#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি
~আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
পর্ব-৭
বারান্দার দু’পাশে ফুলের টব সাজানো। মাঝে পাতানো দুটো লবি চেয়ার। সেথায় বসে আছে জাওয়াদ-মুশরাফা। পাশাপাশি, মাঝে এক হাতের দূরত্ব। জাওয়াদের দৃষ্টি মুশরাফার দিকেই স্থির। দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা করছে বারংবার, কিন্তু ফলাফল শূন্যের কোঠায়। অবাধ্য চোখজোড়ার অনিমেষ চাহনি প্রেয়সীর পানে। যেন তারা পণ করেছে, বহুল প্রতীক্ষিত সাক্ষাতে প্রেয়সীর থেকে চোখ সরাবে না।
গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেল। আকাশটা স্বচ্ছ নীল। সারি সারি মেঘের ভেলা, মৃদু হাওয়ার পসরা বইছে। ছুঁয়ে দিচ্ছে অরুণ রাঙা পোশাকে আবৃত মেয়েটাকে। মেয়েটার দৃষ্টি আকাশ পানে, এখনো চোখে চোখ পড়েনি। চোখ মুখ স্বাভাবিক, কোন অস্বস্তির আভা নেই। জাওয়াদের তাকিয়ে থাকার মাঝে দৈবাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল মুশরাফা। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলল। জাওয়াদের হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। চমকাল, থমকাল।
অথচ মুশরাফা স্বাভাবিক, দ্বিধাহীন। স্থির চোখে সেকেন্ড দশেক সময় নিয়ে জাওয়াদকে পরখ করল। তারপর দৃষ্টি ফিরাল। তাকে একটুও বিচলিত দেখাল না।
মুশরাফার এই অবিচল দৃষ্টিভঙ্গি, বিচলিত করে ফেলল জাওয়াদকে। একদলা অস্বস্তি এসে গা ছুঁলো, হাঁসফাঁস করে উঠল সে। দৃষ্টি সরে গেল। নার্ভাস হয়ে পড়ল। জাওয়াদ খুব করে জানে, এই মুহুর্তে তার কিছু বলা উচিত। আলাপের সূচনা করা উচিত। সে নীতিজ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়ে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু স্বর বেরুল না। নিজেকে ভীষণ নার্ভাস অবস্থায় পেল। আশ্চর্য! এত অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে কেন? স্কুল লাইফ থেকে ভার্সিটি লাইফ অবধি হাজারটা মেয়ের সাথে কথা বলেছে। কই কথা বলতে গিয়ে কখনো তো আটকায় নি, জড়তা কাজ করেনি। নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে অনর্গল কথা বলেছে। কত মেয়ে চোখে চোখে রেখেছে, হাতে হাত রেখেছে, কখনো এতটা দমবন্ধকর অনুভূতি হয় নি। আজ কী হলো হঠাৎ! আকস্মিক এত জড়তা আসছে কোথা থেকে! নিজের উপরই বিরক্ত হলো সে। সরিয়ে নেয়া দৃষ্টি আবার নিবদ্ধ করল পাশসঙ্গীর উপর। মেয়েটা নির্দ্বিধায় তখনো আকাশ দেখছে। বোধহয় তার আলাপ শুরুর অপেক্ষা করছে।
নড়েচড়ে বসল জাওয়াদ। এখন মুখ না খুললেই নয়। নিজেকে ধাতস্থ করল, আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনল। মৃদুশব্দে কাশল। তার কাশিটা যেন মুশরাফাকে বলল, জাওয়াদ আলাপ শুরু করবে, তুমি মনোযোগ দাও। মুশরাফা স্বচ্ছ নীলাকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে টবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।
সাহস সঞ্চার করে জাওয়াদ বলল,
‘কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। ‘ ছোটো করে উত্তর দিল মুশরাফা। তার স্বরে কোমলতা নেই, স্বরটা গম্ভীরতায় ভরা। তবুও মধুর শুনাল জাওয়াদের কানে। মুশরাফা সৌজন্যবোধে তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না। খানিকটা অপমানবোধ করলেও প্রখর অনুভূতির কাছে বিশেষ গ্রাহ্যতা পেল না। জাওয়াদ ভাবল, এরপর কী বলা যায়! ভেবে পেল না। কথার ভাণ্ডারে চোখ বুলিয়ে দেখল, শূন্যতা ছেয়ে আছে। নিজেকে ধিক্কার দিল, তোর কথার কারণে মেয়েরা তোর উপর মরতো, সেই তুই কথা হারিয়ে বসে আছিস!
খেই হারিয়ে ফেলল ও। ভাবনায় কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেসা আসছে না। কী জিজ্ঞেস করবে! খানিক ভেবে বলল,
‘তোমার সম্পর্কে কিছু বলো।’
মুশরাফা তাকাল জাওয়াদের পানে, সরাসরি। চোখ মুখ একবারেই স্বভাবিক। স্বরে গম্ভীরতা টেনে বলল,
‘আমি মুশরাফা সিদ্দিকী। ইসলামিক স্টাডিজ নিয়ে পড়ছি। চেষ্টা করছি, জানা বিষয়বলি মেনে চলার। এই তো।’
জাওয়াদ কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইল, ‘ আরও কিছু বলো, যা আমার জানা নেই।’
‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আপনি আগ থেকে আমাকে পড়েছেন, আমার সম্পর্কে সব জানেন। ‘ কথাটা ধারণার মতো শুনালেও মুশরাফার স্বরটা ছিল দৃঢ়। যেন সে নিশ্চিত।
জাওয়াদ বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। মেয়েটা জানল কিভাবে! সে তো কিছু বলে নি। অনিক ছাড়া দ্বিতীয় কেউ তো জানে না। মা জানে এক আধটু। কিন্তু তিনি তো বলবেন না। তবে কিভাবে টের পেল? সমীকরণ মেলাতে গিয়ে ব্যর্থ হলো সে। অবাক হয়ে তাকাল এক পলক। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘এমন মনে হওয়ার কারণ?’
মুশরাফা আকাশ পানে চেয়ে খানিক সময় নিয়ে জবাব দিল,
‘আপনি বিগত দশমিনিটে তেত্রিশবার আমার দিকে তাকিয়েছেন। সেই সাথে প্রথম সম্বোধন ‘তুমি’ দিয়ে শুরু করেছেন। ‘তুমি’ সম্বোধনে আপনার মাঝে কোন দ্বিধা ছিল না। এই ধাঁচটা চেনা কারো জন্য প্রয়োগ হয়ে থাকে। তাছাড়া, আপনার মুখভঙ্গী, দৃষ্টি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে আপনি আমাকে জানেন আগ থেকে।’ মুশরাফার স্বর দৃঢ়, তার কথার মাঝে আত্মবিশ্বাস লক্ষণীয়। যা স্পষ্ট প্রমাণ করে মেয়েটা সবটা পরখ করেছে।
জাওয়াদ ধাক্কাটা ভালোই খেল। মুশরাফা ওকে এভাবে পরখ করবে তা অকল্পনীয় ছিল। মেয়েটা তো অন্যদিকে ফিরে আছে, তবে এতসব পরখ করল কখন! সামনের দিকে তাকিয়ে ওর তাকানো পরখ করেছে, সেই সাথে হিসেব কষেছে! এই মেয়েতো ভীষণ চতুর! সাংঘাতিক। ধরা পড়ে লজ্জার আবহে ডুবল জাওয়াদ। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এই প্রথম কোন মেয়ের সামনে তাকে লজ্জা পেতে দেখা যাচ্ছে। অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করতে দেখা যাচ্ছে। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। জাওয়াদ আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলতে চাইল স্বর বেরুল না। কথারা হারিয়ে গেছে। নিরবতায় গা মাড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
মনে চাপা একটা কৌতূহল অনেকক্ষণ যাবত বের হওয়ার সংগ্রাম করছে। কথা হারিয়ে সেই কথাকে মুক্ত করল। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
‘আমার সম্পর্কে তোমার মতামত কী? বিয়েতে হ্যাঁ বলবে?’
জাওয়াদের প্রশ্নে ওর পানে তাকাল মেয়েটা। চোখ মুখ স্বাভাবিক রেখে গম্ভীর স্বরে বলল,
‘আমি তো আপনাকে দেখিনি। না দেখে মতামত জানানো সম্ভব হচ্ছে না।’
জাওয়াদ অবাক স্বরে বলল,
‘তুমি আমাকে দেখো নি! ‘
মুশরাফা চোখ নামিয়ে নিঃসঙ্কোচে উত্তর দিল, ‘না’
জাওয়াদের বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ল। মুশরাফার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারছে না সে। মেয়েটা কী বলতে চাইছে?
‘তোমার সামনে যে বসে আছে, সে নিশ্চয়ই কোন ভূত নয়!’ বিদ্রুপ করল জাওয়াদ।
মুশরাফা আম্ভরিক গলায় বলল,
‘ বাহ্যিক রূপটা আপনি নন, আপনি হলেন আপনার ভেতরকার ব্যক্তিত্ব। বিয়েটা আপনার রূপের সাথে নয়, আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে হবে। যে ব্যক্তিত্বকে আপন ভেবে পার করতে হবে সারাজীবন। আমি সেই ব্যক্তিত্ব দেখিনি। মতামত জানার হলে আপনাকে প্রথমে সেই ব্যক্তিত্ব উপস্থাপন করতে হবে, যা পরখ করে আমি মতামত জানাতে পারব।’
জাওয়াদ চমকাল, ভড়কাল। মেয়েটাকে প্রথম দেখায় সে লাজুক ভেবেছিল। মেয়েটা লাজুক নয়, কেমন গম্ভীর! স্ট্রং, বোল্ড পার্সোনালিটির। এত মেয়ের সাথে ডেটে গেছে। প্রথম সাক্ষাতে সবার মাঝে লাজুকতা ভর করেছে। টমবয় মেয়ে অবধি প্রথম সাক্ষাতে লজ্জা, অস্বস্তিতে লাল হয়েছিল। অথচ এই মেয়ে অনড়, গম্ভীর, অস্বস্তিহীন। লজ্জা নেই, দ্বিধা নেই। স্বর দৃঢ়। কথা স্পষ্ট। স্বরে আত্মবিশ্বাস মাখানো। কথাগুলো বেশ গুছানো। কথার ধাঁচে আন্দাজ করা যায়, শিক্ষিত, মার্জিত, প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক নারীর বসা তার পাশে।
জাওয়াদের মনে হলো, তার চেনা হাজারটা মেয়ের সাথে এই মেয়ের ব্যক্তিত্বের মিল নেই। এই মেয়ে আলাদা, সবার চেয়ে আলাদা। এত বোল্ড পার্সোনালিটির মেয়ে ইতঃপূর্বে দেখা হয়নি তার। আজই দেখল, তাও প্রেয়সী রূপে!
বারান্দার এক কোণে একটা দশ বছরের ছেলে বসা। ছেলেটার নাম জিহান। সম্পর্কে জাওয়াদের ভাইয়ের ছেলে। দুজনের সাক্ষাতের পাহারাদার হিসেবে পাঠানো হয়েছে তাকে। সে তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছে না। হাতে ফোন। গভীর মনোযোগ দিয়ে ফোনে গেমস খেলছে। এদিকে মনোযোগ আছে বলে মনে হয়না। ভাগ্নেকে পরখ করল জাওয়াদ। তারপর নিচুস্বরে বলল,
‘ সুযোগের অভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারিনি। আমার সু্যোগ প্রয়োজন। ‘
থামল সে। মুশরাফাকে পরখ করল। ওর দৃষ্টি মেঝেতে আবদ্ধ। মুখে মনোযোগী ভাব স্পষ্ট। জাওয়াদ চোখ ফেরাল না, ওর মুখ পানে চেয়ে মনের ডায়েরির প্রথম পাতায় বড়ো অক্ষরে লেখা বাক্যটি উচ্চারণ করল,
‘ জীবনে জীবন জড়িয়ে নিজেকে উপস্থাপন করার সুযোগটা, তুমি কি আমায় দিবে?’
জাওয়াদের ধারণা এবার মুশরাফার চোয়ালে লজ্জা, অস্বস্তির আভা ফুটে উঠবে। উঠবেই। কিন্তু তার ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করে অস্বস্তি কিংবা লজ্জার টিকি চিহ্ন ও দেখা গেল না। মুখভঙ্গির কোন পরিবর্তন হলো না। স্থির থাকা নেত্রপল্লব ঘনঘন দু’বার উঠানামা করল শুধু। পরপরই চোখ তুলে চাইল পাশে। নিঃসঙ্কোচে উত্তর দিল,
‘ ‘বিয়ে দুটো মানুষের সারাজীবনের ভালো থাকার প্রশ্ন। উত্তরটা তৎক্ষনাৎ দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি ভাবব এ সম্পর্কে। যদি আদতেই মনে হয়, আপনাকে নিয়ে জান্নাতে যাওয়ার দোয়াটা আমি নির্দ্বিধায় করতে পারব, তবে আমি আপনাকে সুযোগ দিব ইন শা আল্লাহ। ‘
আর কথা খুঁজে পেল না জাওয়াদ। কথারা সব পুরিয়ে গেছে। সে নিশ্চুপ বসে রইল। মুশরাফাও কোন কথা বলল না। অনেকটা সময় পেরুলো এভাবে। আকস্মিক প্রশ্নঝুলি খেলে বসল মুশরাফা,
‘আপনি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেন?’
মুশরাফা থেকে আসা প্রথম প্রশ্নে কিছুটা চমকাল জাওয়াদ। প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ল। ধর্মীয় কাজ বলতে ওই নামাজটাই পড়ে। তাও প্রতি ঝুম’আ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া হয় না ওর। রমজানের রোজাটা ও রাখে না। সিগারেটের ক্রেভিংএর জন্য মধ্যবেলাতেই রোজা ছাড়ার ব্যাপারটা অহরহ ঘটে। জাওয়াদ ভেবে দেখল সে ধর্মীয় অনুশাসন মানে না। ব্যাপারটা স্বীকার করতে চাইল না। বলল,
‘চেষ্টা করি।’
‘আমি যদি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে চাই, আপনি বা আপনার পরিবার থেকে কোন বাধা আসবে?’
‘না।’ ছোটো করে উত্তর দিল জাওয়াদ।
আকস্মিক অস্বস্তিবোধ হলো তার। কেন কে জানে। কেমন হাঁসফাঁস করে উঠল।
আকাশে গোধূলি নেমেছে। চলছে আলো আঁধারির খেলা। বারান্দাটা কালচে ধূসর আলোয় ছেয়ে আছে। সন্ধ্যা নামতেই মশার উপদ্রব বেড়ে গেল। কয়েকটা মশার কামড় খেয়ে উঠে দাঁড়াল জিহান। ফোন বন্ধ করে জাওয়াদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘চাচ্চু চলো এবার যাই। মশা কামড়াচ্ছে। থাকা যাচ্ছে না।’
জাওয়াদ যেন একটা অস্বস্তিঘন পরিস্থিতির থেকে মুক্তির পথ দেখল। ওকে উৎফুল্ল দেখাল। ওর পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি। জুম’আ নামাজের জন্য পরেছিল এই পাঞ্জাবি। অনিক চেঞ্জ করতে না দিয়ে সেভাবেই নিয়ে এসেছে। মুখে কদিনের না কাটা দাঁড়ি। এটাও উকিলবাবার নির্দেশে। পাত্রী দেখতে যাওয়ার সময় তাকে ধার্মিক বেশ নিয়ে যেতে হবে। নাহলে মুশরাফার পছন্দ হবে না, এমন আশঙ্কা অনিকের।
জাওয়াদ কুচকে যাওয়া পাঞ্জাবি টেনে সোজা করল। তারপর উঠে দাঁড়ানোর সময় মুশরাফার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ এবার আমাদের যাওয়া উচিত। ‘
মুশরাফাও উঠে দাঁড়াল। জিহান আগে আগে হাটা ধরল। জাওয়াদ সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
‘ আসি? ভালো থেকো। আবার দেখা হবে।’
‘আচ্ছা।’ ছোটো করে উত্তর দিল মুশরাফা।
প্রথমালাপের ইতি টেনে বেরিয়ে গেল জাওয়াদ। গিয়ে বসল বসার ঘরে। সেখানে নাজমুল সাহেব, ফরিদা, জাওয়াদের বাবা জয়নাল আবেদীন, মা, মায়মুনা আক্তার, অনিক বসে গল্প করছেন। মেয়ে মায়মুনার পছন্দ হয়েছে। জাওয়াদকেও খুব একটা খারাপ লাগে নি ফরিদার। তিনি মায়মুনার সাথে আলাদা কথা বলে নিয়েছেন ভাগ্নীর জীবনধরণ সম্পর্কে। মায়মুনাও আশ্বাস দিয়েছেন। বাইরের মানুষ থেকে পুত্রবধূকে দূরে রাখবেন। মায়মুনার সাথে কথা বলে ফরিদা মনের কোণে আশ্বাস জন্মেছে, এই মহিলার কাছে তার ভাগ্নী ভালো থাকবে। ইনি অন্তত লায়লার মতো কঠোর হবেন না। এখন যদি মুশরাফা ইতিবাচক জবাব দেয় তবে বিয়ের কথা আগাতে কোন দ্বিরুক্তি করবেন না তারা।
লায়লার কথা মনে হতেই মনটা বিষিয়ে গেল ফরিদার। পাত্র পক্ষকে দেখতে আসার আমন্ত্রণ জানানোর পর লায়লাকে ফোন করেছিলেন তিনি। মুশরাফার জন্য সমন্ধ এসেছে জানালেন। বিপরীতে তিনি কোন আগ্রহ দেখালেন না। বললেন, ‘আপনাদের যদি ভালো লাগে তবে বিয়ে দিন, আপদ বিদায় হোক। ‘
দুই পক্ষের বৈঠকে তাদের থাকতে বলেছেন ফরিদা। জবাবে লায়লা সাফ মানা করে দিলেন। আগের বার যে অপমানিত হয়েছেন, এখনো তা হজম করতে পারেন নি। আবার অপমান সহ্য করার ইচ্ছে নেই জানালেন। সেই সাথে বললেন, ‘আপনারা আছেন তো, আমরা লাগবে না। আপনারা ম্যানেজ করে নিন। পারলে বিয়েটাও দিয়ে দিন। আমরা কিছু মনে করব না। টাকা লাগলে বলবেন, আমি পাঠাব।’
তার এই বাঁকা কথায় ফোন রেখে ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়েছেন ফরিদা। মা ও এমন হয়! এত পাষাণ! রাগের বশে আর ফোন করেন নি। নিজেরাই সব ব্যবস্থা করেছেন।
জাওয়াদকে দেখে ফরিদা অন্তর্ভেদী চোখে পরখ করলেন। বুঝার চেষ্টা করলেন, পাত্রী সম্পর্কে ওর ধারণা কী? মনোভাব ইতিবাচক না নেতিবাচক? হ্যাঁ বলবে? ছেলে তার সামনের সোফায় বসে বন্ধুর সাথে নিচুস্বরে আলাপ সারছে। শ্যামবর্ণের সুদর্শন চোয়ালে রাগ কিংবা বিরক্তির আভা নেই, তবে খুব একটা উৎফুল্ল ও দেখা যাচ্ছে না। ফরিদা দ্বিধায় পড়লেন। ইতিবাচক, নেতিবাচক মনোভাব ধরতে পারলেন না। ওপাশের কী খবর? জানার প্রয়াসে উঠে দাঁড়ালেন। অনুমতি নিয়ে ভেতরে গেলেন।
মুশরাফার রুমে গিয়ে খুঁজলেন ওকে। মুশরাফা রুমে নেই। ওয়াশরুমে পানির শব্দ শুনা যাচ্ছে। মাগরিবের আযান হচ্ছে চারদিকে। বোধহয় অযু করতে গেছে, আন্দাজ করলেন ফরিদা। খাটে অপেক্ষায় বসলেন। সেকেন্ড দশেক বাধে বেরিয়ে এলো মুশরাফা। মুখে অযুর পানি। ফরিদা উদ্ধিগ্ন হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘কেমন দেখলি? পাত্র…
মুশরাফা চোখের ইশারায় কী যেন বলল। কথার মাঝে থেমে গেলেন ফরিদা। চারদিকে আযান হচ্ছে, আযানের সময় কথা বলা সুন্নাহপরিপন্থী কাজ। এটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে মুশরাফা। ফরিদা উদ্ধিগ্নতা চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন।
চেয়ারের হাতলে রাখা টাওয়াল। মুশরাফা টাওয়াল তুলে মুখ মুছল। টাওয়াল রাখল। আযান শেষ, বিড়বিড় করে দোয়া পড়ল। ফরিদা অন্তর্ভেদী চোখে পরখ করলেন ওকে। চোখ মুখ একবারে স্বাভাবিক। এর মাঝে কি রাজি? উৎকন্ঠিত হয়ে প্রশ্ন করলেন,
‘এবার বল?’
‘বলো, কী জানতে চাও?’ শান্ত, কোমল স্বরে প্রশ্ন করল মুশরাফা। ফরিদা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘পাত্র কেমন? বিয়ের জন্য রাজি তুই?’
মুশরাফা ভেবেচিন্তে জবাব দিল, ‘বিয়েটা সারাজীবনের ব্যাপার। হুটহাট এক দেখায়, একদিনে কিভাবে সিদ্ধান্ত নিই? আমাকে সময় দাও, ভেবেচিন্তে জানাব। ‘
ফরিদা উত্তর বুঝলেন না। এই মেয়ে হ্যাঁ বলল না কি না! দ্বিধায় পড়লেন। এই মেয়ে একটু বেশিই গম্ভীর! বুঝার চেষ্টায় পরবর্তী প্রশ্ন করলেন,
‘পাত্রের মায়ের তোকে পছন্দ হয়েছে। রিং পরাতে চাচ্ছেন। কী বলব?’
মুশরাফা জায়নামাজ বিছাতে বিছাতে বলল,
‘ দ্বিধার চিহ্ন উঠবে না আমার আঙুলে। বলো, সঙ্গী বাছাইয়ের অধিকারটা পাত্রপাত্রীর। দেখাদেখি পর্বের পর বিয়ের সিদ্ধান্তটা পাত্র পাত্রীর উপর ছেড়ে দিই। তারা ভেবে জানাক, একে অপরের সাথে সারাজীবন কাটাতে পারবে কি না।
ফরিদা এবারও মুশরাফার কথায় উত্তর খুঁজতে গিয়ে হতাশ হলেন। তার কাছে মনে হলো এটা কোন রহস্যজাল। ভীষণ কৌতুহল কাজ করছেন, সমাধান জানার জন্য। কিন্তু উত্তর মিলছে না। কোন সূত্রের ও দেখা নেই, যা দিয়ে তিনি সমাধান আন্দাজ করবেন। শুধু মনে একটাই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে, উত্তরটা কী হবে?
চলবে…