একটুখানি_সুখ #আনিশা_সাবিহা পর্ব ২২

0
475

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২২

বেডে বসে বালিশে ঠেস লাগিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে মাথার চুল চেপে ধরে বসে আছে সৌমিত্র। ফর্সা মুখ খানিতে লাল আভায় বর্ণিত। বিরক্ত লাগছে তার খুব। কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে। বড় বড় চোখজোড়ার পলক পড়ছে না। মাথায় হালকা কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল ধরে টানছে সে। মিসেস. রেবা বসে বসে ছেলেকে খাইয়ে দিতে ব্যস্ত। কিন্তু সৌমিত্র খাওয়া বাদ দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বসেই আছে। এবার সে দৃষ্টি মায়ের দিকে রাখে। সৌমিত্রের দৃষ্টি সবসময় হিংস্রতা ছেয়ে থাকে। তার অদ্ভুতভাবে চোখ পাকানো দেখলে সাধারণত যে কেউ আচমকা ভড়কে যাবে। মিসেস. রেবাও ছেলের থেকে ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

“মম, এটা কি ঠিক হচ্ছে? বিয়েটা তো ভাইয়ার নামে হয়ে যাচ্ছে। আমার কিন্তু বিষয়টা ভালো লাগছে না। বিয়ে তো আমি করার কথা। তাহলে আমার নামের সাথে কেন মোহের নাম জুড়ছে না?”

মিসেস. রেবা এবার কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। ছেলেটার প্রতিটা প্রশ্নের জবাব দিতেও ভাবতে হয় তার। যদি এমন কিছু বলে ফেলে যেটা তার পছন্দ না তাহলে আর রক্ষে নেই। মোলায়েম সুরে বললেন,
“কেউ তো তোর কথা জানে না সৌমিত্র! আর মোহের সাথে তো তোরই নাম জুড়বে। তোর ভাইয়া তো তোর হেল্পই করছে।”

“কিন্তু বিয়েতে ওইযে কিসব রিচুয়ালস হয় না? গায়ে হলুদ, মেহেন্দি এসব কাজ তো ভাইয়াই করবে না? কেন ভাইয়া করবে এসব আমার করার কথা। দ্যাটস নট ফেয়ার মম। বিয়ের বর ঘরবন্দী হয়ে বসে আছে! ভাইয়াকে এসব করতে দেব না আমি। ভাইয়া যদি মত পাল্টে নিজে বিয়ে করে ফেলে তখন কি হবে?”

বেশ অস্থির ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে সোজা হয়ে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সৌমিত্র মিসেস. রেবার দিকে। উনি কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে বলেন,
“কেন এতো চিন্তা করছিস? আমি সব ব্যবস্থা করে রেখে এসেছি। কিছু হবেনা। ছোটো করে বিয়ের আয়োজন করবে শুধু। এসব অনুষ্ঠান কিছুই হবে না। আর তোর ভাইয়া থাকলে তো কিছু করবে? ওকে চট্টগ্রাম পাঠাচ্ছি কাজের বাহানায়। একেবারে ৫ দিনের মাথাতেই ফিরবে আর এসে দেখবে তোদের বিয়ে হয়ে গেছে।”

এবার বেশ কিছুটা ক্ষ্যান্ত হয় সৌমিত্র। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক স্মিত হাসি। সেখানেও রয়েছে কিছুটা হিংস্রতার ছোঁয়া। জেদ, মোহ, আকর্ষণ খুব খারাপ। এসবের মধ্যে কোনো একটা যদি মানুষের মনে চেপে বসে তাহলে মানুষের মস্তিষ্ক অচল করে দেয়।

কেটেছে পাঁচদিন। রাত-দিন, রাত-দিন করতে করতে পেরিয়ে গেল সময়টুকু। এসেছে কাঙ্ক্ষিত দিনটি। ভোরের সময়। চারিদিকে নিস্তব্ধ। আলোটুকুও ফোটেনি এখনো। ভোরের পরিবেশ স্নিগ্ধ হয় বড্ড। বাতাসে থাকে মিষ্টি ঘ্রাণ আর শীতলতা। তার ওপর রাতে হয়েছে বৃষ্টি। রাস্তাঘাট পানিতে ভেজানো। গাছের পাতায় পাতায় ফোঁটা ফোঁটা পানি। পরিবেশ যেন বলে দিচ্ছে আজকে অনেক কিছু পাল্টাবে। জীবনের সমীকরণটাও। কেউ পাবে নিজের কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। কেউ পাবে হতাশা, অসাফল্য।

কম্বল জড়িয়ে বিছানায় গুটিশুটি মেরে এক গভীর ঘুমে মত্ত মোহ। মাথাটুকু কম্বলে ঢুকিয়ে নিয়েছে সে। জানালা দিয়ে আসা শিরশিরে বাতাসে বড্ড ঠান্ডা লাগছে তার। যাকে নিয়ে এতো এতো আয়োজন সে ঘুমে বিভোর। এই পাঁচটি দিন বড্ড দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কেটেছে তার। মাঝে মাঝে না চাইতেও মনে হয়েছে স্বচ্ছ নামধারী মানুষটাকে কেন বাছল সে নিজের জীবনে? স্বপ্ন তো দেখেছিল অন্য কাউকে নিয়ে। সেটা পূরণ হলো না কেন? এ ছিল তার ভাগ্য? নিজের ভাগ্যের ওপর চরম বিরক্ত প্রকাশ করেছে মোহ সবসময়।

এই অসময়ে আচমকা ফোনটা বাজতে শুরু করে মোহের। হালকা নড়েচড়ে উঠে আবারও ঘুমটা গাঢ় হতে শুরু করে মোহের। কিন্তু রিংটোনের আওয়াজ তীব্র হতে থাকে। এবার ঘুমটা একেবারে হালকা হয়ে আসে তার। বিরক্তির মাত্রা বেশি হওয়ায় ‘চ’ প্রকৃতির আওয়াজ করে কম্বল থেকে মাথা বের করে চোখজোড়া বিরক্তির সাথে খুলে ফোনের দিকে উঁকি দেয় মোহ। তারপর দৃষ্টি যায় জানালার দিকে। এখনো রাতের রেশ কাটেনি আকাশের। নেই কোনো আলো। মানে এখনো ভোরই আছে। দাঁতে দাঁত চেপে ফোনটা হাতে ধরতে ধরতেই কেটে যায়। হাফ ছেড়ে ফোনটা নিয়ে আবারও চোখ বুজতেই ফোনটা নিজ ছন্দে আবারও বেজে ওঠে। এবার তিড়িংবিড়িং করে খানিকটা ফোন ধরে মোহ হাতে শক্ত করে। কে ফোন করেছে সেটা দেখার প্রয়োজনবোধ করে না সে। যেই করুক না কেন! তার মাথা ঠিক নেই নিশ্চিত! চোখ বুঁজেই ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে নিজমনে ক্ষোভের সাথে বলে ওঠে,

“কি সমস্যা? মেয়াদ শেষ হওয়া গাঞ্জা খেয়ে ফোন দেওয়া হইছে? ভোরে কেউ ফোন দেয়? নিজের মাথায় বাড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আর আমায় থ্যাংকস জানাতে ভুলবেন না।”

“মদখোর পর্যন্ত বলেছো ঠিক আছে মেনে নিয়েছি। এখনো এগুলো হাতে ধরেই দেখিনি। তাতেই এসব খোর বানিয়ে দিচ্ছো?”

এবার চোখজোড়া আপনাআপনি খুলে যায় মোহের। তড়িঘড়ি করে দেখে নেয় ফোন নামিয়ে ফোন নম্বরটা। স্পষ্ট মোহ সেভ করে দেখে ‘অস্বচ্ছ ব্যক্তি’। আবারও কানে ফোন ধরে মোহ। আর অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“আপনি? এতো ভোরে? মাথা ঠিক আছে আপনার? আমার কত সুন্দর ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলেন।”

“জীবনে অনেক ঘুম পাবে। কিন্তু এই দিনটা তো পাবেনা। আমি আধঘন্টার মধ্যে তোমার বাড়ির সামনে পৌঁছাচ্ছি তুমি বাহিরে আসবে। এক মিনিটও দেরি হলে ভেতরে যেতে কিন্তু সময় লাগবে না গট ইট?”

হাই তুলে শোয়া থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে পড়ে মোহ। স্বচ্ছের কথা শুনে সে বর্তমানে বিস্ময়ের আকাশে ভেসে যাচ্ছে। চোখজোড়া কপালে উঠে যাচ্ছে। আবারও বাহিরে তাকায় সে। ঘড়ির দিকেও তাকায়। তারপর বিস্ময়ের সুরে কিছুটা জোরে বলে ওঠে,
“ভোর সাড়ে চারটার দিকে? লাইক সিরিয়াসলি? আমার কি মনে হচ্ছে বলুন তো আপনি ড্রিংক করে আমাকে ফোন করেছেন। আর এসব বকে যাচ্ছেন। একটা কাজ করুন। ঘুমিয়ে পড়ুন ফোনটা কেটে দিয়ে। সকালবেলা সব ঠিকঠাক লাগবে।”

“অলরেডি এক মিনিট কমে গিয়েছে। ইউ হ্যাভ টুয়েন্টি নাইন মিনিটস মিস. মোহ! উপস সরি… হবু মিসেস. আহিয়ান স্বচ্ছ। স্বচ্ছ লেট করা একদম পছন্দ করে না। সো আমি নিশ্চয় এটা এক্সপেক্ট করতে পারি যে তার স্ত্রীও অন্যদের মতো লেট করবে না? টাইম চলে যাচ্ছে। উড়ে পড়ো। ফ্রেশ হয়ে নাও।”

“কিন্তু আজকে তো বিয়ে!”

“আমি কি তোমায় বিয়ে বন্ধ করতে বলেছি? না তো? অযথা বন্ধ করো। আমি ফোন রাখছি। রিমেম্বার দ্যাট, ইউ হ্যাভ টুয়েন্টি এইট মিনিটস।”

ফোনটা কেটে গেল। মোহ রাগে ফোনটা অন্যদিকে ছুঁড়ে মেরে স্বচ্ছকে ভেঙ্গিয়ে বলল,
“রিমেম্বার দ্যাট, ইউ হ্যাভ টুয়েন্ট এইট মিনিটস। মামার বাড়ির আবদার পেয়েছে। এই ভোরে আমি উনার সাথে দেখা করব? আমার মাথা এতোটাও খারাপ না। তাছাড়া সকালের পর থেকে কি যে ধকল যাবে আমার ওপর দিয়ে। আমি কারো সাথে বের হতে পারব না। ইম্পসিবল।”
বলেই আবারও বড় একটা হাই তুলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় মোহ। ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। ধীরে ধীরে আবারও চোখ লেগে এলো তার।

ভোরে রাস্তায় যানবাহনের আনাগোনা খুব কম। নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে শাঁ শাঁ করে একটা করে ট্রাক নয়ত বাস যাচ্ছে। তার মাঝে মুখ দিয়ে শিঁস ফুটিয়ে ড্রাইভ করছে স্বচ্ছ। জানালা দিয়ে আসছে হিম করা বাতাস। সাইড করে চুল ঠিকঠাক করে বের হলেও চুলের অবস্থা এলোমেলো তার। ফোন বাজতেই ব্যাঘাত ঘটে ড্রাইভ করাতে। পাশের সিটে রাখা ফোনের দিকে একবার তাকিয়ে স্বচ্ছ নিজের শুষ্ক ঠোঁটজোড়া প্রসারিত করে হাসে নিঃশব্দে। তারপর গাড়ি ব্রেক করে সাইডে। ফোনটা হাতে নিয়ে সাথে সাথে কানে ধরে বলে,
“হ্যালো মা?”

“হ্যালো, স্বচ্ছ? কোথায় তুই?”

“আমার কোথায় থাকার কথা? অভিয়েসলি চট্টগ্রাম। অদ্ভুত প্রশ্ন করো আজকাল। সন্দেহ করছো নাকি নিজের ছেলের ওপরে।”

ওপাশ থেকে মিসেস. রেবা বিরক্ত টেনে বললেন,
“তোকে সন্দেহ করব কেন? আজকে রাতে তোদের বিয়ে। সকাল সকাল রওনা দিস।”

“তুমি এতো সকালে উঠে বসে আছো যে? আমি তো কাজ করছিলাম। এখনো তো সকালের আলোও ফোটেনি। মনে হচ্ছে দুপুরের মধ্যেই বিয়ে টিয়ে সেড়ে ফেলবে!”
বাঁকা হেঁসে প্রশ্ন করে স্বচ্ছ। মিসেস. রেবা থতমত খেয়ে জবাব দেয়,
“তুই বুঝবি না ছেলের মাকে কতদিক সামলাতে হয়। ছেলের বিয়ে বলে কথা।”

“ঠিক আছে আমি রাখি?”
মিসেস. রেবা সম্মতি দিতেই ফোনটা কেটে দিল স্বচ্ছ। ফোন রেখে বড় শ্বাস নিয়ে সামনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে নিজমনে বলে,
“যাকে তুমি এতোটা চতুর করে তৈরি করেছো তাকে তুমি এতো সহজে বোকা বানাতে চাইছো মা? সৌমিত্রের সঙ্গে মোহের দুপুরের মধ্যে বিয়ে সেড়ে ফেলে রাতে আমাকে চমকে দিতে চাইছো? চমকে আমি তোমাদের দেব। ভালোবাসা বড্ড বাজে মা। কারোর কথা শোনে না। কারোর না। এটা যতটা বিষাক্ত ততটা সুন্দর। পবিত্র ভালোবাসার বন্ধন ততটাই সুন্দর।”

ঘুম ঘুম চোখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে মোহ। ঘুমের চোটে মাঝে মাঝে চোখ কচলিয়ে যাচ্ছে সে। তবুও তার সামনে থাকা নির্দয় আর কঠোর লোকটা ভ্রুক্ষেপহীন। একটু আগেই ফোন দিয়ে মোহের ঘুম আবারও ভাঙিয়ে একপ্রকার ব্ল্যাকমেইল করে রাস্তা পর্যন্ত টেনে এনেছে স্বচ্ছ। এমনকি ফ্রেশ হবারও সুযোগ পায়নি মোহ। গায়ে শুধুমাত্র একটা চাদর জড়িয়ে রেখে। ঘুম সামলাতে না পেরে এবার কাঁদো কাঁদো মুখে তাকায় মোহ স্বচ্ছের পানে। ঠান্ডা পরিবেশ। গাছের পাতা দিয়ে টপটপ করে পড়ছে পানি। ভেজা রাস্তা। সোডিয়াম লাইট এখনো জ্বলছে রাস্তায়। মোহ কাতর সুরে বলে,
“এখন যাই?”

“উঁহু না।”
নির্বিকার সুর স্বচ্ছের। তার দৃষ্টি তখন থেকেই স্থির মোহের ওপর। দৃষ্টিতে রাজ্যের শীতলতা। মাতাল করা চাহনি। মোহের এলোমেলো কোঁকড়ানো চুল, ফুলে থাকা চোখমুখ আর উল্টে রাখা ঠোঁটজোড়াতে মত্ত স্বচ্ছ। মোহ কিছু বলতে চাইতেও স্বচ্ছ বলে ওঠে,
“জীবনে যেন এই রুপে কারোর সামনে যেও না। তোমার মোহের আগুনে জ্বলে যাবে। আমি কিন্তু জ্বলে পুড়ে গিয়েছি। আমি চাই না তোমার এই রুপের নেশায় অন্যকেউ নেশাগ্রস্ত হক। কারণ এর অধিকার শুধু আমি পেতে চলেছি।”

চলবে….

[বি.দ্র. অগোছালো একটা পর্ব। সবাই রেসপন্স করবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here