#জীবনের জলছবি
#পর্ব ৩৪
গত দিন তিনেক ধরেই শেষ ক্লাসটা র আগেই কলেজ থেকে বেরিয়ে পড়ছে ও যাতে তপু দার সঙ্গে দেখা হবার সুযোগ না থাকে। মনের ভেতরের দোলাচল টা কিছুতেই দুর করতে পারছিলো না ও, তপু দা যতই বলুক ও সীমা কে বিয়ে করতে চায়না টুসি সেটা কি করে বিশ্বাস করবে!
সীমা তো ওকে নিজের মুখে বলেছে, যে সীমা তপু দা কে ভালোবাসে! ওদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কোনো মেয়ে কি নিজের সম্বন্ধে এই ভাবে মিথ্যে কথা বানিয়ে বলতে পারে! তপু দা যে টুসি কে ভালোবাসে এটা তো নিজের বেলায় অনেকবার তপু দার ব্যবহারে বুঝেছিলো ও, কিন্তু তাও তো ও সিওর হতে পারেনি কখনো। সোমা তো ওর কাছে কতো বার জানতে চেয়েছে, কিন্তু ও তো তপু দা ওকে ভালোবাসে, এটা সোমাকে কনফিডেন্ট হয়ে বলতে পারেনি একবারও। সেখানে এই মেয়েটা কিসের জোরে এত কনফিডেন্ট ছিলো! যদি না ওকে তপু দা কিছু বলে থাকে! তপু দা তো ওকে নিজেও বলেছিলো ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
আজও কলেজ শেষ হবার আগেই বেরিয়ে যাচ্ছিলো ও, সোমা ও ওর সঙ্গেই বেরিয়ে এলো। দুজনে গেটের মুখে আসতেই তপু দা কে দেখতে পেলো, গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সোমা তপু দা কে চেনে, টুসি কিছু বলার আগেই সোমা তপু দা কে দেখে এগিয়ে গেলো।
চলো তুমিও গাড়িতে ওঠো, নামিয়ে দিয়ে যাবো,
সোমার দিকে তাকিয়ে বললো তপু, সোমা কে গাড়িতে উঠতে দেখে টুসি আর কিছু না বলে নিজেও উঠে বসলো। সোমার সামনে কোনো রকম তর্ক বিতর্ক চাইছিলো না ও। সোমা কে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা নিয়ে সোজা আগের দিনের পার্কে গিয়ে ঢোকালো তপু।
সেদিন আসতে বললাম তাও এলি না দেখে আজ তোদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, শুনলাম তুই কলেজে এসেছিস। কাকিমা কে বলে এসেছি দেরি হবে, আজ আর কোনো অজুহাত নেই তোর কাছে,
গাড়ির দরজা টা খুলে ধরে বললো তপু, টুসি একটু নিশ্চিন্ত হলো, ও সত্যি মনে মনে মা এর কথাই ভাবছিলো।
কেনো এলি না? আমি আশা করেছিলাম তুই আসবি!
বেঞ্চে বসে বললো তপু, টুসি একটু ভাবলো। ও খোলাখুলি সব কথাই জিজ্ঞেস করবে আজ। বারবার নিজেকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছে না।
ইচ্ছে করেই আসিনি, কদিন সময় নিলাম!
কিসের সময়!
টুসির উত্তরে অবাক হয়ে বললো তপু।
আমি কিছু কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই! বেশ কিছু ভুল করে ফেলেছি আমি, বাবার সম্মানও নষ্ট করে ফেলেছি অফিসে, আর নতুন করে বাবা মা কে কোনো কষ্ট দিতে চাইনা। আমি জানি কোনো এক সময় হয়ত তুমি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে, কিন্তু এখন তুমি সীমা কে ভালোবাসো। কাকিমা আমাদের বাড়িতে গিয়ে কথা দিয়ে এসেছে বলেই হয়ত তুমি পিছিয়ে আসতে পারছো না এখন। কিন্তু আমি আর আমার জীবনে কোনো জটিলতা বাড়াতে চাইনা, তাতে শুধু আমি নই, বাবা মাও খুব কষ্ট পাবে ভবিষ্যতে!
তোকে একদম অন্য রকম লাগছে টুসি! এই তোকে আমি চিনতে পারছি না। সেদিন তোকে অতবার বললাম যে আমি রাগের মাথায় কথাগুলো বলেছিলাম তোকে, এর সঙ্গে সীমার কোনো সম্পর্ক নেই! তাও তুই একই কথা বলে যাচ্ছিস! কাকু, কাকিমার কষ্ট পাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই!!
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো তপু,
তুমি বলছো না হয়ত, কিন্তু সীমা আমাকে সব বলেছে, তুমি মাসির কাছে গিয়েছিলে ওকে বিয়ে করার কথা বলতে,
সীমা তোকে এসব বলেছে! অসম্ভব, হতেই পারে না, ও মিথ্যে কথা বলেছে!!
কেনো বলবে ও মিথ্যে?
তপুর কথার উত্তরে একদম ঠান্ডা গলায় বললো টুসি, তপু একটু চিন্তা করলো।
তুই যখন বলছিস ও বলেছে তখন আমি অবিশ্বাস করছি না! কিন্তু এটুকু বলতেই পারি, সত্যি অহেতুকই মিথ্যে বলেছে! কিন্তু কেনো বলেছে সেটা জানতে গেলে মাসির সঙ্গে কথা বলতে হবে আমাদের। যদিও আমার কাছে সেটা খুব সম্মানের হবে না, যথেষ্ট ছোটো করতে হবে নিজেকে। সীমার সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতেও রুচিতে বাধছে আমার, তবু তোর মানসিক শান্তির জন্য না হয় বলবো। আর যদি সত্যিই আমার ওর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে যেতো তাহলে কি মা তোদের বাড়ি যেতো আর? আমি এরকম কোনো কথা মাসি কে বললে সেটা মাসি মা কে বলতো না বলে মনে হয় তোর? ঠিক আছে, চল, মাসির বাড়িতে নিয়ে যাবো তোকে!
তপু কে এবার উঠে পড়তে দেখে, খুব লজ্জায় পড়লো টুসি, সত্যিই তো! সীমার কথায় ও তপু দা কে অবিশ্বাস করছে! সত্যি ওরও তো এটা নিয়ে সীমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, এটা যদি সত্যি হতো তাহলে তো তপু দা কিছুতেই সীমার মুখোমুখি হতে চাইতো না! কোনো অজুহাত দিয়ে ঠিক এড়িয়ে যেত! আর কাকিমাও ওদের বাড়ি আসতো না। ওর কাছেও তো কোনো প্রমাণ নেই, এখন যদি ও তপু দার সামনে সব অস্বীকার করে, উল্টে ওকেই সবার কাছে মিথ্যেবাদী বানিয়ে দেয়! তাহলে তো তপু দা বা ওর আত্মীয়দের কাছেও ও ছোটো হয়ে যাবে!
সরি, আমার ভুল হয়ে গেছে! যাবো না কোথাও,
বলে উঠলো টুসি, তপু আস্তে আস্তে টুসির পাশে বসে পড়লো।
আজ পিছিয়ে যাচ্ছিস, কিন্তু ভবিষ্যতে যদি আবারও কোনো সময় মনে হয়!
টুসি ঘাড় নাড়লো,
না, হবে না, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি!
একটা কথা বলবো? আমি কিন্তু তোকে একটুও বিশ্বাস করি না, তুই যা! আবার কবে কার প্রেমে পড়ে যাস! চল রেজিস্ট্রি টা করে ফেলি! সেই ছোটো থেকে কম ছেলের সঙ্গে তো প্রেম করিস নি,
মুচকি হেসে বললো তপু, টুসি অবাক হয়ে গেলো, উফফ! তপু দা না! কিছুতেই বেশিক্ষন সিরিয়াস থাকতে পারেনা! এই অবস্থাতেও মজা করছে ওর সঙ্গে! টুসির পেছনে না লাগলে ঘুম হয়না ওর!
মানে? একটাই তো, রেগে গেলো টুসি।
কেনো, বাপী কে ভুলে গেছিস? তুই ভুলে গেলেও আমি কিন্তু ভুলিনি, তুই যে বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে চিঠি নিয়েছিলি, রাতে জানলায় দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম তো। কম জ্বালাস নি আমাকে আজ পর্যন্ত।
চমকে গেলো টুসি, ওটা তপু দা ছিলো! ও তো কাকিমা ভেবেছিলো তখন!
মোটেও আমি চিঠি নিই নি, ও জোর করে দিয়ে গিয়েছিলো আমার হাতে।
আচ্ছা, তাই নাকি!! ফেলে তো দিসনি, সঙ্গে করে ঘরে তো নিয়ে গিয়েছিলি, সেটা ও জোর করে নাকি?
সেতো কি লিখেছে দেখার জন্য, দেখেই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম, আর বেশ করেছি নিয়েছি, তোমার কি? তুমি বলনি কেন আমাকে তখন? লুকিয়ে দেখছিলে? সব কিছু দেখে রাখার দায়িত্ব আমি তোমাকে দিয়েছিলাম নাকি?
গোমড়া মুখে বললো টুসি।
তুই দিবি কেনো, আমিই নিজেই নিয়ে ছিলাম, তাই জন্যই তো তোকে চোখে চোখে রাখতে গিয়ে ইউজড হতে হচ্ছিলো আমাকে। আর ওসব নয়, অনেক কাজ কর্ম থাকে আমার, তোর পেছনে অত সময় দিতে পারবো না আর, তাই এই ব্যবস্থা, এবার তুই আর কিছু করতে পারবি না,
আর গম্ভীর থাকতে পারছিলো না, এবার হেসে ফেললো টুসি।
এইবার তোকে চেনা যাচ্ছে, সেই আগের মতো, এরকম টুসি কেই দেখতে ভালোবাসি আমি,
টুসি চোখ নামিয়ে ফেললো, ওর খুব লজ্জা লাগছিলো। সন্ধ্যে হয়ে আসছিলো তাই এবার উঠে পড়লো ও,
তোমাকে আর যেতে হবে না, আমি চলে যাচ্ছি,
নাহ! চল তোকে ছেড়ে দিয়ে আসি, সন্ধ্যে হয়ে গেছে,
আর কিছু বললো না টুসি, একসঙ্গে যাওয়ার এই সময়টুকু তো ভালোই লাগে ওর। তপু গাড়ি চালাচ্ছিল, টুসি চুপ করে আছে কোনো কথা বলছে না দেখে একটু অবাক হলো,
তুই কি এখনও সীমা কে নিয়েই ভেবে যাচ্ছিস?
টুসি অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নাড়লো,
নাহ! আসলে সব ঘটনাগুলো কিরকম একসাথে হয়ে গেলো না!! যদি আরও আগে তুমি এগুলো বলতে আমাকে, তাহলে এই অঞ্জনের ব্যাপারটা হতো না আর। কিছু ভুল বোঝাবুঝির জন্য বাবা কে মিছিমিছি অপমানিত হতে হলো।
তুই যে কিছুই বুঝিস নি এতদিনেও, কি করে বুঝবো বলতো! শুধুই কি অঞ্জন, তুই নিজেও তো কিরকম বোকামি করে ফেললি! আমি যখন তোকে কথাগুলো বলেছিলাম আমার মনে হয়েছিলো তুই সব বুঝিস! আর আমার কথাগুলো কে আমার রাগের, অভিমানের এক্সপ্রেশন বলেই তুই বুঝবি, আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম যে পরের দিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কাকিমা যখন আমাকে ফোন করলো সেদিন তোর খবর জানিয়ে, তখন আমি এটা ফিল করলাম যে তুই এতদিনেও আসলে কিছুই বুঝিস নি! তুই জানিস না সেদিন আমি কিভাবে তোকে এনে ভর্তি করেছিলাম হসপিটালে, এতো আফসোস হচ্ছিলো তখন!
তুমি তো মুখে বলোনি কখনো, কি করে বুঝবো বলো!
তপুর কথার উত্তরে অভিমানের গলায় বললো টুসি, ও তো কতবার শুনতে চেয়েছে এই কথা গুলো, কিন্তু তপু দা তো ওকে সরাসরি বলেনি কখনো!
বাড়ি এসে গিয়েছিলো, মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে আর বেশি কথা বললো না, মায়ের সামনে তপু দার গাড়ি থেকে নামতে একটু অস্বস্তিই হচ্ছিলো ওর, তাই ছোট্ট একটা “আসছি ” বলেই ঘরে ঢুকে পড়লো টুসি।
ক্রমশ
(গল্পের শেষ পর্ব থাকবে কাল, যাঁরা এতদিন ছিলেন গল্পটার সঙ্গে, শেষ পর্বেও থাকবেন কিন্তু❤️)