স্বর্নাভ_সুখানুভূতি আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা পর্ব-১৬

0
408

#স্বর্নাভ_সুখানুভূতি

আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

পর্ব-১৬

‘তোমার হাতে এগুলো কিসের দাগ?’

মুশরাফার ধ্যান ভাঙলো। নড়েচড়ে বসল। জাওয়াদের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের হাতের দিকে তাকাল। হাতা ছোটো হওয়ায় হাতের কাটা দাগ বেরিয়ে এসেছে। ভীত ঢোক গিলল ও। এবার কী বলবে? ও তো মিথ্যা বলে না। কিন্তু সত্যটা কীভাবে বলবে! কিভাবে বলবে, এগুলো ওর পরিবারের পক্ষ থেকে আসা মারের দাগ?

মুশরাফা হাজার চেষ্টার পরও সত্যটা বলতে পারল না। কোন মিথ্যাও ওর মুখ থেকে বেরুল না। জাওয়াদ ওর সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। মুশরাফা তাকাতেই চোখাচোখি হলো। মুশরাফা চোখ সরিয়ে চারদিকে তাকাল। তারপর উঠে গেল। জাওয়াদের না খাওয়া ক্যারামেল কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,
‘ এতটাও খারাপ হয়নি। আপনি টেস্ট করলেন না কেন?’

জাওয়াদ তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ঘুরাতে চাইল। মুখ খুলতেই মুশরাফা মগটায় ওর মুখ লাগাল। বলল,
‘আপনার বউ কত ভালো কফি বানায়, আপনার জানা উচিত।’

জাওয়াদের হাতে মগটা ধরিয়ে দিয়ে ওড়না দিয়ে গা ঢাকল মুশরাফা। পরক্ষণেই চলে গেল বিছানায়। জাওয়াদ এবার স্পষ্ট টের পেল, মুশরাফার কথা ঘুরানোটা। ও ভ্রু কুঁচকাল, মেয়েটা কথা ঘুরাল কেন? রহস্য কী?

প্রশ্নরা উত্তর পেল না। কোতুহল নিয়ে ঘুমোতে গেল। ঘুমের মাঝে কৌতূহল বিলীন হলো। উঠে আর মনে পড়ল না। ফজর নামাজ পড়ে আবার ঘুমাল জাওয়াদ। ঘুম থেকে উঠে হাতের কাছে চা পেল, অফিসের ফরমাল ড্রেসাপ নামানো দেখল। ফোন, ওয়ালেট, অফিস ব্যাগ গুছানো দেখল। এই কাজগুলো যে মুশরাফার বুঝতে বাকি নেই জাওয়াদের। ফ্রেশ হয়ে আসতেই নাস্তার জন্য ডাকল মুশরাফা। নাস্তা খেয়ে তৈরি হওয়া ধরল। তখন টিফিন বক্স হাতে নিয়ে রুমে এলো মুশরাফা। জাওয়াদের অফিস ব্যাগে টিফিন বক্স রেখে বলল,
‘টিফিন দিয়ে দিচ্ছি। মনে করে খেয়ে নিবেন।’

জাওয়াদ বিরক্তিভরে বলল,
‘বললাম তো, আমি বাড়ি থেকে টিফিন নিই না। নামাও এটা।’

মুশরাফা ও স্পষ্ট জানাল,
‘ প্রতিদিন বাইরের খাবার খেলে শরীর ভালো থাকবে না। অসুস্থ হয়ে পড়বেন। ঘরের খাবার খান।’

জাওয়াদ দ্বিরুক্তি করল। গম্ভীরমুখে বলল,
‘ আমি টিফিন নিব না। কথা বাড়িয়ো না।’

মুশরাফা ওর পাশে এসে দাঁড়াল। আয়নায় ওকে পরখ করে বলল,
‘বাইরের খাবারের ফ্যাট হয়। এই দেখুন, আপনার ভুড়ি বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে বাইরের খাবার খেলে মেদভুড়ি বেড়ে কদিন বাদে আপনাকে দেখতে আংকেল আংকেল লাগবে। পেটের জন্য পা দেখবেন না, পা চুলকানোর জন্য লোক রাখা লাগবে। তারচেয়ে ভালো নয় কি, এখন স্বাস্থকর খাবার খাওয়া, নিজের শরীরের খেয়াল রাখা?’

জাওয়াদ বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। কী অসভ্য মেয়ে! বলে কি না ওকে আংকেল লাগবে! জাওয়াদ আয়নায় নিজেকে দেখল? কোথায় ভুড়ি! একটু ও দেখা যাচ্ছে না। এই মেয়ে বাড়িয়ে বলে। বেয়াদব মেয়ে। অপমানে মুখে থমথমে হয়ে গেল ওর। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
‘আমাকে আংকেল লাগবে!’

মুশরাফা ঠোঁট চেপে হাসল। তারপর বলল,
‘ বাইরের খাবার খেলে কদিন বাদেই লাগবে। টিফিন নিয়ে যান। অস্বাস্থ্যকর খাবার বর্জন করুন, ব্যায়াম করবেন নিয়মিত। তাহলে দেখবেন আপনি একদম ফিট আর হ্যান্ডসাম থাকবেন অনেককাল। নাহলে আংকেলই লাগবেন। চিন্তা করুন, আপনার মাথার চুল পড়ে গেছে, ভুড়ি বেড়ে পা দেখা যাচ্ছে না। তখন আপনাকে দেখতে কেমন লাগবে?’

জাওয়াদের চোখে ভাসল নিজের এক প্রতিভম্ব। টাক মাথার ভুড়িওয়ালা লোকটাকে নিজের স্থানে আবিস্কার করেই চোখ মুখ কুঁচকে এলো ওর। কী বিকট দেখাচ্ছে!
জাওয়াদ চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ আমাকে মোটেও এমন লাগবে না। বেয়াদব মেয়ে!’

মুশরাফা কিছু বলল না। ব্যাগের চেইন মেরে ব্যাগটা জাওয়াদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘আমি চাইছিনা আপনাকে ওমন লাগুক। তাই আপনার স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে চাইছি। আপনি নিজেও রাখুন। মনে করে লাঞ্চ করে নিবেন।’

অনিচ্ছা সত্ত্বেও জাওয়াদকে টিফিন নিতে হলো।

আলোকোজ্জ্বল সকাল। জেরিন কাপড় গুছাচ্ছে। শ্বশুরবাড়ির পথ ধরবে খানিক বাদে। মুশরাফা খাটের এক পাশে বসে আছে। তার মুখে মলিনতার ছাপ। এ কটাদিন মায়মুনার কথার দাবানল থামিয়েছে জেরিন। ফলে মায়মুনা মুশরাফাকে বকার খুব একটা সুযোগ পায়নি। জেরিন চলে গেলে মায়মুনা আবার আগের স্বরূপে ফিরবেন। একা পেয়ে মুশরাফার সাথে কী কী করে বসেন ভেবেই আতঙ্ক লাগছে ওর। মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘আপু আর কটাদিন থেকে যান?’

জেরিন হেসে বলল,
‘ এক সপ্তাহ থাকলাম তো। আর থাকতে পারব না। সংসার ভেসে যাচ্ছে আমার। তুমি যেও আমার বাসায়। বেড়িয়ে এসো কয়েকদিন। ‘

মুশরাফা ছোটো করে বলল, ‘আচ্ছা।’

জেরিন ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল। জাওয়াদ অফিস যাওয়ার সময় বোনকে গাড়িতে তুলে দিয়ে যাবে। দুজন একসাথে বেরিয়ে পড়ল। জাহিনকে নিয়ে স্কুলে চলে গেছে কাকন। যায়েদ আর জয়নাল আবেদীন সকাল সকাল অফিসের জন্য বেরিয়ে গেছে। বাসায় শুধু মায়মুনা আর মুশরাফা। মায়মুনা রিমোট হাতে টিভি দেখতে বসলেন।

মুশরাফা চলে এলো রুমে। জেরিনকে মনে পড়ছে ভীষণ। কেন চলে গেল? আর কটাদিন থাকলে কী হতো? বিক্ষিপ্তমনে কত কী ভাবছে। এর মাঝে মায়মুনা রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। গম্ভীরমুখে বললেন,
‘ কাকনের ফিরতে দেরি হবে। রান্না বসাও।’

মায়মুনা চলে গেলেন। মুশরাফা ও রান্নাঘরের দিকে আগাল। দরজায় দাঁড়াতেই বসার ঘর থেকে পুরুষালি স্বর কানে এলো। সাথে মায়মুনার কথা ও শুনা গেল। খানিক পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারল, ওটা জিশান। মুশরাফার দেবর। উনি ফিরে এসেছেন! মুশরাফা অবাক হলো। ওকে ভীত সন্ত্রস্ত দেখাল। রান্নাঘরের যাবার সময় বসার ঘর থেকে দেখা যাবে ওকে। কিভাবে রান্নাঘরে যাবে ও! যতযাই হোক এভাবে তো যাওয়া যাবে না। মুশরাফা রুমে ডুকে গেল। আতঙ্কিত হয়ে খাটে বসে রইল।

মিনিট দুয়েক বাদে মায়মুনার স্বর শুনা গেল। বসার ঘর থেকে ডাকছেন জোরে জোরে,
‘মুশরাফা, এখানে এসো। ‘

মুশরাফা অবাক হলো। বসার ঘরে কেন ডাকছে ওকে? ওখানে তো জিশান আছে। জিশানের সাথে ওর কী কাজ! মায়মুনা বারদুয়েক ডাকলেন। মুশরাফা গেল না, জিশান শুনবে বলে জবাব ও দিতে পারল না। মায়মুনা নিজেই এলেন খানিক বাদে। মুশরাফা ওকে খাটে বসে থাকতে দেখে রাগ চড়ল মাথায়। ধমকে বললেন,
‘ ড্রয়িংরুমে যেতে বলছি। শুনতে পাওনি? এতবার ডাকা লাগে কেন?’

মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘ কেন ডেকেছেন মা?’

মায়মুনা গম্ভীরমুখে বললেন,
‘জিশান এসেছে। তোমার সাথে তো ওর দেখা হয়নি। তোমাকে দেখতে চাইছে। যাও, আলাপ করে এসো।’

মুশরাফা বিস্ফোরিত চোখে তাকাল শ্বাশুড়ির দিকে। ও যাবে জিশানের সাথে দেখা করতে, আলাপ করতে! অসম্ভব। ইসলামে দেবরকে ভাবির মৃত্যু স্বরূপ বলা হয়েছে। এই সম্পর্কটা সবচেয়ে বিপদজনক সম্পর্ক। সমাজে হাজারটা ঘর ভাঙে দেবর ভাবির অনৈতিক সম্পর্কের কারণে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই হয়তো ইসলাম দেবর ভাবির সম্পর্কটা এত কঠিনভাবে দেখেছে। দেবর গায়রে মাহরাম। দেবরের সাথে দেখা দেয়া জায়েজ নেই। আলাপ করা তো অনেক দূরের কথা।
এই কথার উপর ভিত্তি করে মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘ উনার সামনে যেতে পারব না আমি। ‘

মায়মুনার রাগটা আবার বাড়ল। স্বরে রাগ মাখিয়ে প্রতিবাদী সুরে বললেন,
‘ কেন পারবে না? ও কী বাইরের মানুষ? ঘরের মানুষের সাথে পর্দা কিসের! যাও শিগগির। ‘

মুশরাফা স্পষ্ট স্বরে বলল, ‘ উনি গায়রে মাহরাম, মা। কোনভাবেই আমি উনার সামনে যেতে পারব না।’

মায়মুনা ‘গায়রে মাহরাম’ এর সংজ্ঞা ও জানেন না। তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন,
‘ আমার ছেলেকে খারাপ মনে হয়, তোমার? কতবড় সাহস, তুমি আমার ছেলেকে খারাপ ভাবো! আমার ছেলের সামনে যেতে কী সমস্যা তোমার? ও তোমাকে টিজ করবে? আমার ছেলেকে আমি ওমন শিক্ষা দিইনি। ও ভীষণ ভালো। নিজে ঠিক থাকলে দুনিয়া ঠিক। তুমি নিজে ঠিক নেই। আবার আসছো আমার ছেলেকে খারাপ প্রমাণ করতে। বেয়াদব মেয়ে। ‘

মুশরাফা হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল। ও কখন জিশানকে খারাপ প্রমাণ করতে চাইল! ও তো শুধু বলেছে দেখা কর‍তে পারবে না, এর মাঝে এসব কথা কোথা থেকে এসেছে বুঝতে পারল না। মুশরাফা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলল,
‘ আমি উনাকে খারাপ বলিনি, মা। আপনি ভুল বুঝছেন। আমি শুধু বলেছি…

মায়মুনার কি আর সে কথা বুঝার সময় আছে? তিনি মনগড়া কথায় নেচে মুশরাফাকে থামিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
‘ এখন শাক দিয়ে মাছ ডাকার চেষ্টা করো না। আমার ছেলেকে খারাপ ভেবেই ওর সামনে যেতে চাইছো না। তোমার কী মনে হয়, আমি বুঝি না? আমি সব বুঝি। হাদিস কালাম আমরাও জানি। ঘরের মানুষের সামনে পর্দা করতে বলে নাই কেউ। শুধুমাত্র ঘরে অশান্তি করার জন্য তুমি এসব করছ। অ/স/ভ্য, বে/য়া/দ/ব, ল/ম্প/ট মেয়ে! নিজেকে ঠিক করো তারপর মানুষকে ভালো খারাপ বলতে এসো। আসোলে মানুষ ঠিকই বলে, এসব জুব্বাতেই শয়তান থাকে বেশি। ব/দ/মা/ইশ মেয়ে। ‘

মুশরাফা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। চোখে বিস্ময় খেলা করছে, স্বর অবরুদ্ধ। শ্বাশুড়ির কথা গুলো হজম হচ্ছে না ওর। সামান্য একটা কথাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এসেছে। সে ভালো একটা কথা বলেছে, সেটাকে ঘুরিয়ে কত কঠিনভাবে গ্রহন করেছে! ভালোভাবে গ্রহন করতে পারল না কেন?

একটা মেয়ে একটা ছেলের থেকে পর্দা করা মানে কি ছেলেটা খারাপ? তাকে খারাপ ভাবা হয়? তেমন তো নয়। দুজন গায়রে মাহরাম ছেলে মেয়ের মাঝে তৃতীয়জন থাকে, সে হলো শয়তান। যার কুমন্ত্রণায় পড়ে ছেলে মেয়ে দুজনে গুনাহের কাজে জড়িয়ে পড়ে। শুধু একজন নয় দুইজনই পড়ে। এই কারণে ইসলাম ছেলে মেয়ে উভয়কেই গায়রে মাহরাম থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বলেছে। মেয়েদের বলেছে শরীরের পর্দা করতে। তেমনি ছেলেকে ও বলেছে চোখের পর্দা করতে। কোন গায়রে মাহরামের সাথে বিনা প্রয়োজন কথা না বলতে, না তাকাতে। ভুলক্রমে একবার চোখ চলে গেলে তড়িৎ চোখ নামিয়ে ফেলতে। দ্বিতীয়বার না তাকাতে। পর্দা শুধু মেয়েদের জন্য নয়, ছেলে মেয়ে উভয়ের জন্য ফরজ করা হয়েছে। সমাজে ইসলামী বিধান বিলীন হতে হতে ছেলেদের পর্দার বিধান ও বিলীন হয়ে গেছে। আল্লাহ ভীরু পুরুষ ছাড়া কোন পুরুষ চোখের পর্দা করেন না। তবে নারীর পর্দা আছে এখনো। আল্লাহভীরু নারীরা পরপুরুষ থেকে পর্দা করে চলেন। এটা ছেলেদেরকে খারাপ ভেবে নয়, শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। এই কথা আমাদের সমাজের বয়স্করা বুঝেন না। বিশেষ করে নিজের ছেলের বেলায়। বাইরের সব ছেলের কাছে মেয়েরা পর্দা করুক, এটা ভালো কথা। কিন্তু নিজের ছেলের কাছে পর্দা করলেই তারা ভাবেন, মেয়েটা তার ছেলেকে খারাপ ভাবছে। তারা সহ্য করতে পারেন না। মেয়েটাকে খারাপ ভাবেন, ভীষণ কষ্ট পান মনে।

একটু ভালোভাবে ভেবে দেখলে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। পরিস্কার হয়ে যায় যে, মেয়েটা ছেলেটা খারাপ ভাবছে না। মায়মুনার গভীর পর্যবেক্ষণের সময় কই? যা মনে আসে তাই ধরে নেন। মুশরাফা নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল,
‘আল্লাহ, আমাকে ধৈর্যধারণ করার তাওফিক দাও। শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে আমি যেন রেগে না যাই, আমাকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করো।’

নিজেকে ধাতস্থ করে অতিব ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ কারো সাথে পর্দা করা মানে সে খারাপ নয়। শুধুমাত্র শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষার উপায় এটা। পর্দার বিধানটা আল্লাহর পক্ষ থেকে। আমি শুধু তার বিধান পালন করতে চাইছি, আর কিছু নয়। একটু বুঝার চেষ্টা করুন, মা!’

মায়মুনা আবার ধমকে উঠলেন,
‘থাপড়িয়ে গাল লাল করে দিব, বে/য়া/দ/ব মেয়ে! আমাকে শিখাতে এসেছো! হাদিস কালাম আমরাও জানি। আমার দাদা আলেম ছিল। আমিও মেনেছি কত বিধান। এসব জানা আমাদের। শিখাতে এসোনা আমাকে। ঘরের মানুষের জন্য কোন পর্দা নেই, সব পর্দা বাইরের মানুষের জন্য। জিশান ঘরের মানুষ। কী শিখছো তুমি? কিচ্ছু ত শিখোনাই, শুধু জুব্বা পরে জ/ঙ্গি সেজে ঘুরো। ‘

মায়মুনার উঁচা গলা শুনে বসার ঘর থেকে জিশান বলল,
‘কী হয়েছে মা?’

ছেলের কন্ঠ শুনে মায়মুনার স্বর ধীর হলো। দাঁত কিড়মিড় করে ধীর স্বরে বললেন,
‘ তুমি কি জিশানের সাথে দেখা করবে না?’

মুশরাফা স্পষ্ট উত্তর দিল, ‘না।’

মায়মুনা রাগ চলকে উঠল। রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেলেন। চেঁচিয়ে বললেন,
‘ তোর বাপ মা তোরে আদব কায়দা শিখায়নাই? কী খাইয়া তোর মায় তোরে জন্ম দিছে। এত অসভ্য মেয়ে আমার ঘরে হইলে গলা টিইপ্পা মাইরা ফেলতাম। এই জুব্বা পরোস কেন? জুব্বার ভেতরই তো সব শয়তানি। তোর নিজের চরিত্রের ঠিক নাই, আবার অন্যের চরিত্র লোইয়্যা কতা কস। কত বড়ো সাহস তোর! তোর মতো খারাপ মাইয়্যা আমার পোলার বউ হইছে ভাইবাই কপাল চাপড়াইতে ইচ্ছা করতাছে আমার। আমার পোলার জীবন শেষ কইরা ফালাইবি তুই। হায় হায় কী অইল! এই মাইয়্যা লোই আমার পোলা জীবন পার করব কেমনে? ‘

মায়মুনা কপাল চাপড়ালেন বার দুয়েক। প্রতিটা কথা মুশরাফার বুকে গিয়ে বিধলে ও সে নিশ্চুপ রইল। তার চুপ থাকার সুত্র হলো দুইটা। এক, বুদ্ধিমান লোক কখনো তর্ক করে না। দুই, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের ভালোবাসেন।

মায়ের চেঁচামেচি শুনে উঠে এলো জিশান। বসার ঘর থেকে বেরিয়ে মুশরাফার রুমের কাছে আসার সময় বলল,
‘ এত চেঁচামেচি করছো কেন মা?’

মুশরাফাকে দেখেনি তখনো জিশান। মুশরাফা ওর কথা শুনেই বুঝতে পেরেছে ও এদিকে আসছে। টের পেয়ে তৎক্ষনাৎ মাথায় একটা কথাই এলো। ওকে সরতে হবে। কোনভাবে জিশানের সামনে পড়া যাবে না। দিক বেদিক না ভেবে রুমে ডুকে গেল। দরজা দিয়ে চুপচাপ বসে রইল।
ততক্ষণে জিশান চলে এসেছে। ছেলের মুখের সামনে এভাবে দরজা দেয়ায় মায়মুনা রাগের মাত্রা বাড়ল। জলন্ত চোখে তাকালেন দরজার দিকে। জিশান আবার জানতে চাইল, ‘ঘটনা কী?’

মায়মুনা চেঁচিয়ে বললেন,
‘এক কাল না/গি/ নী বিয়া কইরা আনছে তোর ভাই। এই নাগিন আসতে না আসতেই অশান্তি শুরু করেছে। মুখের উপর দরজা দিল কেমনে দেখলি? এত বেয়াদব। ভদ্রতার ভালাই নাই। আদব লেহাজ এক জিনিস জানে না। নাহ, এই মাইয়্যা দিয়া আমার ছেলের জীবন যাইব না। আমি ওরে আবার বিয়া দিমু। ‘

জিশান অবাক হয়ে চাইল কেবল। অনিকের কাছে মুশরাফা সম্পর্কে ভালো কথাই শুনেছে। বেশ ভদ্র নম্র নাকি! এই তার নমুনা!

মুশরাফা জায়নামাজ বসা। সেজদায় লুটেছে সেই ক্ষণে। এখনো উঠেনি। যখন ও মন খারাপ হয় বা বিপদগ্রস্ত হয় তখন অযু করে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। কারো সামনে চোখের পানি ফেলা ওর নীতিবিরুদ্ধ কাজ। ওর মতে, মানুষের চোখের পানি অনেক মুল্যবান। এর সঠিক মুল্য আল্লাহ ছাড়া কেউ দিতে পারেনা। কারো সামনে কাঁদলে সে কী করবে? সর্বোচ্চ চোখের পানি মুছিয়ে দিবে, বা সান্ত্বনা দিবে? এত কি কষ্ট দূর হবে? সমস্যা সমাধান হবে? হবে না। কিন্তু আল্লাহর কাছে সেজদায় লুটে কিংবা মোনাজাতে হাত তুলে কাঁদলে, আল্লাহ প্রতি ফোঁটা চোখের পানির মূল্য দুনিয়ায় ও আখিরাতে দিবেন। কষ্ট গুলো আল্লাহর কাছে ব্যক্ত করে সেজদা থেকে মাথা তুলে উপলব্ধি করা যায়, মনটা হালকা হয়ে গেছে। মনে শক্তি এসেছে। আল্লাহ সমস্যার সমাধান করে দেন। তড়িৎ কিংবা মঙ্গলময় দেরিতে। কিন্তু দিনশেষে এত চমৎকার সমাধান দেন যা কল্পনা ও করা যায় না।
মুশরাফা মনের সব গ্লানি চোখের পানিতে ঝরিয়ে নামাজ শেষ করল। সালাম ফিরিয়ে মোনাজাত ধরল। কারো বিরুদ্ধে নালিশ দিল না। শুধু দোয়া করল, সবাই যেন সঠিক বুঝ পায়। কোন ভাবে তার পর্দা যেন লঙ্ঘন না হয়। জাওয়াদের জন্য দোয়া করল। এই মানুষটা যেন দুনিয়ায় ওর পাশে খুটির মতো থাকে। ওকে সাপোর্ট করে, একসাথে যেন জান্নাত যেতে পারে। মোনাজাত শেষে মুখে হাত বুলিয়ে হাত রাখতেই ও উপলব্ধি করল, ওর মনটা হালকা হয়ে গেছে। কোন কষ্ট নাই। হেসে ফেলল। এটা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টির হাসি। এই হাসিটা সুন্দর, আল্লাহর কাছে প্রিয়।

জায়নামাজ গুটিয়ে উঠার পর রান্নার কথা মাথায় এলো। কাকন বাসায় নেই। মায়মুনার যা রাগ, আজ রুম থেকে বেরুবেন না। তাহলে রান্না হবে না? খাবারের সাথে কীসের রাগ? ও তো খাবে। অন্যের জন্য না হোক নিজের জন্য হলেও রাঁধতে হবে। জিহান, কাকন দুপুরের ফিরবে। তাদের খাবারের ও ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু জিশান আছে বাইরে। ওর সামনে তো এভাবে যাওয়া যাবে না। এদিকে রান্না ও করতে হবে। মুশরাফা ভাবনায় পড়ল, এমন কী করা যায় যাতে পর্দার ও লঙ্ঘন হবে না আর রান্না ও হবে। খানিক ভাবতেই একটা আইডিয়া এলো। স্মিত হেসে বোরকায় আবৃত করল নিজেকে। তারপর রুম থেকে বের হলো। জিশান নেই বসার ঘরে, সম্ভবত নিজের ঘরে। মুশরাফা হাফ ছাড়ল, বোরকা খুলল না। এভাবেই রান্না করল। রান্না করে ঢেকে রেখে গেল।

রুমে গিয়ে গোসল সেরে নামাজ পড়ল। মুশরাফা আবার বোরকা পরে বের হলো। কাকন জাহিন এসে গেছে। তাদের খাবার টেবিলে পেল। মুশরাফা শ্বাশুড়িকে ডাকলেন। তিনি বের হলেন, কড়া স্বরে জানালেন, খাবেন না তিনি। মুশরাফা কয়েকবার সেধে আবার টেবিলে ফিরল। কাকন ওকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’

ও বলল,’ যাচ্ছি না।’ আর কিছু না বলে, নিজের প্লেটে খাবার তুলে চলে গেল।

জাওয়াদ ফিরল সন্ধ্যায়। ক্লান্ত অবিশ্রান্ত শরীরটা টেনে বসার ঘরের সোফায় এলিয়ে দিতেই মায়মুনা এসে হাজির হলেন বসার ঘরে। যেন এরই অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। ছেলেকে দেখেই মুশরাফার বিরুদ্ধে অভিযোগের পসরা সাজিয়ে বসলেন। ইনিয়ে বিনিয়ে মুশরাফাকে খারাপ প্রমাণ করলেন। অপবাদ দিলেন, মুশরাফা উনাকে বলেছে, জিশান খারাপ তাই ওর সাথে দেখা করবে না ও। মুখের সামনে দরজা দিয়েছে। নিজে রেধে বেড়ে একা একা খেয়েছে, উনাকে একটু সাধে ও নি। এমন ও বললেন। নিজে না খেয়ে থাকার কথাও বললেন। বলতে গিয়ে কেঁদে ও দিলেন। এক পর্যায়ে বললেন,
‘ভালো ভালো বলে পছন্দ করে বিয়ে করে এনেছিস। এখন হলো তো! আমি এর থেকে ভালো মেয়ে আনতাম তোর জন্য। তোর দিকে চেয়ে রাজি হলাম, এখন অপমানের ভাগি হচ্ছি। এর জন্য বিয়ে করিয়েছি তোকে! আমার এতদিনের সংসারে আগুন লাগিয়েছে আসতে না আসতেই।’

নিজে পছন্দ করে এনেছে বলেই হয়তো জাওয়াদের রাগ হলো। মনে হলো ব্যাপারটা ওর দেখা উচিত। রাগটা মায়ের উপর নয়, কারণ মা নিজের দোষ ঢেকেই বলেছেন। মা নির্দোষ। দোষ যদি কারো হয়ে থাকে, তবে তা হলো মুশরাফার। মেয়েটা কেন এমন করল!

সারাদিন খাটাখাটুনিতে মেজাজ এমনিতেই চটে আছে। তারউপর মায়ের কান্নাকাটি এসব অভিযোগ যেন রাগ আরও বাড়িয়ে দিল। মুশরাফার প্রতি তিক্ততা তো ছিলই তা এবার ক্ষোভে পরিণত হলো।রাগ ক্ষোভ মিলে মিশে একাকার হয়ে জাওয়াদ চেহারার রং বদলে গেল। মাকে বুঝিয়ে উঠে দাঁড়াল। হন হন করে এগিয়ে গেল রুমের দিকে। রক্তলাল চোখ, এই চোখে মুশরাফার সর্বনাশ লেখা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here