#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-২৬
সপ্তাহ খানেক যেতেই জেসিকার মৃ’ত্যু’র প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসে। অপরাধী সব ধরা পড়ে প্রকাশ্যে। যেহেতু সম্পূর্ণ বিষয় প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ায় সেহেতু জনসাধারণ খুব দ্রুত অবগত হয়ে যায়। যার দরুণ, ক্যাসটা চলে উচ্চ পর্যায়ে এবং কঠোর পদক্ষেপে। টাকার জোরে আর ছাড় পায় না অপরাধীরা। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সকল দোষীকে আটক করে নেয় পুলিশ। বর্তমানে জেসিকার কু’ক’র্ম,মৃ’ত্যু,প্রকৃত ঘটনা এসব নিয়ে নতুন গুঞ্জন তৈরি হয় চারদিকে। তবে কে এই তথ্য ফাঁস করেছে তা জানা যায় নেই। কিন্তু যেই বা করেছে, আড়ালে থেকে খুব সুক্ষ্মভাবে কাজটা করেছে।
প্রাণ এসবের খবরাখবর রাখলো ঠিকই। যথারীতি, প্রিয়মের নাম আসেনি কোথাও। যদিও এটা নিয়ে প্রাণের মধ্যে তেমন একটা ভাবান্তর সৃষ্টি হয়নি, তবে ভাবনা তার আঁটকে আছে অন্য এক জায়গায়। একটা হিসাব সে কোনভাবেই মিলাতে পারছে না। প্রশ্ন তার এখানে, “প্রিয়ম এসবে জড়ালো কিভাবে? ও কখন?” তার জানা মতে, প্রিয়ম বাংলাদেশ এসেছেই গত বছর। এতদিন দেশের বাহিরে থেকেই নিজের পড়াশোনা শেষ করেছে। সেহেতু দেশেই এই সার্কেলে ঢুকে পড়া মুখের কথা না। সে খোঁজ নিয়েছিল ঠিক, প্রিয়ম এসবে জড়িত কি-না। পেয়েছিলও জড়িত। কিন্তু এখন সেদিক তাকালে তা পাকাপোক্ত প্রমাণ লাগছে না। কারণ সেই রাতে প্রিয়ম উপস্থিত ছিল কি-না এটা নিশ্চিতভাবে জানতে পারেনি সে। উপরন্তু, কোথাও একটা ফাঁক আছে লাগছে৷ তখন সামান্য প্রমাণ পেয়েই নিহাল শিকদারের করা অতীতের কার্যক্রমের জন্য তার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে, তাই কথা শোনানোর সুযোগ পেয়ে হাত ছাড়া করতে চায়নি। সবকিছু গভীরভাবে না ঘেটেই চলে যায় নিহাল শিকদারের নিকট। কিন্তু এখন লাগছে, আরেকটু যাচাই-বাছাই করা উচিৎ ছিল।
প্রাণ যখন এসব ভাবনায় মগ্ন তখনই আগমন ঘটে নিহাল শিকদারের। তিনি কোনরূপ শব্দ না করে সোজা ঢুকে পড়েন প্রাণের রুমে। অকস্মাৎ তাকে প্রাণ চমকায়। ক্ষণেই ইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “এই অবেলায় আপনি?”
নিহাল বিছানায় গিয়ে বসে বলেন, “কথা আছে তোমার সাথে। দরজা লাগাও।”
মুহূর্তেই প্রাণের ভ্রু দুটির মধ্যকার দূরত্ব ঘুচে আসে। প্রশ্ন করতে গিয়েও নিহালের গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহেরা দেখে আর করলো না। নিঃশব্দ পায়ে চলে যায় দরজা লাগাতে। দ্বারের কাছে যেতেই কয়েক হাত দূরে আশা বেগমকে লক্ষ্য করে সে,ভীতিগ্রস্ত নয়নে তাকিয়ে আছেন তিনি। প্রাণ ক্ষীণ হেসে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে তাকে, অতঃপর ভিড়িয়ে দেয় দরজা। এগিয়ে যায় নিহালের দিকে। জিজ্ঞেস করে, “বলুন।”
নিহাল শিকদার প্রাণের দিকে একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলেন, “প্রিয়ম ওয়াস নট গিল্টি।”
কথাটা কর্ণগোচর হওয়ার পরও প্রাণ কোনরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায় না। নীরবে ফাইলটা হাতে নিয়ে দেখতে থাকে। নিহাল বলেন, “যেদিন জেসিকার খু’ন হয় সেদিন প্রিয়ম ঢাকায় ছিল না। বন্ধুদের সাথে খাগড়াছড়ি গিয়েছিল, ঘুরতে। ওর হাত ছিল না এসবে।”
প্রাণ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, “তাহলে ওর রবিন কর্মকারের সাথে এত উঠাবসা কেন? যেসব অনৈতিক কাজে রবিন কর্মকার জড়িত সেসবে প্রিয়মের নাম উঠেছে কেন? আমি খোঁজ নেওয়ার সময় ওর নাম কেন সামনে এসেছে?”
নিহাল বলেন, “প্রিয়ম মা’দ’কা’স’ক্তে’র সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল। কবে কিভাবে আমার জানা নেই, খুব সম্ভবত বিদেশ থাকাকালীন এই নে’শা’য় জড়িয়ে পড়েছিল ও। আর এই বিষয়টা রবিন জানতো। ওই প্রিয়মকে প্রয়োজনীয় সব এনে দিত এবং নিজের সাথে সাথেই রাখতো তাই ওর নাম সব জায়গায় উঠেছে। আর এসবের পিছনে রবিনের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রিয়মকে হাত করে আমার থেকে সব কেড়ে নেওয়ার। কিন্তু প্রিয়ম রবিনের আসলরূপ জানতো না, ওর মতলব শুধু নে’শা’দ্র’ব্য পাওয়া থেকে ছিল। ওকে এতদিন জেরা করা পর ও সব স্বীকার করে। তার উপর জেসিকার ক্যাসটাও সামনেই ছিল, সব খুঁজে বের করতে সময় লাগেনি আমার।”
এবার পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয় প্রাণের নিকট। যে অংশটা শূন্য ছিল তা এখন পরিপূর্ণ হলো যেন৷ সে আলগোছে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “আমাকে এসব জানানোর কারণ? আমি যাতে আমার কথাগুলো ফেরত নিয়ে নেই তার জন্য? না-কি আপনার আদর্শে যে প্রশ্ন তুলেছিলাম, তা তুলে নেওয়া জন্য?”
নিহাল উঠে দাঁড়ান। ধীর গতিতে প্রাণের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেন, “কোনটাই না। কারণ তোমার কোন কথা ফেলনা ছিল না। আমার আদর্শ তো হেরেই গিয়েছে। মানুষ হয়নি আমার ছেলে। কিন্তু তবুও কেন জানি এবার আমার আফসোস হচ্ছে না। তোমার থেকে জিতার আগ্রহ পাচ্ছি না।”
“কিন্তু তবুও, ছেলের নির্দোষিতা প্রমাণ করার জন্য উঠে-পড়ে লাগেন?”
নিহাল স্মিত হেসে বলে, “এর পিছে অন্যসব কারণও ছিল। ও তুমি বুঝবে না। হয়তো চাইবেও না। তাই বাদ দাও। কিন্তু একটা কথা, তোমায় এসব ডকুমেন্টস কে দিয়েছিল? আমার জানা মতে তোমার এত ভালো কানেকশন নেই যে এসব তথ্য তুমি নিজ থেকে করতে পারবে।”
প্রাণের সহজ স্বীকারোক্তি, “নয়ন দিয়েছিল এসব আমায়।”
নিহাল শিকদার ভ্রু কুঁচকে বলেন, “ভিতরে অনেক তথ্যই ভুল দেওয়া ছিল। এক্সট্রা ছিল বলতে। এসব আমি চেক না করালে বা তুমি আমাকে এসব না জানিয়ে পাবলিশ করালে খুব বাজেভাবে ফাঁসতে।”
নিহালের শিকদারের কথায় হঠাৎ নয়নের একটি কথা এখন টনক নাড়লো তার, সে বলেছিল তার পজিশন, পাওয়ার কিছুই নেই। তাই এই নিউজ পাবলিশ করা তার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু কথা হচ্ছে, তার কিছু না থাকলেও তার বাবার তো ছিলই। নিহালের সমান নাহলেও একবারে কম যান না তিনি। কিন্তু তাও সে কিছু করেনি। কারণ এখানে আবার গভীর কোন ষড়যন্ত্র ছিল, সে সাথে আলাদা ফাঁদও। সুন্দর সাজানো প্র’তি’শো’ধ। মূলত, তাকে নিয়ে কাজ করানোর ছিল তা বেশ বুঝতে পারছে প্রাণ। যার জন্য এখানে প্রিয়মের নাম আসে। সে সাথে ভুল তথ্যও৷ যাতে সে নয়নের কথায় এসে সব করে ও জ্বালে ফেঁসে যায়। যার ফলে নিহাল শিকদারও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতো, প্রিয়মকে ভুয়া ক্যাসে ফাঁ’সা’নো’র জন্য। এটা নয়নের ভালো করেই জানা, সে ইন্ডাস্ট্রিতে সেফলি টিকে আছে একমাত্র নিহালের পাওয়ারের কারণ। তো নিহাল মুখ ফিরিয়ে নিলে তখন তার কাছে নিজেকে বাঁচানোর জন্য আর কোন পথ খোলা থাকতো না। উফফ! আগে এসব ঠান্ডা মাথায় কেন ভাবলো না সে। কেন নয়নকে এতটা হালকায় নিয়ে ফেলেছিল? ভুলে গিয়েছিল, “কু’কু’রে’র লেজ কখনো সোজা হয় না।”
প্রাণের এবার ক্ষোভে চোখ দুটো র’ক্তি’ম হয়ে আসে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করে উঠে, “দ্যাট বা’স্টা’র্ড!”
নিহাল রো’ষা’গ্নি কন্ঠে বলেন, “নয়নের ব্যবস্থা এবার আমি নিচ্ছি। ওর সাহস একটু বেশি বেড়ে গিয়েছে, আ’গু’ন নিয়ে খেলতে চাচ্ছে তো? বেশ! ওর অবস্থা এবার কি হবে আমি নিজেও জানি না।”
প্রাণ কথাটা শুনে তাকায় একবার। সে জানে, এবার তার পরিবারের উপর কথা এসেছে বলেই এতটা হিং’স্র হয়ে উঠেছেন নিহাল। অন্যথায় তিনি প্রত্যেকবারের মতই শান্ত থাকতেন৷ তার সো কলড সম্মান রক্ষার জন্য লোকদেখানো পদক্ষেপ বাদে কিছুই করতেন না। প্রাণ দৃষ্টি নত করে রাখে। এর মাঝে নিহাল ধাতস্থ কন্ঠে বলে উঠেন, “তুমি এখন আর বো’কা না প্রাণ। যে কারো কথায় গলে গেলে বা বিশ্বাস করলেই হবে না। আর না এত দরদী হওয়া উচিৎ তোমার। একা থাকো, একাই জীবনযাপন কর৷ তাই ভবিষ্যতে কিছু হলে এর দায় কেউ নিবেও না।”
প্রাণ শ্লেষের হাসি হেসে বলে, “আমার দায় কারো নিতেও হবে না। এট লিস্ট আপনাকে তো নাই-ই। তাই চিন্তামুক্ত থাকুন।”
নিহাল বলেন না কিছু। তিনি জানেন, প্রাণ প্রচন্ড বুদ্ধিমতি ও কঠোর। একাই সব সামলে উঠতে পারে সে। কিন্তু তবুও ভয় হয় তার, শুরু থেকেই প্রাণ ন্যায় বিচার করতে গিয়ে অনেক শত্রু তৈরি করে নিয়েছে নিজের বিরুদ্ধে। অনেকে আবার ওর সফলতার পিছনেও আছে। এখন এর মাঝে কে কোনদিক দিয়ে পিঠে ছুঁ’ড়ি চালিয়ে দেয় কে জানে? লম্বা নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি৷
প্রাণ এবার নিজ ভাবনা থেকে জিজ্ঞেস করে, “প্রিয়ম কোথায় এখন?”
নিহাল নত দৃষ্টিতে শুধু বলেন, “রিহ্যাব সেন্টারে পাঠানো হয়েছে ওকে। অবস্থা খারাপ ওর।”
“অহ!”
নিহাল বলার মত কিছু খুঁজে পেলেন না আর। তাই মিনিট দুই-এক যেতেই বেরিয়ে গেলেন সেখান থেকে। প্রাণ তার যাওয়ার পাণে তাকিয়ে দূর্লভ হাসে। বাবারা বুঝি এমনই হয়? নিজের সন্তানের উপর আঁচ আসলে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়? তবে তার বেলায় বাবার সংজ্ঞাটা এভাবে বদলে গেল কেন?
________
অপরাহ্ণের শেষভাগ তখন। অন্তরিক্ষ জুড়ে হলুদ, কমলা মেঘের হাতছানি। দমকা হাওয়ায় শ্বেত কাঞ্চন দুলছে মৃদু মৃদু। তা দেখে গাছের পাতার ফাঁকে স্নিগ্ধ হাসছে কামিনী। আড়ালে থাকতে চাইলেও মধুময় সৌরভ তার জানিয়ে দেয় উপস্থিতি। পরিবেশ যখন নিজেতে মত্ত তখন প্রাণের দুয়ারে কড়া নাড়ে আগন্তুক কেউ। পার্সেল নিয়ে এসেছে সে। পার্সেল বললে ভুল হবে, বৃহৎ আকৃতির বক্স এটি। প্রাণ বক্সটা হাতে নিয়ে নাম দেখে প্রথমে। উপরে ছন্দের নাম দেখতেই গ্রহণ করে নেয় সে। ভিতরে এসে বক্সটা খুলতেই খাঁচায় বন্দী একটি টিয়াপাখি দেখতে পায়। পাখিটি জীবন্ত। প্রাণ খাঁচাটি বের করতেই পাখিটি পাখা ঝাঁপটা দিয়ে উঠে৷ অতঃপর স্থির ভঙ্গিতে কতক্ষণ বসে প্রাণকে দেখতে থাকে৷ প্রাণ ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সে বলে উঠে, “প্রাণপাখি! প্রাণপাখি! লেভিউ।”
#চলবে
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।]