নীল চিরকুট লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা ৫৬.

0
1246

নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

৫৬.

ইরার কথায় কোনোরূপ উচ্চবাচ্য করল না নীরা। শান্ত চোখে চেয়ে বলল,

‘ তোর ভাইয়া কিছু জানে না। এসব জানার প্রয়োজনও তার নেই। গলার স্বর নিচু করে চুপচাপ বোস। উচ্চবাচ্য করলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না ইরু।’

ইরা জবাব দিল না। চোখ-মুখ শক্ত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নীরা নরম কন্ঠে বলল,

‘ তোর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তা করলে, আমার সেল্ফ রেসপেক্ট নেই। আমার স্বামী-সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু বেরিয়ে যাব তো যাব কোথায় সেটা তো বললি না। বিয়ে ভাঙার পর কম অপদস্ত হতে হয়নি আমায়। নিজের জন্মদাতা মায়ের কাছেও উঠতে বসতে জ্বালাধরা কথা শুনতে হয়েছে। মায়ের কথা সহ্য করতে পারলে শাশুড়ি মায়ের ঝাঁঝ কেন সহ্য করতে পারব না ইরু? উনি শাশুড়ি বলে? জামা-কাপড়ের প্রতি মায়ের দেওয়া রেস্ট্রিকশন মেনে চলতে পারলে শাশুড়ি মায়ের রেস্ট্রিকশন মানতে দোষ কি? আচ্ছা ওসব বাদ দে। ধর, আমি তোর ভাইয়াকে ডিভোর্স দিলাম। কিন্তু তারপর? তোর উত্তর হবে, পড়াশোনা করেছি। নিজের খরচ চালানোর যোগ্যতা আমার আছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পড়াশোনা করলেই কি চাকরী পাওয়া সম্ভব? সব শিক্ষিতদের চাকরী দেওয়ার যোগ্যতা কি সরকারের আছে? ধর, চাকুরীটাও পেয়ে গেলাম। কিন্তু আমার সেফটি?দিনশেষে কে হবে একটু ভরসা? আমার মা? ভাই? অথবা তুই? একবার বিয়ে ভাঙার পর পরই যারা সমাজের রোষানলে পড়ে প্রায় ছাড়তে চলেছিল আমায় তারা কী শেষ পর্যন্ত এই সো কল্ড ডিভোর্সী মেয়ের পাশে থাকবে বলে তোর ধারণা? থাকবে না ইরু। কেউ থাকবে না। এমনকি তুইও না।’

ইরা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই তাকে থামিয়ে দিল নীরা। ভীষণ ধৈর্য নিয়ে ছোটবোনকে বোঝানোর চেষ্টা করল,

‘ সব জায়গায় প্রতিবাদ করতে নেই ইরু। সব প্রতিবাদ সুখ ঢেকে আনে না। মাঝে মাঝে সহ্য করে নিতে হয়। মানিয়ে নিতে হয়।’

ইরা ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

‘ সহ্য? এটা সহ্যের পর্যায়ে পড়ে বলে তোমার ধারণা? উঠতে বসতে নিজের যোগ্যতা, পরিবার, ভূষণ-ভাষণ নিয়ে খোঁটা খেয়ে চলা তোমার কাছে মানিয়ে নেওয়া? সারাজীবন এভাবে মানিয়ে মানিয়েই কাটিয়ে দিবে তুমি? সারাদিন গাধার মতো খাটছ। তাদের তালে তালে নাচছ তবুও প্রাপ্য সম্মানটুকু নেই। এটা বাড়ির বউয়ের নমুনা? এমন হলে আমি কারো বাড়ির বউ হতে চাই না। এমন নিকৃষ্ট জীবন থেকে একটা গৃহপালিত পশুর জীবনও বেশি প্রেফার করব আমি। তাদের অন্তত দুই লোকমা ভাতের বিনিময়ে উঠতে বসতে অপমান গিলতে হয় না। তোমাদের এই মানিয়ে নেওয়া তদবিরের জন্যই সমাজের এই অবস্থা। আজ তুমি মানিয়ে নিচ্ছ। কাল তোমার মেয়ের মাথাতেও এই একই বীজ ঢুকাবে। পরশু সেই-ও মানিয়ে নিবে। এই মানিয়ে নেওয়ার ট্রেন্ডগুলো দিয়ে সমাজটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে তোমার মতোই কিছু সতীসাবিত্রী। নিজের জীবনটা নরক বানানোর পাশাপাশি নিজের ভবিষ্যৎ সন্তানের জীবনটাও নরক বানাচ্ছ। তোমার নিজের প্রতি ঘৃণা আসছে না আপু?’

নীরা স্তম্ভিত চোখে চেয়ে রইল। ইরা নিজের রাগ ধরে রাখতে না পেরে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিল। নীরার সামনে চেয়ার টেনে বসল। টেবিলের সামনে থেকে চেয়ার টেনে নিতেই প্রচন্ড শব্দ হলো মেঝেতে। ইরা ক্ষোভ নিয়ে বলল,

‘ তুমি এক সময় আমার আইডল ছিলে আপু। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য যে সংগ্রামটা তুমি করেছিলে, যে সাহসটা দেখিয়েছিলে সেই সাহসটা ছিল আমার অনুপ্রেরণা। আমার ভেতরটা বদলে গিয়েছিল আপু। আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, তুমি অন্যরকম। সমাজের বিশ্রী নিয়মগুলোতে বাঁধা পড়ার মানুষ তুমি নও। কিন্তু আমি ভুল। তুমি পাল্টে গিয়েছ আপু। আজ এতোদিন পর তোমাকে আমার মেরুদণ্ডহীন বলে মনে হচ্ছে। আত্মসম্মানহীন বলে মনে হচ্ছে। আর এমন একজন মানুষের জন্য মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েছ যার কাছে তোমার বিন্দুমাত্র সম্মানটুকু নেই। আমি বিস্মিত হয়ে দেখছি, একটা মানুষ কিভাবে তার ভাইকে নিজের স্ত্রীর ড্রেসআপের কথা বলতে পারে? নিজের স্ত্রীর পোশাক নিয়ে আলোচনা কি ভাইয়ের সাথে শোভা পায়? কতটা কাপুরুষ সেই ব্যক্তি। ছিঃ!’

নীরার চোখদুটো টলমল করে উঠল। বুকের ভেতর কিছু একটা ভেঙে গুঁড়ো হলো। ইরার অনবরত ছুঁটতে থাকা ঠোঁটদুটোর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল নীরা। ভাষাহীন, অনুভূতিহীন চোখদুটোতে নামল ফোঁটা ফোঁটা সাদা বৃষ্টির নহর।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই মায়ের থমথমে মুখ দেখল অন্তু। দুই একটা প্রশ্ন করেও উত্তর না পেয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। দরজার কাছাকাছি আসতেই ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলো ইরা। ইরার থমথমে, রাগান্বিত চোখ-মুখ দেখে কিছুটা থমকাল অন্তু। হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘ কি ব্যাপার? ব্যাগ হাতে কোথায় যাচ্ছ?’

‘ বাড়ি ফিরছি।’

‘ বাড়ি ফিরছ মানে? এই সন্ধ্যাবেলা একা কিভাবে যাবে তুমি? যেতে যেতে কত রাত হবে ধারণা আছে? আজ রাতটা আপাতত থাকো। আমি নাহয় কাল পৌঁছে দেব তোমায়।’

ইরা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল,

‘ যাকে সঙ্গ দেওয়ার কথা তার খোঁজটাও তো নিতে পারেননি ভাইয়া। অযথা আমার প্রতি মায়া দেখিয়ে কি লাভ? কাপুরুষদের পুরুষসুলভ অভিনয় আমার একদমই পছন্দ নয়, ভাইয়া।’

ইরার অপ্রত্যাশিত উত্তরে হতবুদ্ধি হয়ে গেল অন্তু। ততক্ষণে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে নীরা। চোখ-মুখ ঈষৎ লাল। শাড়ির আঁচল অবিন্যস্ত। নীরা কন্ঠে কঠোরতা ঢেলে বলল,

‘ ভদ্রভাবে কথা বল ইরু।’

ইরা প্রায় সাথে সাথেই উত্তর দিল,

‘ এটাই তো আমার সমস্যা আপু। আমি যার তার সাথে ভদ্রতা বজায় রাখতে পারি না।’

ইরার উগ্র ব্যবহারে অবাক হলো অন্তু। সবার চোখ-মুখের গম্ভীরতা দেখে কিছু একটা আঁচ করল সে। নীরার মুখের দিকে চেয়ে অকৃত্রিম উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ কি হয়েছে?’

নীরাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অন্তুকে পাশ কাটিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল ইরা। অন্তুকে স্তম্ভিত করে দিয়ে, সকলের নিষেধকে উপেক্ষা করে, ভরা সন্ধ্যায় রূপগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হলো ইরা। অন্তু নিজের দোষ বুঝতে না পেরে অসহায় চোখে চেয়ে রইল শুধু!

_

অফিস থেকে ফিরেই মেয়ের ঘরে উঁকি দিলেন নুরুল সাহেব। অন্ধকারে ডুবে থাকা ঘরটিতে ঝাপসা জ্যোৎস্নার আলো। ঘরজুড়ে হিম ধরা নিস্তব্ধতা। নুরুল সাহেব সাবধানে দরজায় এসে দাঁড়ালেন। খোলা জানালার মুখে, জ্যোৎস্নায় ডুবে থাকা রমণীকে দেখতে পেয়ে মৃদু হাসলেন। রমনীর বাঁধনছাড়া উন্মুক্ত চুলে তখন ঢেউ খেলানো জ্যোৎস্নার মেলা। নুরুল সাহেব ধীর পায়ে জানালার মুখোমুখি বিছানায় এসে বসলেন। আদুরে কন্ঠে ডাকলেন,

‘ নমু মা?’

নম্রতা চমকে তাকাল। পরমুহূর্তেই বাবার উপস্থিতি টের পেয়ে ঝলমল করে উঠল তার মুখ। জানালা থেকে সরে গিয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসল। হাসিমুখে বলল,

‘ শুভ সন্ধ্যা, বাবা।’

নুরুল সাহেব হাসলেন। নম্রতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

‘ তোর সাথে কিছু কথা ছিল মা।’

নম্রতা আগ্রহ নিয়ে তাকাল। নুরুল সাহেব ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে বলল,

‘ তুই কি এখন বিয়ের জন্য তৈরি মা? ডাক্তার আরফানের বাড়ি থেকে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। আমরা কি এগোব।’

নম্রতা উত্তর দিল না। নুরুল সাহেব আবারও বললেন,

‘ জীবনটা যেহেতু তোর। জীবন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও হবে শুধু তোর। তোর যদি মনে হয়, তুই তৈরি আছিস তাহলে আমরা এগোব। আর যদি মনে হয় আরও সময় প্রয়োজন তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। আমার কাছে সবচেয়ে ইম্পোর্টেন্ট হলো তোর হ্যাপিনেস। তুই খুশি তো পৃথিবী খুশি। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নে, কোনো তাড়াহুড়ো নেই।’

নুরুল সাহেবের কথা শেষ হতেই চোখ ধাঁধানো আলোয় ভরে গেল ঘর। নম্রতা আর নুরুল সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালেন। নম্রতার মা এক হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে গটগট করে ভেতরে ঢুকলেন। তার পেছন পেছন এলো নন্দিতা। খাবারের ট্রে-টা টেবিলের উপর রেখে গম্ভীর কন্ঠে ঘোষণা করলেন মেহরুমা,

‘ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার নেই। আমি এসব ডাক্তার-ফাক্তারের কাছে মেয়ে বিয়ে দেব না। আজ ঢাকা আছে কাল যদি কোনো পাড়াগাঁয়ে পোস্টিং হয় তখন? বড় আপার ছেলের পোস্টিং কোথায় হয়েছিল দেখোনি? ঠিকঠাক যোগাযোগ সুবিধা পর্যন্ত নেই। ওখানে আমার মেয়ে কেমন থাকবে কে জানে?মেয়েকে আমি ঢাকার বাইরে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমুতে পারব? মেয়ের উপর যদি ওরা অত্যাচার টত্যাচার করে?’

মেহরুমার কথায় তিন জোড়া চোখ স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল। তিনজন একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে আবারও মেহরুমার দিকে তাকাল। নুরুল সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

‘ তোমার দূরদর্শী চিন্তায় মুগ্ধ আমি মেহরুমা। ইউ আর আ গ্রেট উইমেন। কি আশ্চর্য! এই দূর্দান্ত যুক্তিগুলো আমার মাথায় কেন এলো না মেহরুমা?’

নন্দিতা মুখ টিপে হাসল। মেহরুমা ক্ষেপে উঠে বললেন,

‘ এই তুমি আমার সাথে ফাজলামো করছ?’

নুরুল সাহেব সরল গলায় বললেন,

‘ হ্যাঁ, করছি। তোমার কথাবার্তা ফাজলামো করার মতোই বলে মনে হচ্ছে। গ্রো আপ মেহরুমা।’

মেহরুমা জ্বলে উঠে বললেন,

‘ কেন? কি এমন বলেছি আমি? আমার মেয়েকে নিয়ে আমার চিন্তা থাকবে না? আমার ভোলাভালা মেয়ে, সংসারের জুত ঝামেলা বুঝে কিছু? আমি এমন জায়গায় মেয়ে দেব যেখানে তার এক গ্লাস পানি পর্যন্ত ঢেলে খেতে হবে না।’

নুরুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চশমা পরিষ্কার করতে করতে বিরবির করলেন,

‘ নির্বোধ মহিলা।’

মেহরুমা রাগান্বিত চোখে তাকালেন। বাবা-মার ঝগড়ার প্রথম পর্যায় দেখে মৃদু হাসল নম্রতা। নুরুল সাহেব শান্ত কন্ঠে বললেন,

‘ আরফান নামক ছেলেটিকে আমি দেখেছি। দূর্দান্ত ছেলে, জেন্টেলম্যান। অত্যাচার তো দূর, তোমার মেয়েকে মাথায় তুলে রাখবে। এরপরও যদি সেটিসফেকশন না আসে তাহলে তুমি নিজেই ওদের সাথে দেখা করো। কথা বলো। উনারা আমাদের নিমন্ত্রণ দিয়েছেন। তাদের দেখে-শুনে যদি মনে হয়, সেখানে তোমার মেয়ের এতটুকু অযত্ন হবে তাহলে বিয়ে ক্যান্সেল।’

মেহরুমা স্বামীর কথার পিঠে কিছু বলবে তার আগেই উঠে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল নম্রতা। মায়ের গালে আলতো চুমু খেয়ে ভীষণ আদুরে কন্ঠে বলল,

‘ আই লাভ ইউ আম্মু। তুমি পৃথিবীর সব থেকে ভালো আম্মু। আমি তোমাকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি।’

নম্রতার এটুকু কথাতেই চোখদুটো ছলছল করে উঠল মেহরুমার। বোনের দেখাদেখি ছুটে এলো নন্দিতা। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেল গালে। মেয়েদের হাতের উপর হাত রেখে রুদ্ধ কন্ঠে বললেন মেহরুমা,

‘ তুমি ওদের মানা করে দাও তো। আমি আমার মেয়েদের বিয়ে-শাদি দেব না।’

নম্রতা হাসল। নন্দিতা তীব্র প্রতিবাদ করে বলল,

‘ আমি বিয়ে না করলে আমার হবু বর চিরকুমার থেকে যাবে না? বিয়ে তো আমাকে করতেই হবে আম্মু। আমি তো আমার বরকে কষ্ট দিতে পারি না।’

নন্দিতার কথায় হেসে ফেললেন নুরুল সাহেব। মেহরুমা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,

‘ এক চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব বেয়াদব মেয়ে। সারাদিন ‘বিয়ে বিয়ে’ করবে না। বাবার থেকে এসব বেলেহাজ কথা শিখেছ দুজনে। খবরদার আমার মেয়েদেরকে এমন বেলেহাজ কথা বলতে শেখাবে না, নমুর বাবা।’

নুরুল সাহেব হাসলেন। হাত বাড়িয়ে মেয়েদের কাছে ডেকে বললেন,

‘ বন্ধুদের সাথে যে কথাগুলো অনায়াসে বলা যায় সেই কথাগুলো বাবা-মাকে কেন বলা যাবে না মেহরুমা? ”বাবা-মা সন্তানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু” এই কথাটা তো শুধু মুখে মুখে আওড়ালে হবে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাস্ট বিহেভ লাইক আ ফ্রেন্ড। আমার মেয়েরা আমার কাছে উন্মুক্ত। লজ্জা ধরে রেখে চুপ থাকতে শেখালে তো ওদের সমস্যা, দুর্বলতা, প্রশ্নগুলো আমার পর্যন্ত পৌঁছাবে না। ওদের বলতে দাও। লাভিং ডটারস্? ইউ ক্যান ছে এনিথিং হোয়াট ইউ ওয়ান্ট।’

_

খাবার টেবিলে থমথমে নিস্তব্ধতা। জাহানারার মুখশ্রী গম্ভীর। খাবার টেবিলের ছোটখাট কাজগুলোতে প্রকাশ পাচ্ছে তেজ। নীরা শুকনো মুখে ভাতের গামলাটা হাতে নিতেই একরকম ছিনিয়ে নিলেন জাহানারা। আনিসুল সাহেবের পাতে ভাত বেড়ে দিয়ে বাকি কাজটুকুও করলেন নিজ হাতে। অন্তু ব্যাপারটা নিঃশব্দে খেয়াল করল। নীরা মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ আপনিও বসে পড়েন মা। খাবারগুলো আমি এগিয়ে দিচ্ছি।’

জাহানারা ক্ষোভ নিয়ে তাকালেন কিন্তু কিছু বললেন না। সন্ধ্যা থেকেই নীরাকে চোখে লাগার মতো এড়িয়ে চলছেন তিনি। কোন কথা বলছেন না। কোনো কাজে হাত লাগাতেও দিচ্ছেন না। নীরা মিনমিন করে আবারও একই কথা বলতেই ধমকে উঠলেন জাহানারা,

‘ কেন?তুমি এগিয়ে দেবে কেন? যাতে বাপের বাড়ি গিয়ে বলতে পারো, শ্বশুর বাড়িতে শাশুড়ী তোমায় খাঁটিয়ে মেরেছে? তোমার জীবন নাশ নাশ করে দিয়েছে?’

নীরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। অন্তু বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ এভাবে কথা বলছ কেন আম্মা?’

অন্তুর কথায় যেন জ্বলে উঠলেন জাহানারা। সন্ধ্যায় নীরার কথাগুলো কানে না এলেও ইরার কথাগুলো কান এড়ায়নি তার। সেই ক্ষোভ আর রাগ নিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,

‘ ও খুব খারাপভাবে বলে ফেলেছি? তোর বউয়ের পা ধরে মাফ চাইতে হবে এবার?’

অন্তু আহত কন্ঠে বলল,

‘ আম্মা!’

জাহানারা বেগম টলমলে চোখে তাকালেন,

‘ আম্মা? কিসের আম্মা? আম্মা মানিস আমারে তুই? বিয়ের দুইদিনের মাথায় বউয়ের আঁচল ধরতে শিখে গিয়েছিস। তোর বউ পটের রাণী। তার জন্য এই বয়সে এসে, জোয়ান ছেলের সামনে চড় খেতে পেরেছি আর সামান্য পা ধরতে পারব না? তোর বউকে তো সমঝেই চলতে হবে এখন। কত লায়েক হয়ে গিয়েছিস তুই। আজ স্বামীর হাতে চড় খেয়েছি কাল ছেলের হাতে চড় খাব। সমস্যা কই?’

নীরার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। অন্তু হতাশ কন্ঠে বলল,

‘ ছোট্ট একটা কথা ধরে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছ আম্মা?’

‘ আমারে আম্মা ডাকবি না। আমি কারো আম্মা নই। তোর বউকে নাকি গাধার মতো খাটিয়ে মারি আমি? বিরাট অপরাধ হয়েছে আমার। আজ থেকে তার কোনো কাজ করার প্রয়োজন নেই। স্বামী-ছেলের ঘাড়ে বসে খাচ্ছি। জন্মমূর্খ মানুষ। বউকে কথায় কথায় অপদস্ত করি। ছেলে ক্ষেপে গিয়ে দুই চারটা চড় মারতেই পারে। মাফ করে দে। কাল থেকে সব কাজ আমি করব। কাজ করে দু’মুঠো ভাত জুটলে খাব নয়তো নয়।’

ভাতের শেষ লোকমাটা গলা দিয়ে নামল না অন্তুর। মায়ের মুখের দিকে আহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। আনিসুর সাহেব ধমকে উঠে বললেন,

‘ দুমুঠো জুটলে খাবে মানে কি? তোমার ছেলের পয়সায় খাও তুমি? এই বাড়ি তোমার ছেলের? এতো লায়েক… ‘

নীরার নতশ্রী শুকনো মুখটাতে খেলে গেল অচেনা এক উদ্বেগ। ইরার সেই অবুঝ তেজ যে গুছিয়ে আসা সংসারটাকে আবারও নরক করে দিয়ে গেল তা কি করে সামলাবে নীরা? বোনের ভালো করতে গিয়ে কি ভয়ানক সর্বনাশটাই না করে গেল মেয়েটা!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here