#জীবনের জলছবি
#পর্ব ২৩
পাহাড়ি জায়গার ভোরবেলা গুলো ভীষণ সুন্দর, দূরে পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে গোল থালার মত লাল টকটকে সূর্য টা যখন বেরিয়ে আসে, খুব ভালো লাগে টুসির। প্রত্যেকবার যখনই এখানে আসে ও, এই সময়টা বিছানায় শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না ওর।
এবারও গায়ে একটা পাতলা শাল জড়িয়ে নিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলো ও। অন্য দিন এই সময় ও টিউশন পড়তে বেরিয়ে পড়ে, আজ এখন কোনো কাজ নেই, কাকিমা বা মাসি কেউ এখনও ওঠেনি, বারান্দার রেলিং এ হেলান দিয়ে দূরের কুয়াশা ঢাকা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো টুসি।
এতো ভোরে উঠে পড়েছিস!
ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো তপু। টুসি কোনো উত্তর দিলো না, ভোর বেলা ঘুম ভেঙে বেশি কথা বলতে কোনো সময়ই ভালো লাগে না ওর। আর এখন তো খুব অভিমান হয়ে আছে, কাল রাতে অনেক ভেবেছে ও।
তপু দার সম্বন্ধে ও যা ভেবেছে সেটা কি আদৌ ঠিক! সত্যিই কি তপু দা ওকে ভালোবাসে, নাকি সবটাই ও নিজের মতোই ভেবে নিয়েছে! কালকে তপু দা ওর সঙ্গে যে ব্যবহার করেছে তাতে এই ধারণা আরও দৃঢ় হয়েছে ওর, সত্যি যদি তপু দার ওর জন্যে কোনো ফিলিং থাকতো তাহলে এতো টা দূরে সরিয়ে রাখতে পারতো না ওকে।
কি হয়েছে? এতো গম্ভীর কেনো? রেগে আছিস নাকি!
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বললো তপু, এই প্রশ্নের উত্তর আর কি দেওয়া যায়! সত্যি যে ওর খারাপ লেগেছে সেটা তো আর বলা যায় না তপু দা কে, তাই এবারও চুপ করেই থাকলো টুসি।
চল, ঘুরে আসি একটু, এই সময় টা হাঁটতে খুব ভালো লাগে আমার,
টুসি মনস্থির করতে পারছিলো না যাবে কিনা, ওর নিজের খুব যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ভেতরের চেপে রাখা অভিমান ওকে যেতে দিচ্ছেনা কিছুতেই।
চল, প্লিজ,
এবার একদম নরম গলায় অনুরোধের সুরে বললো তপু, টুসি আর জেদ ধরে রাখতে পারছিল না।
কাকিমা কে বলে আসি দাঁড়াও, না হলে কাকিমা চিন্তা করবে,
কাকিমা কে বলে এসে তপু র সঙ্গে হাঁটতে বেরোলো টুসি। ফাঁকা, নিস্তব্ধ রাস্তায় হেঁটে যেতে খুব ভালো লাগছিলো, কোনো কথা না বলেই হাঁটতে লাগলো ও,
শুভ র বিয়ে জানিস তো! মামার শরীর তো ভালো না, শুভই সব করে এখন। কিন্তু নিজের বিয়েতে তো ওর পক্ষে অন্য কাজগুলো করা সম্ভব হবে না, আমাকেই করতে হবে ওগুলো। তাই কালকে ওর সঙ্গে একটু আলোচনা করছিলাম, তোর সঙ্গে আর গল্প করা হয়নি,
খানিকটা কৈফিয়তের মত করেই বললো তপু, মনটা একটু হলেও ভালো হয়ে যাচ্ছিলো টুসির। শুভ দার বিয়ের কথা কাকিমার কাছে শুনেছে ও, কাকিমার দাদা গিয়ে ওদের বাড়িতেও তো নিমন্ত্রণ করে এসেছিলো আগেই জানতো, তপু দা কে যে অনেকটাই দায়িত্ব নিতে হবে সেটাও কাকিমা বলেছিলো, সেটা এখন মনে পড়ছিলো টুসির। কিন্তু সীমা ওখানে কি করছিলো,ওর তো ওই সব কথায় থাকার কথা নয়। মনে পড়তেই আবার তপু র ওপর অভিমানটা ফিরে এলো টুসির।
সীমাও তোমাদের সঙ্গে বিয়ের দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করছিলো বুঝি! ওকেও দায়িত্ব দিয়েছে শুভ দা!
এতক্ষনে অভিমানের গলায় বলে ফেললো টুসি। তপু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো, টুসির অভিমান কি বুঝে ফেললো তপু দা! টুসির খুব লজ্জা লাগছিলো, ইস তপু দা যদি বুঝতে পারে টুসির সীমার ওপরে রাগ হচ্ছে,সেটা খুব লজ্জার হবে! তপু দা ঠিক সবটা বুঝে যাবে, ওর যে তপু দা কে ভালো লাগে, ও যে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে তপু কে,এটা তপু দা বুঝুক সেটা একদম চায় না টুসি। নিজের লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা তপু দা কে দেখতে না দিয়ে অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলো ও।
চল, নিচের দিকের রাস্তা টায় নামি, এদিকে লোকের ভিড় হয়ে যাচ্ছে, ভালো লাগছে না,
হটাৎ করেই টুসির হাতটা টেনে নিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে যাওয়া পায়ে চলা পথ টা দিয়ে নামতে লাগলো তপু। রাস্তাটা বেশ খাড়াই, সোজা নিচের দিকে নেমে গেছে, টুসি ব্যালান্স রাখতে না পেরে আরও শক্ত করে তপু দার হাত টা চেপে ধরলো। বেশ খানিকটা নামার পরেই একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়লো দুজনে, টুসি এবার হাত টা ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো, কিন্তু তপু শক্ত করে ধরে আছে দেখে টুসি আর চেষ্টা করলো না। ওর নিজেরও খুব ভালো লাগছিলো।
জায়গাটা ভীষণ সুন্দর, উল্টোদিকের পাহাড়ের ঢাল বলে রোদ এসে পড়েনি এদিকে, হালকা কুয়াশায় ঢাকা হয়ে আছে, পরিবেশটাই এমন দুজনেই চুপ করে বসেছিলো।
সব সময় আমরা চোখের সামনে যা দেখি, আর আসলে যা ঘটে দুটো এক হয়না বুঝলি তো!
টুসির হাত টা ধরে রেখেই ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললো তপু, টুসি একটু অন্য মনস্ক হয়ে গিয়েছিলো চমকে তাকালো। তপু র কথার পেছনে লুকিয়ে থাকা কথাটা বোঝার চেষ্টা করছিলো ও।
ধর এই যে আমরা দুজনে এখানে বসে গল্প করছি, এখন যদি অন্য কেউ এখানে এসে আমাদের সঙ্গে বসে, আমরা কি তাকে চলে যেতে বলতে পারবো? পারবো না তো! সেই রকম অনেক কিছুই আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয়, সেটা কে মেনে নিই আমরা। তোর খারাপ লেগেছে জানি, কালকেই বুঝেছি সেটা, কিন্তু কিছু করার ছিলো না।
তপু দার বলা কথাগুলো শুনে খুব লজ্জা লাগছিলো টুসির, কেনো যে ও বলতে গেলো তখন! মনে মনে একটু আনন্দও হচ্ছিলো, ওর খারাপ লাগাটা বুঝতে পেরেছে তপু দা! আর ও কতো কি ভেবেছে কাল রাত থেকে, আজকের সকাল টা যেনো ওর কাল রাতের সব দুঃখ ভুলিয়ে দিচ্ছে। টুসি চুপ করে রইলো, এই তপু দাকেই তো চেনে ও, ও যে কেনো ভুল বুঝলো! মনে মনে লজ্জা পেলো ও।
আমি ওই ভাবে কিছু বলতে চাইনি! তুমি অন্য রকম ভাবছো!
লজ্জা লজ্জা গলায় বললো টুসি, তপু হেসে ফেললো।
তুই এখনও আগের মতই আছিস, একটুও বড়ো হোসনি, কি ভাবে বলতে চাসনি তুই! আর আমি কি রকমই বা ভাবছি!
ও যে কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেললো! টুসির আরও লজ্জা লাগছিলো, তপু দা না! বড্ড পেছনে লাগে ওর!
শুভ দার বিয়ে কবে?
কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে জানতে চাইলো টুসি,
তুই কার্ড দেখিস নি? মামা গিয়েছিলো না তোদের বাড়ি! আর তো মাস খানেক বাকি মাত্র! ওই জন্যেই তো মাসিও চলে এসেছে।
সত্যিই! ও কার্ড টা খুলেই দেখেনি একবারও, একটু খারাপ লাগলো টুসির। কিন্তু মাসি চলে এসেছে মানে! সীমা রাও কি মাসির সঙ্গে এখন থেকেই থাকবে নাকি! টুসির বুকের ভেতর টা ধক করে উঠলো।
মাসির দেওর, জা? ওরাও থাকবে এখন?
সীমা থাকবে কিনা এটা আর সোজাসুজি জিজ্ঞেস করতে পারলো না ও, যদিও ও আসলে ওটাই জানতে চাইছিলো।
না, ওরা চলে যাবে, পরে আসবে আবার,
একটু মুচকি হেসে বললো তপু, হাসির পেছনের কারণ টা বুঝতে পারলেও খুব বেশি পাত্তা দিতে চাইলো না টুসি, ওর যা জানার ছিলো সেটা জানা হয়ে গেছে।
হোটেলে ঢোকার সময় বারান্দায় দাঁড়ানো সীমা কে দেখতে পেলো টুসি, একদৃষ্টে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সীমা কে দেখতে পেয়েই এতক্ষন ধরে টুসির ধরে থাকা হাত টা ছেড়ে দিলো তপু। টুসি মনে মনে একটু দুঃখ পেলো, ইস তপু দা যে ওর হাত ধরে ছিলো এটা কি সীমা দেখতে পেলো! পেলে খুব ভালো হতো! এই মুহূর্তে আর ওর কোনো দুঃখ নেই, তপু দার কথা থেকেই পরিষ্কার যে না চাইতেও সীমা কাল ওদের সঙ্গে গিয়ে বসেছিলো।
হোটেলে ঢুকে দেখলো কাকিমা বাদে অন্য সবাই লনে চেয়ার নিয়ে বসে আছে, ওদের কে একসঙ্গে ঢুকতে দেখেই সবাই একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। তপু না খেয়াল করলেও টুসি সেটা খেয়াল করলো, ওর ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো। সবার তাকিয়ে থাকার পেছনের লুকিয়ে থাকা প্রশ্নগুলো যেনো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল টুসি।
ক্রমশ