ছিল? আমার ঠিক মনে পড়ছে না।’

রাগে নম্রতার ফর্সা নাক লাল রঙ ধারন করল। বাঘিনীর মতো ফুঁসতে ফুঁসতে ঢকঢক করে বোতলের পুরো পানি সাবাড় করল। ডানহাতের পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে চেয়ার পা গুটিয়ে বসল। প্রচন্ড রাগে গায়ে ঘাম দিচ্ছে তার। পিঠজুড়ে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোকে হাত খোঁপা করে আবারও ফোনের দিকে তাকাল নম্রতা। মাথার উপর ক্যাট ক্যাটে শব্দ তুলে ঘুরে চলেছে পাখা । নম্রতার মনে হচ্ছে, এই পাখায় বাতাসের থেকে শব্দই পাওয়া যাচ্ছে বেশি। ‘খালি কলসি বাজে বেশি’ টাইপ অবস্থা। কিছুতেই ঘাম বন্ধ হচ্ছে না। নম্রতা চোখ বোজে জোরে জোরে দম নিল। ওই অসভ্য লোকটা শুধু অসভ্য নয়, ভয়ানক থেকে ভয়ানক ফাজিলও। ইচ্ছে করে ছ্যাচলামো করছে। বেয়াদব। এইসব বেয়াদব দিয়ে হাসপাতাল ভরে থাকলে রুগীরা সুষ্ঠু চিকিৎসা পাবে কোথায়? দেখা যাবে, অপারেশন থিয়াটারে দাঁড়িয়েও এদের ছ্যাচলামো, ফাজলামো শুরু হয়ে গিয়েছে। নম্রতাকে যেমন সব জেনেশুনেও জিগ্যেস করছে, ‘ওই হঠাৎ বেরিয়ে যাওয়া উইয়ার্ড শব্দ দুটো কী?’ ঠিক তেমনই অপারেশন বাদ দিয়ে রুগীকে জিগ্যেস করবে, ‘ আপনার এই উইয়ার্ড রুগের পেছনে কারণ কী? বিশ্লেষণ করুন তো শুনি।’ নম্রতা বিপন্ন দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল। এখন কী উত্তর দিবে সে? উফ্ ভাল্লাগে না। নম্রতা বার কয়েক ঘন ঘন দম নিয়ে লিখল,

‘ নেতিবাচক বিষয়গুলো মনে না থাকায় ভালো। সেগুলো মনে না করিয়ে দেওয়া আরও ভালো। আপনার মনে নেই শুনে স্বস্তি পেলাম। আপনি প্লিজ সরিটা একসেপ্ট করে নিন। ক্ষমা করা মহৎ গুণ।’

‘ তাই নাকি? কে বলেছে?’

‘ সবাই বলে। তাছাড়া আল্লাহ ক্ষমাশীল ব্যক্তিকে পছন্দ করেন। আজকাল, মানুষ নিজের হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিচ্ছে আর আপনি ওই ছোট্ট দুটো শব্দের জন্য আস্ত একটা সরি একসেপ্ট করতে পারবেন না?’

বেশ কিছুক্ষণ পর উত্তর এলো,

‘ আপনি খুবই হিপোক্রিট মহিলা। নিজের কথার প্রতি নিজেরই ভরসা নেই ঠিকঠিক।’

‘হিপোক্রিট’ শব্দটা শুনেই নম্রতার মিইয়ে থাকা আগুনটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। এতো বড় সাহস! এই লোক নম্রতাকে হিপোক্রিট বলে। নম্রতাকে? রাগে হাত-পা কাঁপছে নম্রতার। মাথা ধরে যাচ্ছে। এই লোকটা আস্ত শয়তান, অসভ্য। যে কুক্ষণে এই লোকটাকে নক করতে গিয়েছিল, সেই কুক্ষণটাকে কেঁটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে ইচ্ছে করছে নম্রতার। ইনবক্স ভর্তি গালি দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, ব্যাটা তুই হিপোক্রিট, ম্যানারলেস। নাও গো টু হেল। কিন্তু বলা যাচ্ছে না। এহেন অপমান সহ্যও করা যাচ্ছে না। রাগে-দুঃখে-বাধ্যবাধকতায় কান্না পেয়ে যাচ্ছে নম্রতার। কিছুক্ষণ চোখ বোজে বসে থেকে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিল নম্রতা। তারপর আরফানের কথাটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে উত্তর দিল,

‘ এসাইনমেন্টে আপনার সাইন লাগবে। ইট’স ইমারজেন্সি। প্লিজ।’

‘ আমাদের মতো ফালতু ডাক্তার থেকেও সাইন লাগে নাকি আজকাল?’

‘ লাগছে তো।’

‘ কখন চাই?’

‘ দশটায়।’

‘ দশটায় আমার ক্লাস আছে।’

‘ প্লিজ স্যার। প্লিজ। কৃতজ্ঞ থাকব।’

নম্রতা দাঁতে দাঁত চেপে আবারও লিখল,

‘ কালকেই জমা দিতে হবে। নয়তো ঝামেলা হয়ে যাবে। প্লিজ, স্যার। ‘

‘ সাড়ে দশটায় চলবে?’

‘ চলবে চলবে।’

‘ বেশ! আসবেন সাড়ে দশটায়।’

নম্রতা হাফ ছেড়ে বাঁচল। ফোনটা রেখে বিছানায় যেতে যেতে মাথায় একটা চিন্তায় খেলে গেল। এই বেয়াদব লোকটিকে শুকনো কথায় ছেড়ে দিলে তো চলবে না। ভয়ানক কিছু ভাবতে হবে। এই লোককে হাই লেভেলের অপমান না করতে পারলে ঠিকঠাক ঘুমও হবে না নম্রতার। বিশাল যন্ত্রণা।

ভার্সিটির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে বই ঘাটছিল নীরা। তার পাশের সেল্ফ থেকেই সাইকোলোজির উপর কোনো একটা বই খুঁজছিল অন্তু। অন্তুর চোখ-মুখ আজ গম্ভীর, থমথমে। কাল থেকে নীরার সাথে হা-হু ছাড়া কথা বলছে না সে। নীরা খেয়াল করেছে। নম্রতা, ছোঁয়াদের সাথে হাসিমুখে কথা বলে নীরার সাথে এমন নিষ্ঠুরতা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। অন্তু বই হাতে কোণার একটা টেবিলে চেয়ার টেনে বসল। নীরা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্তুর পাশের চেয়ারটাতে বসল। অন্তুর গায়ে কালো রঙের পাতলা টি-শার্ট। ছিমছিমে কালো গায়ে কালো রঙটা বেশ মানিয়েছে। পরিপাটি চুল আর শক্ত চিবুকে আকর্ষনীয় দেখাচ্ছে। নীরা গলা খাঁকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। অন্তু ফিরেও তাকাল না। গভীর মনোযোগে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগল। নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচু কন্ঠে জিগ্যেস করল,

‘ তুই ঠিক আছিস?’

অন্তু চোখ তুলে তাকাল। অবাক হয়ে বলল,

‘ আমাকে বলছিস?’

‘ এখানে আর কেউ আছে?’

অন্তু তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,

‘ ঠিক থাকব না কেন? আমার কী বেঠিক থাকার কথা ছিল নাকি?’

নীরা আহত কন্ঠে বলল,

‘ এভাবে কথা বলছিস কেন?’

অন্তু বই থেকে মুখ উঠিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। ভারি অবাক হয়ে বলল,

‘ কিভাবে কথা বলছি?’

‘ কেমন ঠেস মারা কন্ঠে কথা বলছিস। শুনতে খারাপ লাগছে।’

অন্তুর সহজ উত্তর,

‘ খারাপ লাগলে যেচে পড়ে কথা বলতে আসছিস কেন?’

‘ তুই দু’দিন যাবৎ খুব রুড বিহেভ করছিস আমার সাথে। কি করেছি আমি?’

অন্তুর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। টেবিলের নিচে থাকা নীরার বাম হাতের কনুইয়ের নিচে শক্ত করে চেপে ধরল। হেঁচকা টানে নীরাকে নিজের দিকে এনে রক্তলাল চোখে তাকাল। তপ্ত কিন্তু ধীর কন্ঠে বলল,

‘ তোর সাথে সবসময় আদর আদর কন্ঠে কথা বলতে হবে এমন কোনো চুক্তি ছিল নাকি আমার?’

নীরা চাপা স্বরে বলল,

‘ অন্তু হাত ছাঁড়। লাগছে।’

অন্তুর হাতের থাবা আরও খানিকটা শক্ত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ লাগুক। আমারও লাগছে। তিন বছর ধরে কন্টিনিউয়াসলি লাগছে। কই? আমি তো অভিযোগ করি না। তাহলে তোর এতো হাসফাস কেন?’

‘ ছাঁড় অন্তু।’

‘ আমাকে ভালোবাসিস না কেন?’

‘ অন্তু এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।’

‘ হোক বাড়াবাড়ি। বল, কেন ভালোবাসিস না আমায়? কেন? কি করলে ভালোবাসবি?’

বিরক্তি আর রাগে চোখ-মুখ কুঁচকে এলো নীরার। জারি দিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,

‘ জোরজবরদস্তি নাকি? ভালোলাগে না তাই ভালোবাসি না। এখন কি জোর করে ভালোবাসাবি আমায়? এতোটা নীচে নেমেছিস তুই।’

অন্তু এবার রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেল। ইচ্ছে করেই হাতের বাঁধনটা শক্ত করল সে। রাগান্বিত মস্তিষ্ক নীরাকে কষ্ট দিতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত কোমল মনের সাথে পেরে উঠল না। হাতটা ঝাঁকি দিয়ে ছেড়ে দিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে হিসহিসিয়ে বলল,

‘ ভালোবাসিস না অথচ সস্তা মেয়েদের মতো আগেপিছে ঘুরিস কেন? খবরদার আশেপাশে আসবি না আমার।’

নীরা হতভম্ব চোখে অন্তুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ থেকে টসটসে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। অন্তু সত্যিই কথাটা বলল? তাকে সস্তা, নোংরা মেয়েদের সাথে তুলনা করতে পারল? কন্ঠে আটকাল না? নীরা কী সত্যিই এতো সস্তা? নীরার বুকের ভেতর উথলে উঠল কান্না। বইটা টেবিলের ওপর রেখে সেল্ফের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়াল। এতো কষ্ট হচ্ছে কেন তার? অন্তুর কথাগুলো ঘুরেফিরে কানে এসে বাজছে। নীরা দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠে। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়। ওড়নার আঁচল কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ নিঃশব্দ অশ্রু বিসর্জন করে। মনে মনে খুব করে কামনা করে, এই সস্তা আমিটার যেন খুব জলদিই মরণ হয়। খুব খুব জলদি মরণ হয়। এই সাংসারিক টানাপোড়েন। পরিবার আর মান-সম্মানের চিন্তায় অস্থির থাকার চেয়ে মরণটা কি সহজ নয়?

#চলবে…

[ ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত। কাল বড় করে দিতে পারতাম। কিন্তু ছোট করে হলেও খানিকটা রেগুলার হওয়ার চেষ্টা করছি বলেই আজ দেওয়া। তাড়াহুড়ো করে লিখেছি। রি-চেইক করা হয়নি। ধন্যবাদ। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here