অনুভবের_প্রহর পর্ব___০১

0
2008

#অনুভবের_প্রহর পর্ব___০১
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)

‘অনুভব ভাই আমায় ডেকেছেন?’

ভার্সিটির বটতলায় বসে আছে অনুভব ভাই। পায়ের উপর পা তুলে রাখা। আমি কাছে এগিয়ে যেতে সে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো। পরক্ষণে ধমকে বলে উঠলো,

‘এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিব তোমার। তোমাকে বারণ করা সত্ত্বেও গাদা গাদা চিঠি পাঠাচ্ছো কেন আমায়? তোমার চিঠির যন্ত্রণায় বাসায় পা ফেলার অবস্থা নেই। ময়লা ফেলার ঝুড়িও বিরক্ত হয়ে গেছে। সমস্যা কি তোমার? হুঁহ?’

আমি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার কি সমস্যা আমি নিজে-ই জানি না। শুধু জানি, সামনে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে থাকা এই মানুষটাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। কিয়ৎক্ষণ নিরবতার পর মাথা তুলে অনুভব ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি আজও এদিক ওদিক তাকিয়ে কথা বলছে। চোখে মুখে এক ধরনের কাঠিন্যতা। যার সাথে আমি পরিচিত বহুদিন হলো। উনি হঠাৎ ওনার পাশের ছেলেদের ইংগিত করে বলল,

‘এই! ওকে বসতে বল কেউ। আজ এর একটা বিহিত করে ছাড়বো।’

রকিব নামের ছেলেটা উঠে আমায় জায়গা করে দিল। আমি তৎক্ষনাৎ বসলাম না। বসার আগে আশপাশে একবার নজর বুলালাম। ক্লাস শেষ হয়েছে ঘন্টা দুই আগে। এদিকটা এখন পুরোপুরি ফাঁকা। দু চারজন যাও বা ছিল, অনুভব ভাইকে দেখে তারা সটকে পড়েছে। তবে দূরে বাসের সারির কাছে বেশ কিছু উৎসুক মুখ দেখা যাচ্ছে।

আমি কাঁধের ব্যাগটা কোলের উপর নিয়ে বসে পড়লাম। আমার সামনে বসে থাকা মানুষটি অনুভব মোর্শেদ। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। জিওগ্রাফি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সাইন্স ডিপার্টমেন্টে আড়াই বছর হলো ফোর্থ ইয়ারে তিনি। কিন্তু এখনো সিজিপিএ উঠিয়ে ভার্সিটি ত্যাগ করতে পারেনি। উনার সাথের ব্যাচমেটদের সবার গ্রাডুয়েশন কমপ্লিট! কেউ কেউ মাস্টার্সে। কেউ বা কর্পোরেট জব করে। কিন্তু উনি!এখনো সদ্য ফোর্থ ইয়ারে উঠা কয়েকটা ছেলেদের নিয়ে ঘুরঘুর করে সবসময়। সিনিয়র বলে ভয় পেয়ে বেচারা ছেলেগুলো সবসময় তাকে বড়ভাই, বড়ভাই বলে ডাকে।

অনুভব ভাই পড়াশোনায় একদম ফাঁকিবাজ। সম্পূর্ণ বাউন্ডেলে একটা ছেলে। ভার্সিটিতে একটা মানুষ নেই যে তাকে পছন্দ করে। অবশ্য সামনাসামনি সবাই তাকে মান্য করে। কিন্তু আড়ালে অনেকে অনেক কথা বলে যার সব আমার কানে আসে। তাকে নিয়ে প্রচুর গসিপ হয় ভার্সিটিতে। কিছু কিছু জুনিয়র তাকে আদুভাই বলেও ডাকে। এমন একটা ভালো গুণ খুঁজে পাওয়া যাবে না যা তার মধ্যে আছে। অথচ এরকম একটা গুণহীন ছেলেকে আমি প্রচন্ড রকম ভালোবাসি!

হঠাৎ অনুভব ভাই বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো,

‘নাম কি তোর?’

আমি অবাক হলাম না। মানুষটা আমার নাম জানা সত্ত্বেও প্রতিবার নাম জিগ্যেস করে। আমাকে হয়তো বোঝাতে চায় যে সে আমার কোনোকিছুতে তার ইন্টারেস্ট নেই। এই মানুষটা আমাকে যা তা বলে বহুবার অপমান করেছে। তুই তুকারি করেছে।হেলাফেলা করেছে। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। তাকে ভালোবাসি মানে তাকেই ভালোবাসি। তার অবহেলাসহ সব ভালোবাসি। আমি বুকে সাহস নিয়ে বললাম,

‘এত কষ্ট করে চিঠি লিখি, ভেতরের লেখা না হয় নাই পড়লেন। তাই বলে নামটাও মাথায় রাখবেন না? দেড় বছর ধরে জ্বালাচ্ছি নাম তো মনে থাকার কথা অনুভব ভাই!’

‘এই খবরদার। আমার নাম মুখে নিবি না তুই!’

পাশ থেকে রবিন নামক ছেলেটা বললো,

‘ভাই ওর নাম প্রহর। পূর্বিতা মাহমুদ প্রহর! ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট।’

‘তুই থাম। ওকে বলতে দে! সো, প্রহর! তুই এতদিন লুকিয়ে আমার বইয়ের ভাঁজে,খাতার ভেতর,ব্যাগের ভেতর চিঠি দিতিস! তোর জন্য লাইব্রেরি যা-ওয়া বাদ দিয়েছি আমি। এতদিন তোর এই রং তামাশা ভার্সিটিতে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তুই এখন নতুন কি ড্রামা শুরু করলি? তোর এই সিলি প্রেম ভালোবাসা টেনে আমার বাসা অবধি নিয়ে গেলি। ডেইলি দু তিনটে করে পার্সেল, কুরিয়ার থেকে ফোনকল, আর দরজার সামনে চিঠির ভাড়ে আমি বিরক্ত। পাগল হয়ে যাব আমি! এসব বাদ দে! তোকে আর কতটা ভদ্র ভাবে বললে তুই আমার পিছু ছাড়বি বল তো?’

আমি উত্তর দিলাম না। চুপচাপ ব্যাগ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বসে রইলাম। অনুভব ভাই একবার আমায় রেগে ভার্সিটির কিছু জুনিয়রের সামনে থাপ্পড় মেরেছিল। আর মার খেতে চাই না। উনি হঠাৎ ধমকে বললো,

‘চুপ করে আছিস কেন? কথা বল!’

আমি মুখ তুলে তাকালাম। অনুভব ভাইয়ের সাথের ছেলেগুলো কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম,

‘আপনাকে ছাড়া আমি অন্যকিছু ভাবতে পারি না।বহুবার আপনাকে ভোলার চেষ্টা করেছি। আপনাকে ভোলার জন্য অনেক কঠিন কঠিন স্টেপ নিয়েছি যেটা আপনি ভালো করে জানেন। ভুলতে না পারলে আমি করবো?’

‘গাল টেনে দু চার ঘা দিলে ঠিক ভুলতে পারবি।’

‘সেটা তো বাদ রাখেননি। ভুলাতে পেরেছেন?’

‘স্টপ! এখন শোন! তুই আমায় ভুলতে পারিস না, সেটা তোর সমস্যা। আমার নয়। আর এই অনুভব মোর্শেদ নিজের সমস্যা বাদে আর কারো সমস্যার ধার ধারে না। কাল থেকে যেন খবরদার আমার বাসায় তোর নামের কিছু না যায়। মনে থাকবে?’

‘জানি না।’

অনুভব ভাই হঠাৎ হতাশ সুরে বললো,

‘বল কি চাস তুই? কি করলে আমার পিছু ছাড়বি?’

আমি ছলছলে চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। দু হাতে ব্যাগ চেপে বললাম,

‘আমি বাসায় যাব অনুভব ভাই।’

অনুভব চোখের পলকে উঠে দাঁড়ালো। আঙুল উঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললো,

‘তোকে বলেছি না,আমার নাম মুখে আনবি না?বেদ্দপ, বেহায়া মেয়ে। তোর লজ্জা কবে হবে রে! দেড় বছর ধরে আমার পেছনে পড়ে আছিস! তোকে কিভাবে বুঝাব যে আমি তোর প্রতি ইন্টারেস্টেড না? তোর মধ্যে কি আছে? এট্রাকশনের মতো কিছুই নেই। সিমরানকে চিনিস? ফোর্থ ইয়ারের সিমরান। ওর ফিগার দেখেছিস? ওর ধারে কাছেও তো তুই না। আমি সিমরানকে ভালোবাসি। তুই খবরদার আর আমাকে চিঠি পাঠাবি না। আমার নামে আর একটা চিঠি লিখবি তো তোকে কেটে পিসপিস করবো। তোর হাতের আঙুল গুলো ছিন্নভিন্ন করবো। তারপর জেলের ভাত খাব। নির্লজ্জ কোথাকার!’

এটুকু বলেই অনুভব ভাই কাশতে শুরু করলো। চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। দ্রুত প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ চেপে ধরলো। ছেলেগুলো এগিয়ে এসেছে। পাশ থেকে একটা ছেলে দৌঁড় দিল পানি আনার জন্য। আমি উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললাম,

‘অনুভব ভাই, কি হয়েছে আপনার? আপনি অসুস্থ?’

অনুভব হাত উঁচিয়ে আমায় চলে যাওয়ার ইশারা করলো। কিন্তু আমি নড়লাম না। দ্রুত ব্যাগের চেইন খুলে পানির পট এগিয়ে দিলাম। কিন্তু উনি পানির পট ছিনিয়ে নিয়ে দূড়ে ছুঁড়ে ফেলল। আমি অসহায় চোখে মুখে তাকালাম। আর একটু কাছে যেতে উনি হঠাৎ আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরে গেল। আমার বসে থাকা সিমেন্টের ঢালাইয়ে কষে লাথি দিতে আমি চমকে উঠলাম। রবিন ভাই আমার ব্যাগ টেনে আমাকে ক্যান্টিনের বাইরে নিয়ে এসে বললো,

‘চলে যাও জলদি!’

আমি একবার পেছন ঘুরে তাকালাম। অনুভব ভাইকে কোথাও দেখতে পেলাম না। চোখের জল মুছে আবার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। আমার তখন গতকালের কথা মনে পড়লো।

গতকাল ক্লাস করছি বসে বসে। দুপুর বারোটার দিকে হঠাৎ ধুলোবালি উড়িয়ে অনেকক্ষণ বাতাস শুরু হলো।ঝড়ো বাতাসের পরপরই তুমুল বেগে বারিধারা বর্ষণ।আমি তখন কর্ণারের দরজা ঘেঁষে বসা। তুহিন স্যারের ইলেকট্রিসিটি এন্ড ম্যাগনেটিজম ক্লাস চলছে। স্যার ডায়াসে দাঁড়িয়ে হোয়াইট বোর্ডে বিচিত্র সব আঁকিবুঁকি করছে আর হাত নেড়ে নেড়ে লেকচার দিচ্ছে। আমার সেদিকে মনোযোগ নেই। আমি ভার্সিটির লম্বা করিডোরের দিকে তাকিয়ে আছি। বৃষ্টির ঝাপটা এসে করিডোর ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে আমার মনটা! খুব করে অনুভব ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে।

কতক্ষণ বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ করিডোর দিয়ে দৃষ্টি সম্মুখে দিতে দূরে মাঠে অনুভব ভাইকে ভিজতে দেখলাম। হাত পা ছড়িয়ে কাকতাড়ুয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে যেন। তিন তলায় আমি ক্লাস করি। তবুও এতদূর থেকে বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না যে উনি অনুভব ভাই! মুহুর্তে আমার মন চঞ্চল হয়ে উঠলো। মুখে লজ্জা মিশ্রিত হাসির বলিরেখা ফুটে উঠলো। অনুভব ভাই আশপাশে থাকলে আমার সব ভালো লাগতে শুরু করে। আমি একদৃষ্টিতে অনুভব ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলাম।

কয়েক মিনিট যেতে অনুভব ভাই আশপাশে একবার তাকিয়ে লম্বা শিমুল গাছটার আড়ালে চলে গেল।কয়েক সেকেন্ড অাগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। শিমুল গাছের আড়ালে থেকে উনি হঠাৎ বের হয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ম্যাথ ডিপার্টমেন্টে ঢুকে গেল।আর চোখে পড়লো না।

কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে যখন বুঝতে পারলাম উনি আর ভিজতে আসবে না তখন সামনে তাকালাম। ডায়াসে ইংলিশ বুলি ফুটিয়ে লেকচার দিতে থাকা টাকলা রাগী স্যারটাকেও আমার হুট করে ভীষণ ভালো লাগতে শুরু করলো। বহুদিন পর আমি স্যারের লেকচারে মনোযোগ দিলাম।

স্যার ফার্স্ট সেমিস্টারের রিকভারি ক্লাস নিচ্ছে। ইলেকট্রিক ফিল্ড এন্ড পটেনশিয়ালের উপর। তিনি বিরস মুখে বার বার বলছেন,

‘প্লেইন গ্লাসরডস্ নেইদার অ্যাট্রাক্ট নর রিপিল ইচ-আদার! বাট আফটার বিইং রাবড্ উইথ সিল্ক,দ্য রডস্ রিপিল ইচ-আদার! সো,লাইক চার্জেস রিপিল ওয়ান অ্যানাদার এন্ড আনলাইক চার্জেস অ্যাট্রাক্ট ওয়ান অ্যানাদার।গট ইট?’

সাই করে একটা বাইক খুব কাছ ঘেঁষে চলে গেল। আমি চমকে দু পা পিছিয়ে গেলাম। কল্পনা থেকে বের হয়ে বুঝতে পারলাম দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে অনেক আগে। ভার্সিটির বাস চোখে পড়লো না। মনটাও বিরস।হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া মনটা খুব খারাপ।প্রচন্ড রকম চিন্তা হচ্ছে অনুভব ভাইয়ের জন্য। উনার বোধ হয় গতকালের বৃষ্টিতে ভেজার ফলে ঠান্ডা লেগে গেছে। যেই হারে কাশি শুরু হয়েছে! না জানি কতটা অসুস্থ!

অন্যমনস্ক হয়ে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। দু একটা খালি রিকশা যাচ্ছে। তবুও ডাকতে মন চাইছে না। হঠাৎ করে আমার সামনে হুডতোলা একটা রিকশা থেমে গেল। আনমনে এগিয়ে গিয়ে উঠতে নিতে দেখি রগচটা অনুভব ভাই বসে আছে। মুহূর্তে আমার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। কাঁধের ব্যাগটা হাতে নিয়ে রিকশায় এক পা রাখতে কেউ পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো।

(চলবে)…..

আসসালামু আলাইকুম। এই গল্পটি শুধু পেইজে দিবো।কোনো গ্রুপে পোস্ট করবো না। পরবর্তী পর্ব কাল পেয়ে যাবেন। ভালোবাসা সবার প্রতি।

দ্রঃ কিছু জিনিস এডিট করা হয়েছে। যারা আগে পড়েছিলেন তারাও পড়বেন। আগে থেকেই গল্পের চরিত্র বিশ্লেষণ না করার অনুরোধ রইলো। এটা একজন পাগলাটে প্রেমিকার কাহিনি যে শুধুমাত্র তার নিজস্ব জগতের যুক্তি শোনে এবং মানে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here