#জীবনের জলছবি
#পর্ব ৮
টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়েছে দিন কয়েক আগে। আজ অঙ্ক, কাল রাতে ঘুমের মধ্যে শুধুই দুঃস্বপ্ন ঘুরে ঘুরে আসছিলো টুসির। যে স্বপ্নটা ও প্রতিবার অঙ্ক পরীক্ষার আগে দেখে থাকে, সেই অঙ্ক না মেলার স্বপ্ন, শেষ পর্যন্ত একটাও অঙ্ক না মেলা অবস্থায় পরীক্ষা শেষের ঘন্টা পড়ে গেলে, স্যার যখন হাত থেকে খাতা টেনে নেন, তখনই ঘেমে নেয়ে ঘুম ভেঙে যায় টুসির।
এবারও তাই হলো, সেই যে ঘুম টা ভাঙলো আর কিছুতেই ঘুম এলোনা তার পর থেকেই। প্রতিবারের মতো এবারও ভগবানের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো টুসি, এবারের মতো অঙ্কটা উতরে দাও ঠাকুর! পরের বার ঠিক রেডী হয়ে থাকবো একদম। মা যখন সন্ধ্যেবেলা খেলে ফেরার পর সন্ধ্যে প্রদীপ জ্বালাতে বলতো, তখন কি যে বিরক্তি লাগতো! এখন কেমন যেন ভয় ভয় লাগতে লাগলো! ইস! কেনো যে ও সন্ধ্যে দিতে চায়না! এবার যদি পরীক্ষাটা ঠিক হয়ে যায়, তাহলে আর সন্ধ্যে দিতে একটুও বিরক্ত হবে না, মনে মনে নিজেকেই প্রমিজ করলো টুসি।
যদিও এই প্রমিজ গুলো প্রত্যেকবার পরীক্ষার আগেই করে, তবুও কেনো যে পরীক্ষা শেষ হলেই ভুলে যায়! এবার কিছুতেই ভুলবেনা, যতই হোক সামনে এখনও মাধ্যমিক আছে বাকি! টেস্ট হলেই তো আর শেষ হয়ে গেলো না সব কিছু! শুয়ে শুয়ে রাত কেটে ভোরের আলো ফুটতে দেখলো টুসি, এই আলো টুকুর জন্যেই তো এতক্ষন অপেক্ষা করেছিলো ও! আজ আর মা কে ঘুম থেকে ডাকতে হলো না, লাফ দিয়ে উঠে ছাদের দিকে ছুটলো টুসি। এখন একটা খুব বড়ো কাজ বাকি আছে, ওটা না করে কিছুতেই পরীক্ষা দিতে যেতে পারবে না ও।
ছাদে উঠতে উঠতে অবাক হলো, এত সকালে ছাদের দরজা খোলা! কাকিমা কি তবে ফুল তুলতে এসেছে! সেই ঘটনার পর থেকে কাকিমা র সঙ্গে কথা বলতে একটু অস্বস্তি হয় ওর! শুধু মনে হয় তপু দা যদি কিছু বলে দেয়! কাকিমা যদিও কিছু বলে না আর! তবু ওর ভয় লাগে।
দরজার সামনে পৌঁছেই বহু কাঙ্ক্ষিত সেই জিনিসটা দেখতে পেলো টুসি, শালিক! কিন্তু জোড়া টা কই! দুটো না দেখলে তো পরীক্ষা দিতে যাওয়াই যাবে না। এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে সবে মাত্র দ্বিতীয় শালিক টা কে প্রথম টা র পাশে সরে আসতে দেখে দু হাত জোড় করে মাথায় ঠেকাতে যাচ্ছিলো ও, তখনই ছুটে আসা একটা ঢিলের বাড়ি খেয়ে উড়ে গেলো শালিক টা।
অঙ্ক? তাই না? দুটো কেনো দশটা শালিকও তোকে বাঁচাতে পারবে না আজ,
মাথাটা ঘুরিয়ে দেখেই মেজাজ টা একদম গরম হয়ে গেলো টুসির, তপু দা! ছাদের দেওয়ালে হেলান দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, হাতে একটা সিগারেট!
তাই বলে তুমি শালিক টা উড়িয়ে দিলে! জানো আমি কতক্ষন ধরে এটার জন্যে ওয়েট করছিলাম!
রাগের গলায় বললো ও, অঙ্কে ভালো বলে খুব ঘ্যাম তপু দার, সহ্য হয় না একদম টুসির। দাঁড়াও! ও ও দেখাবে মজা! লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া! এক্ষুনি কাকিমা কে বলে দেবে ও!
তুমি যে সাত সকালে ছাদে এসে সিগারেট খাচ্ছো, কাকিমা জানে? কোনো কাজ নেই না! শুধু লোকের ক্ষতি করা! তোমার হচ্ছে দাঁড়াও! কাকিমা কে বলছি আমি,
এতো সুন্দর একটা অস্ত্র হাতে পেয়ে যা আনন্দ হচ্ছিলো টুসির! তপু দা খুব জব্দ হবে আজ।
বলে দিবি? আচ্ছা দিস তাহলে! দেখি তোর কাকিমা কি করে আমাকে! একটু সিগারেট টা ধর তো, গেঞ্জি টা পরে নিই! বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে তাই না!
বলতে বলতে ওর হাতেই সিগারেট টা ধরিয়ে দিয়ে গেঞ্জি টা গায়ে গলাতে লাগলো তপু দা। টুসি একটু থতমত খেলো, কাকিমা কি তাহলে জানে নাকি! তপু দা একটুও ভয় পেলো না তো! ইসস! এত সুন্দর একটা প্ল্যান ভেস্তে গেল! খুব রাগ হচ্ছিলো টুসির। গেঞ্জি পরেই সিগারেট টা ওর হাত থেকে নিয়ে পর পর কয়েকটা টান দিয়েই ছুঁড়ে ছাদ থেকে দূরে ফেলে দিলো তপু দা, দিয়েই ওর হাত টা চেপে ধরলো,
তোর হাতে সিগারেটের গন্ধ কেনো? তুই ছাদে লুকিয়ে এসে সিগারেট খাস! চল তোকে কাকিমার কাছে নিয়ে যাই,
একদম হতভম্ব হয়ে গেলো টুসি! কি শয়তান তপু দা টা! নিজে খেয়ে, ওর হাতে ধরিয়ে আবার ওকেই মায়ের কাছে নিয়ে যেতে চাইছে! মা যা! তপু দা পড়াশোনায় ভালো বলে মা ওর সব কথা বিশ্বাস করবে, তপু দা যে মিথ্যে বলতে পারে একদম মানবে না মা। এবার কি করবে ও! কেনো যে সিগারেট টা ধরতে গেলো! ধ্যাত! সব কিছুই খারাপ হচ্ছে আজ, নির্ঘাত অঙ্কে ফেল করবে ও।
প্লিজ তপু দা, আমার ভালো লাগছে না, আমার খুব খারাপ অবস্থা, বিশ্বাস করো!
এবার প্রায় কেঁদে ফেললো টুসি, এমনিতেই আজ সকালে তপু দার মুখ দেখেছে, কি যে হবে কে জানে! টুসির কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে একটু সিরিয়াস হলো এবার তপু,
তুই তো আবার উপপাদ্য মুখস্থ করিস! কি যে করিস না! শোন, যদি মুখস্থই করতে হয়, তাহলে আট আর চব্বিশ বুঝলি তো! পুরো গ্যারান্টেড সাজেশন, প্রশ্নে দেখে আমার কথা মনে করবি,
মুচকি হেসে বললো, টুসি যেনো আশা র আলো দেখতে পেলো!
সত্যি? থ্যাংক ইউ তপু দা!
আর একটা কথা! একটা শালিক কে কি করে দুটো করতে হয় জানিস? কিছুই তো জানিস না, খালি ন্যাকা কান্না কাঁদিস, চোখ দুটো ট্যারা করে নে, দেখবি দুটো হয়ে যাবে,
অবাক হয়ে গেলো টুসি, তপু দা এত কিছু জানে! কিন্তু ওকে ন্যাকা বললো, যাক গে! এতো হেল্প এর বদলে না হয় ওটুকু শুনলোই ও! গায়ে ফোস্কা তো পড়ছে না আর! প্রায় লাফাতে লাফাতে নিচে নামলো টুসি, একটা শালিক পাবার জন্যে আর ছাদে দাঁড়ানোর দরকার নেই, ও তো সব সময় দেখা যায়। কিন্তু এই সিক্রেট টা কাউকে বলা যাবে না, মাম কেও নয়। তাহলে সবাই দুই শালিক দেখে ফেলবে!
সারা বছর বই নিয়ে বসবি না, আর পরীক্ষার দিন শালিক দেখে আরও সময় নষ্ট,
দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই মায়ের গলার চিৎকার শুনতে পেলো টুসি। উফফ! এই শুরু হলো, এবার চলতেই থাকবে! মা একবার শুরু করলে আর থামতেই চায় না!
মা কে প্রণাম করে মাম এর সঙ্গে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিলো টুসি, কেমন যেনো চুপচাপ ওরা দুজনেই।
সকাল থেকেই এক শালিক দেখছি জানিস! আজ খুব খারাপ হবে,
মাম এর নির্জীব গলা শুনে খুব খারাপ লাগলো টুসির, তপু দার ট্রিক টা বলে দেবে নাকি! মাম কেই শুধু বলবে, আর কাউকে নয়, মনে মনে ঠিক করলো ও। অতঃপর এক শালিক কে দুই শালিক করার ট্রিক শিখিয়ে এবং শিখে দুজনে যখন স্কুলে ঢুকলো তখন রীতিমত ঘামতে লাগলো টুসি।
নভেম্বরের ঠান্ডাও যেনো অঙ্কের কাছে ফেল মেরে গেছে আজ। স্যার এর দেওয়া প্রশ্ন টা মাথায় ঠেকালো টুসি, ঠাকুর পাশ করিয়ে দিও কিন্তু! প্রশ্ন টা খুলেই একদম চমকে গেলো টুসি, আট আর চব্বিশ! উফফ! তপু দা যা ভালো না! তপু দার ওপর আর কোনো রাগ নেই এখন, তপু দার মুখ দেখেই রোজ ঘুম থেকে উঠতে চায় এবার থেকে টুসি। কিন্তু তপু দা যে কলকাতায় থাকে! মাধ্যমিকের অঙ্কের আগে যে করেই হোক তপু দা কে এখানে আনতেই হবে!
ক্রমশ
( এই পর্বটা লিখতে গিয়ে আমার এক বন্ধুর কথা মনে পড়লো, সে পরীক্ষার দিনগুলোয় চোখ নামিয়ে,মাথা নিচু করে স্কুলে আসতো, পাছে এক শালিক দেখে ফেলে। আর অঙ্কে ভীতি! সেতো আর বলার নয়, আপনাদের ছিলো কিনা জানিনা, এ ব্যাপারে আমি কিন্তু টুসির মতোই 😀, কেমন লাগলো আজকের পর্ব, সবাই কমেন্ট করবেন কিন্তু❤️)