#জীবনের জলছবি
#পর্ব ২৪
আজকে সকালে ঘুরে হোটেলে ফেরার পর থেকেই সীমার গম্ভীর মুখটা দেখতে পাচ্ছিলো ও, কারোর সঙ্গে কথা বলছিলো না সীমা। কাকিমা, মাসি সবাই ওকে বেশ কয়েকবার শরীর খারাপ কিনা জিজ্ঞেস করছিলো, অন্যরা কেউ কারণটা না বুঝলেও টুসি সবটাই বুঝতে পারছিলো। সীমা যে তপু দার সঙ্গে ওকে দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছে সেটা ওর আচরণ থেকেই পরিষ্কার হচ্ছিলো।
দুপুরে খাওয়ার পরে সবাই একটা ঘরে বসে শুভ দার বিয়ে নিয়ে আলোচনা করছিলো, ওদের পারিবারিক আলোচনায় টুসি ঢুকতে চায়নি বলেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলো। শুয়ে থাকলেও ঘুম আসছিলো না, কাকিমা বা ওদের বাড়ির অন্য কেউ কি তপু র সঙ্গে সকালে ওকে বেরোতে দেখে কিছু ভাবলো! সীমা কি ওর মা এর কাছে কিছু বলবে! মন টা খুব অস্থির লাগছিলো, ও বোধহয় না এলেই ভালো করতো! এমন সময় দরজায় নক শুনে উঠে গিয়ে দেখলো তপু দা, ও ভেবেছিলো কাকিমা বোধহয় বিশ্রাম নিতে এসেছে।
এখানে একা বসে আছিস কেনো? কি হল তোর আবার?
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো তপু, টুসি একটু ভাবলো, তপু দা কে এই ঘরে ওর সঙ্গে গল্প করতে দেখে অন্যরা কিছু ভাববে না তো! কাকিমা যদি কিছু মনে করে! সকালে ফেরার পরে সবাই যেনো একটু অবাক দৃষ্টিতেই তাকিয়েছিলো ওদের দিকে।
যাবি নাকি আর একবার হাঁটতে? নাকি ক্লান্ত হয়ে গেছিস সকালে হেঁটেই!
তুমি গল্প করো ওঘরে গিয়ে, আমি একটু রেস্ট নেবো এখন,
তপু কে এড়ানোর জন্যেই এবার বললো ও, যদিও ওর খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো তপু এখানে থাকুক, কিন্তু অন্যরা জানলে কি হবে এই ভাবনাটা কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছিল না টুসি। তপু একটু অবাক হলো,
চলে যাবো! কি যে হয় তোর মাঝে মাঝে! সত্যিই আমি তোকে বুঝতে পারিনা টুসি! কাল তোর সঙ্গে গল্প করিনি বলে রেগে ছিলি তুই, আর আজ নিজেই চলে যেতে বলছিস!! তপু দার যে খারাপ লেগেছে সেটা টুসি বুঝতে পারছিল, কিন্তু ওর মনের মধ্যে যে ভয় টা ঢুকেছে সেটা ও কি করেই বা তপু কে বলবে!
তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? সত্যি কথা বলবি কিন্তু, আমার মন রাখার জন্যে নয়,
টুসি কে চুপ করে থাকতে দেখে বললো তপু, একটু অবাক হলো টুসি, কোনো কথা না বলেই আস্তে করে ঘাড় টা হেলালো ও।
আমার বাবার ব্যবহারের জন্য কি তোর আমার ওপরেও কোনো ক্ষোভ আছে ?
টুসি খুব অপ্রস্তুত হলো,
কি বলছো তপু দা! ছি ছি, আমি কখনো এরকম ভাবিনি!
তাহলে মাঝে মাঝেই এরকম করিস কেনো কোনো কারণ ছাড়াই!
কি বলবে ও বুঝতে পারছিলো না, ও যেটা ভেবেছে সেটা মুখে তপু দা কে বলা তো সম্ভব নয় কিছুতেই। কিন্তু তপু দা ওকে ভুল বুঝছে, সেই ভুল টা ভাঙাতে চাইলো ও। ঘরে বসে গল্প না করে হোটেলের সামনে হাঁটলে, কেউ কিছু মনে করবে না!
সেরকম কিছু নয়, ঘুম পাচ্ছিলো আমার, ঠিক আছে চলো হাঁটি,
তপু কে আর কিছু বলতে না দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো টুসি।
কোনোদিন যদি এরকম আসে যে তোকে বাবার মুখোমুখি হতে হলো আবার, তুই কি সহজ ভাবে নিতে পারবি সেটা?
হাঁটতে হাঁটতে তপু সোজাসুজি টুসির চোখের দিকে তাকালো। টুসি এতক্ষন চুপ করেছিলো, এবার একটু অবাক হয়ে তাকালো।
কিছু উত্তর দিলি না তো?
টুসির অন্যমনস্ক ভাব নজর এড়ালো না তপুর। কয়েক মুহূর্তের জন্যে ছোটো বেলার সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিটা ফিরে এলো টুসির, কিছুক্ষন আগেও কতো খুশি ছিলো ও। এই মুহূর্তে সেই ভালোলাগাটা একটু হলেও হারিয়ে যাচ্ছিলো। কাকু কি ফিরে আসবে তপু দাদের বাড়িতে!
আমি জানিনা এটা কেনো বললে তুমি! তুমিই তো বলেছিলে কাকুর সঙ্গে তোমাদের কোনো যোগাযোগ নেই, তাহলে? যেখানে তোমাদেরই যোগাযোগ নেই সেখানে আমার মুখোমুখি হবার কথা আসছে কেনো!
হটাৎ করে এমন কথা তপু দার মুখে! কিছুই বুঝতে পারছিলো না টুসি।
ভবিষ্যত কে বলতে পারে বল! আচ্ছা! এই ঘটনাটা যদি তোর খুব কাছের কেউ করতো! যার সঙ্গে সম্পর্ক তুই ইচ্ছে হলেও নষ্ট করতে পারবি না, এমন কেউ! তখন কি করতিস তুই?
একটু থমকে গেলো টুসি, এই ভাবে ও ভাবে নি কখনো আগে, বলেই ফেললো সেটা,
আমি সত্যি ভাবিনি কখনো এটা নিয়ে, জানিনা এরকম হলে কি করতাম, বা ভবিষ্যতে কি করবো!
বাবা খুব অসুস্থ শুনলাম মাসির কাছে, দেখার মতো কেউ নেই!
মাসির সঙ্গে যোগাযোগ আছে কাকুর? কিভাবে!
চমকে তাকালো টুসি।
যোগাযোগ নেই, তবে খবর রাখে মাসি, আমরাও খবর রাখি তো! কিছু সম্পর্ক যোগাযোগ না রাখলেও অস্বীকার করা যায় না বুঝলি!! এমন অনেক সম্পর্ক থাকে যেগুলো তোকে দুঃখই দেয় সারাজীবন, কিন্তু তবুও সেগুলোর পিছুটান তুই অবহেলা করতে পারবি না কখনই,
তপুর গলার স্বরে এমন কিছু ছিলো যেটা টুসির মন টা খুব খারাপ করে দিলো।
তুমি কি কাকু কে বাড়িতে নিয়ে আসতে চাইছো?
আস্তে করে বললো টুসি, তপুর কথার মধ্যে ও সেরকমই আভাস পাচ্ছিলো।
আমার চাওয়া না চাওয়ার ব্যাপার নয় এটা, মা চাইছে! তবে এই মুহূর্তে বাড়িতে আনতে নয়, আমি যেনো গিয়ে যোগাযোগ করি সেটা চাইছে মা। আমার সঙ্গে তো বাবার কোনো বিরোধ কখনো ছিলো না, মায়ের ইচ্ছাতেই আমি সায় দিয়েছিলাম। আজ যদি মা নিজের থেকেই আবার বাবার দায়িত্ব নিতে চায় তাহলে সেখানে আমার কিছুই বলার থাকেনা।
এই কথাগুলো তুমি আমাকে কেনো বলছো? এগুলো তো তোমাদের নিজেদের ব্যাপার,
তোকে বলছি কেনো! তুই কি সত্যিই বুঝিস না তোকে কেনো বলছি!
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো তপু, টুসি চোখ নামিয়ে ফেললো,
বাবার দায়িত্ব যদি নতুন করে নিই আবার, তাহলে ভবিষ্যতে এরকম দিন আসতেও পারে কখনো যখন হয়তো বাবা কে বাড়িতে নিয়েই আসতে হলো! তাই সব দিকটা ভেবেই এগোতে চাই!
তপু দার কথার পেছনে লুকিয়ে থাকা কথাটা বুঝতে পারছিল ও, কিন্তু কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না টুসি, ওর যে খুব অস্বস্তি হবে সেটা তো ও জানেই, কিন্তু কাকিমার চাওয়াটা তো অন্যায় নয়! কিন্তু ওর জন্যে যদি তপু দা কে কাকিমা কে না বলতে হয়, সেটাও যে ঠিক হবে না সেটা বুঝতে পারছিল ও। আর কোন অধিকারে ই বা বলবে ও, কাকু যদি তাঁর নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন, তাহলে সে ব্যাপারে কথা বলার ও কে!! তাও তপু দা এই কথাগুলো যে ওকে বললো সেটা মনে করেই ভালো লাগলো ওর। তপু দা যে সত্যি ওর ইচ্ছে জানতে চায়, এটা ওর কাছে বড়ো পাওয়া।
তুই কি চাস এটা সত্যি জানতে চাই,
ও কে চুপ করে থাকতে দেখে আস্তে করে বললো তপু, কি বা বলবে আর ও নতুন করে! না বললে যে মুখে কিছু না বললেও মনে মনে দুঃখ পাবে তপু দা, সেটা তো আর ওর অজানা নয়! ওদের সব ব্যাপারে কি ওর মতামত দেওয়া উচিত!
যদি কাকিমা চায় তাহলে যাও তুমি, আমার এই বিষয়ে সত্যি কিছু বলার নেই!
বলেই ফেললো টুসি। কিন্তু মনের মধ্যের দোলাচল টা গেলো না কিছুতেই। এই কি শুরু হলো জীবনে মানিয়ে নেওয়া! এর আগে তো মা এর সঙ্গে মত বিরোধের সময় নিজের যুক্তিতেই অনড় থেকেছে ও, আজ পারছে না কেনো! শুধুই মনে হচ্ছে তপু দার খারাপ লাগবে, অন্যের ভালোলাগা বা খারাপ লাগা কে তো ও গুরুত্ব দেয়নি এতদিন। আজ তাহলে ওর খারাপ লাগার কথাটা সোজাসুজি বলতে পারছে না কেনো!
কি ভাবছিস এখনো! ছেড়ে দে এসব এখন, আমি শুধু তোকে বলে রাখতে চেয়েছিলাম, কোনো কিছুই স্থির করিনি এখনও। আসলে মাসি একটু খোঁজ খবর রাখতো, কিন্তু মাসিরা তো এখানে বাড়ি কিনে চলে আসছে, তাই আর খবর পাওয়া সম্ভব হবে না,
তপুর কথায় নতুন করে অন্য চিন্তা মাথায় ঢুকলো টুসির, মাসি চলে আসছে মানে তো সীমা রা ও চলে আসবে! ওই মেয়েটা কে টুসির একটুও পছন্দ নয়, বড্ড গায়ে পড়া! কালকে তপুর পেছন ছাড়তেই চাইছিলো না একদম! আজও কেমন বিরক্ত মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
সীমাও তো তারমানে শিলিগুড়িতে থাকবে এবার থেকে তাই না?
ধৈর্য্য রাখতে না পেরে বলে ফেললো টুসি, তপু এবার হেসে ফেললো,
তুই এতো ওকে নিয়ে ভাবছিস কেনো! কাল থেকেই দেখছি তুই বড্ড রেগে আছিস ওর ওপরে,
মনে মনে একটু লজ্জিত হলো ও, তপু দা বোধহয় খুব খারাপ ভাবলো ওকে! কিন্তু ও যে নিজের উৎকণ্ঠা কিছুতেই চেপে রাখতে পারছে না। মেয়েরাই বোধহয় মেয়েদের মন ভালো বুঝতে পারে! সেই থেকেই ও লক্ষ্য করছে সীমা কে, ও যেনো তপু দা কে একটু অন্যরকম চোখেই দেখে। কিন্তু এই কথাটা তপু দা কে বললে ও একটুও বিশ্বাস করবে না, তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গেলো টুসি।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেকক্ষন, চারিদিকে বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব, রাস্তাঘাট কুয়াশায় ঢাকছে আস্তে আস্তে, কাল দুপুরে খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়বে এখান থেকে, জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিতে হবে এবার, তাই এবার হোটেলে ফেরার জন্যে উঠে দাঁড়ালো ওরা।
পরের দিন ফেরার সময় সীমা যথারীতি তপু দার পাশে গিয়ে বসে পড়লো, কিন্তু এখন আর টুসির খারাপ লাগছিলো না। গত দুদিন ধরে ও তপু দা কে যেভাবে পেয়েছে তার পরে সীমা কে ওর একটুও নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হচ্ছিলো না আর। ও যতই চেষ্টা করুক না কেনো তপু দা যে আসলে ওকেই ভালোবাসে সেটা বুঝতে পারছিলো টুসি।
বাড়ি পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেলো, গাড়ি থেকে নেমে ও দাঁড়িয়ে ছিলো। তপু দা গাড়ির পেছন থেকে ওর ব্যাগ টা বার করে ওকে গেটের সামনে পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। ব্যাগ টা কাঁধে নিয়ে সবে দরজার কড়া টা নাড়তে যাচ্ছিলো টুসি, তপু দার ডাকে পেছন ফিরে তাকালো,
শোন, তুই কাল জানতে চেয়েছিলি না মাসির দেওর রা চলে যাবে কিনা, তোকে বলা হয়নি তখন, তুই আসলে যার কথা জানতে চেয়েছিলি সে কিন্তু বাবা, মায়ের সঙ্গে ফিরছে না, এখন থেকে এখানেই থাকবে, মাসির বাড়িতে চলে যাস মাঝে মাঝে, গল্প করে আসিস!
বলেই একটু মুচকি হেসে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলো তপু, টুসি একদম বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলো। ইস! তপু দা সব বুঝে গেছে!
ক্রমশ