#জীবনের জলছবি
#পর্ব ৩২
ঘোরের মধ্যেই একটা টানা বিপ বিপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলো টুসি, মাথাটা খুব ভারী, শরীর টা অসম্ভব দুর্বল, বাম হাত টা নাড়াতে গিয়েও পারলো না, ও কি মরে যাচ্ছে! নাকি এখনো বেঁচে আছে কিছুই বুঝতে পারছিলো না ঠিক মতো।
একবার মা কে ডাকার চেষ্টা করলো, গলাটা শুকিয়ে কাঠ, আওয়াজ বেরোলো না একটুও। খুব জল তেষ্টা পাচ্ছিলো, ওকে ঠোঁট নাড়াতে দেখে কেও জিজ্ঞেস করলো
জল খাবে?
কথা গুলো যেনো অনেক দূর থেকে ভেসে আসছিলো, কেমন যেনো আবছা আবছা চারিদিকে, ও কোথায় আছে এখন, আওয়াজ টা কিসের ভাবতে ভাবতেই আবার ঘুমিয়ে পড়লো টুসি।
চোখের ওপর একটা চড়া আলো এসে পড়তেই চোখ খুলে তাকালো টুসি। সামনের ডানদিকের জানলা টা দিয়ে রোদ এসে পড়ছে ওর চোখে, সারা ঘর টা আলোয় ভরা। মাথাটা তুলতে গিয়ে অসম্ভব দুর্বল লাগছিলো, ওঠার চেষ্টা করেও আবার শুয়ে পড়ল।
এতক্ষনে বিপ বিপ আওয়াজের উৎস টা বুঝতে পারল ও। ওর মাথার পাশে একটা মনিটর, আওয়াজ টা ওখান থেকেই আসছে, ডান হাতে লাগানো চ্যানেলের সাথে লাগানো নল বেয়ে ওপরে ঝোলানো বোতল থেকে নেমে আসছে রক্ত, মানে রক্ত দিতে হচ্ছে, কিন্তু কেনো? ওর কি কিছু হয়েছে? কিছুতেই মনে করতে পারছিলো না টুসি। এদিক ওদিক তাকিয়েও জিজ্ঞেস করার মতন কাউকে খুঁজে পেলো না ও।
এতক্ষনে বুঝতে পারলো এটা সম্ভবত কোনো হসপিটালের কেবিন, যেখানে ও শুয়ে আছে, তার উল্টো দিকেই একটা সোফা কাম বেড, যেখানে কেউ ছিলো এতক্ষণ, হয়ত বাইরে গেছে এই মুহূর্তে। ও হসপিটালে কেনো, খুব চেষ্টা করছিল মনে করতে টুসি।
হসপিটাল বুঝতে পেরেই ওর তপু দার কথা মনে হলো, এটা কি তপু দার হসপিটাল, নাকি অন্য কোথাও, ভাবতে গিয়েই ওর রাত্রের কথা গুলো মনে পড়লো এই মুহূর্তে।
তার মানে ও মরেনি শেষ পর্যন্ত, নিশ্চয়ই বাবাই নিয়ে এসেছে এখানে, কিন্তু কেনো নিয়ে এলে বাবা, আমি তো বাঁচতে চাইনি, তুমি তো চলেই যেতে বলেছিলে আমাকে, তাহলে যেতে দিলে না কেনো শেষ পর্যন্ত, একরাশ অভিমান ফিরে এলো মনে। ও বেঁচে গেছে এটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই একটা অদ্ভুত খারাপ লাগা ঘিরে ধরছিলো ক্রমশ।
নিশ্চয়ই অনেক লোকের হেল্প নিতে হয়েছে ওকে এখানে আনার জন্য, মানে গোটা পাড়ার লোকেরা জেনে গিয়েছে, এই মুহূর্তে পাড়ায় ওই তাহলে চর্চার বিষয়।
আর তপু দা? সেও কি জেনেছে, জানলেই বা কি এসে যায় তার, সে তো টুসি কে ফিরিয়েই দিয়েছিলো কাল। ইসস, কেনো বেঁচে গেলো ও, বেঁচে যাওয়ার জন্য একটুও আনন্দ হচ্ছিলো না আর, এরপরে তো পাড়ায় সবাই ওকে দেখে হাসাহাসি করবে, কোথায় যাবে ও, কলেজের সব বন্ধুরাও জেনে গেছে নিশ্চয়ই, যত বার এইগুলো মনে হচ্ছিলো আরও ক্রমশ খারাপ লাগা টা চেপে বসছিলো ওর মনে।
চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো, চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে আসছে জলের ধারা, নিজেকে ধরে রাখতে পারছিল না। কেউ ওর কপালে হাত রাখলো বুঝলো টুসি,
কাঁদছিস কেনো? কি এমন হয়েছে মন খারাপ করার মত, এত অভিমান তোর, এইরকম করে বসলি, একবারও আমাদের কথা ভাবলিনা,
কানে ভেসে আসা মায়ের গলাটা শুনেই, মুহূর্তের মধ্যে বাবার কথা গুলো মনে পড়লো আবার, চোখ টা একটুও খুলতে ইচ্ছা করছিল না আর। কেউ আমার নয়, কেউ আমার কথা ভাবেনি, তোমরাও না, তুমিও তো খেতেও ডাকোনি কাল রাত্রে, আর বাবা তো বলেছিলো আমাকে মেয়ে হিসাবে স্বীকারই করেনা, তাহলে আমি কেনো ভাববো তোমাদের কথা, মনে মনে ভাবলেও মুখে কোনো কথা বললো না টুসি।
শরীর কেমন আছে? ঘুম ভেঙেছে ওর?
মা কে জিজ্ঞেস করছে বাবা, চোখ না খুলেও বাবা এসেছে বুঝতে পারছিলো ও। কিন্তু নাহ! ও কিছুতেই চোখ খুলবে না, কারোর সঙ্গে ওর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না একটুও, তাই সব কিছু বুঝতে পারলেও চোখ শক্ত করে বন্ধ করে রাখলো টুসি।
চেয়ার টেনে ওর পাশে বসলো বাবা, আওয়াজে বুঝলো,
বাবা, মা রাগে কত কিছু বলে, তাই বলে এই রকম বোকামি কেউ করে নাকি, তোকে কি ভালোবাসি না আমরা? যাই বলিস, তোর রাগ টা কিন্তু আমার মতই, একদম বাপ কা বেটি তুই
হেসে বলল বাবা,
আর কথাটা শুনেই, এতক্ষণের ধরে রাখা কষ্ট টা একদম কান্না হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো এবার, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো টুসি।
দুপুর হয়ে এসেছে, চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো ও, ওকে খাইয়ে দিয়ে মা গেছে তপু দাদের বাড়ি স্নান খাওয়া দাওয়া সারতে, ফেরেনি এখনও। বাবা বাড়ি ফিরে গেছে, বিকেলে আবার আসবে বলে গেছে।
শুয়ে শুয়ে সকালের কথা গুলো ভাবছিলো ও।
বাবা সবাই জেনে গেছে না, হাসছে সবাই? আমার বন্ধুরা, ওদের কেও বলেছ তুমি?
কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো ও।
ধুর বোকা, কেউ জানেনা, আর জানলেই বা কি হতো, তুই কষ্ট পেয়ে করে ফেলেছিস, হতেই পারে। তবে কেও বোঝেনি কিছু, তুই চিন্তা করিস না।
আমাকে হসপিটালে কিভাবে নিয়ে এলে বাবা যে কেউ জানলো না, তুমি আসলে কষ্ট পাবো বলে লুকিয়ে যাচ্ছো আমাকে, সব বুঝি আমি।
না রে, ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে তোকে দেখে তোর মা বুথ থেকে ফোন করেছিলো তপু কে, ওই গাড়ি করে এসে নিয়ে এসেছে তোকে, কেউ বুঝতে যাতে না পারে তাই অ্যাম্বুলেন্সও ডাকেনি,
খানিকটা নিশ্চিন্ত লাগছিলো টুসির। যাক পাড়ায় ফিরে ওর অন্তত লজ্জা লাগবে না একটুও।
কিন্তু তপু দাকেই ডাকতে হলো শেষে, খারাপ লাগাটা আবার ফেরত আসছিলো, সত্যিই ওর সব অনৈতিক কাজগুলো তেই তপু দা জড়িয়ে পড়ছে বার বার। অথচ এবার তো ও সত্যিই জড়াতে চায়নি আর, শুধু তপু দা কেনো কাউকেই জড়াতে চায়নি এবার, নিজেই সরে যেতে চেয়েছিল শুধু।
ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো কেও, চোখ বন্ধ করেও বুঝতে পারছিলো টুসি। চোখ খুলে দেখার প্রয়োজন বোধ করলো না ও, আর কারোর আসা যাওয়ায় ওর কিছু এসে যায় না এখন।
আমি জানি তুই জেগে আছিস, ঘুমাচ্ছিস না, চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো যে, তার গলা টা খুব ভালো করে চেনে টুসি, তপু দা!! মনে মনে চমকে উঠে চোখ টা আরও শক্ত করে বন্ধ করলো ও।
নাহ! তপু দার কোনো কথা শুনতে চায় না ও, এখন ওর কোনো সহানুভূতির কথা শুনতে একটুও ইচ্ছে করছে না, বিশেষ করে তপু দার কাছ থেকে কোনো সহানুভূতি চায় না টুসি। যাই বলুক না কেনো, কিছুতেই তপু দার সামনে চোখে জল আসতে দেবে না ও, মন টা কে শক্ত করলো টুসি।
কাজ টা কি ঠিক করেছিস বলে মনে হয় তোর? কাকে জব্দ করার চেষ্টা করলি? সব সময় তুইই লোক কে আঘাত দেবার ক্ষমতা রাখবি, আর তোকে কেউ কিছু বললেই উল্টে তাকেই জব্দ করার জন্য এইরকম উল্টোপাল্টা কাজ করে নিবি, এত টা সাহস কে দিলো তোকে?
একদম ঠান্ডা গলায় বললো তপু।
আমি কাউকে জব্দ করতে চাইনি, বিশ্বাস করো, এবার তোমাকে আমাকে হেল্প করতে ডাকতেও চাইনি আমি, যদি জানতাম মা তোমাকে ফোন করবে,
কথা টা শেষ না করেই থেমে গেলো টুসি।
তাহলে কে কাকে ফোন করবে, সেটাও তুই ই ঠিক করে দিবি এবার থেকে তাইতো?
কেনো এই সব বলছো তপু দা, আমি তোমার সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাইনা আর, প্লিজ তুমি যাও এখন এখান থেকে, করুন গলায় বললো টুসি।
সত্যি কথা বলতে কি তোর মতন এসকেপিস্ট মেয়ের সঙ্গে আমারও একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না জানিস তো, তোকে আমি অন্য রকম ভাবতাম, মনে হতো তুই খুব সাহসী, কিন্তু আসলে যে তুই খুব ভীতু সেটা পরশুর ঘটনায় বুঝলাম।
পরশু? তার মানে ও যেটা কে কাল ভাবছিলো সেটা দুদিন আগের ঘটনা, ও দুদিন ধরে অজ্ঞান ছিলো!! মনে মনে চমকে উঠলো টুসি।
লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাওয়া মানুষদের একটুও পছন্দ নয় আমার,
বলেই যাচ্ছিলো তপু,
আমার মা সারাজীবন লড়াই করেছে, আমি তোর জন্য আমার বাবা কে ছেড়ে এসেছিলাম একদিন, কিন্তু কেউ পালাতে চাইনি তোর মত। যেদিন তুই ছাদে দাঁড়িয়ে আমার বাবার বিরুদ্ধে আমাকেই বলার সাহস দেখিয়েছিলি সেদিন তোকে আমার খুব ভালো লেগেছিল, তোর সাহসের প্রশংসা না করে পারিনি, আর আজ সেই তুই এরকম কিছু করার মত মূর্খামি করবি ভাবতেও অবাক লাগছে আমার। তোর কি মনে হয়েছিলো? তুই চলে গেলেই সবাই ভালো থাকব আমরা? মিটে যাবে সব সমস্যা? তুই আসলে খুব স্বার্থপর, সব সময় নিজের স্বার্থ দেখিস।
কিসের স্বার্থ? এতে আমার কোনো স্বার্থ ছিলোনা, আমি তো নিজেই বাঁচতে চাইনা, কারোর তো ক্ষতি করতে চাইনি, তাহলে? আমি মরে গেলে কি আমার স্বার্থ পূরণ হতো?
হতোই তো, যারা স্বার্থপর, তারাই প্রয়োজনের সময় পালিয়ে যায়, তুই ও একদম তাই। কাকুর শরীর খারাপ, তুই বড়ো হয়েছিস, তুই তো পাশে থাকবি, তার বদলে তুই পালিয়ে যাবার কথা ভেবেছিস, তোর স্বার্থ কোথায় ছিলো বলতো? কিছু জিনিস তোর পছন্দ মতো হয়নি, শুধু এটাই তো? সে তো তোর অনেক কাজ অনেকের পছন্দ হয়না, তারা তোকে ফেলে পালিয়ে যায় না তো কখনো।
যাইহোক, তোকে বিছানায় শুয়ে দেখতে ভালো লাগছে না আমার, তাই তুই বাড়ি না যাওয়া পর্যন্ত আর আসবোনা আমি, তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে, যেগুলো তুই সুস্থ হলে বলবো তোকে,
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো তপু।
টুসির খুব অভিমান হচ্ছিলো, ও তপু দার কোনো কথা শুনতে চায় না আর! কিন্তু কিছুতেই রাগ টা ধরে রাখতে পারছেনা কেনো! যাদের সবার ওপর এতো অভিমান হয়েছিলো ওর, যাদের জন্যে ও পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাইছিলো দুদিন আগেই, তাদের এই রূপগুলো তো ও দেখেনি আগে! তারা সবাই আসলে কি খুব ভালোবাসে ওকে! এদের কে ছেড়ে চলে গেলে, এরাও কি খুব কষ্ট পেতো? তপু দা কি ঠিকই বলেছে, সত্যিই কি ও এসকেপিস্ট? বাবাও তো অপমানিত হয়েছে ওর জন্যে, তার পরেও তো আবার অফিসে যাবে পরের দিন! তাহলে ও কেনো পারলো না সেদিন! ইস! ভাগ্যিস ও মরে যায়নি! না হলে কতো কষ্ট পেতো মা, বাবা! আর কোনোদিনও এরকম বোকামি করবে না আর, মনে মনে নিজেই নিজের কাছে শপথ করছিলো টুসি।
ক্রমশ
(কাল টুসির জন্যে অনেক উদ্বেগে ছিলেন আপনারা সবাই, আজ সেটার অবসান হলো নিশ্চয়ই। হেরে যাওয়া নয়, জীবনে জিতে যাওয়ার গল্পই ভালোবাসি বলতে, কমেন্টে জানাবেন আজকের পর্ব কেমন লাগলো আপনাদের 🙏)