#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩২
ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে স্বচ্ছ। ভ্রুজোড়া হালকা করে কুঁচকানো। প্রশস্ত বাহুবল হাত তড়তড় করে ল্যাপটপ চালিয়ে যাচ্ছে। চোখজোড়া স্থির ল্যাপটপে। ধীর পায়ে দরজা হালকা করে খুলে ঘরে ঢোকে মোহ। আস্তে করে স্বচ্ছের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। একবার ল্যাপটপের দিকে তাকায় আর একবার স্বচ্ছের দিকে। কিছু একটা বলে ওঠার আগেই স্বচ্ছ ল্যাপটপেই নিজের দৃষ্টি স্থির রেখে গম্ভীর সুরে বলে ওঠে,
“বেডে পাশে টেবিলে ঔষধ আর পানি রাখা আছে খেয়ে নাও। ফাস্ট!”
“ঔষধ না খেলে কি চলে না? এটার কি কোনো…”
“আমি বাহানা শুনতে চাইনি। খেয়ে নাও আদারওয়াইজ আমাকে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।”
এবার ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে বেশ কড়া দৃষ্টিতে তাকায় স্বচ্ছ। মেয়েটাকে ঔষধ খাওয়ানো যে একটা যুদ্ধের সমান সেটা স্বচ্ছের জানা রয়েছে। মোহ মিনমিন করে বলে,
“ইয়ে মানে আগে তো এতো মেডিসিন ছিল না তাই না? আগে যারা আমাদের পৃথিবীতে ছিল আই মিন আমাদের পূর্ব পুরুষ ওরা তো আঘাত পেলে এতো কিছু করতে হতো না। এমনিই সেড়ে যেত। জানেন তো, আজকাল মানুষ এতো আধুনিক হয়েছে বলেই এতো সমস্যা। আমি আবার এতো আধুনিকতা পছন্দ করি না। এসব ঔষধের চেয়ে এমনিতেই আমি ঠিক হয়ে যাব। ঠিক বলছি না বলুন? আমার লজিক ঠিক আছে না?”
“শেষ হয়েছে তোমার লেকচার? এতোটা লেকচার তো কোনো লেকচারারও দেয় না। বড্ড ফালতু বকবক করো তুমি। এখানে আসো।’
হতাশার চোখে তাকালো মোহ। ছোটবেলা থেকেই তার ঔষধ খেতে ভালো লাগে না। আবার একবার তার গলায় একটা বড় ঔষধের ট্যাবলেট আঁটকে গেছিল। তারপর থেকেই এসব দেখলে তার ভয় করে আর বিরক্তও লাগে। বেশ কৌশল করে মোহ স্বচ্ছের দিকে অসহায়, নরম দৃষ্টি নিক্ষেপ করেও কাজ হলো না। স্বচ্ছ হাতে ঔষধ নিয়ে সাথে পানি নিয়ে এগিয়ে আসে মোহের দিকে। ভ্রু উঁচিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে পিছু ফিরে মোহ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে। স্বচ্ছ এবার ধমকে বলে ওঠে,
” আর এক পা যদি বাড়িয়েছো তাহলে তোমার ওই হাতটাও ভেঙে দেব মোহ। শুধু আর এক পা বাড়িয়ে দেখো।”
মোহ পা বাড়াতে গিয়েও পারে না। লোকটার ঠিক নেই। কখন কি করে বসে। স্বচ্ছ আবারও হাতে ট্যাবলেট খুলে নিয়ে বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“জাস্ট ইমাজিন, তোমার দুটো ভাঙা হাত নিয়ে আমরা বেড়াতে গেছি। আর লোকে তোমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে আর দুটো হাতই ভাঙা।”
“আপনি আমার হাত ভাঙতে পারবেন?”
“যদি আমার কথার অবাধ্য কেউ হয় তাহলে যা মন চাইবে তাই করতে পারি। তুমি কি ভাবছো আমি পাল্টে গিয়েছি? আমি সেই আগের স্বচ্ছই আছি। যা মন চায় তাই করি। ইউ নো না? আমি কি মিন করছি! যা ইচ্ছা তাই?”
কথাগুলো মস্তিষ্কটা বুঝতে বেশ সময় নিল মোহের। বুঝে ওঠা মাত্র ছিটকে গিয়ে দাঁড়াতে গিয়েও পারে না সে। স্বচ্ছ তার হাত টেনে ধরে বলে,
“ইউ হ্যাভ টু অপশনস কিস মি ওর টেক মেডিসিনস! চয়েস ইজ ইউরস সুন্দরী।”
“আরে! এ…এটা কেমন অপশন? আমি মানি না। আপনি তো জোরজবরি করছেন। হবেনা।”
স্বচ্ছকে দূরে ঠেলে দিয়ে ভীতির সাথে বলে মোহ। কিন্তু স্বচ্ছ এক ইঞ্চিও দূরে সরে না। আচমকাই মোহের গাল চেপে ধরে তার মুখের মধ্যে ট্যাবলেট দিয়ে দেয় স্বচ্ছ। অতঃপর পানি ধরে মোহের সামনে। মোহ ট্যাবলেট ফেলতে চাইতেও পারে না স্বচ্ছের কড়া দৃষ্টি দেখে। কাঁদো কাঁদো চোখমুখ করে পানি খেয়ে গিলে নেয় ট্যাবলেট। স্বচ্ছ একসাথে প্রায় ৩-৪ টা ঔষধ গিলিয়েছে মোহকে। সব কাজ শেষে স্বস্তির শ্বাস নেয় স্বচ্ছ। মোহ মুখটা কাঁচুমাচু করে বলে,
“হয়েছে? এবার তো আমাকে ছেড়েও শ্বাস নিতে পারেন?”
“ছাড়াছাড়ির প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? ওয়ান মিনিট! তুমি তো আমার কোনো অপশনই মানো নি। তাহলে কি করা উচিত? দুটো অপশনই তোমাকে জোর করে মানিয়ে দিই কি বলো?”
পিছিয়ে যাওয়ার প্রয়াস চালায় মোহ। কিন্তু প্রতি বারের মতোই ব্যর্থ হয় সে। এবার স্বচ্ছ করে বসে ভয়াবহ কাজ। নিজের ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা আবদ্ধ করে নেয় মোহের ওষ্ঠদ্বয়। স্তব্ধ হয়ে যায় মোহ। শিরা-উপশিরায় বয়ে যায় শীতলতা। অসার হয়ে আসে শরীর। কয়েক মূহুর্তেই আলগা করে দেয় স্বচ্ছ মোহের বাঁধন। সরে আসে স্বচ্ছ। সেখানেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে মোহ। কি হলো তার সাথে? মাথা ভনভন করে ওঠে তার। কান গরম হয়ে আসছে। স্বচ্ছের সাথে মেলাতে পারছে না চোখজোড়া।
“এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আরেকটা লাগবে? আমিও আবার কারো চোখ দেখলেই তার চাহিদা বুঝতে পারি। ভালো না?”
মোহ লজ্জা আর সংকোচে হাত মুঠো করে বলে,
“আ…আপনি আপনি একটা…”
“কি আমি?”
“বেয়াদব আর লুচ্চা লোক!”
আর এক মূহুর্ত থামে না মোহ। পিছু ফিরে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যায় সে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে নির্ঘাত তাকে ঢুকে যেতে হবে মাটির নিচে নয়ত ভেসে যেতে হবে আকাশের সাথে। চারিপাশে শুধুই লজ্জা! মোহের বেরিয়ে যাওয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে রইল স্বচ্ছ। একটুপর নিজের ঠোঁটে হাত বুলিয়ে নৃুবলল,
“মাঝে মাঝে একটু এডভান্টেজ নিলে খারাপ হয় না। আমারই তো সেই মোহময়ী নারী! আমারই তো বউ! তার কাছে বেয়াদপ, লুচ্চা হলে ক্ষতি কি?”
নাফিসা বেগমের কাছে বসে আছে মোহ একধ্যানে। হাতে খাবারের প্লেট। নাফিসা বেগম আধশোয়া হয়ে খাবার খাচ্ছেন। আজকাল বসে থাকার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছেন উনি। বসে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। তা নিয়ে মোহ ভীষণ চিন্তিত। সেটা নিয়েই চিন্তা করছে সে। নাফিসা বেগম তা খেয়াল করে মোহের হাতে হাত রেখে একটু নাড়া দিয়ে বলেন,
“মোহ? কি হইছে তোর? এমনে বসে আছিস কেন?”
ভবঘুরে মোহ ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে। নাফিসা বেগমের দিকে তাকায় সে। দুপুরের খাবার খাচ্ছেন উনি। তাও জোর করে মোহ খাইয়ে দিচ্ছে। মুখের রুচিটাও হারিয়েছেন। স্বচ্ছকে বলে ডক্টর দেখিয়েছিল মোহ। কিন্তু ডক্টরের একই কথা উনি বেশিদিন বাঁচবেন না। কারণ উনার সমস্যা গুরুতর। এখন ইনজেকশন আর মেডিসিনস সব মিলিয়ে যতদিন বাঁচানো যায়।
“কিছু না নানিমা। তুমি খাও।”
“পাগলি মাইয়া! কারে কখন কি বলে ডাকিস খেয়াল আছে? আমি এখন তোর সম্পর্কে দাদিশ্বাশুড়িও হই।”
“তো কি হয়েছে? তুমি আমার নানিমাই থাকবে। তোমাকে অন্য কোনো নামে ডাকতে পারব না।”
বিষণ্ণ মুখে জবাব দেয় মোহ। নাফিসা বেগম একটু ঘাঁটিয়ে প্রশ্ন করে,
“মন খারাপ তোর? কি হইছে? স্বচ্ছের সাথে ঝগড়া?”
“উনার সাথে ঝগড়া হলে মন খারাপ থাকে না আমার। আচ্ছা শোনো! তুমিও আমাকে ছেড়ে যাওয়ার প্ল্যানিং করছো না?”
আকুলতার সঙ্গে প্রশ্ন করে মোহ। নাফিসা বেগম কিছুটা চুপ থাকেন। কান্না দমন করার চেষ্টা করেন। এমনিতেই তার কন্ঠস্বর অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কাঁদলে মোহও দুর্বল হয়ে পড়বে। একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন,
“আল্লাহ আমার হায়াত যতটুকু রাখছে ততদিনই তো বেঁচে থাকব বল! সবাইকে একদিন চলে যেতে হবে। এই জগতের নিয়ম কেউ ভাঙতে পারে? আমি গেলেও যাতে তোর পাশ খালি না হয়ে যায় তার জন্য তো ব্যবস্থা করেছি। স্বচ্ছ একটু বদমেজাজি আর একরোখা ছেলে হলেও ওর মতো আমি আর কাউকে দেখিনি আমার জীবনে। তুই তো এখন ওর আশেপাশে থাকিস। খেয়াল করেছিস কখনো? ও যেমন দেখায় সবাইকে ও তেমন নয়?”
বড় বড় করে চোখ পাকিয়ে থাকে মোহ। তারপর মাথা নাড়ায়। আসলেই লোকটা সকলকে যেমন দেখানোর চেষ্টা করে আদোও উনি তেমব নন। উনার ভেতরে সত্ত্বা অন্যরকম। সঙ্গে সঙ্গে নাফিসা বেগম বলে ওঠেন,
“আমি জানি না ওই এমন কেন! তবে ও তোকে যেভাবে আগলে রাখবে সেভাবে আর কেউ রাখবে না সেটা আমার জানা।”
মোহ নিরব হয়ে থাকে। নাফিসা বেগম মোহকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
“এখন কেমন আছিস তুই? হাতের ব্যথা কমছে?”
মোহ বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়,
“না। ডক্টর বেশ কয়েকদিন আমাকে এভাবে হাত ঝুলিয়ে রাখতে বলেছে ব্যান্ডেজ করে। এই অবস্থায় নাকি তোমার নাতি আমাকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। এটা কেমন হলো? তুমিই বলো?”
“ছেলেটা তো পাগল রে! তোকে পেয়ে হয়ত আরো পাগল হয়ে গিয়েছে। তুই যে আমার রত্ম। কখন যাবি তোরা আর কোথায়?”
“বললেন তো আজই যাবেন। বান্দরবান হোটেল বুকিং দিয়েছেন। সেখানেই যাবেন হয়ত। আমাকে তো কিছুই বলেন না।”
নাফিসা বেগম হালকা হেঁসে বলেন,
“সাবধানে যাস আর খেয়াল রাখবি নিজের আর স্বচ্ছের।”
মোহ হালকা করে মাথা দুলিয়ে আবারও কষ্ট করে ডান হাতে খাওয়াতে থাকে নাফিসা বেগমকে। নাফিসা বেগম বারবার বারণ করা সত্ত্বেও মোহ শোনেনি। এভাবেই খাইয়ে যাচ্ছে। খাইয়ে দেওয়ার মাঝে মোহের মাথায় একটা প্রশ্ন আসে। সেটা মুখ দিয়ে বলেও ফেলে সে।
“আচ্ছা নানিমা? আমায় একটা কথা বলতে পারবে? এই বাড়িতে কখনো কোনো অদ্ভুত জিনিস ঘটেছে? মানে এই বাড়িতে এমন কেউ আছে? যার কথা আমি জানি না?”
নানিমা এবার কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন মোহের দিকে। খানিকটা ভেবে অবাক হয়ে বলেন,
“কি বলছিস? এমনটা মনে হলো কেন তোর? আর কে-ই বা থাকবে যার কথা জানবি না? এই বাড়িতে তো আমরা মানে নেহাল, স্বচ্ছ, রেবা বউমা, তুই আমি আর বাকি যারা কাজ করে তারাই থাকে। অনেকে তো তাও থাকে না। রাতে নিজের বাড়ি চলে যায়। হঠাৎ এমন আজগুবি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
“না কিছু না। হয়ত ওটা আমারই ভুল ছিল। কয়েকদিন ধরে হয়ত বেশি কল্পনা করছি।”
নাফিসা বেগম এবার হতাশা ভরা নয়নে তাকিয়ে থাকেন মোহের দিকে। আনমনে বলে ওঠেন,
“যদি সব ঠিক থাকতো আরেকজনও হয়ত থাকতো এই বাড়িতে। কিন্তু সে তো নেই।”
চমকে ওঠে মোহ। এগিয়ে বসে বেশ তাড়াহুড়ো করে জিজ্ঞেস করে,
“কে সে? কার কথা বলছো তুমি?”
“সৌমিত্র!”
“সৌমিত্র? মানে তো….”
মোহকে থামিয়ে নাফিসা বেগম কাতর সুরে বলেন,
“মানে স্বচ্ছের ছোট ভাই। আহিয়ান সৌমিত্র! আমার ছোট নাতি। যদি বিদেশ না যেতো তাহলে ওই দুর্ঘটনা ঘটতো না রে মোহ। আমার ওই নাতিটাও বেঁচে থাকতো। এখন হয়ত সবাই ভুলে গেছে ওর কথা। কিন্তু রেবা আর নেহাল ভুলছে কিনা জানি না। আমিই ভুলতে পারি না। ওরা কি ভুলবে!”
মোহ কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। সৌমিত্রের কথা তার অজানা নয়। মোহের মায়ের সাথে স্বচ্ছের পরিবারের সম্পর্ক ভালো না থাকলেও কিছু কিছু খবর অবশ্যই রাখতো তারা। সৌমিত্র ছিল স্বচ্ছের ছোট ভাই। সৌমিত্রের বেশ বিরল রোগ হয়েছিল শুনেছিল মোহ। যার কারণে বিদেশ নিয়ে যেতে হয়েছিল। তারপর একটা এক্সিডেন্টে মারা যায় সে। এতটুকুই জানে মোহ। হঠাৎ এতোদিন পর সৌমিত্র নামটি স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েও বেরিয়ে এলো। সাথে এক অদ্ভুত ক্ষীণ অনুভূতি! যা ভয় জাগালো মোহের মনে।
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আজকের পর্বটা বেশ অগোছালো হয়েছে মনে হয়। সকলে রেসপন্স করবেন।]