#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৯
বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোহ। চোখমুখের রঙ পাল্টে গেছে তার। বার বার চোখ বন্ধ করে আবার মেলছে সে এই ভেবে যে সে ভুল দেখেনি তো? কিন্তু চোখজোড়া ভুল প্রমাণিত হচ্ছে না। এতোক্ষণ হেঁসে স্বচ্ছের সঙ্গেই কথা বলছিল আয়মান। এবার চোখ সরিয়ে স্বচ্ছের বউকে দেখার উদ্দেশ্যে সোফার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই তার চোখমুখের রঙও ফ্যাকাশে বর্ণে পরিণত হয়। হাসিটুকু বিলীন হয়ে যায়। মোহের কাজল ভর্তি চোখে বার বার পানি আটকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই অবাধ্য চোখে পানি তো মানছে না। তার কান্না পাচ্ছে ঘৃণার কারণে। সামনের বাম পাশের মানুষটা মোহের জন্য বিষাক্ত। আয়মান আগ বাড়িয়ে ডাকতে চাইলো মোহকে। কিন্তু মোহ দুপাশে মাথা নাড়ায়। আয়মান সেখানেই থামে। তিক্ততায় চোখ সরিয়ে চোখ নামিয়ে নেয় মোহ।
“ওহ মি. আয়মান! আপনি তো আমাদের অফিসে নিউ যাকে বাবা বান্দরবান পাঠিয়েছিলো। কংগ্রাচুলেশনস। বিকজ কাজগুলো আপনি নিউ হওয়া সত্ত্বেও খুব সুন্দর হ্যান্ডেল করেছেন।”
“থ্যাংক ইউ স্যার। ইউর ওয়াইফ…”
বলেই থেমে আয়মান মোহের দিকে তাকালো। মোহ আবার মাথা উঠিয়ে বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। এর মানে আয়মান এই কোম্পানিতেই চাকরি পেয়েছিল? ভেবেই বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে মোহ। স্বচ্ছ স্মিত হেঁসে আচমকা মোহের পাশ ঘেঁষে বসতেই মোহের বিস্ময়ের ঘোর কাটে। খানিকটা চমকে স্বচ্ছের দিকে তাকায় সে। স্বচ্ছ হাসিটা প্রসারিত করে মোহের কাঁধে হাত রেখে মোহকে আরেকটু কাছে টেনে নেয়। বুকের সঙ্গে লাগিয়ে নেয় মোহকে আর বলে,
“ইয়াহ, হি ইজ মাই ওয়াইফ। মিসেস. মোহ। অ্যান্ড মোহ, মিট আয়মান। হি ইজ আয়মান। আমার অফিসে নিউ…”
“জানি আমি।”
দুর্বল কন্ঠে বলে ওঠে মোহ। চোখমুখ লাল হয়ে আসছে তার। দৃষ্টি একদিকে স্থির। মনটা ভালোই ছিল তার। এভাবে কাকতালীয় ভাবে হলেও আয়মানকে তার সামনে আসা কি দরকার ছিল? মনটাকে বিষিয়ে দেওয়া কি খুব জরুরি ছিল? মোহের কথায় স্বচ্ছ বেশ কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে…
“সিরিয়াসলি? তুমি জানো? মানে তুমি মি. আয়মানকে চেনো আগে থেকে?”
“হ্যাঁ চিনি তো। খুব ভালো করে চিনি।”
“কি করে?”
স্বচ্ছের আগ্রহের সাথে আয়মানও বেশ আগ্রহী হয়ে তাকালো। মোহ হয়ত সত্যি উত্তর দেবে সেই আশায়। যদিও মোহের মুখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছেনা আয়মান। তবুও তাকিয়েছে সে। মোহ আয়মানের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল,
“আমাদের ভার্সিটিতেই পড়তেন একসময়। আমি তখন জুনিয়র ছিলাম। অনেকটা ফেমাস ছিলেন উনি। তাই আমিও চিনতাম। দ্যাটস ইট।”
“হোয়াট অ্যা কোয়েন্সিডেন্স।”
স্বচ্ছ কথাটা বলতেই আয়মান আশাহত হলো। সে আসলে একটা ইডিয়ট। বড় মানের বোকা। মোহকে অবিশ্বাস করেছিল সে। যদিও আয়মান জানতো না স্বচ্ছই ভবিষ্যতে নেহাল সাহেবের চেয়ারে বসতে চলেছে। কারণ সে জানতোই না তার স্যারের ছেলে স্বচ্ছ। প্রথমবার শুনছে এবং জানছে। আয়মান যখন জানতে পারে সব মিথ্যা ছিল তখন মোহের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল সে কিন্তু পারেনি। আয়মান ভেবেছিল মোহ অভিমান করে বসে আছে। বাড়ি ফিরতেই মোহের বাড়িতে একেবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে। কিন্তু তার জানা ছিল না মোহ তার জন্য থেমে নেই। অনেকটা পথ এগিয়েছে। নিজের জীবনে অন্য চলার সাথী বানিয়েছে।
আচমকা সোহা সহ বেশ কয়েকটা মেয়ে এসে বলল,
“ভাবি। কয়েকটা ছবি তুলব তোমার সাথে একটু তাকাও না প্লিজ!”
আবদার ফেলতে না পেরে জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকালো মোহ।
মোহ কত ভালো আছে! সংসার আর বাকিদের নিয়ে কতটা ব্যস্ত সে। এসব ভেবেই দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল আয়মান। মাঝখানে নিজের বোকামির কারণে মোহ নামক মেয়েটিকে হারিয়ে বসল চিরতরে! অপমানবোধ আর লজ্জাবোধে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না আয়মানের। ঢক গিলে বলল,
“স…স্যার আমি আসছি। আসলে মাথাব্যথা করছিল আর শরীরটাও খারাপ লাগছে। আজকে ভোরেই লং জার্নি করে পৌঁছেছি সো একটু খারাপ লাগছে।”
স্বচ্ছ উঠে দাঁড়ায়। আয়মানের দিকে এগিয়ে এসে হালকা জোর গলায় বলে,
“অন্তত খেয়ে তো যাবেন?”
“খাওয়াদাওয়া তো অনেক হবে। পড়েই তো আছে সময়। একদিন সময় করে এসে আপনার মিসেস. এর হাতের রান্না খেয়ে যাব।”
একটা মেকি হাসি দিয়ে মোহের দিকে তাকিয়ে চলে গেল সে। আয়মানে জানে মোহ রান্নার র ও জানে না। ইচ্ছে করেই কথাটা মোহকে কটাক্ষ করে বলে গেল আয়মান। মোহ তিক্তভরা নয়নে ততক্ষণ তাকিয়ে রইল যতক্ষণ না আয়মান বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হলো। আয়মান চলে যেতেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল সে। মনে উঁকি দিচ্ছে অতীত। যেটা মধুর হবার কথা ছিল তা হয়ে উঠছে তিক্ততায় ভরা। আদোও কি তাদের মাঝে ভালোবাসা ছিল? হয়ত ছিল না। ছিল না বলেই এতো সহজে ভেঙেছে সম্পর্ক! হয়তবা সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
রিসেপশন অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে প্রায় এগারোটা বেজেছে। সকলে বেশ ক্লান্ত। মিসেস. নিরা সহ তৃণা ও তিহানও এসেছিলো। সকলে নাকি আজ রাতেই চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছে। সেখানেই তো ওদের বাড়ি। কতদিনই বা আর পড়ে থাকবে এখানে? তাদেরও তো ঘরসংসার রয়েছে। মিসেস. নিরাকে সামলাতে হবে। তাছাড়া অবশেষে মোহের জীবনে একজন আনতে পেরে বড্ড খুশি মিসেস. নিরা।
নিশুতিরাতে সকলে ঘুমে। মোহ ও স্বচ্ছের ঘরেও বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। মাঝেমাঝে হালকা নড়েচড়ে উঠছে মোহ। সে জেগেই আছে। বিষণ্ণ মনে ঘুম আসছে না তার। অতীত তার পেছনে ছুটছে। তাকে থামাতে পারছে না। মনকেও থামানো দায় হয়ে পড়েছে। বড্ড মন খারাপ হলেও মোহের ঘুমটাও উড়ে যায়। বেড হালকা নড়তেই চোখ মেলে স্বচ্ছের দিকে তাকায় মোহ। স্বচ্ছ মোহকে ঘুমের আবেশে জড়িয়ে ধরতে চাইতেও খানিকটা সরে যায় মোহ। কারণ সে জানে স্বচ্ছ একবার নিজের সঙ্গে ধরলে তার নড়াচড়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। আরো বেশ কিছুক্ষণ পর শুয়ে থাকতে না পেরে উঠে বসে পড়ে মোহ। কোথাও শান্তি পাচ্ছেনা সে। তার শান্তি চাই শুধু শান্তি!
বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে খোঁপা করে আবারও স্বচ্ছের দিকে চোখ বুলিয়ে নেয় মোহ। স্বচ্ছের ঘুমানোর ধরনটাও এলোমেলো। মাথার বালিশ লম্বালম্বি করে নিয়ে জড়িয়ে ধরে উপুড় হয়ে ঘুমায় সে। মাঝারি আকারের লম্বা চুলে মাঝে মাঝে চোখ ছুঁয়ে দেয় স্বচ্ছের। ঠোঁটজোড়া আলতো ফাঁকা করে ঘুমায় সে।
খোঁপা করা শেষে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মোহ। বেশ ধীরে হেঁটে গিয়ে পৌঁছায় কড়িডোরের শেষ প্রান্তে যেখানে একটা খোলা কাঁচের বারান্দা রয়েছে। সবুজের সমারোহ যেখানে। সেখানে গেলে হয়ত হালকা শ্বাস নিতে পারবে সে। বাহিরের লাইট জ্বালিয়ে দরজার থাই খুলে প্রবেশ করতেই মোহকে ছুঁইয়ে যায় শিরশিরে বাতাস। সেখানে মন খুলে বড় শ্বাস নিয়ে দুই বাহু দুই হাতে ঘষতে ঘষতে গিয়ে বসে মোহ। ওপরে হালকা লাইট জ্বলছে। পরিবেশটা সুন্দর। আশপাশটা ভালো করে দেখে নিতেই তার চোখ স্থির হয় কাঁচের দেয়ালে আটকানো এক কাগজে। মোহ ভালো করে স্পষ্ট করে দেখে নেয় লিখাগুলোর ধরন। সঙ্গে সঙ্গে পিলে চমকে যায় তার। আবারও সেই ধরনের লিখা। মোহ দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে,
“এতোদিন পর আবার ওই মি. চোরটা চিঠি পাঠিয়েছে? আহাম্মক! সামনে ধরা দেয় না। এখন চিঠি দিয়েও লাভ নেই। আমি এখন বুকড হুহ! এখন আমার আর কিচ্ছু করতে পারবে না মি. চোর। কিন্তু লিখেছে টা কি?”
উৎসুক হয়ে মোহ এগিয়ে গেল চিঠির দিকে। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল সে।
“তোমার মতো মোহময়ী নারীকে কখনো বিষণ্ণ মুখে মানায়?
তুমি হয়ত বিষণ্ণ মুখে থাকতে ভালোবাসো, কিন্তু আমার যে ভেতরে আগুন জ্বলে। তোমার মুখে একটু হাসি দেখার জন্য।
সেই মুক্ত ঝরানো হাসিটা কি দেবে না?
তোমার বিষণ্ণ মুখ দেখে আহত হওয়ার থেকে তোমার হাসি মুখ দেখে নিহত হতো রাজি আছি আমি। একটু হাসবে? কতক্ষণ হাসতে দেখিনা তোমায়! নিজের প্রাণ জুড়িয়ে নিতাম।”
কথাগুলোর মাঝে যেন প্রাণ ছিল! মোহ মুগ্ধ হয়েই চার বার পড়ে নিল লিখাগুলো পড়ে নিল সে। এতোটা মুগ্ধকর লিখনী কি করে লিখতে পারে একটা চোর? সে কি আশোপাশেই আছে? থাকার কথা তো! নয়ত সে কি করে জানল মোহ এখানে আসবে? নিশ্চয় লোকটা আশেপাশে আছে।
ভেবেই খুঁজতে শুরু করে মোহ। এদিকসেদিক আশেপাশে সবদিকে খুঁজে ফেলে সে। হুট করে খটমটে শব্দে পিছু ফিরে দরজার ওপাশে তাকায় সে। শব্দটা তো ওদিক থেকেই আসছে। মোহ হন্তদন্ত হয়ে বারান্দা থেকে বেরিয়ে করিডোরে এলো। কিন্তু করিডোর পুরো অন্ধকার। একি! মোহ আসার সময়ই তো দেখেছিল লাইট জ্বালিয়ে রাখা। কে বন্ধ করল লাইট? আশেপাশে হাতড়াতে শুরু করল মোহ। এখন কোথায় লাইট কোথায় সুইচ বুঝতেও পারছে না সে। হাতড়াতে গিয়েই তার হাত গিয়ে পড়ে এক প্রশস্ত বুকে। আচানক কাজটি ঘটাতে হাতটা সরিয়ে নেয় মোহ। তৎক্ষনাৎ আবারও আন্দাজ করে লোকটাকে ধরে ফেলে জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে,
“চোর!”
এমনটা শুনে সামনে থাকা আগন্তুক ব্যক্তিটিও চমকে ওঠে। নিজেকে ছাড়াতে চায় সে কোমলভাবে কিন্তু পারলে তো? আজকে মোহও যেন শপথ করে রেখেছে চোরটাকে ধরবেই ধরবে।
“চোর! সবাই আসুক চোর ধরেছি।”
“আমি চোর? আর একটা ওয়ার্ড বের করেছো তো….”
বেশ অদ্ভুত চাপা কন্ঠ বেরিয়ে এলো। মোহ থামল না তবুও। মোহের মুখ অন্যহাত দিয়ে চেপে ধরে আগন্তুকটা কৌশলে পেঁচিয়ে ধরল মোহের হাত।
“হুঁশশ… আমি এতো সোহাগ করে তোমার হাসিমুখটা দেখতে চাইলাম তুমি তার বদলে চোর প্রমাণ করতে চাইছো সবার সামনে? এর বদলে তো তোমার উল্টে আমায় আদর-সোহাগ করা উচিত!”
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এর বাস্তবে কোনো ভিত্তি নেই।]