একটুখানি_সুখ #আনিশা_সাবিহা পর্ব ১৫

0
481

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৫

ঘরের দরজা আঁটকে দিয়ে বসে আছে মোহ। তার ধারণা স্বচ্ছ আসবেই তাকে নিতে। কোলে নেওয় কোনো ব্যাপারই না লোকটার কাছে। যেই মানুষ পাবলিজ প্লেসে কোলে নিতে অস্বস্তিবোধ করে না সেই মানুষটা বাড়ির ভেতরে এসে কোলে করে টেনে নিয়ে যাবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। দরজার দুটো লক আঁটকেই শান্তি মতো ওয়াশরুমে আরো একবার শাওয়ার নিতে চলে গেল সে। বেশ ভ্যাপসা গরম পড়েছে। এসব টেনশনে এসির বাতাসটুকুতে মন ভরছে না তার। কৃত্রিম জিনিসে তার অনেক অনেক বিরক্ত!

গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ওয়াশরুমের দরজাটা খোলে মোহ। পড়নে সাদা রঙের বাথরোব আর মাথায় জড়ানো টাওয়াল। মুখে স্বস্তির হাসি। এবার ফ্রেশ লাগছে তার। টকটকে গোলাপি ঠোঁটের আশেপাশে পানির ছিটেফোঁটা এখনো রয়েছে। সে মনের সুখে বলে ওঠে,
“এতোক্ষণে স্বচ্ছ নামক আস্ত বিরক্তির ড্রামটা নিশ্চয় চলেই গেছে। আহারে বেচারা… ”

“আসলে বিরক্তিকর জিনিসটা সহজে পিছু ছাড়ে না জানো তো? একেবারে চিপকে থাকে। কিন্তু তোমার প্রতি চিপকে থাকার ইন্টারেস্ট আমার নেই। বাধ্য হয়ে আমার মতো ছেলেকে তোমার মতো মেয়ের সাথে চিপকে থাকতে হচ্ছে।”

স্তব্ধ হয়ে গেল মোহ। সবেমাত্র ফ্লোরে পা রেখে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছিল সে। কন্ঠস্বরটা শুনে পিলে চমকে গেল তার। মাথা উঠাতেই চোখজোড়া বেরিয়ে আসার উপক্রম তার। পিছু ফিরে ড্রেসিংটেবিলের সামনে পকেটে হাত গুঁজে একটা বাঁকা হাসির সহিত দাঁড়িয়ে আছে স্বচ্ছ। তৎক্ষনাৎ মোহ নিজের দিকে তাকাল। সেদিন স্বচ্ছের বাথরোবের ফিতা ভুল করে খুলে ফেলেছিল মোহ। আজকেও সেই একই পরিস্থিতি কিন্তু উল্টোটা। চোখ বড় বড় করে স্বচ্ছের দিকে তাকালো সে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় স্পষ্ট স্বচ্ছের মুখ। নেভি ব্লু কালারের একটা শার্ট সাথে সাদা রঙের ডেনিম প্যান্ট পড়ে মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। এবার আগপাছ না ভেবেই মোহ পিছিয়ে দৌড় দিয়ে ওয়াশরুমের আড়ালে গিয়ে লুকায়।

“এই আপনি ভেতরে ঢুকলেন কি করে? আমি তো…”

“তুমি তো দরজা লক রেখেছিলে!”

“হুমম সেটাই তো, সেটাই তো!”

স্বচ্ছ ড্রেসিংটেবিলের শোপিচ ধরে সেটা ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে ক্যাচ করতে করতে বলে,
“তোমার বাড়িতে তো সব দরজারই এক্সট্রা চাবি না থাকে না?”

“কিন্তু সেটা কে দিল আপনাকে?”

“অভিয়েসলি চুরি করিনি। ছোট ফুপি দিয়েছে। উনি জানেন আমি অযথা সময় কাটাতে এই বাড়ি আসিনি। দরকারেই এসেছি। তুমি তো আবার যাকে তাকে চোর বানিয়ে দাও।”

সরু চোখে তাকায় মোহ। স্বচ্ছও এবার শোপিচটা রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আড়ালে থাকা মোহের দিকে তাকিয়ে কন্ঠে জোর দিয়ে বলে,
“এখন কি চাচ্ছো তুমি? তোমাকে এই অবস্থায় তুলে নিয়ে যাই?”

“আপনি বাহিরে যান। আমি আপনার মতো নেশাখোর লোকের সাথে মোটেই যাব না। ভালোই ভালোই বলছি বাহিরে যান নয়ত…”

“নয়ত কি?”
স্বচ্ছ এগিয়ে এলো মোহের দিকে। আরো সেঁটে দাঁড়াল মোহ। অতঃপর ওয়াশরুমে আবার ঢুকে পড়ল সে। তাড়াহুড়ো করে দরজা লাগাতে গেলেও স্বচ্ছ আঁটকে ধরল দরজা এক হাতে। মোহ দুহাতেও আর দরজা লক করতে সক্ষম হচ্ছে না। বরং স্বচ্ছই তার একহাত দিয়ে প্রায় অর্ধেক দরজা খুলে প্রায় ঢুকে পড়েছে।
“নিশ্চয় তুমি এমনটা চাও না যে তোমায় এই অবস্থায় তুলে নিয়ে যাই? নয়ত এটাও করতে পারি সেদিন আমার সাথে যা কান্ড করেছিলে! তোমার বাথরোবের ফিতা…”

বলেই থেমে গেল স্বচ্ছ। অসভ্যের মতো হাসি দিল সে। মোহের এক হাত চলে গেল পেটের কাছে ফিতাতে। ঢক গিলতেই স্বচ্ছ আবারও বলল,
“তোমার আমার ওসব দেখার লোভ থাকতেই পারে। আমার নেই। আমার বিয়ে হবে দেন এসব দেখা যাবে। তোমার মতো নাকি? একটা অবিবাহিত সিঙ্গেল ছেলেকে জোর করে তার সম্মান ছিনিয়ে নেওয়া?”

“আমি তো ওসব ইচ্ছে করে করিনি বিশ্বাস করুন। আপনি এমন করলে কিন্তু মান হানির মামলা করব।’

“ওহ রিয়েলি? আইন শুধু মেয়েদের জন্য? আমাদের মতো অসহায় ছেলেদের জন্য কোনো আইন নেই? তোমাদের মতো মেয়েরা যে আমাদের নির্যাতন করে যাচ্ছে?”

“আপনি… আপনি এটা…”

“হুঁশশ! নো মোর ওয়ার্ড। রেডি হয়ে বাহিরে এসো আদারওয়াইজ, ভয়ানক কিছু ঘটিয়ে ফেলব।”
রক্তচক্ষু নিয়ে হুমকিস্বরূপ বলে ওঠে স্বচ্ছ। মোহ স্বচ্ছকে পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে বলে,
“আপনি ঘরের বাহিরে তো যান।”

“তা তো যাবই। বাট ইয়েস, চালাকি করার চেষ্টা করবে না।”
মোহ ঠোঁট উল্টে মাথা দুলাতেই গেট ছেড়ে বাহিরে গিয়ে দাঁড়ায় স্বচ্ছ। হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় সে রুম থেকে। হাফ ছেড়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে মোহ। কি জ্বালাতন শুরু করেছে? কি এমন দরকার তার সাথে স্বচ্ছের?

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। অর্ধচাঁদ দেখা দিয়েছে আকাশে। তার পাশেই জ্বলজ্বল করছে সন্ধ্যাতাঁরা। রাতে বাহিরের পরিবেশ খুব সুন্দর ভাবে ফুটে ওঠে। আশেপাশে রাস্তার পাশে সোডিয়াম লাইট। ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরছে লোকজন। আশেপাশে বেশ ট্রাফিক। সোডিয়াম লাইটের বেশ কাছেই দাঁড়িয়ে আছে চকচকে কালো রঙের গাড়ি। তার ভেতরে সামনের সিটে বসে রয়েছে মোহ ও স্বচ্ছ। এসিটা বন্ধ করে জানালা খুলে বসে রয়েছে মোহ। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে আর নাকের ডগায়। সোডিয়াম লাইটের আলোতে অন্যরূপ ফুটে উঠেছে তার। গোল্ডেন রঙের লং জামা আর কালো ওড়না গলায় পেঁচিয়ে রাখা। গালে হাত দিয়ে আনমনে তাকিয়ে আছে বাহিরে। মেয়েটার মোহ নামটি যেন ভেবেচিন্তেই রাখা হয়েছে। এই রুপ, এই চোখ সকলের নজর কাঁড়লেও স্বচ্ছের নজর কাঁড়ে তার আচরণ! মাঝে মাঝে রাগ, দুঃখ, অদ্ভুত আচরণ মাতিয়ে দেয় স্বচ্ছকে। তার আচরণেও রয়েছে সীমাহীন মোহ! স্বচ্ছের মন বলে ওঠে,

“একেই কি বলে পুরুষের সর্বনাশা নারী?”
কথাটুকু প্রকাশ করে না সে। তার প্রকাশ করা মানা। সে বাদ্ধ। মোহকে ভালোবাসা যাবে না। পৃথিবীর যেকোনো মেয়েকে ভালোবাসলেও মোহকে ভালোবাসা এতো সহজ নয়।

গভীর মনোযোগ দিয়ে স্বচ্ছের ব্যাপারেই ভেবে যাচ্ছে মোহ। লোকটা কত অদ্ভুত। মাঝে মাঝে আঁড়চোখে স্বচ্ছের দিকে তাকাতে চেষ্টা করছে সে। স্বচ্ছ তাকে নিয়ে গেছিল কিছু নিউজ চ্যানেলের অফিসে। কঠোরভাবে বারণ করে দিয়েছে এমন বদনাম ছড়ালে বা ভুলভাল খবর ছড়ালে সেকেন্ড বার চান্স দেবে না স্বচ্ছ। ওপর মহলে গিয়ে বন্ধ করিয়ে ছাড়বে চ্যানেল। তৎক্ষনাৎ সেসব খবর ডিলেট দেওয়া হয়। মোহ তখন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিল স্বচ্ছের পানে। বলার কিছুই ছিল না তার। তার মনে হয়েছিল স্বচ্ছই এসবকিছু করেছে। কিন্তু, কিন্তু, কিন্তু! সে এটা ভেবে বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছে। স্বচ্ছকে এই বিষয়ে বেশ কথাও শুনিয়েছে সে। ওকে সরি বলতে গিয়েও থামছে মোহ। কারণ স্বচ্ছও তো তাকে কম কথা শুনাইনি। বিয়ে করার প্রস্তাবও দিয়ে ফেলেছে। সেজন্য নিজের অনুতপ্ত হয়েও হচ্ছেনা।

ট্রাফিক ছাড়া মাত্রই গাড়ি স্টার্ট দেয় স্বচ্ছ। চলল সে নিজের গন্তব্যে। মোহ স্বচ্ছকে তার নিজের বাড়ির রাস্তায় না নিয়ে যেতে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে,
“এটা কোথায় যাচ্ছেন? এটা তো ভুল রাস্তা!”

“নিয়ে গেলেই দেখতে পাবে।”

“সব কাজ তো শেষ তাই না তাহলে কোথায় যাচ্ছি?”

“তোমাদের মেয়েদের একটা সমস্যা হলো তোমরা সবসময় নিজেদের খুব বেশিই ইম্পরট্যান্স দাও। তোমায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব না। নো টেনশন।”

স্বচ্ছের একটা কথাতেই মোহের মুখটা ভোঁতা হয়ে যায়। সে কি সোজাসুজি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না? পারবেই বা কেন? মামা-মামি তো কম যায় না। মুখ ফুলিয়ে বসে রইল সে।

গাড়িটা এসে থামে একটা হসপিটালে। স্বচ্ছ দ্রুত নেমে যায় গাড়ি থেকে। মোহও নেমে হসপিটালের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের সুরে বলে,
“আমরা এখানে কেন? নানিমা ঠিক আছে তো?”

“সবাই ঠিক আছে। শুধু একজন বাদে।”

“কে?”

স্বচ্ছ মোহের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“কাল একজনকে খুব মেরেছি। বড়সড় অপরাধ করতে যাচ্ছিল সে। একটা বউ থাকতে আরেকটা বিয়ে করতে যাচ্ছিল। তাই বলছিলাম একটু চলো তো! দেখবে তুমি চেনো কিনা?”

“আমি চিনব কিভাবে? আমার চেনাজানা তো এমন কোনো নিচ মানুষ নেই।”
বেশ ভাবুক হয়ে বলল মোহ। স্বচ্ছ অদ্ভুত হেঁসে হসপিটালের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল,
“ওয়েল! এক পলক দেখেই নাও। চিনলেও চিনতে পারো।”

স্বচ্ছের মাথায় কি চলে তা বোঝা মোহের পক্ষে হয়ত সম্ভব না। তার এসব কথা শুনে তার পিছু পিছু হেঁটে যায় মোহ। তিন নম্বর ফ্লোরে ডান দিয়ে করিডোর ধরে এগোতেই মোহের দৃষ্টিতে পড়ে কিছু চেনা মুখ। ধীরে ধীরে মস্তিষ্কে চাপ দিতেই চোখ বড় বড় হয়ে আসে তার। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“এ…এটা… এটা তো ওই লোকটা মানে আদিল…”

পুরোটা বলতেই পারে না সে। স্বচ্ছের সাথে এগিয়ে যেতেই মাথা নুইয়ে ফেলে আদিলের মা-বাবা। তৎক্ষনাৎ স্বচ্ছ বলে ওঠে,
“তাহলে কি ভাবলেন? ছেলেকে আরেকটা বিয়ে দেওয়ার অপরাধে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া যাক?”

আদিলের বাবা এগিয়ে এলেন। বেশ বিনয়ের সুরে বললেন,
“এমনটা করো না বাবা। এমনি ছেলেকে মেরেছো এর বদলে আমরা মেনে নিয়েছি। পুলিশে ধরিয়ে দিলে মানসম্মান থাকবে না।”

“কিন্তু আমি তো খবর পেয়েছি মোহের মিমিকে কল দিয়ে যা ইচ্ছে তাই শুনিয়ে দিয়েছেন আপনার স্ত্রী? মোহ অপয়া? অলক্ষ্মী?”

আদিলের মা মাথা নাড়ায়। স্বচ্ছ হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“মোহ আপনাদের সস্তার ছেলেকে ডিজার্ব করে না। এটাকে হয়ত বাদরের গলায় মুক্তর মালা বলে। আমি আমার মোহকে কোনো থার্ডক্লাস পরিবারের হাতে তুলে দেব না।”

মোহের হাতটা ধরে স্বচ্ছ। ধরেই টেনে নিয়ে কেবিনে যায়। মোহ হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে স্বচ্ছ নামক লোকটির দিকে। ‘আমার মোহ’ বলতে কি বুঝাতে চাইলো স্বচ্ছ?

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কালকে ছোটখাটো ঝটকা দেব। গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here