#অনুভবের_প্রহর
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব____২৬
আজও অফিসে ঢুকতে প্রথম মুখোমুখি হলো নাজমুল হাসানের। প্রহর ক্লান্ত স্বরে জিগ্যেস করলো,
‘বাবা কি এখনো অফিসে আছে?’
নাজমুলের চোখে মুখে বিস্ময় ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। তার নিষ্পলক দৃষ্টি প্রহরের পানে। মুখে রা নেই। প্রহর হাত উঁচিয়ে বললো,
‘আমায় চিনতে পারেননি? আমি প্রহর। বাবা কি অফিসে?’
‘নাহ। না মানে হ্যাঁ! স্যার আছে।’
নাজমুলের তোতলানো সুর। প্রহরের কপালে কুঁচকানো রেখা দৃশ্যমান হলো। এই ছিমছাম গড়নের ছেলেটা প্রথম থেকে তাকে প্রচন্ড ভয় পায়। কেন তা অজানা। তার বাবা কি কঠিন ব্যবহার করে ছেলেটার সাথে? মনে তো হয় না। বাবা ততটা রাগী নয়!
‘গতবার জিগ্যেস করেছিলাম আপনার দেশের বাড়ি কোথায়। বলতে পারেননি। এখন মনে পড়েছে?’
‘জ্বি না!’
নাজমুলের ভীত সন্ত্রস্থ স্বর। প্রহর মৃদু হাসলো। আর দাঁড়ালো না। বাবার রুমের দিকে এগোল। প্রহরের গমনপথের দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলো নাজমুল। কেবিনে ঢুকে পড়তে সে দৃষ্টি সরালো। গলা উঁচিয়ে পিয়নকে ডাকলো।
‘এক্ষুণি দু কাপ কফির ব্যবস্থা করো।’
বালক বয়সের পিয়ন মাথা নাড়লো। কিন্তু কৌতূহল দমন করতে পারলো না। যদিও অনধিকার চর্চা তবুও শেষমেশ জিগ্যেস করলো,
‘এই বিকাল বেলা কফি খাইবো কেডা? শুধু কফি?’
‘থাক তোমার কিচ্ছু করতে হবে না। আমি দেখছি।’
কয়েক সেকেন্ড ভাবলো নাজমুল। পরক্ষণে একছুটে অফিস থেকে বের হয়ে গেল। ছেলেটি ভ্রু উঁচিয়ে চেয়ে রইলো। হঠাৎ এত ব্যস্ততার কারণ উদ্ধার করতে পারলো না।
________
ইরতাজ উদ্দিনের মুখ থমথমে। হাতের কলমটা অনেক আগে খসে পড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটা অবহেলিত ভাবে পড়ে আছে। ঠিক তার বিপরীত পাশে প্রহর হাসি হাসি মুখে বসে আছে। তাকে বেশ নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছে। সে বাবার দিকে একটু ঝুুঁকে এলো। আচমকা হাসি থামিয়ে দিল। নাঁকি সুরে বললো,
‘বাবা! এত ভয় পাচ্ছো কেন তুমি? দুটো টিকেট সংগ্রহ করে দিতে পারবে কি না বলো।’
‘কিন্তু পূর্বি মা। তুমি তো গত কয়েক বছর ধরে কোনোপ্রকার ট্যুরে যাওনি। কারণ ট্যুর তোমার পছন্দ না। পছন্দ না বলতে অনেকটা ফোভিয়া টাইপের। হুট করে আবার কক্সবাজার যেতে চাচ্ছো কেন?’
‘অনেকদিন হলো আমার সমুদ্র দেখার ইচ্ছে বাবা৷ ইচ্ছেটা মনের কোণে ঘাপটি মেরে ছিল। ইদানীং সেটা ডালপালা গজিয়ে বিশালাকৃতির হয়ে গেছে। একে সামাল দিতে পারছি না। প্লিজ সব ব্যবস্থা করে দাও না বাবা।’
‘কিন্তু?’
ইরতাজ উদ্দিনের নিমরাজির যথেষ্ট কারণ আছে। কয়েক বছর আগের ঘটনা। প্রহর তখন সদ্য নাইনে উঠেছে। অষ্টম শ্রেণিতে রেজাল্ট ভালো করায় তিনি সবাইকে নিয়ে ট্যুরে যাওয়ার প্লান করেছিলেন। পাঁচদিনের ট্যুরের দুদিন সুন্দর মতো কাটলো। তৃতীয় দিনে হঠাৎ অঘটন দেখা দিল। বিছানাকান্দি যাওয়ার পথে গাড়িটা ভয়াবহ এক্সিডেন্ট করলো। অদ্ভুত ভাবে কারো তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও প্রহর মারাত্মক ভাবে আহত হয়। দেহের বেশকিছু ইন্টার্নাল অর্গান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মেয়েকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ছোটাছুটি আর আতংকের দিনগুলো স্পষ্ট মনে আছে তার। প্রহরের সেই ইরজুরি ঠিক হতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল। মূলত সেই সময় থেকে তারা কেউ ট্যুরে যায়নি৷ প্রহরও সব রকমের ট্যুরের বিপক্ষে ছিল। কিন্তু আজ হঠাৎ কক্সবাজারের কথা শুনতে তাঁর কেমন খটকা লাগলো। মন সায় দিল না।
‘বাবা, রাজি হয়ে যাও না। প্লিজ!’
প্রহরের আবদারে মন গলতে শুরু করলো ইরতাজ উদ্দিনের। শেষমেশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ঠিক আছে। সবকিছু গুছিয়ে প্রস্তুতি নাও। বাকিসব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
প্রহর খিলখিল করে হেসে উঠলো। এক ছুটে চেয়ার ছেড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ পর বললো,
‘এখন আসি তাহলে?’
‘দুপুরে খাওয়া হয়েছে?’
প্রহর মিথ্যে বলতে পারলো না। মাথা নেড়ে বললো,
‘এখন গিয়ে খেয়ে নিবো।’
ইরতাজ উদ্দিনের বুকের ভেতর হু হু করে উঠলো। এই মেয়েটা তাঁদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। তাঁদের ভালোবাসার প্রথম ফুল। ছোটবেলা থেকে কতটা যত্নে বড় করেছেন। ছিঁটেফোঁটা দুঃখ স্পর্শ করতে দেননি। তারা না করলে কি হবে! বিধি বাম। মেয়েটা স্বেচ্ছায় দুঃখকে আলিঙ্গন করে নিলেন। তার পরোপকার স্বামী আবার না খেয়ে মরবে তবুও অন্যের অনুগ্রহে বাঁচবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। উপলব্ধি করলেন ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তাঁর। মেয়ের সিদ্ধান্তকে ভুলও ভাবতে পারছে না। একটা সময় ভালোবাসার জন্য তারাও ঘর ছেড়েছিলেন। দারিদ্র্যতাকে জয় করেছিলেন। তার মেয়েও জয় করবে। সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ঠিক সুখ খুঁজে নেবে। তিনি মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘আমি খাবার পাঠাতে বলছি। এখানে খেয়ে নাও।’
ইরতাজ উদ্দিনকে কিছু করতে হলো না। তার আগে কেবিনের দরজায় নক পড়লো। তিনি হুকুম দিতে নাজমুল ভেতরে ঢুকলো। তার দু হাত ভর্তি খাবার। দোকানের সব প্রকারের খাবার নিয়ে এসেছে যেন। তার পেছন পেছন এলো পিয়ন ছেলেটি। হাতে পানির জগ আর বাকি সরঞ্জাম। তিনি কৃতজ্ঞতা অনুভব করলেন। নাজমুল ছেলেটা এতটা চটপটে! কিভাবে যেন সব বুঝে যায়। তাঁর মনে পড়লো, একটা সময় প্রহরের দায়িত্ব এই ছেলেটার হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে ডেস্ক ফাঁকা করে প্রহর আর তার বাবা খেতে বসলো। কতগুলো মাস পর দুজন একত্রে খাচ্ছে। দুজনের মুখ ভার। মাথা নিচু, চোখের কোণা ঝাপসা হয়ে আসতে চাইছে বার বার। এত সুস্বাদু খাবারও কয়েক লোকমার বেশি কেউ খেতে পারলো না।
________
অনুভব বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যার পর। দু বার ডোরবেল বাজাতে দরজা খুলে গেল। ওপাশে ঘুম ঘুম চোখের প্রহরকে দেখে তার সারাদিনের ক্লান্তি উবে গেল। ঠোঁটে দৃশ্যমান হলো এক অমায়িক প্রশান্তির হাসি। পথভোলা পথিকের শেষ গন্তব্যস্থল। ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল সে। পেছন ঘুরে প্রহরের দিকে এগোতে লাগলো। দু পা এগোতে প্রহর চিৎকার করে উঠলো। বাঁধা দিয়ে বললো,
‘আর এগোবেন না একদম। জুতা খুলুন আগে৷ জুতা খুলে রেখে তারপর ভেতরে আসুন।’
সেকেন্ড দু-একের মতো অনুভব নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর বাঁধা মানলো না। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে প্রহরের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল। নরম সুরে বললো,
‘একটু তো ময়লা-ই হচ্ছে। এমন করছো কেন? আমি না হয় পরে পরিষ্কার করে দিবো।’
চোখ আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে আসলো তার। ফের বললো,
‘আজ সারাটাদিন তোমায় ভীষণ মিস করেছি প্রহর। অভাববোধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সন্ধ্যার পর একদমই থাকতে পারছিলাম না। সেজন্য এক ছুটে চলে এলাম। এতগুলো বছর অনুভূতি গুলোকে বন্দী কুঠুরিতে আটকে রেখেছিলাম। সেগুলো মুক্ত হয়ে এখন লাগামছাড়া হয়ে গেছে। নিজের অনুভূতির উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই। মনের উপর নেই মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ। আর নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না। ওরা যেভাবে চলছে চলুক! যেভাবে উড়ছে উড়ুক।’
প্রহরের ঘুম ছুটে গেল মুহূর্তে। হাত দুটো অনুভবের পিঠ স্পর্শ করলো। কাছে ঘেঁষে অনুভবকে গভীর ভাবে আলিঙ্গন করলো। উষ্ণ এক অপার্থিব স্পর্শানুভূতি ছড়িয়ে পড়লো দেহজুড়ে। অনুভবের বাচ্চামো, পাগলামি সব প্রহরের কাছে কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। দীর্ঘ সময়ের কোনো স্বপ্ন বুঝি! মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে ঘুম ভেঙে যাবে। ঘুম ভাঙলো না। অনুভবের বাহুডোর ঢিলে হয়ে এলো। প্রহরের মুখটা দু হাতে বন্দী করে চেয়ে রইলো দীর্ঘক্ষণ। প্রহর বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারলো না। অনুভবের বিধ্বংসী চোখের দৃষ্টি। নেত্র ঝলসানো মুখের অবয়ব। প্রহর চোখ নিচু করে বললো,
‘আপনাকে এতো সুদর্শন হতে বলেছে কে বলুন তো? সৌন্দর্য্য নারীদের জন্য। পুরুষ মানুষদের এমন ভয়ংকর সুন্দর হতে হয় না, জানেন না বুঝি?’
‘আমি সুদর্শন না হলে আমার প্রেমে পড়তে?’
‘জানি না!’
ফিক করে হেসে ফেলল প্রহর। আচমকা অনুভব প্রহরের কানে একটা ফুল গুঁজে দিল। কিন্নর কন্ঠে বললো,
‘আমার এত বছরের জীবনে কেনা প্রথম গোলাপ৷ আমার কেনা প্রথম গোলাপটা আমার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা, প্রথম এবং শেষ স্ত্রী পূর্বিতা মাহমুদ প্রহরের জন্য। মিসেস অনুভব মোর্শেদের জন্য।’
ফুলটা হাতে নিল প্রহর। আবেগতাড়িত হওয়ার সময় পেল না। তার আগে অনুভব তাকে টেনে রুমে নিয়ে গেল। প্রহরকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে কোলে মাথা রাখলো।
_______
সুনশান-নিস্তব্ধ রাত। সময় বয়ে চলেছে নিরব গতিতে। অনুভবের চোখে ঘুম নেই৷ দৃষ্টি আটকে আছে প্রহরের মুখপানে। তার উন্মুক্ত বুকে মেয়েটা কি গভীর নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। অনুভব জানে না আর কতদিন, আর কতগুলো রাত প্রহর এমন নিশ্চিন্তমনে ঘুমাতে পারবে! ইদানীং হুটহাট কেমন অস্থির লাগে। ছোটখাটো শব্দে বুক কেঁপে ওঠে। প্রহরের চিন্তায় দিন কে দিন কেমন বেসামাল হয়ে যাচ্ছে।
ঘুমের মাঝে প্রহর হালকা নড়ে উঠলো।
(চলবে)