#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৭
বিছানার চাদর খামছে ধরে এদিকওদিক তাকাচ্ছে মোহ। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। কপাল বেয়ে যেন টুপ করে ঘাম বেয়ে গাল দিয়ে থুঁতনিতে এসে পৌঁছাবে। ঘরে সামান্য একটা সফট সাদা রঙের আলো। যেটা দিয়ে হালকা করে আশেপাশে দেখা যাচ্ছে। ঢক গিলে বড় নিশ্বাস নিলেই যেন স্বচ্ছ ঘরে ঢুকে পড়বে। ঘরটা স্বচ্ছের। স্বচ্ছের বললে ভুল হবে। আজ থেকে তো ঘরটা এক দম্পত্তির। এতে মোহেরও অধিকার আছে। কিন্তু আজকে বাসর রাত কথাটা ভাবলেই লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে মোহ। স্বচ্ছের ঘরে এই প্রথম প্রবেশ করেনি সে। তাহলে আজ কেন এমন লাগছে বুঝছে না মোহ। এসির রিমোট হাতিয়ে খুঁজছে সে। গরম লাগছে তার। অথচ আবহাওয়া দিব্যি ঠান্ডা! সে নিজেই নিজেকে শান্তনা দিয়ে বলে উঠল,
“মোহ, মোহ, মোহ! রিল্যাক্স। মি. আহিয়ান স্বচ্ছ তোকে খেয়ে তো আর ফেলবে না। এতো ঘামাঘামির দরকার নেই।”
বলেই বড় বড় শ্বাস নিয়ে এসির রিমোটটা হাতাতে লাগল সে। ফুলে ভরা ঘর। আসার রাস্তা থেকে শুরু করে টেবিলেও ফুল। বেড ওপরটা নেটের কাপড় দিয়ে সাজিয়ে রাখা। টেবিলে রাখা এসির রিমোট। মোহ এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে এসির রিমোট হাতে নিতেই দরজা খোলার শব্দে হকচকিয়ে উঠে পিছু ফিরে তাকাতেই হাত থেকে পড়ে গেল রিমোট। শুকনো ঢক গিলে নিচে তাকালো সে। নাক থেকে ইতিমধ্যে নোলক খুলে পড়ে গেছে। কানে আঁটকে আছে শুধু। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে প্রশস্ত অবয়বের দিকে তাকালো সে। বুঝতে এক মূহুর্তও লাগল না মানুষটা স্বচ্ছ। দরজা আঁটকে দিতেই মোহের মাঝে শিহরণ বয়ে গেল। থরথর করে কাঁপতে শুরু করে মোহ। স্বাভাবিক হতে চেয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে নাকের নোলকটা হাতে তুলে নেয় সে। নাকে লাগাতে গিয়ে আবারও পড়ে গেল হাত থেকে।
স্বচ্ছ দূর থেকে মোহের কান্ড দেখছে তার বিস্ময়ের চোখে তাকাচ্ছে। এমন করছে কেন মেয়েটা?
“কি হয়েছে? মৃগী রোগীর মতো কাঁপছো কেন?”
“আ…আপনি…”
পুরোটা শেষ করতে পারল না মোহ। স্বচ্ছ বেশ খানিকটা এগিয়ে এসেছে। তা দেখে পিছিয়ে যেতেই টেবিলের সাথে ধাক্কা লেগে উল্টে পড়ে যেতে লাগল সে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিতেই স্বচ্ছও মোহের হাত ধরে বলল,
“আস্তে! এমন করছো কেন? আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক?”
“একচুয়ালি, নার্ভাস লাগছে। প্রথমবার বিয়ের পর ফার্স্ট নাইট তো তাই।”
হাতের পিঠ দিয়ে নিজের কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল মোহ। স্বচ্ছ ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেলল। ক্ষীণ সুরে বলল,
“ওয়ান মিনিট! প্রথম বিয়ের পর ফার্স্ট নাইট মানে কি? আরো বিয়ে করার প্ল্যানিং নিয়ে বসে আছো নাকি?”
চোখ বড় বড় করে তাকায় মোহ। কি বলতে কি বলে ফেলেছে ভেবে জিহ্বা কেটে স্বচ্ছের দিকে দৃষ্টিপাত করে সে। স্বচ্ছ কি যেন মনে করে বাঁকা হেঁসে ওঠে।
“আবার বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে নো প্রবলেম। আমি এখনি রেডি। কিন্তু অন্য কাউকে বিয়ে করার ইচ্ছে মাথায় এনো না আবার। কারণ এই সুন্দরী সম্পূর্ণ ভাবে আমার হয়ে গেছে। তাকে না আমি অন্যকারো হতে দেব না অন্যকেউ তার হবে। সো…”
“সো?”
“সি ইজ মাইন!”
কর্ণকুহুরে স্বচ্ছের বলা কথাটি বাজতেই মৃদু কেঁপে উঠল মোহ। চোখ নামিয়ে ফেলল সে। এই মূহুর্তে স্বচ্ছের চোখের দিকে তাকালে যে তাকে হারিয়ে যেতে হবে। পথ হারিয়ে স্বচ্ছ নামক ব্যক্তিটির ভালোবাসার সাগরে এতো দ্রুত ডুবতে চায় না সে। নিজের কোমড়ে ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে চোখ পাকিয়ে তাকায় মোহ। স্বচ্ছ একহাতে জড়িয়ে নিয়েছে মোহের কোমড়। স্বচ্ছ মৃদু হেঁসে বলে,
“ভয় পাও?”
“ভ…ভয়? কিসে ভয়?”
“ভালোবাসতে! এই স্বচ্ছ নামক অস্বচ্ছ ব্যক্তির মাঝে হারিয়ে যাবার ভয় পাও?”
“ন…না মানে বলছিলাম য…যে… ”
তুতলিয়ে চলেছে মোহ। স্বচ্ছ মোহের এমন কান্ডে হাসছে নিঃশব্দে। এক পর্যায়ে মোহের কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে দেয় স্বচ্ছ। চোখ বুঁজে বলে,
“আজ থেকে আমার সুখপাখি তোমার। আর তোমার দুঃখপাখি হবে আমার। তোমার সুখেতে বেশি সুখি হবো আমি। তোমার হাসিতেই হাসব আমি। তোমার দুঃখেই কাঁদব আমি। তোমাকে তোমার মাঝ থেকে চুরি করে ফেলব। তুমি বুঝতেও পারবে না। আই প্রমিস!”
স্বচ্ছের একেকটা উত্তপ্ত ও ঘন নিঃশ্বাস মোহের মাঝে ফুটিয়ে তুলছে অস্থিরতা। অদ্ভুত অস্থিরতার মাঝে সুখময় মূহুর্ত। বেশিক্ষণ থাকলে হয়ত এই অস্থিরতায় ভরা সুখে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। কাঁপা কাঁপা হাতে স্বচ্ছকে আলতো ধাক্কা দেয় সে।
“এইযে ভয় পাচ্ছো। ভীতু মেয়ে।”
বলেই একটু জোরে হেঁসে সরে যায় স্বচ্ছ। বড় নিঃশ্বাস ফেলে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে মোহ। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই কেটে যায় তাদের। মোহ কথা খুঁজে না পেয়ে হুট করে বলে ওঠে,
“ঘুমোবেন না?”
“ঘুমাবো তো। বাট আমি আমার কোলবালিশ তো তুলে রেখেছি। ইউ নো? আমি ভেবেছিলাম বাসায় এক তুলতুলে কোলবালিশ আসবে! বাট আই ওয়াজ রং। তুলতুলে কোলবালিশের বদলে একটা মশা ঘরে নিয়ে এলাম। নো প্রবলেম এটাতেই কাজ চালিয়ে নিতে পারব।”
কথাটা বলে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল স্বচ্ছ। একটা বড় হাই তুলে অগোছালো হয়ে শুয়েও পড়ল সে বেডের মাঝখানে। মোহ শুধু কান্ডকারখানা দেখছে। এটা কোন পাগলের পাল্লায় পড়ল সে? মশা ঘরে এনেছে? ভাবতেই স্বচ্ছের দিকে চোখ রাঙালো সে। স্বচ্ছ অলরেডি চোখ বুঁজে ফেলেছে।
“আমি কোথায় ঘুমাবো এতো বড় বেড একাই জুড়ে ঘুমোলে অদ্ভুত তো!”
“আমি নিজেই আজ থেকে তোমার বেড। শুয়ে পড়তে পারো। মাইন্ড করব না।”
বলে একটা চোখ খুলে দুষ্টু হাসি দিল স্বচ্ছ। মোহের ইচ্ছে করল তার মুখটাই সেলাই করে দিতে। এতো আজেবাজে কথাবার্তা লোকটা পায় কোত্থেকে? একটু পরই সরে যায় স্বচ্ছ। এক সাইডে শুয়ে পড়ে সে।
“এবার ঠিক আছে? আই মিন কমফোর্টেবল হবে তো?”
মোহ মাথা নাড়ায়। স্বচ্ছ পাশ ফিরে চোখ বুঁজে নেয়। সে আজ বড়ই ক্লান্ত। তার ঘুম প্রয়োজন। কত রাত যে নির্ঘুম কাটিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। শুধুমাত্র মস্তিষ্ক ভরা ছিল একটাই প্রশ্ন, ‘এই মেয়েটা ঠিক আছে তো? ভাই কিছু করে বসল না তো? নিজের করে পাবে তো তাকে?’
অবশেষে নিজের চোখের পাতা শান্তিমতো এক করতে পেরেছে স্বচ্ছ।
রাত তখন প্রায় ১ টা ছুঁইছুঁই। ঝনঝনানি শব্দে ঘুমটা হালকা হয়ে আসে স্বচ্ছের। হালকা নড়েচড়ে পাশ ফিরে হাত দিতেই কারো হাতের ওপর হাত পড়ে। কিছুটা চমকে ঘুম থেকে জাগে স্বচ্ছে। বিস্ময় ভরা চোখজোড়া নিয়ে তাকায় সে। মোহ এখনো জেগে। ইতস্ততবোধ করে হাতটা সরিয়ে নেয় মোহ।
“তুমি এখনো ঘুমাওনি? আমার চোখ লেগে এসেছিল তাই ঘুমিয়ে পড়েছি অল্পতে। তুমি ঘুমাওনি কেন? এনি প্রবলেম? কেউ এসেছিল ঘরে? কে কি করেছে তোমার সাথে?”
শেষ কথাগুলো বেশ উত্তেজনার সাথে জিজ্ঞেস করল স্বচ্ছ। সাথে সাথে উঠে বসল সে। মোহের বাহু ধরতেই মোহ হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
“এই ঘরে কে আসবে এখন? আর কি করবে আমার সাথে? কেউ তো আসেনি। আমার তো ব্যাস ঘুম ধরছিল না সেকারণেই জেগে ছিলাম। নতুন জায়গা তো তাই ঘুম পাচ্ছিল না।”
কিছুটা স্বস্তি পায় স্বচ্ছ। তবে মোহের প্রশ্নে কিছুটা থতমত খায় সে। হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“আসলে এই দিনে অনেকে বিরক্ত করে তো! মানে কাজিন আর বন্ধুবান্ধবরা তাই ভাবলাম ওরা হয়ত কেউ তোমায় বিরক্ত করছে।”
“না এমন কিছু না।”
স্বচ্ছ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“তোমার ঘুম আসছে না তাই তো? তাহলে কি করা যায়! চলো বাহিরে যাই। ফাঁকা রাস্তায় একটু হেঁটে আসি।”
চকিতে দেখে মোহ। বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে,
“আপনার মাথা ঠিক আছে? এতো রাতে বাহিরে যাব?”
“সো হোয়াট? ইউর হাজবেন্ড আহিয়ান স্বচ্ছ ইজ উইথ ইউ।”
“তাই বলে এতো রাতে বাহিরে…”
বলে থামে মোহ। প্রস্তাবটা মন্দ লাগেনা তার। খারাপ কি? নরম সুরে জবাব দেয়,
“ঠিক আছে চলুন যাই।”
মোহ বলামাত্রই তার হাত ধরে সকলের আড়ালে লুকিয়ে বেরিয়ে পড়ে স্বচ্ছ। এই শুরু হলো তাদের একসঙ্গে পথ চলা। এক পবিত্র সম্পর্কের মূল সূচনা!
শীতের শুরুটা হয়েছে ভালোভাবেই। কুয়াশা পড়েছে রাস্তায়। নিস্তব্ধ পরিবেশ। মাঝে মাঝে স্নিগ্ধ বাতাসে নড়ছে গাছপালার পাতা। বাতাসেও যেন এক ভালোবাসাময় অনুভূতি মাখানো। পাশাপাশি হাঁটছে এক রমনী সাথে তার পুরুষ। প্রথমে রাতের সূচনা হক ভিন্নভাবে ক্ষতি কি তাতে?
হাঁটতে হাঁটতে নিজের জুতো খুলে নেয় মোহ। তা দেখে সঙ্গে সঙ্গে মোহ জিজ্ঞেস করে,
“জুতো খুললে কেন? পায়ে অনেক কিছু বিঁধতে পারে তো!”
“উঁহু, বিঁধবে না। কুয়াশায় ভেজা রাস্তা। জুতো পায়ে দিয়ে হাঁটতে ভালো লাগে নাকি?”
স্বচ্ছ মানা করে না। মেয়েটার মুখে হাসির রেখা। সেটা মুছে দেওয়া ঠিক হবে না। এতে যদি সে খুশি হয় হক না। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আস্তে আস্তে মোহের হাতটা চেপে ধরে স্বচ্ছ। একটু বিশ্বাস পাওয়ার আশায়। মোহের দিকে তাকায় সে। এখনো পরনে বিয়ের সাজসজ্জা। মাথায় টিকলি দুলছে। কানে দুল। গাঢ় লাল লিপস্টিক দেওয়া ঠোঁটে মৃদু লাজুক হাসি। গায়ে লাল রঙের লেহেঙ্গা তার ওপর চাদর জড়িয়ে রাখা। স্বচ্ছের ভাবতেই মনটা আনন্দে নেচে উঠছে যে ‘যার জন্য ছিল এতো পিপাসা! এখন সেই প্রেয়সী শুধুই তার?’
মোহ লাজুক হাসি দিয়ে স্বচ্ছের হাসিতে জ্বলজ্বল করা মুখশ্রীর দিকে তাকায়। এই মানুষটাকে যদি বুঝতে পারা যায় তবে মানুষটা সত্যিই স্বচ্ছ হয়ে উঠবে। স্বচ্ছের বড় বড় দীর্ঘদিন ধরে না কাটা চুল কপালে পড়ে মাঝে মাঝে উড়ছে। মায়াবী চোখে মায়া বেড়েই চলেছে যেন! মোহ সেটাতেই মত্ত হয়ে পড়েছে আজ।
হাঁটতে হাঁটতে একটা বাড়ির সামনে এসে থামে মোহ ও স্বচ্ছ। এখান থেকে নিজেদের বাড়ি ফিরবে তারা। যেখানে থেমেছে সেখানে বড়সড় একটা জবার গাছ চোখে পড়ল মোহের। ইচ্ছে করল জবাফুল নেবার। কিন্তু ইচ্ছেকে দমন করে হাঁটা লাগাতেই স্বচ্ছ লাফিয়ে রক্তবর্ণের জবাফুল পেরে হুট করেই মোহকে চমকে দিয়ে তার কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে তার গালে নিজের উষ্ণ ঠোঁটের আলতো পরশ মাখিয়ে ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
“দুটো ফুলই সুন্দর। কিন্তু আমার ফুলটা কেন জানিনা বেশিই সুন্দর। অত্যাধিক সুন্দর। এই অত্যাধিক সুন্দর ফুলটি আমার। একান্তই আমার।
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]