#জীবনের জলছবি
#পর্ব ২৬
স্ট্যান্ডে এসে যখন বাস থেকে নামলো টুসি, তখন প্রায় বিকেল পাঁচ টা। আজ দিনটা খুব ভালো কেটেছে সকাল থেকেই, কলেজে ঢুকেই শুনেছিলো আজ অবরোধ, গেটের সামনে বসে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলো বেশ কিছু ছাত্র, ছাত্রী। কলেজে আজ ক্লাস হবে না বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা বেরিয়ে পড়েছিলো, টুসি বাড়ির দিকেই ফিরতে চাইছিলো, কিন্তু বন্ধুরা অন্য প্ল্যান করে ফেললো। ওদের পাল্লায় পড়ে টুসিও একটু ভেবে রাজি হয়ে গেলো।
প্রতিবার ওরা কলেজ না থাকলে সেবক যায়, এর বেশি দূরে গেলে ঠিক সময়ে ফিরতে পারা যায়না, এবারও তাই হলো। প্রায় দৌড়ে স্ট্যান্ডে পৌঁছেই সামনেই একটা বাস পেয়ে গেলো ওরা। বাস টা মোটামুটি ফাঁকা, মেয়েরা সবাই একটা করে জানলার ধারের সিট দখল করে নিলো। সোমাও একটা জানলা দখল করে নিয়েছে দেখে টুসি আর ওর পাশে বসলো না। টুসি অন্য একটা জানলার পাশে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজা এসে ওর পাশে বসে পড়লো।
রাজা টা বড্ড বেশি বকে, ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাসটা যখন হসপিটালের সামনে দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিলো তখন টুসি কোয়ার্টারের ছাদে তপু দা কে দেখতে পেলো। তপু দা ওকে দেখতে পেয়েছে দেখে টুসি কিছু বলতে যাবার আগেই বাস টা পেরিয়ে গেলো। তপু দা কে দেখেই সীমার কথা মনে হলো টুসির, ওকি সত্যি আছে এখানে! সেদিনের তপু দার বলা কথার পর টুসির এত লজ্জা লেগেছিলো যে ও আর এই কদিনে একবারের জন্যেও তপু দাদের বাড়ির দিকেই যায়নি।
সেবকে সারাদিন দারুন মজা হয়েছিলো, দুপুরে ওখানে খেয়ে ফেরার বাসে উঠে পড়েছিলো ওরা। রাজা তপু দার মামার বাড়ির ওখানেই থাকে, ওরও নিমন্ত্রণ আছে কথায় কথায় টুসি কে বললো। মনে মনে একটু বিরক্তই হলো টুসি, ও এত কথা বলে তাই ওরা সবাই রাজা কে একটু এড়িয়েই চলে, কলেজে কেউ ওর সঙ্গে বেশি কথা বলতে চায় না। এবার বিয়ে বাড়িতে সারাদিন বকে বকে মাথা ধরিয়ে দেবে ওর।
তুই কি বরযাত্রীও যাবি নাকি?
রাজা কে জিজ্ঞেস করে ফেললো টুসি। ও একটু তপু দার সঙ্গে আলাদা গল্প করবে ভেবে রেখেছে, এখন এই রাজা যদি সঙ্গে যায় তাহলে তো ওর আর কথা বলারই কোনো সুযোগ থাকবে না। রাজা যাবে শুনেই মাথাটা গরম হয়ে গেলো টুসির, উফ! এই ছেলেটা কে যে কিভাবে সরানো যায়!
বাস থেকে নেমে বন্ধুরা একে একে আলাদা হতে থাকলেও রাজা ওর সঙ্গেই হাঁটতে লাগলো। তপু দা সেদিন ওকে কি বলতে চেয়েছিলো না জানা পর্যন্ত ভেতরের টেনশন টা চেপে রাখতে পারছে না ও। টুসি একটু তপু দাদের বাড়ি যাবে বলে ভাবছিলো, সীমা এখানে সত্যি আছে কিনা সেটাও দেখতে চায়। কিন্তু রাজা কে কিছুতেই কাটাতে পারছে না, হসপিটালের সামনে এসে সবে ও রাজাকে চলে যাবার জন্যে বলতে যাচ্ছিলো, তপু দা গেট দিয়ে বেরিয়ে এলো। রাজা কে ওর সঙ্গে দেখেই মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেলো তপু দার,
আমি তোমাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম, তুমি সেদিন কি কথা বলার ছিল বলেছিলে,
তড়িঘড়ি বললো টুসি,
যা, মা বাড়িতে আছে, আমি একটু বেরোচ্ছি,
বলেই হাঁটতে শুরু করলো তপু, যাহ! তপু দা বেরিয়ে যাচ্ছে, ও তো তপু দার জন্যেই যাচ্ছিলো,
কখন ফিরবে তুমি? দেরি হবে?
খানিকটা হতাশ গলায় বললো টুসি, ও আশা করেছিলো তপু দা এক্ষুনি ফিরে যাবে নিশ্চয়ই, ওকে দেখার পর আর বেশিক্ষন বাইরে থাকবে না, কিন্তু তপু দার কথায় অবাক হয়ে গেলো ও,
আমাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলি তুই! অহেতুক মিথ্যে বলিস কেনো! সকাল থেকেই তো একসঙ্গেই বেড়াচ্ছিস, এখন আমাকে দেখতে পেয়েই আমাদের বাড়ি যাবার কথা বলতে হলো তাই না!
চাপা গলায় শুধু টুসির শুনতে পাবার মতো করে কথাগুলো বলেই জোর পায়ে হাঁটতে লাগলো তপু দা, টুসির খুব অপমানিত লাগছিলো। তপু দা কি রাজা কে ওর সঙ্গে দেখে কিছু খারাপ ভাবলো। যত নষ্টের গোড়া এই রাজা টা, সকাল থেকে ওর পেছনেই পড়ে আছে! সব রাগ গিয়ে রাজার ওপর পড়লো ওর,
তুই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেনো! বাড়ি যা না!
প্রায় চিৎকার করে উঠলো টুসি, রাজা একটু থতমত খেলো, কি বুঝলো কে জানে, মাথা নিচু করে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। ও চলে যেতেই খারাপ লাগাটা ফিরে এলো টুসির, ইস! ও খুব বাজে ভাবে রাজার সঙ্গে কথা বলে ফেলেছে। বেচারা বোধহয় বুঝতেই পারেনি ওর দোষ কি!
তপু দার জন্যেই এটা হলো! টুসি যদি ওর বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েই থাকে কোথাও তাতে তপু দার রাগের কারণ কি! তপু দাও তো দার্জিলিঙে গিয়ে সারাক্ষন সীমার সঙ্গে বসেছিলো, টুসি তো একটুও রাগ করেনি তখন। ও তো বুঝতে চেষ্টা করেছিলো ব্যাপারটা, কিন্তু তপু দা তো ওকে কোনো কথা বলার সুযোগই দিলো না! ধুস! ও শুভ দার বিয়েতে যাবেই না আর, ওখানেও তো রাজা থাকবে, আর তপু দা ওকে দেখলেই বিরক্ত হবে টুসির ওপরে।
ভীষণ মন টা খারাপ হয়ে গেলো ওর, সীমা এখানে আছে কিনা সেটা জানতেও আর ইচ্ছে করছে না একদম, শীলা কাকিমার সঙ্গে দেখা না করেই এগিয়ে আসা বাস টাকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্যে উঠে পড়লো টুসি। তপু দার সঙ্গে কথাই বলবে না আর, বাসে উঠেই ঠিক করে নিলো ও।
বাড়িতে ঢুকতেই মায়ের মুখোমুখি হলো ও, একটু দেরি হয়ে গেছে আজ, তপু দাদের ওখানে না গেলে হতো না। ওখানে গিয়ে খারাপই হলো, তপু দাও খারাপ ব্যবহার করলো, আবার মায়ের কাছে বকুনিও খেতে হবে! বাবা এখনও অফিস থেকে ফেরেনি সেটাই রক্ষ্যে, না হলে আরো বিপদ হতো!
আজ এত দেরি কেনো?
মায়ের প্রশ্নে হটাৎ করেই রাগ হয়ে গেলো টুসির, মা কিছুতেই বুঝতে চায় না এখন আর ও আগের মতো ছোটো নেই! সেই ক্লাস এইট, নাইন এর মতোই মনে করে ওকে! সব সময় কৈফিয়ত চায়, ওর কি নিজের ব্যক্তিগত কোনো কিছু থাকতে পারে না!
সেবক গিয়েছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে, কলেজে ক্লাস হয়নি তাই,
আজ সত্যি টাই বলে ফেললো ও, যা হয় হবে! সারাদিন মায়ের এত শাসন আর ভালো লাগে না ওর। ওর অন্য বন্ধুদের মায়েরা এতো কড়া নয়।
বাহ! খুব ভালো, বেশ উন্নতি হয়েছে তো!
বিদ্রুপের গলায় কথাগুলো বলেই ওর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মা। এখন চলে গেলেও বাবা বাড়িতে এলে মা যে বলবেই বাবা কে সেটা জানে টুসি। কিন্তু ওর এখন এসব ভালো লাগছিলো না, তপু দার ব্যবহারে মন টা খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, কেনো যে তপু দা ওর সঙ্গে সব সময় এরকম করে কে জানে! টুসি কে কষ্ট দিয়ে কি খুব আনন্দ পায় ও!
ক্রমশ