নীল চিরকুট #লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা ১৬.

0
1468

#নীল চিরকুট
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

১৬.

আকাশ থমথমে। বোধহয় বৃষ্টি হবে। ভ্যাপ্সা গরমে জ্বলে যাচ্ছে গা। গাছের পাতায় হেলদোল নেই। পশ্চিম আকাশে ঘন মেঘের ছায়া। নম্রতা হাসপাতালের করিডোরে উদাস বসে আছে। চোখদুটো অনুভূতিশূন্য। দূর আকাশে দু-তিনটি কালো পাখি উড়াউড়ি করছে। অলস পাখা মেলে একই জায়গায় ফিরে ফিরে আসছে তারা। আচ্ছা? এই পাখিগুলোর কী ভয় নেই? এই যে বৈশাখী রাজকন্যা তার সখীসহ থমথমে মন খারাপ নিয়ে বসে আছে। চোখে তার একরাশ অভিমান। সেই অভিমান দেখে পাখিদের ভয় হয় না? অভিমানী জলে ভেজার, বজ্রপাতে ভস্ম হয়ে যাওয়ার ভয় কী তাদের হতে নেই? নাকি তারাও নম্রতার মতোই অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে আজ? ভীষণ প্রিয় কারো খুঁজে তারাও কী ঘরদোর ছেড়ে নিরুদ্দেশ আকাশ পথে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে? নম্রতা যেমন বেড়াচ্ছে ওই চেম্বারটার আশেপাশে? দূরের আকাশে চোখ রেখেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল নম্রতা। শরীরটা দুর্বল লাগছে। এক ঘন্টা যাবৎ ঠাঁই বসে থাকায় পা’দুটো ঝিঝি করছে। নম্রতা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাল। নাদিম আর অন্তু হাত ভাঁজ করে বসে আছে। নাদিমের চোখ দুটো ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে। ঘামে ভিজে আছে শার্টের সামনের দিকটা। নম্রতা বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘ তোদের না বললাম চলে যেতে? বসে আছিস কেন শুধু শুধু?’

নাদিম ঘুম মাখা চোখে ঘড়ি দেখল, চারটা বায়ান্ন। তারপর মাথাটা দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে আরাম করে বসল। এখন একটু ঘুমিয়ে নেবে সে। হাসপাতালের শান্ত পরিবেশে একটু পজিশন করে বসলেই দারুণ ঘুম ঘুমানো যায়। অযথা ক্যাচ ক্যাচ ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ নেই। বাড়তি বালিশ-কাঁথার ঝামেলাও নেই। রাতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা টাড্ডা দিয়ে দুটোর দিকে বই নিয়ে বসেছিল নাদিম। পড়তে পড়তে কখন যে সকাল হয়ে গিয়েছে খেয়াল করেনি। সাড়ে নয়টা থেকে টানা দুটো ক্লাস করে টিউশনি করাতে গিয়েছে শহীদ সারণী এলাকায়। সেখান থেকে শাহবাগ গ্রন্থগার। নম্রতার পাগলামো আর জেদের জন্য শাহবাগ থেকে আরফান আলমের চেম্বারে। আরফান আজ ভীষণ ব্যস্ত। এই ব্যস্ত সময়ে অযথা দেখা টেখা করার সময় নেই তার। ক্লাস, রোগী, হাসপাতালের ডিউটি সব মিলিয়ে নাকি শ্বাস ফেলারও সময় পাচ্ছে না সে। আপাতত নাদিমদের তাই জানানো হয়েছে। কিন্তু নম্রতা নাছোড়বান্দা। সে কিছুতেই হলে ফিরবে না। আরফান বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত হসপাতালে থাকে না। আরফান পাঁচটায় যখন হাসপাতাল থেকে বের হবে ঠিক তখনই কথা বলবে নম্রতা। দরকার হলে জোর করে কথা বলবে। কিন্তু আরফানের সাথে কথা টথা না বলে সে যাবে না, মানে যাবে না। নাদিমের পেটে মোচড় দিয়ে উঠল। তল পেটে যন্ত্রণা করতেই মনে পড়ল, সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি তার। সময় হয়নি। টাকাও ছিল না। আগের মাসে সেমিস্টার ফাইনালের চাপে টিউশনি করানো হয়নি। বেতনও জুটেনি। যা টাকা ছিল সেগুলো এবারের ঢাকা টু কক্সবাজার ট্যুরেই উবে গিয়েছে। সকালে পকেটে পঞ্চাশ টাকা ছিল। তিনদিন কোনরকম সকালের খাবার হয়ে যেত এই টাকায়। শাহবাগ গ্রন্থগারে আসার সময় তাড়াহুড়োয় বিশ টাকা রিক্সা ভাড়া দিতে হয়েছে তাকে। আজকাল রিকশা চালকদের যা দেমাক! নাদিম ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করল। এই মুহূর্তে নম্রতার সাথে ফাউ কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না তার। তবে অন্তু চুপ থাকল না। ধমক দিয়ে বলল,

‘ বেশি পাকনামো করিস? তোকে এই অবস্থায় একা রেখে চলে যাব আমরা? বসে থাকতে ইচ্ছে করছে বসে থাক। আমরাও বসে থাকব। বেহুদা খ্যাচ খ্যাচ করে মাথা খাবি না।’

নম্রতা কিছু বলার আগেই চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো আরফান। ক্লান্ত আরফানের গায়ে নীল-সাদা চেইক শার্ট। পরনে ডেনিম জিন্স। ডানহাতের কব্জির ওপর সাদা ঝকঝকে ঘড়ি। মাথার পরিপাটি চুল থেকে পায়ের পোলিশ করা জুতোজুড়ে স্মার্টনেসের ছড়াছড়ি। আরফানকে দেখেই সটান দাঁড়িয়ে পড়ল নম্রতা। আরফান নম্রতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পাশ কাটাতেই দৌঁড়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াল নম্রতা। আরফান আবারও পাশ কাটানোর চেষ্টা করতেই আবারও সামনে গিয়ে দাঁড়াল নম্রতা। বেশ কিছুক্ষণ পাশ কাটানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ক্লান্ত চোখদুটো মেলে নম্রতার মুখের দিকে তাকাল আরফান। সেই নিষ্পাপ চাহনিতেই কেমন বিভ্রান্ত হয়ে গেল নম্রতা। এই লোকের চোখে অদ্ভুত কিছু আছে। এই চোখের চাহনিতে কেমন এক সম্মোহনী শক্তি আছে। গুছিয়ে রাখা কথা, গুছিয়ে রাখা সময়গুলোকে এলোমেলো করে দেওয়ার শক্তি। নম্রতাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে গমগমে কন্ঠে বলল আরফান,

‘ পথ ছেড়ে দাঁড়ান। আমি যাব।’

নম্রতা আরফানের চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,

‘ আপনার সাথে আমার কথা আছে। জরুরি কথা।’

আরফানের ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

‘ আমার সাথে আপনার জরুরি কথা? আবারও সরি বলতে এসেছেন নাকি? জেনে রাখুন, আপনার সরির কোনো প্রয়োজন আমার নেই। পথ ছাড়ুন।’

কথাটা বলে পাশ কাটাতে নিতেই আবারও সরে এসে সামনে দাঁড়াল নম্রতা। আরফান চোয়াল শক্ত করে বলল,

‘ সমস্যা কি আপনার?’

‘ বললাম তো, কথা আছে।’

‘ কিন্তু আমার সময় নেই। আমি ব্যস্ত আছি। এই দুই ঘন্টা আমার জন্য খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনার গুরুত্বহীন ফালতু কথার পেছনে আমি আমার প্রয়োজনীয় সময়টুকু নষ্ট করতে চাইছি না। দয়া করে পথ ছাড়ুন।’

নম্রতা নরম কন্ঠে বলল,

‘ দেখুন। আমার সত্যিই আপনার সাহায্যের প্রয়োজন। আপনি আপনার বন্ধু নিষাদের ফোন নাম্বারটা দিন। আই প্রমিজ আমি আপনাকে বিরক্ত করব না।’

আরফান বিরক্ত চোখে তাকাল। তার চোখে খেলে গেল নিদারুণ বিতৃষ্ণা। সন্দিহান কন্ঠে বলল,

‘ নিষাদের সাথে আপনার কি কাজ? তাছাড়া, নিষাদ তো বলল সে আপনাকে চেনে। আপনার নাম্বারও হয়ত আছে। সে ইচ্ছে করলেই যোগাযোগ করতে পারে। নিষাদ যেহেতু যোগাযোগ করছে না তারমানে আপনার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ সে করতে চাইছে না। আর বন্ধু হিসেবে নিষাদের ইচ্ছের বাইরে গিয়ে তার ফোন নাম্বার আমি আপনাকে দিতে পারি না। দুঃখিত।’

এটুকু বলেই নম্রতাকে পাশ কাটিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল আরফান। নম্রতা কয়েক সেকেন্ড থম ধরে দাঁড়িয়ে থেকে আরফানের পেছন পেছন দৌঁড় লাগাল। অন্তু-নাদিম একে অপরের দিকে বিস্মিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নাদিম কপাল কুঁচকে বলল,

‘ মাইয়া মানুষ মানেই হারামি। চিন্তা কইরা দেখ অন্তু। একটু আগে যে মাইয়া ফিট মারতাছিল সে এখন ডাক্তারের পিছনে পিছনে দৌড়াইতাছে। শালী! এখন শক্তি কই থেকে আসে শরীরে?’

অন্তু চিন্তিত কন্ঠে বলল,

‘ আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে দোস্ত। এই নিষাদের ব্যাপারটা কী? সব জায়গায় গন্ডগোল লাগাচ্ছে কেন এই লোক? কি হচ্ছে, কিছুই তো বুঝতাছি না।’

নাদিম ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে আবারও চেয়ারে বসে পড়ল। নম্রতার পেছন পেছন ছুটার আর কোনো মানে হয় না। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, এই মেয়ের টাকি মাছের প্রাণ। অতো সহজে মরবে না। ফিটও খাবে না। সুতরাং, চিংড়ি মাছের মতো লাফালাফি না করে স্বস্তিতে ঘুমোনো যাক।

হাসপাতালের বাইরে কিছুদূর হেঁটেই রিকশা নিয়েছিল আরফান। কিন্তু রিকশা চলতে শুরু করার আগমুহূর্তেই কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল নম্রতা। তাড়াহুড়ো করে রিকশায় উঠে বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ আশ্চর্য! এমন রোবটের মতো বসে আছেন কেন? সরে বসুন। আমার জায়গা হচ্ছে না।’

আকস্মিক ঘটনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ল আরফান। খানিকটা সরে বসে ধাঁধা লাগা দৃষ্টিতে তাকাল। নম্রতা ব্যাগটা কোলের উপর রেখে খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

‘ মামা চলুন।’

গোটা ঘটনাটা চোখের সামনে ঘটে যাওয়ার পর কিছুটা ধাতস্থ হলো আরফান। পুরো ব্যাপারটা বুঝে নেওয়ার পর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। যথাসম্ভব শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ আশ্চর্য! আপনি আমার রিকশায় কেন উঠেছেন?’

‘ এটা আপনার রিকশা? আপনি কিনেছেন?’

আরফান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ আমি না কিনলেও আমি ভাড়া করেছি।’

‘ তো? আমি কি বলেছি যে রিকশাটা আপনি ভাড়া করেননি? ভাড়া যেহেতু করেছেন ভাড়াও দিবেন। মানা করেছে কে? দেখুন, আমি জাস্ট আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই।’

আরফান রাগে থমথমে কন্ঠে বলল,

‘ আপনি অত্যন্ত গায়ে পড়া একটা মেয়ে। আমি এই ধরনের মেয়েদের সাথে কথা বলতে পছন্দ করি না।’

অপমানে,দুঃখে চোখদুটো ছলছল করে উঠল নম্রতার। এতোটা অপমান, এতোটা ঘৃণা এর আগে কেউ কখনও করেনি তাকে। নম্রতা খুব দ্রুত সামলে নিল নিজেকে। ওই নিষ্ঠুর মানুষটির জন্যই তো এতো অপমান গায়ে মাখতে হচ্ছে তাকে। ওই নিষ্ঠুর মানুষটিকে হাতের কাছে পেলে সবটা সুদে আসলে শোধ করবে নম্রতা। নম্রতা যতটা কষ্ট পেয়েছে তার থেকেও দ্বিগুণ কষ্ট দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেবে সেই মানুষটাকে। কিন্তু সেজন্য তো তাকে খুঁজে পেতে হবে। যেভাবেই হোক পেতেই হবে। নম্রতা অতি সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আরফানের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,

‘ আপনি আমাকে যা ইচ্ছে ভাবতে পারেন কিন্তু আমার কাছে এছাড়া কোনো উপায়ও নেই। আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন। সেই প্রশ্নের উত্তরগুলো ছাড়া বেঁচে থাকা যাচ্ছে না। একমাত্র আপনার কাছেই আছে সেই উত্তর। উত্তরগুলো দিয়ে দিন। আমি আর বিরক্ত করব না।’

নম্রতার তেজি অথচ ছলছলে দৃষ্টিতে আরফানের মনটা হয়ত কিছুটা নরম হলো। সেই সাথে বিস্মিতও হলো। বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ আপনার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে মানে কী? আমি তো আপনাকে ঠিকঠাক চিনি না পর্যন্ত। কী জানতে চান আপনি?’

‘ নিষাদ আমাকে কিভাবে চেনে? আর উনার কাছে আমার নাম্বারটাই বা কিভাবে আছে?’

আরফান ভারি অবাক হয়ে বলল,

‘ সেটা কী আদৌ আমার জানার কথা? আর আপনি নিষাদকেই বা খুঁজছেন কেন? আপনাদের মধ্যে কী কখনও কোনো সেনসেটিভ সম্পর্ক ছিল? থাকতেও পারে। কিন্তু সম্পর্ক থাকলে তার আপনাকে চেনা বা না-চেনার প্রশ্ন কেন আসছে? আমি কনফিউজড।’

নম্রতা দিশেহারা হয়ে বলল,

‘ আমি নিজেও কনফিউজড।’

বেশ কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ বসে রইল। খানিকবাদে বেশ রয়ে সয়ে প্রশ্ন করল আরফান,

‘ আপনি নিষাদের উপর ক্রাশড? নাকি ভালোবাসেন?’

নম্রতা অসহায় দৃষ্টিজোড়া তুলে আরফানের দিকে তাকাল। ওই চোখ জোড়ায় কী ছিল জানা নেই আরফানের। তবে হঠাৎ করেই মেয়েটার প্রতি বড্ড মায়া হলো তার। আহা! মেয়েটা বোধহয় ভীষণ ভালোবাসে নিষাদকে? ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা তো আরফানও খুব বুঝে। আরফানেরও তো এমনই ভালোবাসাময় এক রাজকন্যা আছে। আরফান এবার নরম কন্ঠে বলল,

‘ ভালোবাসেন?’

‘ জানি না। আমার ভালোবাসার মানুষটি উনিই কিনা জানি না। আমি আসলে কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।’

নম্রতার এমন উত্তরে বেশ অবাক হলো আরফান। ভালোবাসার মানুষকে জানে না মানে? আরফান নম্রতার কথার প্রেক্ষিতে কোনো কথা খুঁজে পেল না। তবে মেয়েটাকে আগের মতো বিরক্তিকর ও অসহ্যও লাগছে না বরং খানিকটা তরল, স্নিগ্ধ অনুভূতি হচ্ছে। আরফান কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের অনুভূতির পরিবর্তন দেখল। মানুষ কি আশ্চর্য জীব। তাদের মন নামক বস্তুটা কতই না ভিন্নতর, কতই অদ্ভুত! আরফান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আপনাদের মধ্যে আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি-না জানি না। আপানাদের কেমিস্ট্রিটাও ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে, নিষাদের পেছনে দৌঁড়ে খুব একটা লাভ হবে বলে মন হয় না। রিসেন্টলি নিষাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে। নিষাদ সর্বদা বাবা-মার বাধ্য ছেলে। ওর বাবা-মা যেহেতু চাইছে বিয়েটা হোক। বিয়েটা হয়ত ও করবেই। আর এজন্যই হয়ত…’

আরফানের কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল নম্রতা। নিষাদের বিয়ে ঠিক? তারমানে নম্রতা যা ভাবছিল তাই? এসব কারণেই কি তবে নম্রতার সাথে যোগাযোগ করেনি নিষাদ? ‘সে’- ও তো তার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসত। সব সময় বাবাকে নিয়ে বিস্তর লিখত। বাবার ইচ্ছে বলেই শিক্ষকতায় যেতে চাইত। নম্রতার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। নিষাদ কি তবে মিথ্যা অভিনয় করেছিল তার সাথে? নীল চিরকুটের সবটাই কী নিতান্তই সময় কাটানোর পসরা ছিল তার? নাকি অন্যকিছু? সবটা কাকতালীয়? নম্রতার বুকে আবারও চাপ পড়ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নম্রতা হা করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল। অস্থিরতায় সারা গায়ে ঘাম দিচ্ছে। নম্রতার হঠাৎ এমন পরিবর্তনে অবাক হলো আরফান। এই মেয়েকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না আরফান।মেয়েটা যেন কেমন ধারার। সব সময় হুটহাট এসে ঝামেলা বাঁধিয়ে দিয়ে আবার কোথায় হারিয়ে যায়। সেদিন ল্যাপটপটা ফেলে দিয়ে কি ভয়ানক ঝামেলাতেই না ফেলে দিল আরফানকে। তারপর আবার এক লঞ্চ মানুষের সামনে নাটক ফাটকও করে ফেলল। চেম্বারে এসে গালি দিয়ে আবার যেচে পড়ে সরিও বলল। আবার কী সব অভদ্র ব্যবহার করল কাল রাতে। এখনও কী নতুন কোনো ঝামেলা করতে চাইছে নাকি এই মেয়ে? আরফান কপাল কুঁচকে নম্রতার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। মেয়েটা এখন বিশ্রীভাবে কাঁপছে। যেকোনো সময় রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে মাথা টাতা ফাটিয়ে কেলেংকারী করে ফেলতে পারে। আরফান তীব্র অস্বস্তি নিয়ে নম্রতার ডানহাতটা ধরল। সন্দিহান কন্ঠে বলল,

‘ আপনি ঠিক আছেন?’

নম্রতা টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। জবাব দিল না। আরফান রিকশা দাঁড় করিয়ে পাশের এক রেস্টুরেন্ট থেকে পানির বোতল কিনে আনল। নম্রতাকে বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ আপনার শরীরটা বোধহয় ভালো নেই। রেস্টুরেন্টে বসবেন একটু?’

নম্রতা কোনরকম মাথা নাড়ল। যার অর্থ, সে রেস্টুরেন্টে বসবে। আরফান একরকম বাধ্য হয়েই দুর্বল নম্রতার এক হাত ধরে রাখল। নম্রতাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে সময় নিয়ে হাতের নাড়ি পরিক্ষা করল। তারপর সেই অদ্ভুত চাহনিটা নম্রতার চোখে মেলে ধরে বলল,

‘ আপনার শরীর আসলেই ঠিক নেই। লাস্ট চেকআপ কবে করিয়েছেন? মনে তো হচ্ছে, প্রেশার লো। আপনার এখনই কিছু খাওয়া উচিত। নয়ত সেন্সলেস হয়ে যেতে পারেন।’

কথা বলতে বলতেই ওয়েটারকে ডেকে কিছু খাবার অর্ডার করল আরফান। অর্ডার দিয়ে ওয়েটারকে বিদায় করার পর ঘাড় ফেরাতেই অসচেতন দৃষ্টি রেস্টুরেন্টের দেয়ালে থাকা ঘড়ির ওপর আটকে গেল, পাঁচটা বিশ। আরফান সময়টা নিজের মনে বিরবির করে সটান উঠে দাঁড়াল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে ডানহাতের কব্জির ওপর থাকা ঘড়িটিতে চোখ বুলাল। মুখ থেকে অস্পষ্ট বেরিয়ে এলো, ‘ওহ শিট!’ নম্রতার দিকে তাকিয়ে অস্থিরতার সাথে বলল,

‘ দেখুন মিস.নম্রতা মাহমুদ। আমি বুঝতে পারছি মানবতার খাতিরে হলেও এই মুহূর্তে আমার আপনার সাথে থাকা উচিত। কিন্তু আমার একটু তাড়া থাকায় আমি পারছি না। কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সারাদিনের ব্যস্ততার মাঝে এই সময়টুকু শুধু তার। আমি অলরেডি লেইট।’

এটুকু বলে থামল আরফান। টেনশন আর অস্থিরতায় অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত কথা বলছে সে। আরফান বড় শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

‘ আপনি খাবারটা খেয়ে নিলেই বেটার ফিল করবেন। আমি রিকশাটা বাইরে রেখে যাচ্ছি। আপনি যেখানে যেতে চাইবেন সে পৌঁছে দিবে। রিকশাচালক আমার পরিচিত। ওকে? আমি আসছি।’

কথাগুলো বলে এক মুহূর্ত দেরী করল না আরফান। হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে। নম্রতা অবাক চোখে পুরো ব্যাপারটা দেখে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কে অপেক্ষা করছে এই অদ্ভুত চাহনির লোকটির জন্য? প্রিয় কেউ? নিশ্চয় প্রিয় কেউ, নয়তো অতো হন্তদন্ত আর অস্থির কেউ হয়? নম্রতার মনটা আবারও বিষাদময় হয়ে উঠল। এই অসভ্য লোকটিও তার প্রিয় মানুষটিকে কত কত ভালোবাসে। তার জন্য কেমন অস্থির হয়ে পড়ে! অথচ নম্রতার সে? তবে কি ভালোবাসা সব সময় ভালোবাসা হয় না? মাঝে মাঝে ভালোবাসাটা ভুলবাসা, মিথ্যাবাসাও হয়? নম্রতার সে-ও কি তবে মিথ্যে বেসেছিল তাকে? সত্যবাসেনি। একটুও ভালোবাসেনি। একটুও না। নয়তো ওভাবে বিয়ের জন্য রাজি হয় কেউ? কই! নম্রতা তো হয় না।

#চলবে….

[ বিঃদ্রঃ ভীষণ ব্যস্ততায় কাটছে সময়। মুখস্থের মতো লিখে গিয়েছি শুধু। বাক্যচয়ন, শব্দচয়ন এবং বানানে বিশদ ভুল থাকতে পারে। রি-চেইক করিনি। আপনাদের চোখে পড়লে দয়া করে নিজ দায়িত্বে ধরিয়ে দিবেন। ধন্যবাদ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here