# জীবনের জলছবি
#পর্ব ৩
এই ভাবে কেটে যায় দু দিন, তনুর কোনো খবর পায় না টুসি।মন টা খারাপ হয়ে থাকে সব সময়।তৃতীয় দিন বিকেলে হইচই এর আওয়াজ এ ঘুম ভাঙ্গলো তার। দৌড়ে নীচে নেমে আসে সে। সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে আলোচনা করছে। খানিক পরে বিষয়টা অনুধাবন করলো টুসি, তনুর বোন আর নেই।
হটাৎ করে অদ্ভুত একটা খারাপ লাগা ছড়িয়ে পড়ে তার মনে। তার রাগের জন্যই কি চলে গেলো মেয়েটা। কিন্তু সেতো এরকম কিছু চায়নি ঠাকুর। শুধু তনুর সঙ্গে দেখা না হওয়ার কষ্টে কিছু অভিমান জন্মে ছিলো তার। তার নিষ্পাপ কিশোরী মন কেনো জানিনা নিজেকেই দায়ী করতে থাকে প্রতি মুহূর্তে।
তার পরের দিন সমস্ত কাজ কর্ম মিটিয়ে বাড়ি ফেরে তনু। ছাত এ দাঁড়িয়ে তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে টুসি। একবারের জন্যও উপরের দিকে মুখ তুলে তাকায় না সে। সারা বিকেল ছট ফট করে টুসি।কোনো ভাবে কি একটুও কথা বলাও যায়না। সন্ধ্যে বেলা মা ও মামী তনু দের বাড়ি দেখা করতে যাবে বলে। টুসিও সঙ্গী হয় তাদের। বাড়িতে থমথমে পরিবেশ, সবাই চুপ চাপ বসে আছে। সমানে কেঁদে চলেছে তনুর মা আর ঠাকুমা।
টুসির চোখ তনু কে খোঁজে। এ ঘর , সে ঘর ঘুরতে ঘুরতে বারান্দার এক কোণে চেয়ার এ বসে থাকতে দেখে তাকে। ধীরে ধীরে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তনু একবার চোখ তুলে তাকায় শুধু, কোনো কথা বলেনা। টুসি ও কোনো কথা খুঁজে পায়না আর। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে আসে আস্তে আস্তে। বাড়ি ফিরে এসে মন টা খারাপ হয়ে থাকে তার। পরের দিন সকালে টুসি আশা করে তনু আসবে এবার নিশ্চয়ই। কিন্তু শুধু সেদিন নয় তার পরে দুদিন কেটে গেলেও তনু আসে না আর।
যাবার দিন এগিয়ে আসতে থাকে ক্রমশ, ধৈর্য্য হারায় টুসি। সরাসরি গিয়ে হাজির হয় তনু দের বাড়িতে। প্রায় একই রকম পরিবেশ, শুধু কান্নার আওয়াজ টা আজ নেই। মা আর ঠাকুমা দুজনেই চুপ করে বসে আছেন আজ। কান্না বোধহয় শুকিয়ে গেছে তাঁদের। টুসির দিকে ফিরেও তাকায় না কেউ, গত দু দিন এ এত লোক যাতায়াত করেছে এই বাড়িতে যে কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন অনুভব করে না আর।
সরাসরি তনুর ঘরে ঢুকে পড়ে টুসি। চুপ করে বসে আছে তনু, টেবিল এ মাথা রেখে।
তুমি একবারও দেখা করতে এলেনা তো? খানিকটা ক্ষোভ আর অভিমান ঝড়ে পড়ে তার গলায়। তনু খানিকটা অবাক দৃষ্টি তে তাকায়। বলে কি টুসি? এই অবস্থায় দেখা করতে যাবে ও?
যাবার কথা ছিল বুঝি, খানিকটা কর্কশ স্বরে জবাব দেয় তনু।
টুসি অবাক হয়, এ কেমন পরিবর্তন? অদ্ভুত অভিমান ঘিরে ধরে তাকে। কিশোরী মন বোঝেনা অতো জটিলতা, সামাজিকতা, শোক, তার মনে হয় তনু এড়াতে চেষ্টা করছে তাকে। উল্টো দিকে তনুর ও মনে হয়, এ কোন টুসি? যাকে সে ভালোবাসে? সেও অনুভব করেনা তার কষ্ট? আমার বোনের মৃত্যুর থেকে দেখা না হওয়া টা বড়ো হয়ে দাঁড়ায় ওর কাছে? দুজনেই চুপ হয়ে যায় কিছুক্ষন।
তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায় টুসি, আটকায় না তনু। নিজেদের মতো করে ক্ষোভ তৈরি হয় তাদের মনে। দুজনের কেউই সেই ক্ষোভ কে ভাঙতে উদ্যোগী হয়না আর। অবশেষে যাবার দিন চলে আসে। ভীষণ কষ্ট বুকে চেপে বাড়ির সামনে ডেকে আনা রিকশায় চড়ে বসে টুসি। মনে মনে বলে নিজেকে, আর কোনো দিনও আসতে চাইনা এখানে।
জীবনের প্রথম প্রেম ভেঙে যাওয়ার কষ্ট তার বুক কে ভেতর থেকে ফালা ফালা করে দিতে থাকে। কথা বলতেও ইচ্ছা করেনা আর। রিকশা এগিয়ে যায়, পুরনো স্মৃতির মতো পিছনে পড়ে থাকে ঘর বাড়ি, রাস্তা ঘাট, সেই প্রিয় জায়গা গুলো যেখানে ছড়িয়ে আছে তার গোপন অভিসারের চিন্হ। স্টেশন এ এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে টুসি, দুর থেকে আসা ট্রেন এর হুইসেল তাকে মনে করায় সব কিছু ছেড়ে যাচ্ছে সে।
ট্রেন এসে দাঁড়ায়, মা এর কথায় সম্বিত ফিরে আসে তার, মন টা কে এখানেই রেখে শুধু শরীর টা কে সঙ্গে নিয়ে ট্রেন এর পা দানি তে পা রাখে সে। মা ব্যাগ ঢোকাচ্ছে ভেতরে, দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টুসি, হটাতই বিদ্যুৎ চমকের মত একটা খুব প্রিয় মুখ সামনে এসে দাঁড়ায় তার, ট্রেন ছেড়ে দেয় সেই মুহূর্তে, চলন্ত ট্রেন এর দরজা দিয়ে একটা কাগজ তার হাতে এসে পড়ে, সঙ্গে অস্ফুটে একটা ছোট্ট শব্দ ‘ সরি ‘, চমকে তাকায় টুসি, দরজার বাইরে ক্রমশ সরে সরে যাচ্ছে একটা খুব চেনা অবয়ব, তনু।
আচমকা দু চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসে তার, বিশ্ব চরাচর লুপ্ত হয়ে যায়, কে তাকে দেখছে মাথায় থাকেনা আর।
ক্রমশ