একটুখানি_সুখ #আনিশা_সাবিহা পর্ব ১৭

0
533

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৭

কন্ঠস্বর এখনো কাঁপছে মোহের। এই বিয়ের প্রস্তাবটা স্বচ্ছের সামনে রাখা মোহের কাছে সহজ ছিল না। গত আধঘন্টা ধরে নিজেকে তৈরি করছিল সে। যখন নাফিসা বেগমের অসুস্থতার কথা শুনল তখন আর থামল না সে। স্বচ্ছ এখনো তার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে চোখের পলক অবধি ফেলতে ভুলে গেছে। মোহে দিকে তাকিয়ে আছে সে। তার ভাবনার ঊর্ধ্বে গিয়ে শেষমেশ মোহ বিয়ে করতে চাইছে তাকে? কেন? স্বচ্ছ বিস্ময়ের সাথে বলল,
“বিয়ে? হঠাৎ বিয়ের কথা তুলছো কেন? তোমার শরীর ঠিক আছে? আমার মনে হয় তুমি ঠিক নেই।”

বলেই মোহের কপালে আলতো করে হাত ছোঁয়ায় স্বচ্ছ। খানিকটা কেঁপে উঠে মোহ তার হাত দিয়ে স্বচ্ছের হাত সরিয়ে খানিকটা যান্ত্রিক কন্ঠে বলে,
“আমি ঠিক আছি। আর বিয়ের কথা ওঠাতে চমকে যাচ্ছেন কেন? আপনি আর মামিও প্রস্তাবটা দিয়েছিল আমাকে।”

“আমার মনে হয় তুমি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছো মোহ। তুমি ইমোশনাল হয়ে ডিসিশন নিচ্ছো। ছোট ফুপি ঠিক হয়ে যাক তারপর এই বিষয়ে কথা বলব আমরা ঠিক আছে?”

“আপনি কি আমায় বিয়ে করতে চান না? যদি তাই হয় তাহলে সোজাসুজি বলুন।”

আগের মতোই থমথমে সুরে বলে মোহ। তার দৃষ্টি ফ্লোরেই স্থির। অন্য কোনো দিকে মনই নেই তার। সে কেমন একটা ভাবলেশহীন হয়ে গিয়েছে। যেন একটা রোবটের মতো জবাব দিয়ে চলেছে। স্বচ্ছ যেটা খেয়াল করলে মোহের গালে আলতো চাপড় দিয়ে খানিকটা জোরে বলে,
“এই মেয়ে? হুঁশে এসো। তুমি ঠিক নেই। বিয়ের কথাবার্তা বাদ দাও এখনো অনেক সময় আছে এসবের। তুমি বসবে চলো এসো।”

মোহ তবুও এক পাও নড়েচড়ে না। বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে স্বচ্ছ। মেয়েটার কি হলো? অতিরিক্ত শক নিতে পারছে না সে। ফলস্বরূপ এমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। উপায়ন্তর না পেয়ে স্বচ্ছ নিজে মোহের হাত টেনে ধরে এনে তাকে বসিয়ে দেয় চেয়ারে। মোহ আবারও একই প্রলাপ বকে ওঠে,
“আপনি বললেন না তো! আপনি বিয়েতে রাজি কিনা?”

“হঠাৎ বিয়ে বিয়ে কেন শুরু করলে তুমি? বিয়ে পাগলি হয়ে যাচ্ছো নাকি স্বচ্ছ পাগলি? আই থিংক স্বচ্ছের ওপর ফিদা হয়ে গেছো। সেজন্যই আচমকা আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছো? ও মাই গড!”

স্বচ্ছের এমন কথায় কাজ হয়। মোহ এবার মাথা উঠিয়ে তাকায় স্বচ্ছের পানে। স্বচ্ছ চাইছিলই মেয়েটা একটু স্বাভাবিক হক। সেকারণে ইচ্ছে করেই এমন কথা বলে উঠল সে। ধীর কন্ঠে বলল,
“আপনাকে বিয়ে ছাড়া আর কোনো অপশন খোলা রেখেছেন আপনি? কোনো অপশন নেই আমার কাছে। এখন আমি সিউর যে মিমি শুধু আমার ভবিষ্যতের চিন্তা করতে করতেই এভাবে অসুস্থ হয়ে গেছেন।”

স্বচ্ছ চমকে ওঠার ভান করে বলে,
“অপশন খোলা রাখিনি মানে? অনেক অপশন খোলা আছে আমার কাছে। কি কি অপশন জানো? ফার্স্ট অপশন হচ্ছে ওইযে ওই ডাফার আদিল মাহমুদের সাথে বিয়ে করতে পারো। তার নাকি একটা বউ আছে? সতিনের সংসার করতে পারবে ভাবতে পারছো? আজকাল সতিনের সংসার কেউ করে? তুমি সতিনকে বোনের মতো করে মেনে নিয়ে পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দেবে সতিনও বোন হয়। সুন্দর আইডিয়া না?”

“খুব সুন্দর আইডিয়া। আপনি যদি আমার সাথে বিয়ে করেন বিশ্বাস করুন পরে এসব ঝামেলার পর আমি আরেকটা বিয়ে করব। তারপর আপনারা দুজন ছেলে সতিন হয়ে যাবেন। তারপর দুজন ভাইয়ের মতো বসবাস করে ওয়ার্ল্ড গিনিস বুকে স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম খোদাই করে নেবেন। সুন্দর না আইডিয়াটা?”

স্বচ্ছকে ভেঙিয়ে বলল মোহ। এবার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে তীক্ষ্ণতা। স্বাভাবিক অবস্থাতে ফিরে আসছে সে। মিটিমিটি হাসতে থাকে স্বচ্ছ। তারপর কিছুটা গম্ভীর মুখভঙ্গি করে বলে,
“আইডিয়াটা ভালো। কিন্তু আমি আবার নিজের বউকে কারো সাথে শেয়ার টেয়ার করতে পারব না। ইউ নো? আমার সম্পদ শুধুই আমার। ইভেন আমার বউয়ের একেকটা ঘামের ফোঁটাও আমার। তার মন থেকে শুরু করে তার চোখ, নাক, গাল, ঠোঁট আর… থাক আর গভীরে না যাই! সবই আমার। যদি কোনো সতিন বানিয়ে নিয়ে আসতে চাও তাকে এসব বলে নিয়ে আসবে। তাহলেই চলবে। ঠিক আছে?”

হতবাক হয়ে এবার তাকায় মোহ। স্বচ্ছ এতোকিছু ভেবে রেখেছে? কি ভয়ানক প্ল্যানিং তার। খানিকটা শুঁকনো ঢক গিলে চোখ ফিরিয়ে কেবিনের দিকে তাকায়। ডক্টরের চেকআপ করা কি এখনো শেষ হয়নি? মোহ ও স্বচ্ছের বিপরীত পাশে বসে আছে তৃণা। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদছে সে। মোহ উঠে দাঁড়ায়। গিয়ে বসে তৃণার পাশে। মোহকে পাশে দেখে কান্নার বেগ বেড়ে গেল তার। ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
“আমার মা ঠিক হয়ে যাবে তো মোহ আপু?”

“মিমির কিছু হয়নি। তুমি চিন্তা করো না। আর যা হয়েছে সেটা আমার জন্যই তো ঘটেছে। আমি তো তোমার আর তিহান ভাইয়ার(তৃণার ভাই) সামনে মুখ দেখাতেও লজ্জা লাগছে। আজ আমার চিন্তা করতে করতে মিমি অসুস্থ হয়ে গেল।”

কিছু বলতে পারল না তৃণা তার আগেই কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো ডক্টর। উনাকে দেখামাত্র সকলে এগিয়ে এলো অস্থির হয়ে। কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই ডক্টর নিজ দায়িত্বে বলে উঠলেন,
“চিন্তা করার কিছু নেই। কিন্তু হ্যাঁ পেশেন্ট মিনি স্টোক করেছে। উনি ঘুমের মাঝেই ঘোরে চলে গেছেন কিছু টের পাননি। হাই ব্লাড প্রেশার থাকার কারণে এমনটা ঘটেছেন। হয়ত কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত ছিলেন উনি। যার কারণে ব্লাড প্রেশার বেড়েছিল। পরের বার খেয়াল রাখবেন উনার যেন টেনশন না হয়। তাহলে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আপনারা এখন দেখা করতে পারেন উনার সাথে।”

হাফ ছেড়ে বাঁচল সকলে। কিন্তু মোহের মাঝে কাজ করতে থাকল অনুতাপ। তার মিমির এই অবস্থা শুধুমাত্র তার জন্য এটাই ভেবে অনুতাপের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে সে। আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে সবার আগে কেবিনে ঢুকে গেল সে।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে রয়েছেন মিসেস. নিরা। মুখটা ফ্যাকাশে। ঝড়ের গতিতে মোহ গিয়ে বসে মিসেস. নিরার পাশে। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকান উনি। মোহ ফুঁপিয়ে কেঁদে দিয়ে বলে,
“আই এম সরি মিমি।”

“ধুর পাগলি সরি বলছিস কেন? তুই কেন সরি বলবি? তোর বয়সটাই এমন যে সঠিক মানুষকে বাছতে পারিস নি। আমি তো তোকে বলেছিলাম যে যদি মনে হয় আয়মান তোকে বিশ্বাস করে তাহলে হ্যাঁ করবি। বিশ্বাসঘাতক বের হলো তো সে? আমি তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত। কি হবে তোর বলতে পারিস?”

দুর্বল কন্ঠে বলেন মিসেস. নিরা। মোহ সঙ্গে সঙ্গে নিজের কান্না গতি কমাতে থাকে। স্বচ্ছ আর তৃণা ধীর পায়ে প্রবেশ করে কেবিনে। তৃণা ছুটে এসে তার মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নাকাটি করতে থাকে।
“মা। ও মা? এভাবে কেউ করে? আর একটু হলে আমার জীবনটা বেরিয়ে যাচ্ছিল।”

“তুই আরেক পাগলি। আমার দুইটা পাগলি। দুজনেই একেবারে মাত্র ১ ঘন্টায় শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিস। কিছু খেয়েছিস?”

দুজনেই মাথা নাড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে কেবিনে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে একটা ছেলে। উজ্জ্বল শ্যামলা চোখেমুখে অস্থিরতার ছাপ একেবারে ফুটে উঠেছে। ব্রাউন কালার টিশার্ট পরিহিত ছেলেটি মিসেস. নিরাকে দেখে চিকন ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল হাসি। তৃণার উদ্দেশ্যে তৎক্ষনাৎ খিটখিটে হয়ে বলল,
“এই তৃণমূলের বাচ্চা সর সামনে থেকে। একাই আদর খাস না পেট ব্যথা করবে।”

বলে এগিয়ে এসেই তৃণাকে সরিয়ে দিয়ে বসে পড়ে তিহান। মোলায়েম কন্ঠে বলে,
“এখন কেমন আছো মা?”

“ভালো। তোরা এতদূর থেকে এসেছিস কিছু খেয়ে এসেছিস?”

তিহানও মাথা নাড়িয়ে বলে,
“জীবনে খাওয়াদাওয়া অনেক করতে পারব। তোমায় হারালে তো ফিরে পাব না তাই না?”
মিসেস. নিরা হাসেন। সকলের সাথে কথাবার্তা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

কেবিন থেকে বেরিয়েছে সকলেই। স্বচ্ছ আর মোহ পাশাপাশি হাঁটছে। স্বচ্ছের বাম পাশে হেঁটে চলেছে তৃণা। মেয়েটা জোরে জোরে স্বচ্ছের সাথে হাঁটার চেষ্টা করেও কূল পাচ্ছে না। তৃণা সবে ক্লাস টেনে পড়ে। সেই হিসেবে স্বচ্ছের থেকে বেশ ছোট সে। তাই পাশাপাশি চলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে মুখ ফুলিয়ে পিছু পিছু হাঁটছে সে। তিহান সামনে হাঁটছে। খানিকটা জোরে বলে,
“হসপিটালের সাথে একটা ক্যান্টিন আছে সেখানে খাবি সবাই?”

“ওখানে কি চিকেন বার্গার আর অ্যাপেল জুস আছে?”
শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে ওঠে স্বচ্ছ। মোহ কিছুটা চমকে ওঠে। পাশাপাশি হেঁটে চলা কালো শার্ট আর কালো ব্লেজার পরিহিত লম্বাটে লোকটার দিকে তাকায়। তাকানোর কারণ হচ্ছে খাবারের নামগুলো। প্রতিদিন সকালে চিকেন বার্গারের সাথে অ্যাপেল জুস পেলে খুশিতে নেচে ওঠে সে। এটা তার ব্রেকফাস্ট হিসেবে প্রিয় খাবার। মোহ এবার আগ্রহ দমাতে না পেরে বলে ওঠে,
“এসব খাবার দিয়ে কি করবেন?”

“কেন খাবার কি করে মোহ? অবশ্যই খাব।”

“আপনি খাবেন?”

“তো তোমায় খাওয়াব ভেবেছো?”
নাক ফুলিয়ে বসে হাঁটতে থাকে মোহ। তার প্রশ্ন করাই ভুল হয়েছে। সে থেমে মিনমিনে কন্ঠে বলে,
“শুনুন আমি খেতে যাব না এখন। আমাকে আপনার বাড়ি নিয়ে যাবেন প্লিজ?”

স্বচ্ছ পিছু ফিরে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কেন?”

“নানিমা অসুস্থ। আমি সেটা শুনেছি। নিশ্চয় মিমির খবরটা শুনেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমায় নিয়ে চলুন।”

“বাবাহ! সবার মনের খবর জানো দেখছি। জ্যেতিষিবিদ্যা শিখেছো?”

দুষ্টু হেঁসে জিজ্ঞেস করে স্বচ্ছ। মোহ কড়া গলায় বলে ওঠে,
“এরজন্য জ্যেতিষিবিদ্যা শিখতে হয় না। মনের কথা চাইলেই বোঝা যায়।”

“হু শুধু একজনেরটাই বুঝতে পারো না।”
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বিড়বিড়িয়ে বলে স্বচ্ছ। মোহ ভ্রু কুঁচকাতেই স্বচ্ছ বলে,
“আমি খাবার নিয়ে আসছি তুমি বসো গাড়িতে। আমার খিদে পেয়েছে।”

“আমিও যাব তোমাদের সাথে।”
লাফিয়ে বলে ওঠে তৃণা। মোহ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
“উঁহু, মিমির কাছে তোদের থাকতে হবে।”
মুখ কালো করে ফেলে তৃণা। তবুও কিছু বলে না মোহ। তৃণার গালে হাত বুলিয়ে গাড়িতে উঠে বসে সে।

নাফিসা বেগমের সামনে বসে আছে মোহ। মাথা নুইয়ে বসে আছে সে। নাফিসা বেগম গমগমে গলায় বলেন,
“তুই সত্যি স্বচ্ছকে বিয়ে করতে চাস?”

“জি নানিমা।”
নিচু করে উত্তর দেয় মোহ। নাফিসা বেগম অকপট ভাবে বলেন,
“তাহলে শোন আমার আর নিরার জন্যই বিয়ে করতে চাইলেই হবে না। স্বচ্ছও আমার নাতি। আমিও চাইব ও এমন কোনো বউ পেয়ে যাক যে তাকে ভালোবাসবে। তুই যদি সত্যি ওকে বিয়ে করতে চাস ওকে ভালোবাসতেও হবে। ওকে পূর্ণ স্বামীর অধিকারটা দিতে হবে। কারণ আমি যতই আগের যুগের মেয়ে হই না কেন! স্বামীর সেবা করতে হয় ভালোবাসা দিয়ে। ওকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতে পারবি?”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here