একটুখানি_সুখ #আনিশা_সাবিহা পর্ব ১৮

0
556

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ১৮

“স্বামীকে কখনো দূরে ঠেলে দিতে নেই। আজকাল তোরা আধুনিক যুগে ভাবিস স্বামীকে ভালো না লাগলে তাকে মেনে নিবি না। তাকে ডিঙিয়ে চলবি। কিন্তু এটা কিন্তু ঠিক নয়। স্বামী কাছে ডাকলে তাকে টেনে নিতে হয়। তাই তাকেই নিজের জীবনসঙ্গী বানা যে তোকে অসম্মান করবে না আর তুই তাকে অসম্মান করবি না। তুই আমার নাতনি আর স্বচ্ছ আমার নাতি। দুজনেরই ব্যাপারেই আমাকে ভাবতে হচ্ছে। কারোর ভাবনা আমি ছাড়তে পারব না। দুজনকেই আমি ভালোবাসি।”

স্থির নয়নে নাফিসা বেগমের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে মোহ। মাথায় আসছে না কিছুই। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। চোখ বন্ধ করে আবার মেলে তাকায় সে। যেই মানুষটাকে সে সহ্য করতে সক্ষম হয় না যার সঙ্গে কোনো কথার মিল হয় তাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নেও একটা অসাধ্য ব্যাপার স্যাপার। একটা নিঃশ্বাস টানতেই নাফিসা বেগম জিজ্ঞেস করল,
“দোটানায় পড়ে গিয়েছিস? বিয়ে জিনিসটাকে একটা দায়িত্ব মনে করলে হয় না। একটা অংকের মতো হিসাব নিকাশ করে বিয়ে করতে চাইছিলি স্বচ্ছকে?”

মোহ উত্তর দেয় না। কারণ তার নানিমার কথা কোথাও না কোথাও গিয়ে মিলেছে। সে আসলেই অংকের মতো বিচার করে বিয়ে করতে চাইছিল। স্বচ্ছের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক এসব দিকে মাথা ঘামায়নি সে। এখন? এখন কি করা উচিত তার? একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে শান্ত সুরে মোহ বলে ওঠে,
“আই নিড টাইম। আমায় ভাবতে হবে নানিমা। আমি আরো একবার ভাবার সুযোগ চাই। তুমি কেন অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলে? আমি কিন্তু খবর পেয়েছি। কি হয়েছিল তোমার? এখন তো মোটামুটি ঠিক আছো।”

“তেমন কিছু না। তুই নিরাকে রেখে এখানে এসেছিস কেন? আমি তো ঠিকই আছি।”

“আমি স্বচ্ছ ভাইয়ের থেকে শুনেছি। মাথা ঘুরছিল তোমার। মোটামুটি জ্ঞান হারিয়ে শুয়ে ছিলে। কি হয়েছে বলবে না? নয়ত রাগ করে চলে যাব।”

বিষয়টা লুকিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারে না নাফিসা বেগম। মেয়েটা মায়ের মতোই জেদি। যা জানতে চাইবে সেটা তাকে যেকোনোভাবে জানতে হবে। উনি মিনমিন করে জবাব দেন,
“আমাকে প্রতি সপ্তাহে যেই ইনজেকশন দেওয়া হয় সেটা দেওয়া হয়নি এই সপ্তাহে। তুই জানিস ওর মাধ্যমে আমার রক্ত তৈরির ক্ষমতা একটু হলেও বাড়ে। সেটা দেওয়া হয়নি এই সপ্তাহে তাই…!”

মেজাজটা বিগড়ে গেল মোহের। এই বাড়িতে সবাই এতোটাই দায়িত্বহীন? একটা অসুস্থ মানুষের খেয়াল রাখার জন্য কেউ নেই? ভাবতেই রাগটা তড়তড় করে বাড়তে লাগল তার। কিছু বলতে উদ্যত হতেই নাফিসা বেগম তার কথাতে বাগড়া দিয়ে বলে উঠল,
“একটু আগে ইনজেকশন দিয়েছে আমায়। স্বচ্ছ রাগারাগি করছে বিষয়টা নিয়ে। একমাত্র ওর জন্যই বাড়িতে যতটুকু আমার খেয়াল রাখা হয়।”

“বাবাহ! এতোটা ভালোমানুষ কবে থেকে হলেন উনি?”
আনমনে প্রশ্ন করে বসে মোহ। স্বচ্ছের কিছুটা প্রশংসা করায় মুখটা অলরেডি ফুলিয়ে বসে আছে মোহ। কিছুটা হিংসে করছে তার। তা বুঝে নাফিসা বেগম হেঁসে দুর্বল কন্ঠে বলেন,
“তোর কাছে ওকে কেমন লাগে জানি না। উগ্র, অগোছালো স্বভাবের ছেলে হলেও কিন্তু ও এমনভাবে মানুষকে যত্ন করতে ভালোবাসে যাতে সেই মানুষটা বুঝতেই না পারে সে ওই মানুষটাকে নিয়ে চিন্তা করে। স্বচ্ছকে কিন্তু আমি কোলেপিঠে মানুষ করেছি। তোর মামিকে তো জানিস। ছেলে নিয়ে তেমন কোনো হেলদোল ছিল না তার। সারাদিন দশ-বারোটা সার্ভেন্ট রাখলেই কি হয়? মাকে তো সন্তান সবসময় কাছে চায়। সেজন্য আমি ওর কাছে থাকতাম। ওর প্রতিটা আচরণ আমার জানা।”

মোহ এবার কিছুটা ভাবুক হয়ে পড়ে। কেন দেখিয়ে কারো জন্য ভাবলে কি জাত চলে যাবে নাকি? ভাবতেই নাফিসা বেগম কিছুটা নরম কন্ঠে বলেন,
“সকাল থেকে তো দৌড়ের ওপর আছিস। খাওয়াদাওয়া হয়েছে কিছু?”

“হয়েছে নানিমা। তোমার নাতি গাড়িতে খাবার দিয়ে ধমকিয়ে ধমকিয়ে কথা শুনিয়ে শুনিয়ে খাইয়ে নিয়েছে আমায়।”

“মানে?”
হতবাক হয়ে বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চান নাফিসা বেগম। মোহ মুখটা বাংলায় পাঁচের মতো করে বলে,
“প্রথমে বলেছিলেন উনি নিজে খাওয়ার জন্য কিনতে যাচ্ছেন। সে ভালো কথা। কিন্তু গাড়িতে উঠে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল ধরে থাকো। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। গাড়িতে এতো জায়গা থাকতে খাবার আমায় ধরে থাকতে হবে কেন বলো তো নানিমা? তাই আমি খাবারটা নিয়ে সামনের খালি জায়গায় রেখে দিতেই গাড়িটা এমন ব্রেক কষলেন যে সিট বেল্ট না থাকলে নির্ঘাত মাথাটা ফেটেই যেতো। আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা রাখতে বলেছি তোমায়? রাখলে কেন? শাস্তি সরূপ এটা তোমায়ই খেতে হবে খাও।’ আমি খাব না উনি ছাড়বেন না। এই বলে খাইয়ে ছেড়েছেন আমায়।”

নাফিসা বেগম হেঁসে ওঠেন এবার। কিছুটা লাজুক ভাব নিয়ে তাকায় মোহ। তার নানিমা হাসছে দেখে তার মুখেও হাসি ফোটে। মানুষটা কতদিন পর হাসছে। যাক স্বচ্ছের এই কান্ড বলাতে কিছুতো লাভ হলো! যেকোনো মানুষের হাসিতে এক অদ্ভুত সৌন্দর্য লুকায়িত থাকে। হাসিটা যদি প্রাণখোলা হয় তাহলে হাসিটা তড়তড় করে সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। নাফিসা বেগম হাসি থামিয়ে বলেন,
“দেখেছিস? কিভাবে যত্ন নিল আর তুই বুঝলিও না? এটাই হচ্ছে আহিয়ান স্বচ্ছ।”

চোখ বড় বড় করে তাকায় মোহ। আসলে বিষয়টা তার ভাবনাতেই আসেনি। নাফিসা বেগম আবারও বলেন,
“ওকে জিজ্ঞাসা করেছিস ও খেয়েছে কিনা?”

“খেয়েছেন হয়ত।”
নিচু সুরে বলে মোহ। নাফিসা বেগম মাথা নাড়ান। ক্ষীণ গলায় বলেন,
“না। ও খায় নি এখনো। সকাল ৭ টাই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। আর এতো সকালে সে খায় না। সকালে বাড়িতে না খাওয়াদাওয়া করলে কোথাও খায় না সে। তোর কি উচিত নয় ওকে এখন গিয়ে জিজ্ঞাসা করা যে ও খেয়েছে কিনা? বা কৃতজ্ঞতা সরূপ খাবারও তো নিয়ে যেতে পারিস।”

কথাটা ভুল বলেনি নানিমা। এটাই ভাবতে থাকে মোহ। তাছাড়া স্বচ্ছকে ফেক নিউজ ডিলেট করার জন্য আর ওই আদিলের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এমনিতেও কিছু করা উচিত ওর। মোহ কিছুটা ইতস্তত বোধ করে বলে,
“বলছো? আমি যাব উনার ঘরে?”

“যা। এতে এতো জিজ্ঞেস করার কি আছে? ইচ্ছে থাকলে চলে যা।”
মোহ উঠে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।

ড্রেসিংটেবিলের সামনে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে বারবার পিঠের আঘাত করা জায়গায় এন্টিসেপ্টিক লাগানোর চেষ্টায় মগ্ন স্বচ্ছ। চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ তার। বিরক্তির কারণ হলো সে পারছে না পিঠে ঠিকঠাক লাগাতে। না পেরে এন্টিসেপ্টিকটা চেপে ধরে একপাশে ফেলে দিয়ে রাগে কটমট করে বলল,
“ডিজগাস্টিং! দরকারই নাই এসবের।”

স্বচ্ছের ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। আরো মেজাজটা খারাপ হলো তার। চোখমুখ খিঁচে রাগে বলল,
“হোয়াট দ্যা হেল ম্যান? নিজের বাড়িতে নিজের কোনো প্রাইভেসি নেই? আসতে হবে…”

কথাটুকু সম্পূর্ণ না হতেই দরজা ঠেলে ঢুকে আসে মোহ। সরু চোখে স্বচ্ছের দিকে তাকায় সে। আবারও খালি গায়ে স্বচ্ছকে দেখে কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে চোখ বন্ধ করতেই স্বচ্ছ বলে ওঠে,
“তোমার ব্যাপার কি বলো তো? আমি যখনই খালি গায়ে থাকি তখনই দেখি তুমি কোনো না কোনো বাহানা দিয়ে ঠিক ঘরে ঢুকে আসো? তোমার মতলব কি? আমার মতো সরল সোজা ছেলের ইজ্জত কাঁড়তে চাইছো?”

“চুপ করুন তো। আমি তো নিজেই ভেবে পাই না যে কি করে আপনার ঘরে এমন সময়ই এসে পড়ি। ঘাট হয়েছে আমার। আপনার জন্য খাবার রেখে যাচ্ছি আপনি খেয়ে নেবেন।”

পাশের শোকেসের ওপরে খাবারের ট্রে রেখে দরজার দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় মোহ।
“বাবাহ! বিয়ের আগেই দেখি বউ বউ কাজকর্ম করছো। নট ব্যাড। এমন বউই তো লাগবে। একটু ছোট ছোট টাইপের পুতুল। যাকে যখন তখন রাগিয়ে দেওয়া যাবে। জানো তো? ছোটদের রাগ বেশি হয়। এদের বেশি করে ভালোবাসতে মন চায়। রাগ দেখলেই ভালোবাসতে মন চাইবে। এখনই দেখছি তুমি আমার সব গার্লফ্রেন্ডদের থেকে ব্রেকআপ করিয়ে ছাড়বে।”

চোখ রাঙিয়ে পিছু ফিরে মোহ। কিছু বলার জন্য দাঁত কিড়মিড় করতে থাকে তার কিন্তু বলতে পারে না। সে কোনো শব্দই খুঁজে পাচ্ছে না। দম ফেলে বলে,
“আপনি থাকুন আপনার গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আমি যাচ্ছি। নানিমা বলল আপনি খাননি অথচ আমি খেয়ে নিয়েছি সেটা ভেবেই খাবার এনেছি।”

“শোনো, আমার পিঠে একটু এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিতে হেল্প করবে?”
কিছুটা কাতর কন্ঠ শুনে আবারও পিছু ফিরে তাকায় মোহ।
“কি হয়েছে পিঠে?”

“উমম… তেমন কিছু না সামান্য এক্সিডেন্ট।”

তবুও সত্যি কথা না বলায় হতাশ হয় মোহ। কিন্তু স্বচ্ছের কথা প্রত্যাখান করতে পারে না সে। এগিয়ে যায় তার দিকে আর ভার কন্ঠে বলে,
“অন্য কাউকেও তো বলতে পারেন। আসার আগে শুনতে পেলাম ডিজগাস্টিং বলছিলেন। অন্যকারো থেকে হেল্প নিলে তো এমন হয় না। বাড়িতে তো অনেকেই কাজ করে দেখি।”

“অভিয়েসলি নট। আমি যাকে তাকে নিজের শরীরে হাত লাগাতে দেব নাকি?”

“তাহলে আমাকে দিচ্ছেন যে?”

“কারণ, কারণ, কারণ তুমি বউ বউ অধিকার ফলাচ্ছো তাই।”

বাঁকা চোখে তাকায় মোহ। ফ্লোরে এন্টিসেপ্টিক পেয়ে সেটা তুলে নেয় সে। ড্রেসিংটেবিলে থাকা তুলো দিয়ে এন্টিসেপ্টিক মাখিয়ে সেটা আলতো করে চেপে ধরে স্বচ্ছে ক্ষততে। হালকা কেঁপে ওঠে স্বচ্ছ। চোখ খিঁচে ফেলে সে। গলার রগ ফুটে ওঠে। নয়ত ব্যথা করছে তার। মোহ তুলো সরিয়ে নিয়ে বলে,
“ব্যথা করছে?”

“তা করছে। কিন্তু বড় বড় আঘাত সাড়াতো ছোট ছোট আঘাত তো পেতে হয়।”

“কি করেছেন পিঠের অবস্থা। সর্বত্র আঘাতের চিহ্ন। মনে হচ্ছে মারামারি করে এসেছেন।”

স্বচ্ছ হাসে। তবুও উত্তর দেয় না। একটু একটু করে মোহ পুরো পিঠে এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিয়ে বলে,
“হয়ে গেছে।”

মোহ সরে আসে। কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে বলে,
“শুনুন, এসব করছি বলে ভাববেন না আপনার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি আছে। আমি শুধু কৃতজ্ঞতার জন্য করছি। আর…”

“আর?”

“আর খাবার দিয়েছি ওখানে একটা কাগজে কিছু লিখা আছে সেটা যেন ফেলে দেবেন না। খুলে দেখবেন।”
স্বচ্ছ তাকায় খাবারের ট্রে এর দিকে। মোহ তড়িৎ গতিতে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। মোহের বেরিয়ে যাওয়া দেখে খাবারের ট্রে এর দিকে যায় স্বচ্ছ। একটা সাদা কাগজে একটা ভাঁজ দেওয়া। বেশ কৌতুহলী হয়ে কাগজ হাতে নিয়ে সুন্দর করে খুলে দেখে সে। বেশ ছোট ছোট করে লিখা কিছু কথা।

“যতটা নিমপাতা আপনাকে ভেবেছিলাম ততটাও আপনি নন। কিছুটা মধুরও ছিটেফোঁটা আছে। আর ধন্যবাদ আমার জীবন বাঁচানোর জন্য একটা বিবাহিত লোকের সাথে আমার বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার জন্য। আপনার জন্য একটা মানুষও চিনতে শিখেছি। তার জন্যও ধন্যবাদ।
আপনার কাছে কি #একটুখানি_সুখ হবে? বেশি কিছু না একটু সুখ চাই আমার। তবেই আপনার হৃদয় নিকটে উপস্থিত হবো আমি। আপনার স্ত্রী আর ভালো বন্ধুর রূপে।”

স্বচ্ছের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফোটে। মনে বইছে অনুভূতির জোয়ার।
“তোমায় #একটুখানি_সুখ নয়। তোমায় সুখের রাজ্যের রানী বানাতে চাই মোহময়ী রানি। সুখে সিংহাসনে তোমায় দেখতে চাই হাসিমুখে।”

চলবে…

[বি.দ্র. গল্প দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। দিন দিন উৎসাহ হারাচ্ছি। আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্য না পেয়ে লিখতে ইচ্ছে করে না আর। পর্বটা অগোছালো লাগতে পারে। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

লেখিকার গল্পের গ্রুপ : আনিশার গল্পআলয় (সাবির পাঠকমহল)🤍

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here