#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩০
অপরাহ্ণের প্রথমভাগ। তেজস্বান সোনালী রোদ্দুর মিঠে হয়ে এসেছে। নীলাভ অন্তরিক্ষ জুড়ে রঙবেরঙের মেঘ খেলা করছে। আড়ম্বরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। নৈসর্গিক মায়ায় ডুবাতে অজানা এক পাখি কূজন তুলেছে। আবহাওয়া ঠান্ডা রাখতে দুর্দম হাওয়া বহমান। দোল খাচ্ছে নীলবর্ণা পর্দাগুলো। প্রাণ সোফায় পিঠ হেলিয়ে বসেছিল তখন। দৃষ্টি তার জানালার বাহিরে, বিস্তৃত আকাশের দুর্গমস্থানে। কিন্তু মন-মস্তিক নিমজ্জিত অতল ভাবনায়। সকালে হয়ে যাওয়া ঘটনাই পুনর্বিবেচনা করছিল। ছন্দের কাজকর্ম, শেষ উক্তি সব। অবচেতন মন উঠে পড়ে লেগেছে ‘শাদি মুবারক’-এর মানেটা খুঁজতে। সন্দেহের কাটা যদিও এক জায়গায় গিয়েই আটকাচ্ছে কিন্তু তা কতটুকু ঠিক জানা নেই তার। মস্তিষ্ক বলছিল, “ওইটা রেজিস্ট্রার পেপার ছিল।” কিন্তু মন বলছিল বিপরীত কথা। কেন যেন, মন বিশ্বাস করতে চাইছে না ছন্দ তার সাথে ছলচাতুরীও করতে পারে। মন ও মস্তিষ্কের দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে বের হতে প্রাণ সকাল হতে অগণিতবার ফোন লাগালো ছন্দকে। কিন্তু ছন্দ মহাশয় না কল তুললেন, আর না কল ব্যাক করলেন। শেষে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে ফোন দিল না আর। থম মেরে বসে রইলো। সে ভেবে কূল পাচ্ছিল না, “যদি কাগজগুলো সত্যি সত্যিই রেজিস্ট্রার পেপার হয়ে থাকে তাহলে কি হবে?” চিন্তায় মাথা ব্যথা করতে শুরু করলো প্রাণের। সে জানে, তার সাথে আর যাই হোক ছন্দের নাম জুড়তে পারে না। তাদের মধ্যে কিছু হওয়া মানেই ভিত্তিহীন। তাই এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইলো না। কিন্তু চাইলেই কি আর হয়? সারাদিনে এক মুহূর্তের জন্যও এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলো না সে। উল্টো চোখের সামনে ভাসতে থাকলো ছন্দের কর্মকাণ্ড গুলো।
এদিকে, দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল হতে চললো অথচ ছন্দের দেখা দেওয়ার কোন নাম গন্ধ নেই। নিরুদ্দেশ কোথায় হলো কে জানে? প্রাণের এসব আকাশ-কুসুম ভাবনার মাঝে জানালার ধারে এসে বসলো একটি দাঁড় কাক। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো তার দিকেই। অকস্মাৎ দাঁড় কাকটি দেখে প্রাণ থমকালো। মনে পড়লো তার মায়ের কথা, ছোট থাকতে তিনি প্রায়শই বলতেন, “দাঁড় কাক অশুভ হয়। যে দুয়ারে যায় মৃত্যুর খবর বয়ে নিয়ে যায়।”
কথাটা টনক নাড়তেই ভয় হয় প্রাণের। একপলক তাকালো সামনেই শুয়ে থাকা আশা বেগমের দিকে। অতঃপর ত্বরিত গতিতে উঠে জানালার কাছে গেল, হাতের ইশারায় ভাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো৷ প্রাণকে নিকটে আসতে দেখে কাকটি অবিলম্বে কা কা শব্দ করে উড়াল দিল উদ্দেশ্যহীন পথে। প্রাণ এবার থাইগ্লাস লাগিয়ে দিয়ে পর্দা টেনে দিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো বুক চি*রে৷ সকল ভাবনা ছুঁ*ড়ে ফেলে আশা বেগমের পাশে ছোট টুল টেনে বসলো সে। তার খালি হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সন্তপর্ণে ঠোঁট ছোঁয়ালো। এরপর হাতটা গালের সাথে লাগিয়ে রেখে বিরবির করে বলল, “তোমাকে আমি হারাতে পারবো না আশামা। কোনভাবেই না।”
.
সায়াহ্নের অরুণ পশ্চিমাকাশে মিইয়ে যাওয়ার পরমুহূর্তেই ছন্দ এসে হাজির হলো। কেবিনের ভিতর ঢুকতেই দেখতে পেল প্রাণ আশা বেগমের কোমরের পাশে মাথা নুয়ে শুয়ে আছে৷ টুলের উপর বসে থাকার কারণের তার অবস্থা কিছুটা নড়বড়ে। ছন্দ এগিয়ে গিয়ে প্রাণের সন্নিকটে হাঁটু গেড়ে বসলো। একটু ঠেস দিয়ে বসলো যাতে পড়ে না যায় সে। অতঃপর ঘুমন্ত প্রাণকে অনিমেষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলো। খুব কাছ থেকে। গভীরভাবে। আদুরে ভাব তার মুখমণ্ডল জুড়ে। সামনের চুলগুলো ছোট থাকায়, ক্লিপ দিয়ে বাঁধার পরও একগাছি চুল হুমড়ি খেয়ে পড়েছে নেত্রপল্লবের উপরিভাগে। বিরক্ত করছে কিঞ্চিৎ। ছন্দ তাদের সাথেই দুষ্টুমি করতে হালকা ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো তাদের। কিন্তু অবাধ্য চুলগুলো নড়ে উঠার বদলে প্রাণ নড়ে উঠলো। প্রায় সাথে সাথে টুল হতে ভারসাম্য হারালো, তবে পড়ার আগেই সময়মত ছন্দ আগলে নিল তাকে। ঝুঁকে আসলো মুখ বরাবর, মাঝে দূরত্ব বিদ্যমান রইলো এক ইঞ্চি। ঝাঁকুনি খেয়ে প্রাণের ঘুম ছুটে গেল, অর্ধনিভন্ত নয়নে তাকালো সামনে। অর্ধসচেতন মন প্রথমে কিছু উপলব্ধি করতে না পারলেও পরমুহূর্তে ছন্দকে নিজের এত কাছে অনুভব করতে পেরে পিলে চমকে উঠলো। প্রাণ তৎক্ষনাৎ সরে আসতে নিলে ঠুস করে বা*রি খেল ছন্দের মাথার সাথে। দুইজনই একসাথে অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো, “উহ!”
প্রাণ কপালে হাত গিয়ে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলে মেরুদণ্ডে টান অনুভব করলো। সুক্ষ্ম ব্যথাটা নিতে না পেরে আঁখিপল্লব এক করে ঠোঁট কাঁমড়ে ধরলো। পড়ে থাকলো ছন্দের সান্নিধ্য, চেপে ধরলো তার এক বাহু। তখন ওভাবে শুয়ে থাকার কারণেই এমনটা হয়েছে। ছন্দ বিষয়টা বুঝতে না পেরে রসিক কন্ঠে বলে উঠে, “আমার থেকে দূরে যেতে ইচ্ছে করে না বললেই হয়। আমি তাহলে দূরে সরিয়ে রাখি নাকি?”
প্রাণ রূঢ়ভাবে বলে, “শাট আপ।”
ছন্দ প্রাণের খিঁচে থাকা মুখটা লক্ষ করে বলে বুঝলো কোথাও কোন সমস্যা হয়েছে। তাই চিন্তিত হয়ে বলল, “আপনার কি কোন সমস্যা হচ্ছে?”
প্রাণ প্রত্যুত্তর করলো না। কিয়ৎক্ষণ লাগলো তার স্বাভাবিক হতে। ব্যথা কমে আসতেই প্রাণ সরে আসলো। এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পিছনে পিঠের মধ্যখানে নিয়ে আস্তে আস্তে বা*রি মারলো। ছন্দ তন্ময় নয়নে সবই পর্যবেক্ষণ করলো, তার আর বুঝতে বাকি রইলো না কি সমস্যা হয়েছে৷ প্রাণ ঘাড় ডান-বামদিক কাঁত করে সোজা হয়ে বসলো। ছন্দের দিকে তী*র্য*ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “কি করছিলেন আপনি?”
প্রাণের প্রশ্নে ছন্দ বিচলিত হলো না। ভাবলেশহীনভাবেই উত্তর দিল, “কিছু না তো। আপনি তখন পড়ে যাচ্ছিলেন বলে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলাম।”
প্রাণ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মৌন রইলো। কথা ঘুরানোর জন্য বলল, “সারাদিন কোথায় ছিলেন? ফোন ধরছিলেন না কেন আমার?”
ছন্দ এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “আজব তো! বউয়ের মত তদারকি করছেন কেন? বাই এনি চান্স, আপনার কি আমার বউ হওয়ার ইচ্ছে জেগেছে?”
ছন্দের পাল্টা আ*ক্র*ম*ণে প্রাণ অপ্রতিভ হলো। গোলগাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন।”
ছন্দ ক্ষীণ হেসে বলল, “কথা আমি ঘুরাচ্ছি না-কি আপনি? বিষয়টা এমন হলো না, চোরের মন পুলিশ পুলিশ?”
ছন্দের কথায় প্রাণ যে দমে যাওয়ার পাত্রী তা একদমই না। সে নিজেকে ধাতস্থ করে জিজ্ঞেস করলো, “কে পুলিশ আর কে চোর তা একটু পরই জানা যাবে। তার আগে বলুন, সকালে আপনি আমাকে দিয়ে কোন পেপারে সিগনেচার করে নিয়েছিলেন?”
“আপনি কিন্তু শর্ত ভাঙ্গছেন মিস. ল্যাভেন্ডার। শর্ত অনুযায়ী, আপনি পেপার নিয়ে আমায় কোন প্রশ্ন করতে পারবেন না।”
“আমি কোন পেপারে সাইন করেছি তা জানার অধিকার নেই আমার?”
ছন্দ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আপাতত নেই। সময় হলে এভাবেই জানতে পারবেন আপনি।”
প্রাণ কিছুক্ষণ মৌন থাকলো। মনের কৌতূহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, “ওইগুলা কি রেজিস্ট্রার পেপার ছিল? ইয়েস ওর নো।”
ছন্দ পকেটে হাত গুঁজে বলল, “আই ডোন্ট নো।”
প্রাণ নিজেও উঠে দাঁড়ালো, “বাট আই নিড এন্সার।”
ছন্দ প্রাণের দিক এককদম এগিয়ে এসে বাম হাতের তর্জনী উঁচিয়ে আলগোছে তার মুখে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের কাছে গুছিয়ে দিয়ে বলল, “আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, তারপর।”
ছন্দের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে প্রাণ শিউরে উঠলো। পা জমে গেল ওখানেই। গাল জুড়ে ছেঁয়ে গেল র*ক্ত*রে*ণু। কম্পিত কন্ঠে কোনরকম জিজ্ঞেস করলো, “কি প্রশ্ন?”
ছন্দ অপার্থিব হেসে জিজ্ঞেস করলো, “আমার প্রাণেশ্বরী হবেন?”
ছন্দের প্রশ্নে তব্দা খেয়ে গেল প্রাণ। নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কতক্ষণ। প্রশ্নটা তার বোধগম্য হয়েছে ঠিক কিন্তু সে চেয়েও প্রত্যুত্তর করতে পারছে না। কন্ঠলগ্নে মৌনতারা পথ রোধ করে রেখেছে যেন। সহজ প্রশ্নের দুই অক্ষরের উত্তর অথচ কোনভাবেই উচ্চারণ করতে পাচ্ছিল না। অদ্ভুত না?
ছন্দ পুনরায় জিজ্ঞেস করে উঠলো, “ইয়েস ওর নো?”
প্রাণের কিয়ৎকাল নিজের সাথে যুদ্ধ করে অনুভূতি সব নিয়ন্ত্রণ করলো। পা*ষা*ণ হৃদয়ের অধিকারী বুঝাতে ছন্দের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “নো!”
ছন্দ প্রাণের চোখে দৃষ্টি স্থাপন করেই বলল, “এবার আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো, যতদিন না আপনার উত্তর ইয়েস হচ্ছে ততদিন আমিও বলছি না পেপারগুলা কিসের ছিল।”
প্রাণ হতবুদ্ধি তাকালো। স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলল, “মানে কি?”
ছন্দ কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলল, “মানে যা বুঝেছেন তাই-ই।”
প্রাণ আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু কেবিনে ডাক্তার ঢুকায় বলতে পারলো না। কথাগুলো কন্ঠবদ্ধ করে ফেললো। ছন্দও এর ফাঁকে বেরিয়ে পড়লো কেবিনটা থেকে৷ এদিকে আশা বেগম এতক্ষণ প্রাণ ও ছন্দের কথোপকথন শুনে হাসছিলেন। প্রশান্ত সেই হাসি।
#চলবে
[কপি করা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ।]